জাতীয় গ্রন্থাগার
জাতীয় গ্রন্থাগার একটি দেশের সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিশেষ ধরনের গ্রন্থাগার যা সংশ্লিষ্ট দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ তথ্যাদি সংগ্রহের ক্ষেত্র হিসেবে সেবা প্রদান করে থাকে। গণগ্রন্থাগার থেকে পৃথক গ্রন্থাগার হিসেবে এগুলোয় খুব কমসংখ্যক নাগরিকদেরকেই গ্রন্থ ধার করার অনুমতি দেয়া হয়। প্রায়শই এখানে অগণিত দুষ্প্রাপ্য, মূল্যবান বা অতীব গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টিকর্মগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকে। জাতীয় গ্রন্থাগার ঐ ধরনের গ্রন্থাগার যা দেশ ও দেশের বাইরের রক্ষিত দেশের সাহিত্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের দায়িত্ব নেয়। এভাবেই সেসকল গ্রন্থাগারকেই জাতীয় গ্রন্থাগাররূপে আখ্যায়িত করা হয় যাতে ঐ জাতির সম্প্রদায়ের সদস্য ব্যাপকসংখ্যকভাবে থাকে। উদাহরণস্বরূপ ব্রিটিশ লাইব্রেরি, প্যারিসের দ্য বিবলিওথিক ন্যাশিওনাল অন্যতম।[১][২]
জাতীয় গ্রন্থাগারের ব্যাপক সংজ্ঞায় কম গুরুত্বপূর্ণ শব্দ থেকে শুরু করে শব্দ ভাণ্ডার থাকতে পারে।[১][২]
একই দেশে অবস্থিত অন্যান্য গ্রন্থাগারের তুলনায় সচরাচর জাতীয় গ্রন্থাগারগুলো তাদের বৃহত্তর আকারের জন্য উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকে। যে সকল রাজ্য স্বাধীন নয় কিন্তু তারা তাদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি রক্ষা করতে ইচ্ছা পোষণ করে থাকে তারাও প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা বৈধ জমাদানের শর্তাবলী পালন করে জাতীয় গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
অনেক জাতীয় গ্রন্থাগার আন্তর্জাতিক গ্রন্থাগার সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান ফেডারেশন (আইএফএলএ)-এর সদস্যভূক্ত জাতীয় গ্রন্থাগারের সাথে তাদের সাধারণ কার্যাবলী নিয়ে আলোচনাসহ সাধারণ মানদণ্ডের উন্নীতকরণ ও গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মতবিনিময়কল্পে পারস্পরিক সহযোগিতা করে থাকে। ইউরোপের জাতীয় গ্রন্থাগারগুলো ইউরোপীয় গ্রন্থাগারে অংশগ্রহণ করে। এটি ইউরোপীয় জাতীয় গ্রন্থাগারিক কনফারেন্সের (সিএফএনএল) সেবাবিশেষ।
ইতিহাস
সম্পাদনাউৎপত্তি
সম্পাদনাপ্রথম জাতীয় গ্রন্থাগারসমূহে সার্বভৌম বা রাষ্ট্রের কিছু সর্বোচ্চ সংস্থার রাজকীয় সংগ্রহশালাকে ঘিরে গড়ে উঠে।
ওয়েলসীয় গণিতবিদ জন ডি জাতীয় গ্রন্থাগার গঠনের বিষয়ে প্রথমদিককার পরিকল্পনা প্রণয়নকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তিনি ১৫৫৬ সালে ইংল্যান্ডের প্রথম মেরি’র কাছে প্রাচীন গ্রন্থ, পাণ্ডুলিপি ও রেকর্ডস সংরক্ষণ এবং জাতীয় গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা উপস্থাপন করেন। কিন্তু তাঁর ঐ প্রস্তাবনা গৃহীত হয়নি।[৩]
ইংল্যান্ডে স্যার রিচার্ড বেন্টলি’র রাজকীয় গ্রন্থাগার নির্মাণের প্রস্তাবনা ১৬৯৪ সালে প্রকাশিত হলে এ বিষয়ে আগ্রহীদের পুণরুজ্জীবন ঘটে। কনিংটনের সম্পদশালী পুরাতত্ত্ববিদ প্রথম ব্যারনেট স্যার রবার্ট কটন ঐ সময়ে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধ ব্যক্তিগত পাণ্ডুলিপির সংগ্রহগুলো জড়ো করেন ও কটন লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। যাজকীয় প্রথা বিলোপনের পর যাজকদের গ্রন্থাগারে অনেক মূল্যহীন ও সুপ্রাচীন পাণ্ডুলিপি বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে চলে যায়। তাঁদের অনেকেই এ সকল পাণ্ডুলিপির গুরুত্ব সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিলেন। স্যার রবার্ট তাঁর বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগে ঐ প্রাচীন দলিলপত্রাদি খুঁজে বের করেন, ক্রয় করেন ও সংরক্ষণ করেন।[৪] তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর নাতি জাতির গ্রন্থাগার হিসেবে প্রথম জাতীয় গ্রন্থাগারে দান করেন। এই স্থানান্তর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্রিটিশ লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠা পায়।[৫][৬]
জাতীয় গ্রন্থাগারসমূহ
সম্পাদনাব্রিটিশ মিউজিয়ামের অংশ হিসেবে ১৭৫৩ সালে প্রথম প্রকৃত জাতীয় গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। এই নবগঠিত প্রতিষ্ঠান জাতীয় পর্যায়ের প্রথম নতুন ধরনের যাদুঘর হিসেবে গড়ে উঠে। এতে গীর্জা কর্তৃপক্ষ বা রাজার কোনরূপ হস্তক্ষেপ ছিল না। সাধারণ জনগণের এতে উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার ছিল ও সবকিছু সংগ্রহের উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে উঠে।[৭] যাদুঘরের প্রতিষ্ঠায় চিকিৎসক ও প্রকৃতিবিদ স্যার হ্যান্স স্লোয়ানের অবদান ছিল অপরিসীম। তিনি তাঁর আগ্রহের বাছাইকৃত সংগ্রহ একত্রে জড়ো করেন যাতে তাঁর জীবদ্দশায় £২০,০০০ ব্যয়িত হয়।[৮]
স্লোয়ানের সংগ্রহে প্রায় ৪০,০০০ মুদ্রিত পুস্তক ও ৭,০০০ পাণ্ডুলিপির পাশাপাশি মুদ্রণ ও চিত্রকর্ম অন্তর্ভুক্ত ছিল।[৯] ব্রিটিশ মিউজিয়াম অধ্যাদেশ, ১৭৫৩-এর মাধ্যমে কটন লাইব্রেরি ও হার্লেইয়ান লাইব্রেরিকে বৈধ প্রতিষ্ঠানরূপে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এগুলো ১৭৫৭ সালে রয়্যাল লাইব্রেরিতে যুক্ত হয় ও বিভিন্ন ব্রিটিশ শাসকদের দ্বারা পরিচালিত হতো।[১০]
১৫ জানুয়ারি, ১৭৫৯ তারিখে প্রথম প্রদর্শনী গ্যালারী ও গবেষকদের জন্য পাঠকক্ষের ব্যবস্থার উদ্বোধন করা হয়।[১১] ১৭৫৭ সালে রাজা দ্বিতীয় জর্জ দেশে প্রকাশিত প্রত্যেক গ্রন্থের একটি সংখ্যা এতে রাখার বিষয়ে অনুমোদন দেন। এরফলে মিউজিয়ামের গ্রন্থাগার অসীমভাবে বিস্তারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়।
১৮৫৬ সালে অ্যান্থনি পানিজ্জি ব্রিটিশ লাইব্রেরির প্রধান গ্রন্থাগারিকের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর আমলে, গ্রন্থাগারের সংগ্রহশালা ২৩৫,০০০ থেকে ৫৪০,০০০-এ বৃদ্ধি পায় যা একে তৎকালীন সময়ে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা বৃহত্তম গ্রন্থাগারে রূপান্তর করে। এর জনপ্রিয় সার্কুলার পাঠ কক্ষ ১৮৫৭ সালে উদ্বোধন করা হয়। পানিজ্জি তাঁর সহকারীদের নিয়ে ১৮৪১ সালে প্রণীত ‘একানব্বই ক্যাটালগিং নিয়মের’ আওতায় নতুন তালিকা পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। ঐ নিয়মগুলো পরবর্তীতে ১৯শ ও ২০শ শতাব্দীতে সৃষ্ট সকল ক্যাটালগ নিয়মের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এটি আইএসবিডি ও ডাবলিন কোরের ন্যায় ডিজিটাল ক্যাটালগিং উপাদানের ভিত্তিস্বরূপ।
ফ্রান্সের প্রথম জাতীয় গ্রন্থাগার হিসেবে বিবলিওথিক ম্যাজারিন গড়ে উঠে। ১৩৬৮ সালে পঞ্চম চার্লস ল্যুভর প্রাসাদে রাজকীয় গ্রন্থাগার হিসেবে এর প্রতিষ্ঠা পায়। ষষ্ঠ চার্লসের দেহাবসানের পর প্রথমদিককার এই সংগ্রহশালাটি ফ্রান্সে নিযুক্ত ইংরেজ প্রতিনিধি বেডফোর্ডের ডিউক ক্রয় করেন ও ১৪২৪ সালে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেন। ১৪৩৫ সালে তাঁর মৃত্যু ঘটলে এগুলো উধাও হয়ে যায়।[১২][১৩] মুদ্রণ ব্যবস্থা উদ্ভাবনের ফলে ১৪৬১ সালে একাদশ লুইসের তত্ত্বাবধানে আরেকটি সংগ্রহশালা গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়।[১৪] ১৫৩৪ সালে প্রথম ফ্রান্সিস এ সংগ্রহগুলোকে ফন্তেইনেব্লিউতে স্থানান্তর করেন ও ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারের সাথে একীভূত করে ফেলেন।
১৭শ শতাব্দীতে জ্যাকুয়েস অগাস্তে দ্য থোকে গ্রন্থাগারিক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এ সময়ে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে। এরফলে এটি বিশ্বের অন্যতম সর্ববৃহৎ ও সমৃদ্ধশালী গ্রন্থের সংগ্রহশালারূপে বিবেচিত হয়।[১৩] মন্ত্রী লুভইসের পুত্র আবে লুভইসের প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে থাকাবস্থায় ১৬৯২ সালে গ্রন্থাগারটিকে সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। আবে বিগনন বা দ্বিতীয় বিগননের স্থলাভিষিক্ত হয়ে তিনি গ্রন্থাগার ব্যবস্থাকে পুণর্গঠন করেন। ১৭৩৯-৫৩ সময়ের মধ্যে ১১ খণ্ডের জন্য ক্যাটালগ প্রণয়ন করেন। ফরাসি বিপ্লব ছড়িয়ে পড়লে ক্রয় ও উপহারের মাধ্যমে এ সংগ্রহশালা স্ফীত হতে থাকে। ঐ সময়ে এটি আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসের মুখোমুখি ছিল। কিন্তু অ্যান্টোইন-অগাস্টিন রেনুয়ার্দ ও জোসেফ ফন প্রায়েতের আপ্রাণ চেষ্টায় এটি কোনরূপ আক্রমণের শিকারে পরিণত হয়নি।[১৩]
ফরাসি বিপ্লব চলাকালে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে অভিজাত ও পাদ্রীদের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার জব্দ করা হলে এ গ্রন্থাগারের সংগ্রহশালা ৩০০,০০০ খণ্ড অতিক্রম করে। সেপ্টেম্বর, ১৭৯২ সালে প্রথম ফরাসি প্রজাতন্ত্র গঠিত হলে, ‘আইনসভা বিবলিওথিক দু রোইকে জাতীয় সম্পদ রূপে ঘোষণা করে ও এ প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে বিবলিওথিক ন্যাশিওনাল রাখা হয়। চার শতাব্দীকাল রাজতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে থাকার পর এই সুবিশাল গ্রন্থাগারটি এখন থেকে ফরাসি জনগণের সম্পদে পরিণত হবে।’[১২]
সম্প্রসারণ
সম্পাদনা১৭৮৩ সালে নবগঠিত মার্কিন প্রজাতন্ত্রের জেমস ম্যাডিসন একটি কংগ্রেসসম্পর্কিত গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার কথা প্রথমবারের মতো প্রস্তাব করেন।[১৫] রাষ্ট্রপতি জন অ্যাডামস ফিলাডেলফিয়া থেকে নতুন রাজধানী ওয়াশিংটনে সরকারের আইনসভার আসন স্থানান্তরে কংগ্রেসের আইনে স্বাক্ষর করলে ২৪ এপ্রিল, ১৮০০ তারিখে লাইব্রেরি অব কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করা হয়। আইনের অংশ হিসেবে $৫,০০০ কংগ্রেসে দরকার পড়তে পারে এজাতীয় গ্রন্থ ক্রয়ের জন্য অর্থবরাদ্দ করা হয় ..., এবং এগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য উপযুক্ত ভবন নির্মাণ করা হয় .... লন্ডনে গ্রন্থগুলো ক্রয়ের জন্য নির্দেশনামা প্রদান করা হয় এবং ঐ সংগ্রহশালায় ৭৪০টি গ্রন্থ ও ৩টি মানচিত্র ক্যাপিটলে রাখা হয়।[১৬]
১৭৯৫ সালে ক্যাথরিন দ্য গ্রেট ইম্পেরিয়াল পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা সংগ্রহশালায় যুক্ত ভলতেয়ার ও দিদেরটের ঘরোয়া গ্রন্থাগারের সংগ্রহগুলো তাঁদের উত্তরাধিকারীদের কাছ থেকে ক্রয় করেছিলেন। ভলতেয়ারের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার অদ্যাবধি এ সংগ্রহশালার উল্লেখযোগ্য বিষয়। ১৭৬৬ সালে ক্যাথরিন রুশ গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে পরিকল্পনা জমা দেন কিন্তু মৃত্যুর আঠারো মাস পূর্বে সম্রাজ্ঞী ২৭ মে, [ও.এস. ১৬ মে] ১৭৯৫ তারিখের পূর্ব-পর্যন্ত রাজকীয় গ্রন্থাগারের এ প্রকল্পটি অনুমোদন করেননি। বিদেশী ভাষা বিভাগের জন্য রুশ সরকার কর্তৃক ঐ সময়ে বিভাজনকালীন ৪২০,০০০ খণ্ডের জালুস্কি গ্রন্থাগারের আদলে পোলীয়-লিথুয়ানীয় কমনওয়েলথ নামীয় একটি প্রান্ত তৈরী হয়েছে।[১৭] অতঃপর ১৯২১ সালে রুশ এসএফএসআর সরকার গ্রন্থাগার থেকে প্রায় ৫৫,০০০ শিরোনামীয় পোলীয়ভাষী গ্রন্থ পোল্যান্ডে ফেরৎ দেয়।[১৮]
১৮৭১ সালে জার্মানি একমাত্র সাংবিধানিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেও প্রথম জাতীয় গ্রন্থাগার ১৮৪৮ সালে জার্মান বিপ্লবকালে গড়ে উঠে। সংসদীয় গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন পুস্তক বিক্রতা ও প্রকাশক ফ্রাঙ্কফুর্ট সংসদকে তাঁদের গ্রন্থসামগ্রী দিতে চেয়েছিলেন। যোহন হেইনরিখ প্লাথের নেতৃত্বে গঠিত গ্রন্থাগারটি রেইশবিবলিওথেক (রেইখ লাইব্রেরি) নামে পরিচিতি পায়। বিপ্লব ব্যর্থ হলে গ্রন্থাগারটি পরিত্যক্ত ঘোষিত হয় ও মজুদকৃত পুস্তকাদি ইতোমধ্যে নুরেমবার্গের জার্মানিশেষ ন্যাশনালমিউজিয়ামে ঠাঁই হয়।[১৯] ১৯১২ সালে স্যাক্সনি রাজ্যের লিপজিগ শহরে বার্ষিক লিপজিগ বই মেলার আসর বসে। এতে বোরসেনভেরেইন দার ডয়েশেন বুচান্ডলার (জার্মান বইবিক্রেতা সংস্থা) লিপজিগে জার্মান জাতীয় গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে একমত পোষণ করে। ১ জানুয়ারি, ১৯১৩ তারিখে অস্ট্রিয়া ও সুইজারল্যান্ডসহ জার্মানির সকল প্রকাশনা সংস্থা এতে পদ্ধতিগতভাবে বই সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু হয়।
বৈধ জমাদান ও গ্রন্থস্বত্ত্ব
সম্পাদনাকিছু দেশে বৈধ জমাদানের নিয়ম-নীতি প্রচলিত রয়েছে।
যুক্তরাজ্যে ১৯১১ সালের গ্রন্থস্বত্ত্ব ধারার পুণরুল্লেখ ২০০৩ সালের বৈধ জমাদান গ্রন্থাগার ধারায় করা হয়েছে। এতে সেখানে প্রকাশিত প্রত্যেক গ্রন্থের একটি সংখ্যা অবশ্যই জাতীয় গ্রন্থাগারে (ব্রিটিশ লাইব্রেরি) প্রেরণ করতে হবে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বডলিয়ান লাইব্রেরি, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি, স্কটল্যান্ডের জাতীয় গ্রন্থাগার, ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজ লাইব্রেরি ও ওয়েলসের জাতীয় লাইব্রেরি - এ পাঁচটি গ্রন্থাগারকেও প্রকাশনার এক বছরের মধ্যে একটি করে সৌজন্য সংখ্যা লাভেরও অধিকার দেয়া হয়। আন্তর্জাতিক পুস্তক প্রকাশনা শিল্পের প্রকৃতি নিশ্চয়তা বিধান করেছে যে, বিশ্বের যে-কোন প্রান্তে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য ইংরেজিভাষী সকল প্রকাশনাও এতে অন্তর্ভুক্ত হবে।
আয়ারল্যান্ড প্রজাতন্ত্রে ২০০০ সালের গ্রন্থস্বত্ত্ব ও সম্পর্কিত অধিকার অধ্যাদেশ বলে নির্দিষ্ট করা হয়েছে যে প্রত্যেক গ্রন্থের একটি করে সংখ্যা আয়ারল্যান্ডের জাতীয় গ্রন্থাগার, ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজ লাইব্রেরি, লাইমেরিক বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি, ডাবলিন সিটি ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরি ও ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে প্রেরণ করতে হবে। চারটি সংখ্যা আয়ারল্যান্ডের জাতীয় গ্রন্থাগারে প্রেরণ করতে হবে যাতে এর অধিভূক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিতরণ করা যায়। এছাড়াও, লিখিত চাহিদার ভিত্তিতে প্রকাশনার বারো মাসের মধ্যে বডলিয়ান লাইব্রেরি, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি, স্কটল্যান্ডের জাতীয় গ্রন্থাগার ও ওয়েলসের জাতীয় গ্রন্থাগারে বিতরণ করার নির্দেশনা রয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ায় ১৯৬৮ সালের গ্রন্থস্বত্ত্ব আইনের প্রচলন রয়েছে ও অন্যান্য রাজ্যের জন্য অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় গ্রন্থাগারে প্রত্যেক প্রকাশিত গ্রন্থের একটি সংখ্যা প্রেরণ করা বাধ্যতামূলক। সম্পর্কীয় রাজ্য গ্রন্থাগারে প্রকাশিত পুস্তক প্রেরণ করা হয় ও কিছু রাজ্যের সংসদীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারসহ অন্যান্য গ্রন্থাগারে বই দেয়া হয়।
একই ধরনের পদ্ধতি কানাডায় বর্তমান। এর জাতীয় গ্রন্থাগার লাইব্রেরি এন্ড আর্কাইভস কানাডাকে একইভাবে গ্রন্থ প্রেরণ করতে হয়।
১৫৩৭ সাল থেকে ফ্রান্সে প্রকাশনা সম্পর্কীয় সমূদয় কাজ বিবলিওথিক ন্যাশিওনাল দ্য ফ্রান্সে জমা রাখা বাধ্যতামূলক। এছাড়াও ১৯৯৭ সাল থেকে ডিজিটাল সাহিত্যকর্মও এটি সংরক্ষণ করছে।
সুইডেনে ১৬৬১ সাল থেকে প্রকাশিত সকল ধরনের সাহিত্যকর্মের একটি সংখ্যা সুয়েডীয় রাজকীয় গ্রন্থাগারে রাখা হচ্ছে।
সিঙ্গাপুরের জাতীয় গ্রন্থাগার বোর্ড আইনে সিঙ্গাপুর থেকে প্রকাশিত সকল প্রকাশককে প্রত্যেক প্রকাশনার জন্য দুইটি সংখ্যা প্রকাশনার তারিখ থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে নিজস্ব খরচে ন্যাশনাল লাইব্রেরি বোর্ডে প্রেরণের নির্দেশনা দেয়া আছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় বিভিন্ন দেশে এ ধরনের শর্তাবলীর প্রয়োজন পড়ে না। তবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে-কোন প্রকাশককে স্বত্ত্বযুক্ত সাহিত্যকর্মের দুইটি সংখ্যা লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে অবস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কপিরাইট অফিসে পাঠাতে হয় যা বাধ্যতামূলক বৈধ জমাদানরূপে পরিচিত।'[২০] আন্তর্জাতিক পুস্তক প্রকাশনা শিল্পের প্রকৃতি নিশ্চয়তা বিধান করেছে যে, বিশ্বের যে-কোন প্রান্তে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য ইংরেজিভাষী সকল প্রকাশনাও এতে অন্তর্ভুক্ত হবে। এছাড়াও এখানে ফেডারেল ডিপোজিটরি লাইব্রেরি রয়েছে যাতে সরকারী মুদ্রণ কার্যালয় থেকে প্রকাশিত সকল প্রকাশনা অবশ্যই সংরক্ষণ করা হয়।
পাশাপাশি প্রকাশকদের গ্রন্থ সংরক্ষণের জন্য আইনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে যাতে ঐ দেশগুলো আইনগত জমাদানের বিষয়ে সচরাচর যথোপযুক্ত ও দ্রুত সংরক্ষণের জন্য অন্যান্য অনেক কিছু করতে হয়। তন্মধ্যে, একই ধরনের নথিপত্রে মেধাস্বত্ত্ব আইনের প্রয়োগের সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং/অথবা প্রকাশনা সেবার ক্যাটালগকরণ অন্যতম।
প্রতি বছর প্রায় ত্রিশ লক্ষ নতুন ইংরেজিভাষী গ্রন্থ ব্রিটিশ লাইব্রেরি ও লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে সংরক্ষণ করা হয়।
জাতীয় গ্রন্থপঞ্জী নিয়ন্ত্রণ
সম্পাদনাজাতীয় গ্রন্থাগারের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে বৈশ্বিক গ্রন্থপঞ্জী নিয়ন্ত্রণের সাধারণ আন্তর্জাতিক উদ্দেশ্যের অংশ হিসেবে সংশ্লিষ্ট দেশের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। যে-কোন পন্থায় নির্দিষ্ট দেশ বা ব্যক্ত নির্দিষ্ট দেশ সম্পর্কে প্রকাশিত সকল গ্রন্থ বা গ্রন্থসম দলিলপত্রাদি গ্রন্থপঞ্জী নিয়ন্ত্রণ করা।
উদ্দেশ্যের প্রথম অংশরূপে বৈধ জমাদান সংক্রান্ত আইন বা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে) প্রকাশনা সেবায় ক্যাটালগকরণের ন্যায় পৃথক অনুষ্ঠানের আয়োজন করার মাধ্যমে অর্জন করা। এ সেবার মাধ্যমে লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে যে-কোন প্রকাশক কর্তৃক চূড়ান্ত খসড়া বা বর্তমানে গ্রন্থ প্রকাশনার বিষয়ে কিছু প্রমাণযোগ্য প্রচ্ছদচিত্র প্রেরণ করলে ক্যাটালগ আকারে গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ তথ্যাদি তুলে ধরা হয়। অন্যান্য জাতীয় গ্রন্থাগারে একই ধরনের সেবা বা একই ধরনের চর্চা বাধ্যতামূলকভাবে অনুসরণের দিকে দিকে জোর দেয়।
উদ্দেশ্যের দ্বিতীয় অংশে অর্জিত প্রকল্প ও সংগৃহীত উন্নয়ন নীতির মাধ্যমে নির্ধারিত অন্যান্য দেশ থেকে গ্রন্থের বাজার ও জাতীয় গ্রন্থাগারের অন্যতম উদ্দেশ্য পূরণে জাতীয় গ্রন্থপঞ্জী নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে নতুন আন্তর্জাতিক চুক্তি গ্রহণ রয়েছে। বিনিময় ও প্রবেশাধিকার চুক্তির আওতায় ঐ দেশগুলো একে-অপরের ক্যাটালগ পঠন ও আদর্শমানের ক্যাটালগ এন্ট্রি করে থাকে। এরফলে প্রত্যেক জাতীয় গ্রন্থাগার সম্ভাব্য প্রত্যেক প্রকাশিত দলিলপত্রাদির বিষয়ে সচেতন হতে সহায়তা করে যা তাদের দেশ সম্পর্কিত।
আন্তর্জাতিক গ্রন্থপঞ্জী নিয়ন্ত্রণ
সম্পাদনাজাতীয় গ্রন্থাগারের অনেকগুলো প্রধান উদ্দেশ্যের অন্যতম হচ্ছে ‘বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গি’ এবং বিশ্বের সকল গ্রন্থপঞ্জী নিয়ন্ত্রণে একযোগে কাজ করা। পূর্বেকার অনুচ্ছেদে বর্ণিত বিনিময় ও চুক্তির আলোকে এটি করা হয় এবং গ্রন্থাগার শ্রেণীকরণ পদ্ধতি ও ক্যাটালগকরণে নিয়ম-কানুনের ন্যায় আদর্শ ধারণাগত সরঞ্জামের নবপ্রবর্তনও এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
সর্বাধিক ব্যবহৃত এ ধরনের সরঞ্জামের মধ্যে জাতীয় পর্যায়ের জন্য ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড বিবলিওগ্রাফিক ডেসক্রিপশন বা আইএসবিডি এবং এএসিআর২ এর ন্যায় আন্তর্জাতিক ক্যাটালগকরণের কোড রয়েছে।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ Line, Maurice B.; Line, J. (2011). "Concluding notes". National libraries, Aslib, pp. 317–318
- ↑ ক খ Lor, P. J.; Sonnekus, E. A. S. (2010). "Guidelines for Legislation for National Library Services" ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৩ আগস্ট ২০০৬ তারিখে, IFLA. Retrieved on 10 January 2010.
- ↑ Fell-Smith, Charlotte (1909) John Dee: 1527–1608. London: Constable and Company Available online ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৬ মার্চ ২০০৯ তারিখে
- ↑ John Aikin. The Lives of John Selden, Esq., and Archbishop Usher; With Notices of the Principal English Men of Letters with Whom They Were Connected. 1812. p. 375.
- ↑ "Cotton Manuscripts"। British Library। ২০০৩-১১-৩০। ২০১৬-০৯-১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৪-০৭-২২।
- ↑ 'An Act for the better settling and preserving the Library kept in the House at Westminster called Cotton House in the Name and Family of the Cottons for the Benefit of the Publick [Chapter VII. Rot. Parl. 12 § 13 Gul. III. p. 1. n. 7.]', Statutes of the Realm: volume 7: 1695-1701 (1820), pp. 642-643. URL: http://www.british-history.ac.uk/report.aspx?compid=46991 ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৩ অক্টোবর ২০১২ তারিখে
- ↑ Dunton, Larkin (১৮৯৬)। The World and Its People। Silver, Burdett। পৃষ্ঠা 38।
- ↑ "Creating a Great Museum: Early Collectors and The British Museum"। Fathom। ২ জানুয়ারি ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ জুলাই ২০১০।
- ↑ "General history"। British Museum। ১৪ জুন ২০১০। সংগ্রহের তারিখ ৪ জুলাই ২০১০।
- ↑ Letter to Charles Long (1823), BMCE115/3,10. Scrapbooks and illustrations of the Museum. (Wilson, David, M.) (2002). The British Museum: A History. London: The British Museum Press, pg 346
- ↑ The British Museum Opened ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২ আগস্ট ২০০৯ তারিখে, History Today
- ↑ ক খ Paul M. Priebe. "From Bibliothèque du Roi to Bibliothèque Nationale: The Creation of a State Library, 1789–1793." The Journal of Library History (1974–1987), Vol. 17, No. 4 (Fall, 1982)
- ↑ ক খ গ One or more of the preceding sentences incorporates text from a publication now in the public domain: রিনেস, জর্জ এডুইন, সম্পাদক (১৯২০)। "National Library of France"। এনসাইক্লোপিডিয়া আমেরিকানা।
- ↑ Konstantinos Staikos (২০১২), History of the Library in Western Civilization: From Petrarch to Michelangelo, New Castle, DE: Oak Knoll Press, আইএসবিএন 978-1-58456-182-8
- ↑ Murray, Stuart. The Library: An Illustrated History (New York, Skyhouse Publishing, 2012): 155.
- ↑ "Jefferson's Legacy • A Brief History of the Library of Congress"। Library of Congress। মার্চ ৬, ২০০৬। সংগ্রহের তারিখ জানুয়ারি ১৪, ২০০৮।
- ↑ Малый энциклопедический словарь Брокгауза и Ефрона, published in the Imperial Russia in the early 1900s
- ↑ Great Soviet Encyclopedia, 3rd. edition
- ↑ Fabian, Bernhard, সম্পাদক (২০০৩)। "Reichsbibliothek von 1848"। Handbuch der historischen Buchbestände in Deutschland। Hildesheim: Olms Neue Medien।
- ↑ "U.S. Copyright Office - Mandatory Deposit (FAQ)"। Copyright.gov। সংগ্রহের তারিখ ২০১৪-০৭-২২।