পহেলা বৈশাখ

বঙ্গাব্দের প্রথম দিন যা নববর্ষ হিসেবে পালিত হয়
(নববর্ষ থেকে পুনর্নির্দেশিত)
এটি একটি পরীক্ষিত সংস্করণ, যা ৫ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে পরীক্ষিত হয়েছিল।

পহেলা বৈশাখ বা পয়লা বৈশাখ (বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের ১ তারিখ) বঙ্গাব্দের প্রথম দিন, তথা বাংলা নববর্ষ। দিনটি সকল বাঙালি জাতির ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের দিন। দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও এই উৎসবে অংশ নিয়ে থাকে। পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশে জাতীয় উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে থাকে। সে হিসেবে এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন লোকউৎসব হিসাবে বিবেচিত।[] পহেলা বৈশাখ উদযাপনের শুরু হয়েছিল পুরান ঢাকার মুসলিম মাহিফরাস সম্প্রদায়ের হাতে।[][]

পহেলা বৈশাখ
ঢাকায় পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপন
আনুষ্ঠানিক নামপহেলা বৈশাখ
অন্য নামবাংলা নববর্ষ
পালনকারীবাঙালি জাতি
উপাসনার রঙরামধনু
তাৎপর্যজাতিগত
উদযাপনবৈশাখী মেলা, মঙ্গল শোভাযাত্রা, হালখাতা
পালনবাংলাদেশ (১৪ই এপ্রিল) (জাতীয়)
ভারত (১৫ই এপ্রিল)
তারিখ১ বৈশাখ
সংঘটনবার্ষিক
সম্পর্কিতদক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সৌর নববর্ষ

গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে বাংলাদেশের প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল এই উৎসব পালিত হয়। বাংলা একাডেমি কর্তৃক নির্ধারিত আধুনিক বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে এই দিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে চান্দ্রসৌর বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে ১৫ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। এছাড়াও দিনটি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ছুটির দিন হিসেবে গৃহীত। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা দিনটি নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করার উপলক্ষ হিসেবে বরণ করে নেয়।

এই উৎসবটি শোভাযাত্রা, মেলা, পান্তাভাত খাওয়া, হালখাতা খোলা ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে উদ্‌যাপন করা হয়। বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্যবাহী শুভেচ্ছা বাক্য হল “শুভ নববর্ষ”। নববর্ষের সময় বাংলাদেশে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। ২০১৬ সালে, ইউনেস্কো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত এই উৎসব শোভাযাত্রাকে “মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য” হিসেবে ঘোষণা করে।[]

বাংলা দিনপঞ্জীর সাথে হিজরি এবং খ্রিস্টীয় সনের মৌলিক পার্থক্য হলো হিজরী সন চাঁদের হিসাবে এবং খ্রিস্টীয় সন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। এ কারণে হিজরী সনে নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যায় আকাশে নতুন চাঁদ দৃশ্যমান হওয়ার পর আর খ্রিস্টীয় সনে নতুন দিন শুর হয় ইউটিসি±০০:০০ অনুযায়ী। পহেলা বৈশাখ রাত ১২টা থেকে শুরু না হয়ে সূর্যোদয় থেকে শুরু এ নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে, ঐতিহ্যগত ভাবে সূর্যোদয় থেকে বাংলা দিন গণনার রীতি থাকলেও ১৪০২ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখ থেকে বাংলা একাডেমি এই নিয়ম বাতিল করে আন্তর্জাতিক রীতির সাথে সামঞ্জস্য রাখতে রাত ১২:০০টায় দিন গণনা শুরুর নিয়ম চালু করে।[][]

মঙ্গল শোভাযাত্রা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা
মঙ্গল শোভাযাত্রা, টিএসসি
বৈশাখী মেলা
ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলার একটি স্টল
ঢাকার ইসলামপুরের এক কাপড়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের হালখাতা অনুষ্ঠান
পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে পান্তা ভাতের সাথে ইলিশ মাছ, বিভিন্ন ধরনের ভর্তা এবং কাঁচা মরিচ পরিবেশন

ইতিহাস

সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বারো মাস অনেক কাল আগে থেকেই পালিত হতো। এই সৌর পঞ্জিকার শুরু হতো গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, বঙ্গ, কেরল, মনিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিল নাড়ু এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালিত হত। এখন যেমন নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, এক সময় এমনটি ছিল না। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আর্তব উৎসব তথা ঋতুকালীন উৎসব হিসেবে পালিত হত। তখন এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ, কারণ প্রাযুক্তিক প্রয়োগের যুগ শুরু না হওয়া পর্যন্ত কৃষকদের ঋতুর উপরই নির্ভর করতে হত।[]

মুঘলদের থেকে উদ্ভব তত্ত্ব

কয়েকজন ঐতিহাসিক বাঙ্গলা দিনপঞ্জি উদ্ভবের কৃতিত্ব আরোপ করেন ৭ম শতকের রাজা শশাঙ্কের উপর।[][][] পরবর্তীতে মুঘল সম্রাট আকবর এটিকে রাজস্ব বা কর আদায়ের উদ্দেশ্যে পরিবর্তিত করেন।[১০]

ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হত। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে রাজকীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ৯৯২ হিজরিতে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে "বঙ্গাব্দ" বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।[]

আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য থাকত। এর পর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হল বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকানদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকে। এই প্রথাটি এখনও অনেকাংশে প্রচলিত আছে, বিশেষত স্বর্ণের দোকানে।[]

শামসুজ্জামান খানের মতে, বাংলার মুঘল সুবাদার মুর্শিদ কুলি খান প্রথম পুন্যাহ এর রীতি শুরু করেন, যার অর্থ হচ্ছে "ভূমি রাজস্ব আদায়ের উৎসবের দিন", এবং তিনি বাংলা দিনপঞ্জির সূচনা করার জন্য আকবরের রাজস্বের নীতি ব্যবহার করেন।[]

শামসুজ্জামান খান,[] ও নীতিশ সেনগুপ্তের মতে বাংলা দিনপঞ্জির উদ্ভব পরিষ্কার নয়।[] শামসুজ্জামান এর মতে, "একে বাংলা সন বা সাল বলা হত, যা যথাক্রমে আরবি ও ফারসি শব্দ। এটা নির্দেশ করছে যে এই এটি প্রথম কোন মুসলিম রাজা বা সুলতানের দ্বারা প্রচলিত হয়েছে।"[] অন্যদিকে সেনগুপ্তের মতে, এর ঐতিহ্যগত নাম হচ্ছে বঙ্গাব্দ[][১১]

বঙ্গাব্দ শব্দটি (বাংলা বছর) আকবরের সময়কালের কয়েক শত বছর পূর্বে দুটো শিব মন্দিরেও পাওয়া যায়, যা বলছে বাংলা দিনপঞ্জির অস্তিত্ব আকবরের সময়ের পূর্বেও ছিল।[] আবার এও অস্পষ্ট যে আকবর বা হুসেন শাহ এর দ্বারা এটি গৃহীত হয়েছিল কিনা। বাংলা দিনপঞ্জি ব্যবহারের রীতি আকবরের পূর্বে হুসেন শাহ এর দ্বারাই হয়ে থাকতে পারে।[] নীতিশ সেনগুপ্ত বলেন, বাংলা দিনপঞ্জির প্রচলন যিনিই করে থাকুন না কেন, ঐতিহ্যবাহী বাংলা দিনপঞ্জির উপর ভিত্তি করে বসন্তের ফসল সংগ্রহের পর রাজস্ব আদায়ের জন্য এটা সহায়ক ছিল, কেননা ইসলামী হিজরি সনের ক্ষেত্রে রাজস্ব সংগ্রহের দিন ঠিক করতে প্রসাশনিক জটিলতা তৈরি হত।[]

বাংলা সনের মূল নাম ছিল তারিখ-এ-এলাহী। মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮৫ সালে তার রাজত্বকালের ২৯তম বর্ষের ১০ কিংবা ১১ মার্চ তারিখে এক ডিক্রি জারির মাধ্যমে তারিখ-এ-এলাহী প্রবর্তন করেন। সিংহাসনে আরোহণের পরপরই তিনি একটি বৈজ্ঞানিক, কর্মপোযোগী ও গ্রহণযোগ্য বর্ষপঞ্জি প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন, যেখানে দিন ও মাসের হিসাবটা যথাযথ থাকবে। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তিনি তৎকালীন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমীর ফতুল্লাহ সিরাজিকে নতুন বর্ষপঞ্জি তৈরির দায়িত্ব প্রদান করেন। বিখ্যাত পণ্ডিত ও সম্রাট আকবরের মন্ত্রী আবুল ফজল এ সম্বন্ধে ব্যাখ্যা প্রদান করেন যে, হিজরি বর্ষপঞ্জি কৃষিকাজের জন্য মোটেই উপযোগী ছিল না কারণ চন্দ্র বছরের ৩১ বছর হয় সৌর বছরের ৩০ বছরের সমান। চন্দ্র বছরের হিসাবেই তখন কৃষকশ্রেণির কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করা হতো অথচ চাষবাস নির্ভর করতো সৌর বছরের হিসাবের ওপর। চন্দ্র বছর হয় ৩৫৪ দিনে আর সেখানে সৌর বছর হয় ৩৬৫ বা ৩৬৬ দিনে। ফলে দুটি বর্ষপঞ্জির মধ্যে ব্যবধান থেকে যায় বছরে ১১ বা ১২ দিন। বাংলা সনের জন্ম ঘটে সম্রাট আকবরের এই রাজস্ব আদায়ের আধুনিকীকরণের প্রেক্ষাপটে।

তারিখ-এ-এলাহীর বারো মাসের নাম ছিল কারবাদিন, আর্দি, বিসুয়া, কোর্দাদ, তীর, আমার্দাদ, শাহরিয়ার, আবান, আজুর, বাহাম ও ইস্কান্দার মিজ। কারো পক্ষে আসলে নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় কখন এবং কীভাবে এসব নাম পরিবর্তিত হয়ে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র হয়। অনুমান করা হয়, বারোটি নক্ষত্রের নাম নিয়ে পরবর্তীকালে নামকরণ করা হয় বাংলা মাসের। বিশাখা নক্ষত্র থেকে বৈশাখ, জায়ীস্থা থেকে জ্যৈষ্ঠ, শার থেকে আষাঢ়, শ্রাবণী থেকে শ্রাবণ, ভদ্রপদ থেকে ভাদ্র, আশ্বায়িনী থেকে আশ্বিন, কার্তিকা থেকে কার্তিক, আগ্রায়হন থেকে অগ্রহায়ণ, পউস্যা থেকে পৌষ, ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা নক্ষত্র থেকে চৈত্র।

হিন্দু উদ্ভব তত্ত্ব

ঐতিহাসিকদের মতে, পহেলা বৈশাখ উৎসবটি ঐতিহ্যগত হিন্দু নববর্ষ উৎসবের সাথে সম্পর্কিত যা Vaisakhi (বৈশাখী ) ও অন্য নামে পরিচিত। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে একই দিনে এই উৎসব পালিত হয়।[১২][১৩][১৪][১৫] এই Vaisakhi-কে Baisakhi উচ্চারণও করা হয়। হিন্দু ও শিখগণ এই উৎসব পালন করে।[১৬]

ভারতের পূর্বাঞ্চল ও উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর নববর্ষের উৎসবগুলো হিন্দু বিক্রমী দিনপঞ্জির সাথে সম্পর্কিত। এই দিনপঞ্জির নামকরণ করা হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ অব্দে বিক্রমাদিত্যের নাম অনুসারে।[১৭] ভারতের গ্রামীণ বাঙ্গালি সম্প্রদায়ে ভারতের অনেক অঞ্চল ও নেপালের মত বিক্রমাদিত্যকে বাংলা দিনপঞ্জির আবির্ভাবের স্বীকৃতি দেয়া হয়। কিন্তু সেই অঞ্চলগুলোর মত বাংলায় বঙ্গাব্দের সূচনা ৫৭ খ্রিস্টপূর্বে হয়নি, বরং ৫৯৩ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয়েছিল, যা নির্দেশ করছে বঙ্গাব্দের সূচনা প্রমাণ সময়কে কোন একসময় পরিবর্তিত করা হয়েছে।[১৮][১৯] মনে করা হয় শশাঙ্কের শাসনামলেই এই পরিবর্তন হয়।[]

আধুনিক ইতিহাস

আধুনিক নববর্ষ উদ্‌যাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্তনপূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওযা যায়।[২০]

সমসাময়িক ব্যবহার

ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলোতে যে বাংলা দিনপঞ্জি ব্যবহার করা হয়ে তা সংস্কৃত গ্রন্থ সূর্য সিদ্ধান্ত-এর উপর ভিত্তি করে লেখা। এখানে মাসগুলোর ঐতিহাসিক সংস্কৃত নামগুলো রাখা হয়েছে যার প্রথম মাসের নাম হল বৈশাখ।[১০] তাদের দিনপঞ্জিটি হিন্দু দিনপঞ্জি ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত এবং বিভিন্ন বাঙ্গালি হিন্দু উৎসবের দিন নির্ধারণে সেটি ব্যবহৃত হয়। পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য অঙ্গরাজ্যের বাঙ্গালিদের জন্য প্রতি বছর ১৪ বা ১৫ এপ্রিলে এই উৎসব হয়ে থাকে।[১০]

কিন্তু বাংলাদেশে ১৯৬৬ সালে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর নেতৃত্বে গঠিত হওয়া ১৯৬৬ সালের একটি কমিটিতে পুরনো বাংলা দিনপঞ্জিকে সংশোধিত করা হয়। এখানে প্রথম পাঁচ মাসকে ৩১ দিন, আর বাকি মাসগুলোকে ৩০ দিন বানানো হয়। প্রতি অধিবর্ষে ফাল্গুন মাসে ৩১ দিন ধার্য করা হয়।[১০] ১৯৮৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে এই দিনপঞ্জি গ্রহণ করা হয়। এরপর, জাতীয় দিনপঞ্জির সূচনা ও প্রতি বছর নববর্ষ ১৪ এপ্রিলেই হয়ে থাকে।[১০] ১৪২৬ বঙ্গাব্দে দ্বিতীয়বারের মত সংশোধনী আনা হয়।[২১] গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির সঙ্গে বাংলা বর্ষপঞ্জির বিশেষ দিনগুলোর সমন্বয় আনতে বাংলা একাডেমি এই পরিবর্তন আনে।[২২] নতুন বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র ও আশ্বিন—এই ছয় মাস ৩১ দিনে হবে। ফাল্গুন মাস ছাড়া অন্য পাঁচ মাস ৩০ দিনে পালন করা হবে। ফাল্গুন মাস হবে ২৯ দিনের, কেবল অধিবর্ষের বছর ফাল্গুন মাস ৩০ দিনের হবে।

পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপন

বাংলাদেশ

নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগ। গ্রামে মানুষ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, নতুন জামাকাপড় পরে এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যায়। বাড়িঘর পরিষ্কার করা হয় এবং মোটামুটি সুন্দর করে সাজানো হয়। বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাও থাকে। কয়েকটি গ্রামের মিলিত এলাকায়, কোন খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার। মেলাতে থাকে নানা রকম কুটির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন, থাকে নানারকম পিঠা পুলির আয়োজন। অনেক স্থানে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। এই দিনের একটি পুরনো সংস্কৃতি হলো গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। এর মধ্যে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা কিংবা কুস্তি একসময় প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশে এরকম কুস্তির সবচেয়ে বড় আসরটি হয় ১২ বৈশাখ, চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দানে, যা জব্বারের বলি খেলা নামে পরিচিত।

মঙ্গল শোভাযাত্রা

ঢাকার বৈশাখী উৎসবের একটি আবশ্যিক অঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখের সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। এই শোভাযাত্রায় গ্রামীণ জীবন এবং আবহমান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলা হয়। শোভাযাত্রায় সকল শ্রেণী-পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে। শোভাযাত্রার জন্য বানানো হয় বিভিন্ন রঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি। ১৯৮৯ সাল থেকে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখ উৎসবের একটি অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।[২৩]

জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কো বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর বাংলাদেশের ‘‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’’কে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। ইথিওপিয়ার রাজধানী শহর আদ্দিস আবাবা’য় ২৮ নভেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর ২০১৬ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর সংশিষ্ট আন্তজাতিক পর্ষদ (অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার জন্য আন্তঃসরকার কমিটি) বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তাবটি অনুমোদন করে। বাংলাদেশের প্রস্তাব অনুমোদনক্রমে ইউনেস্কো লিখে: "মঙ্গল শোভাযাত্রা হল জনসাধারণের একটি উৎসব যা ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখে (নববর্ষের দিনে) উদযাপন করা হয়, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের দ্বারা আয়োজন করা হয়। ঐতিহ্যটি ১৯৮৯ সালে শুরু হয়, যখন সামরিক শাসনের অধীনে বসবাসরত হতাশ শিক্ষার্থীরা সম্প্রদায়কে একটি উন্নত ভবিষ্যতের আশা দিতে চেয়েছিল। এটির বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে মুখোশ ও ভাসমান প্রতিকৃতি যা শক্তি, শান্তি এবং অগ্রগতির জন্য অশুভকে দূরে সরানোর প্রতীক। বিদ্যালয়ের দ্বারা ভাগভাগি করা জ্ঞানের উপাদানসহ, এটি জনসংহতি এবং গণতন্ত্রকে প্রচার করে।"

২০০৫-০৬ অর্থবৎসরে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি তালিকা প্রণয়নের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং এশিয়াটিক সোসাইটিকে এই দায়িত্ব দেয়া হয়। ১২ খণ্ডে প্রকাশিত এই তালিকা তথা সমীক্ষা প্রতিবেদনের ১১শ খণ্ডে পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে জাতীয় সংস্কৃতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে বাংলা একাডেমী ২০১৪ সালে এ প্রস্তাবনাটি সর্বপ্রথম প্রণয়ন করেছিল। কিন্ত তা গ্রহণযোগ্য হয় নি। পরবর্তীকালে ইউনেস্কোর চাহিদা অনুযায়ী এই প্রস্তাবনাকে গ্রহণযোগ্যরূপে পুনঃপ্রণয়ন করা হয়। ২০১৫ এর ১লা জুন প্যারিসে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম. শহিদুল ইসলাম এই পুনঃপ্রণীত প্রস্তাবনাটি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে পুনরায় ইউনেস্কোর নিকট দাখিল করেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রস্তাবটি Nomination File No. 01091 (মনোনয়ন ফাইল নং ০১০৯১) হিসেবে চিহ্নিত ছিল। অতঃপর, ইউনেস্কো মঙ্গল শোভাযাত্রাক বিশ্বঐতিহ্যর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

ঢাকায় রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ ও মঙ্গল শোভাযাত্রা

 
পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপনের জন্য নগরবাসী লাইন ধরে রমনা পার্কে প্রবেশ করছে

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় পহেলা বৈশাখের মূল অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের সঙ্গীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন বছরের সূর্যকে আহ্বান। পহেলা বৈশাখ সূর্যোদয়ের পর পর ছায়ানটের শিল্পীরা সম্মিলিত কণ্ঠে গান গেয়ে নতুন বছরকে আহ্বান জানান। বর্ষবরণের এই সঙ্গীতানুষ্ঠানটি ঢাকার রমনা পার্কের রমনা বটমূলে অনুষ্ঠিত হয়।[২৪] স্থানটির পরিচিতি বটমূল হলেও প্রকৃতপক্ষে যে গাছের ছায়ায় মঞ্চ তৈরি হয় সেটি বট গাছ নয়, অশ্বত্থ গাছ। ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা।[২৩]

বউমেলা

ঈশা খাঁর সোনারগাঁওয়ে ব্যতিক্রমী এক মেলা বসে যার নাম বউমেলা, এটি স্থানীয়ভাবে "বটতলার মেলা" নামেও পরিচিত। জয়রামপুর গ্রামের মানুষের ধারণা, প্রায় ১০০ বছর ধরে পহেলা বৈশাখে শুরু হওয়া এই মেলা পাঁচ দিনব্যাপী চলে। প্রাচীন একটি বটবৃক্ষের নিচে এই মেলা বসে, যদিও সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পুজোর জন্য এখানে সমবেত হয়।[২৫] বিশেষ করে কুমারী, নববধূ, এমনকি জননীরা পর্যন্ত তাদের মনস্কামনা পূরণের আশায় এই মেলায় এসে পূজা-অর্চনা করেন। সন্দেশ-মিষ্টি-ধান দূর্বার সঙ্গে মৌসুমি ফলমূল নিবেদন করে ভক্তরা। পাঁঠাবলির রেওয়াজও পুরনো। বদলে যাচ্ছে পুরনো অর্চনার পালা। এখন কপোত-কপোতি উড়িয়ে শান্তির বার্তা পেতে চায় ভক্তরা দেবীর কাছ থেকে।[২৬]

হালখাতা

হালখাতা হল পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে পালিত একটি উৎসব যাতে গত বছরের সমস্ত হিসাব-নিকাশ শেষ হয় এবং একটি নতুন খাতা খোলা হয়। এটি বাঙালি ব্যবসায়ী, দোকানদার এবং ব্যবসায়ীদের দ্বারা পালন করা হয়।

ঘোড়ামেলা

এ ছাড়া সোনারগাঁ থানার পেরাব গ্রামের পাশে আরেকটি মেলার আয়োজন করা হয়। এটির নাম ঘোড়ামেলা। লোকমুখে প্রচলিত যামিনী সাধক নামের এক ব্যক্তি ঘোড়ায় করে এসে নববর্ষের এই দিনে সবাইকে প্রসাদ দিতেন এবং তিনি মারা যাওয়ার পর ওই স্থানেই তার স্মৃতিস্তম্ভ বানানো হয়। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে স্মৃতিস্তম্ভে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা একটি করে মাটির ঘোড়া রাখে এবং এখানে মেলার আয়োজন করা হয়। এ কারণে লোকমুখে প্রচলিত মেলাটির নাম ঘোড়ামেলা। এ মেলার অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে নৌকায় খিচুড়ি রান্না করে রাখা হয় এবং আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই কলাপাতায় আনন্দের সঙ্গে তা ভোজন করে। সকাল থেকেই এ স্থানে লোকজনের আগমন ঘটতে থাকে। শিশু-কিশোররা সকাল থেকেই উদগ্রীব হয়ে থাকে মেলায় আসার জন্য। এক দিনের এ মেলাটি জমে ওঠে দুপুরের পর থেকে। হাজারো লোকের সমাগম ঘটে। যদিও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কারণে এ মেলার আয়োজন করা হয়। তথাপি সব ধর্মের লোকজনেরই প্রাধান্য থাকে এ মেলায়। এ মেলায় শিশু-কিশোরদের ভিড় বেশি থাকে। মেলায় নাগরদোলা, পুতুল নাচ ও সার্কাসের আয়োজন করা হয়। নানারকম আনন্দ-উৎসব করে পশ্চিমের আকাশ যখন রক্তিম আলোয় সজ্জিত উৎসবে, যখন লোকজন অনেকটাই ক্লান্ত, তখনই এ মেলার ক্লান্তি দূর করার জন্য নতুন মাত্রায় যোগ হয় কীর্তন। এ কীর্তন হয় মধ্যরাত পর্যন্ত। এভাবেই শেষ হয় বৈশাখের এই ঐতিহ্যবাহী মেলা।[২৬]

চট্টগ্রামে বর্ষবরণ

 
চট্টগ্রামের ডিসি হিল প্রাঙ্গনে পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপন

বন্দরনগরী চট্টগ্রামে পহেলা বৈশাখের উৎসবের মূল কেন্দ্র ডিসি হিল পার্ক। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে প্রতিবছর এখানে পুরনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরণ করার জন্য দুইদিনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। মুক্ত মঞ্চে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি থাকে নানা গ্রামীণ পন্যের পশরা। এছাড়াও থাকে পান্তা ইলিশের ব্যবস্থা।

চট্টগ্রামে সম্মিলিত ভাবে পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপনের উদ্যোগ ১৯৭৩, ১৯৭৪ ও ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিকগণের চেষ্টায় ইস্পাহানী পাহাড়ের পাদদেশে এই অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। ১৯৭৮ সালে প্রথমবাবের মতো এই উৎসব এখনকার ডিসি হিল পার্কে সরিয়ে নেওযা হয়। প্রথম দিকে প্রত্যেক সংগঠন থেকে দুইজন করে নিয়ে একটি স্কোয়াড গঠন করা হত এবং সেই স্কোয়াডই সম্মিলিত সঙ্গীত পরিবেশন করতো। ১৯৮০ সাল থেকে সংগঠনগুলো আলাদাভাবে গান পরিবেশন শুরু করে। পরে গ্রুপ থিয়েটার সমন্বয় পরিষদ যুক্ত হওয়ার পর অনুষ্ঠানে নাটকও যুক্ত হয়েছে।[২৭]

নগরীর অন্যান্য নিয়মিত আয়োজনের মধ্যে রয়েছে শিশু প্রতিষ্ঠান ফুলকির তিনদিন ব্যাপী "ছোটদের বৈশাখী উৎসব" যার প্রারম্ভ হয় পহেলা বৈশাখের দুদিন আগে এবং শেষ হয় বৈশাখের প্রথম দিন সন্ধ্যায়। ১৯৯০ সাল থেকে নিয়মিত এই আয়োজন হয়ে আসছে।

নগরীর বাংলাদেশ মহিলা সমিতি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে বর্ষবরণ মেলার আয়োজন হয়ে থাকে। এছাড়া কেন্দ্রীয় রেলওয়ে ভবন বা সিআরবি তে মুক্ত মঞ্চে আয়োজন হয়ে থাকে সঙ্গীতানুষ্ঠানের ।

চট্টগ্রাম চারুকলা ইনস্টিটিউটের বাদশা মিয়া রোডস্থ ক্যাম্পাসে বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে হয়ে থাকে বণাঢ্য সাঙ্গস্কৃতিক অনুষ্ঠান।এবং এই অনুষ্ঠানে উঠে আসে,বাঙ্গালীর ঐতিহ্য,সংস্কৃতি,কৃষ্টি এবং একি সাথে আঞ্চলিক নানা বিষয় আশয় ও।চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়,চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা প্রতিবছর এই অনুষ্ঠান আয়োজন করে আসছে ।

পার্বত্য জেলায়, আদিবাসীদের বর্ষবরণ

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার প্রধান তিনটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা রয়েছে যাদের প্রত্যেকেরই বছরের নতুন দিনে উৎসব আছে। ত্রিপুরাদের বৈসু, মারমাদের সাংগ্রাইচাকমাদের বিজু উৎসব। বর্তমানে তিনটি জাতিসত্তা একত্রে এই উৎসবটি পালন করে। যৌথ এই উৎসবের নাম বৈসাবি উৎসব। এই উৎসবের নানা দিক রয়েছে, এর মধ্যে একটি হলো মারমাদের পানি উৎসব।

পশ্চিমবঙ্গ

 
চৈত্রের শেষদিনে গাজনের মেলার দৃশ্য

পশ্চিমবঙ্গে মহাসমারোহে সাড়ম্বরে উদযাপিত হয় বাংলা নববর্ষারম্ভ পয়লা বৈশাখ। বঙ্গাব্দের প্রথম দিনটিতে বিপুল উৎসাহ এবং উদ্দীপনার সাথে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়ে থাকে সমগ্র পশ্চিম বাংলায়। বাংলার গ্রামীণ এবং নাগরিক জীবনের মেলবন্ধন সাধিত হয়ে সকলে একসূত্রে বাঁধা পড়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আনন্দে। সারা চৈত্র মাস জুড়েই চলতে থাকে বর্ষবরণের প্রস্তুতি। চৈত্র মাসের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তি বা মহাবিষুব সংক্রান্তির দিন পালিত হয় গাজন উৎসব উপলক্ষ্যে চড়ক পূজা অর্থাৎ শিবের উপাসনা। এইদিনেই সূর্য মীন রাশি ত্যাগ করে মেষ রাশিতে প্রবেশ করে। এদিন গ্রামবাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আয়োজিত হয় চড়ক মেলা। এই মেলায় অংশগ্রহণকারী সন্ন্যাসী বা ভক্তগণ বিভিন্ন শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন করে আরাধ্য দেবতার সন্তোষ প্রদানের চেষ্টা এবং সাধারণ মানুষের মনোরঞ্জন করে থাকেন।

এছাড়া, বহু পরিবারে বর্ষশেষের দিন টক এবং তিতা ব্যঞ্জন ভক্ষণ করে সম্পর্কের সকল তিক্ততা ও অম্লতা বর্জন করার প্রতীকী প্রথা একবিংশ শতাব্দীতেও বিদ্যমান। পরের দিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ প্রতিটি পরিবারে স্নান সেরে বয়ঃজ্যেষ্ঠদের প্রণাম করার রীতি বহুলপ্রচলিত। বাড়িতে বাড়িতে এবং সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চলে মিষ্টান্ন ভোজন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলির অধিকাংশই এদিন থেকে তাদের ব্যবসায়িক হিসেবের নতুন খাতার উদ্বোধন করে, যার পোশাকি নাম হালখাতা । এই উপলক্ষ্যে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলিতে মঙ্গলদাত্রী লক্ষ্মী ও সিদ্ধিদাতা গণেশের আরাধনা করা হয়। নতুন খাতায় মঙ্গলচিহ্ন স্বস্তিকা আঁকা হয়ে থাকে।

গ্রামাঞ্চলে এবং কলকাতা শহরের উপকণ্ঠে বিভিন্ন মন্দির ও অন্যান্য প্রাঙ্গনে পয়লা বৈশাখ থেকে আরম্ভ হয় বৈশাখী মেলা। এই মেলা সমগ্র বৈশাখ মাস জুড়ে অনুষ্ঠিত হয়। আগেকার সময় পয়লা বৈশাখের দিনে জমির মালিকরা নিজের অঞ্চলে মিষ্টি বিতরণ করতেন। পরে এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। আকবরের সময় এই দিনে  একটি হালখাতা তৈরি করা হত।  গ্রাম বা শহরে পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হত। হালখাতার দিনে দোকানদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকে। এই প্রথাটি এখনও সোনার দোকানে আছে। আধুনিক নববর্ষ উদ্‌যাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পয়লা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

কলকাতা

ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত কলকাতা পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপনে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। নববর্ষারম্ভ উপলক্ষে শহরের বিভিন্ন পাড়ার অলিতে গলিতে নানা সংগঠনের উদ্যোগে প্রভাতফেরি আয়োজিত হয়। বিগত বছরের চৈত্র মাসে শহরের অধিকাংশ দোকানে ক্রয়ের উপর দেওয়া হয়ে থাকে বিশেষ ছাড়, যার প্রচলিত কথ্য নাম 'চৈত্র সেল'। তাই পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে এবং এই ছাড়ের সুবিধা গ্রহণ করতে অর্থনৈতিক অবস্থা নির্বিশেষে কলকাতার সমস্ত মানুষ একমাস ধরে নতুন জামাকাপড়, ইত্যাদি ক্রয় করে থাকে।

পয়লা বৈশাখের দিন উল্লেখযোগ্য ভিড় চোখে পড়ে কলকাতার বিখ্যাত কালীঘাট মন্দিরে। সেখানে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ভোর থেকে মন্ত্রপাঠপূর্বক গঙ্গাস্নান করে প্রতীক্ষা করে থাকেন দেবীকে পূজা নিবেদন করে হালখাতা আরম্ভ করার জন্য। ব্যবসায়ী ছাড়াও বহু গৃহস্থও পরিবারের মঙ্গল কামনা করে দেবীর আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে কালীঘাটে গিয়ে থাকেন। এইদিন বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পোশাক হিসাবে নতুন ধুতি-পাঞ্জাবি এবং শাড়ি পরার রেওয়াজ প্রচলিত।

 
পয়লা বৈশাখে বিভিন্ন ব্যঞ্জনে ভুড়িভোজ

অন্যান্য দেশে পহেলা বৈশাখ

বাংলাদেশ এবং ভারত ছাড়াও পৃথিবীর আরো নানান দেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হয়ে থাকে।[২৮] মূলত প্রবাসী বাঙ্গালীরা সেসব দেশে পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপন করে থাকেন।

কানাডার বাংলাদেশ হেরিটেজ এন্ড এথনিক সোসাইটি অফ আলবার্টা অন্যান্য সংগঠনের সাথে বর্ণাঢ্যভাবে তার ঐতিহ্য উৎসব (বাংলা নববর্ষ) উদযাপন করে। ক্যালগারির বাঙালিরা ঐতিহ্যবাহী খাবার, পোশাক এবং বাঙালি সংস্কৃতির সাথে দিনটি উদযাপন করে। অস্ট্রেলিয়ার বঙ্গবন্ধু কাউন্সিল সিডনি অলিম্পিক পার্কে পহেলা বৈশাখ অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করে।

চিত্রশালা

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. সমবারু চন্দ্র মহন্ত (২০১২)। "পহেলা বৈশাখ"ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743 
  2. Akram, Ridwan (১৪ এপ্রিল ২০১৭)। "বৈশাখী খাবারের সুলুক সন্ধানে" [In search of Boishakhi banquets]। Bdnews24.com। ৮ মার্চ ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ মে ২০২৩ 
  3. Sahebul Haq, Sheikh। "মাহিফরাসের দাওয়াত টু পয়লার ইলিশ-পান্তা" [From the banquets of the Mahifarash to the Ilish-Panta of Poyla Boishakh]। Ei Samay Gold। ৮ মার্চ ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ মে ২০২৩ 
  4. হোসেন, মোছাব্বের (১৪ এপ্রিল ২০১৭)। "মঙ্গল শোভাযাত্রার বিশ্ব স্বীকৃতি এল যেভাবে"দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ১৪ এপ্রিল ২০১৮ 
  5. মো. সফিকুল ইসলাম। "বাংলা বর্ষপঞ্জির জন্ম"। Archived from the original on ১৬ এপ্রিল ২০১৩। সংগ্রহের তারিখ ১৬ এপ্রিল ২০১৫ 
  6. ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী (অধ্যাপক, ইলেকট্রিকাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) (১০ মে ২০১১)। "রেবতী নক্ষত্র, অয়নচলন, 'সূর্য-সিদ্ধান্ত' ও বাংলা নববর্ষ | মতামত"opinion.bdnews24.com। ১৬ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৬ এপ্রিল ২০১৯ 
  7. Guhathakurta, Meghna; Schendel, Willem van (২০১৩)। The Bangladesh Reader: History, Culture, Politics। Duke University Press। পৃষ্ঠা 17–18। আইএসবিএন 9780822353188 
  8. Hermann Kulke, Dietmar Rothermund, A History of India, আইএসবিএন 0203443454 
  9. Nitish K. Sengupta (২০১১)। Land of Two Rivers: A History of Bengal from the Mahabharata to Mujib। Penguin Books India। পৃষ্ঠা 96–98। আইএসবিএন 978-0-14-341678-4 
  10. Kunal Chakrabarti; Shubhra Chakrabarti (২০১৩)। Historical Dictionary of the Bengalis। Scarecrow। পৃষ্ঠা 114–115। আইএসবিএন 978-0-8108-8024-5 
  11. সৈয়দ আশরাফ আলী (২০১২)। "বাংলা বর্ষপঞ্জি"ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743 
  12. William D. Crump (২০১৪)। Encyclopedia of New Year's Holidays Worldwide। McFarland। পৃষ্ঠা 113114। আইএসবিএন 978-0-7864-9545-0 , Quote: "Nabo Barsho ("New Year"). Hindu New Year festival in West Bengal State, observed on the first day of the month of Vaisakha or Baisakh (corresponds to mid-April). New Year's Day is known as Pahela Baisakh (First of Baisakh)."Karen Pechilis; Selva J. Raj (২০১৩)। South Asian Religions: Tradition and Today। Routledge। পৃষ্ঠা 48–49। আইএসবিএন 978-0-415-44851-2 
  13. Roshen Dalal (২০১০)। Hinduism: An Alphabetical Guide। Penguin Books। পৃষ্ঠা 135–137। আইএসবিএন 978-0-14-341421-6 Constance Brissenden (২০০০)। Vancouver and Victoria: A Colourguide। Lorimer। পৃষ্ঠা 200–। আইএসবিএন 978-0-88780-520-2 
  14. Edain McCoy (২০০২)। Ostara: Customs, Spells & Rituals for the Rites of Spring। Llewellyn। পৃষ্ঠা xiv। আইএসবিএন 978-0-7387-0082-3 
  15. Aruna Thaker; Arlene Barton (২০১২)। Multicultural Handbook of Food, Nutrition and Dietetics। John Wiley & Sons। পৃষ্ঠা 31। আইএসবিএন 978-1-118-35046-1 
  16. Robin Rinehart (২০০৪)। Contemporary Hinduism: Ritual, Culture, and Practice। ABC-CLIO। পৃষ্ঠা 139। আইএসবিএন 978-1-57607-905-8 
  17. Eleanor Nesbitt (২০১৬)। Sikhism: a Very Short Introduction। Oxford University Press। পৃষ্ঠা 122, 142। আইএসবিএন 978-0-19-874557-0 
  18. Morton Klass (১৯৭৮)। From Field to Factory: Community Structure and Industrialization in West Bengal। University Press of America। পৃষ্ঠা 166–167। আইএসবিএন 978-0-7618-0420-8 
  19. Ralph W. Nicholas (২০০৩)। Fruits of Worship: Practical Religion in Bengal। Orient Blackswan। পৃষ্ঠা 13–23। আইএসবিএন 978-81-8028-006-1 
  20. মুহাম্মদ লুৎফুর হক (এপ্রিল ১৪, ২০০৮)। "প্রথম মহাযুদ্ধে বাংলা বর্ষবরণ"। দৈনিক প্রথম আলোঢাকা 
  21. প্রথম আলো। "বাংলা দিনপঞ্জি বদল" 
  22. সাইয়েদা আক্তার। "বাংলা ক্যালেন্ডারের যে পরিবর্তনে খ্রিস্টিয় বর্ষপঞ্জিতে একদিন পিছিয়েছে বসন্ত উৎসব" 
  23. নওয়াজেশ আহমদ। "রমনার বটমূলে জাতীয় উৎসবে"। দৈনিক প্রথম আলোঢাকা 
  24. "ছায়ানটের বর্ষবরণ ছাড়া রমনা পার্কে আর কোনো অনুষ্ঠান নয়, সমকাল, ৩০ জুন ২০১৬"। ১ মার্চ ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০ 
  25. "সোনারগাঁয়ে বটমূলে তেল-পান এবং মাটি দিয়ে শুরু হয়েছে সপ্তাহব্যাপী বউমেলা"eventbd7.comঢাকা। ২০১৬-০৩-১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ এপ্রিল ১৬, ২০১৫ 
  26. ফারজানা তুলি (এপ্রিল ১৪, ২০১২)। "ঘোড়ামেলা বউমেলা"দৈনিক কালের কণ্ঠঢাকা। ৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ এপ্রিল ১৪, ২০১২ 
  27. মোহাম্মদ খালেদ, সম্পাদক (নভেম্বর ১৯৯৫)। "পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপন পরিষদ"। হাজার বছরের চট্টগ্রাম (বাংলা ভাষায়)। চট্টগ্রাম: এম এ মালেক (দৈনিক আজাদী)। পৃষ্ঠা ১৬২। 
  28. "প্রবাসে বৈশাখী উৎসব এবং মিনি বাংলাদেশ"বাংলার বার্তা। ২১ আগস্ট ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ এপ্রিল ২০১৪ 

বহিঃসংযোগ