নবদুর্গা

হিন্দু দেবী দুর্গার নয়টি অভিব্যক্তি

নবদুর্গা (দেবনাগরী: नवदुर्गा) বলতে আভিধানিক ভাবে দেবী পার্বতীর দুর্গার রূপের নয়টি রূপকে বোঝানো হয় ৷ হিন্দু পুরাণ অনুসারে এগুলো দেবী পার্বতীর নয়টি ভিন্ন রূপ ৷ এই নয় রূপ হল যথাক্রমে - শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘণ্টা, কুষ্মাণ্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রি, মহাগৌরী এবং সিদ্ধিদাত্রী ৷ প্রতি শরৎকালে নবরাত্রির নয় দিনে প্রতিদিন দেবী পার্বতীর দুর্গা রূপের এই নবরূপের এক একজনকে পূজা করা হয় ৷আসলে এই নয়টি রূপের সব গুণ বর্তমান দেবী পার্বতীর দুর্গা রূপে, যেই রূপে দেবী পার্বতী বধ করেন হিরণ্যাক্ষাসুরের বংশধর অসুররাজ দুর্গমাসুরকে। দেবী দুর্গার অপর নাম "দুর্গতিনাশিনী"।

নবদুর্গার প্রতিমা

চৈত্র মাসের নবরাত্রির অন্তর্গত অন্তিম দিন শুক্লানবমীর মৃগশিরা নক্ষত্রযুক্ত ব্রহ্মমূহুর্তে সদাশিবপত্নী শিবা, পার্বতীরূপে মেনকার গর্ভে লীলাবশত মনুষ্য চর্ম ধারণ করে জন্ম নেন। তাই এই পবিত্র তিথির উক্ত দিনটিকে সনাতন ধর্মের “বিশ্ব মাতৃ দিবস” হিসেবে পালন করা হয়। আবার এটি ‘দেবী জয়ন্তী’ নামেও বিখ্যাত। এই দিনেই ভগবান রামচন্দ্রের জন্ম হয় , যা ‘রামনবমী’ নামে পরিচিত।

ভগবতীর বিভিন্ন রূপ

সম্পাদনা

দেবী দুর্গা আর নবদুর্গা (পার্বতী) আদ্যাশক্তিরই অন্যরূপ। দেবী দুর্গা ত্রিশূল দিয়ে মহিষাসুরকে বধ করে বলে "মহিষমর্দিনী" নামে অভিহিত করা হয়। মাতা পার্বতীও আদ্যাশক্তি। আদ্যাশক্তি ঈশ্বরের মাতৃরূপের প্রকাশ। ভগবতীর আর অনেক রূপ রয়েছে, সেগুলো হলো: মহাকালী, মঙ্গলচন্ডী, বামনী, ব্যাসাণী, গঙ্গা, কামাখ্যা, বগলামুখী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, কাশীপুরাধিশ্বরিণী অন্নপূর্ণা, জয়ন্তী, মঙ্গলা, ভদ্রকালী, অজিতা, বিজয়া, জয়া, কন্যাকুমারী, কাপালিনী, ক্ষমা, ধাত্রী, স্বাহা, স্বধা, বসন্তেশ্বরী বাসন্তী, মীনাক্ষী, কামেশ্বরী, সম্পাটকারী, মাতঙ্গী, বনচন্ডী বা বনবিবি, ধূমাবতী, ছিন্নমস্তা, ললিতাম্বা ত্রিপুরাসুন্দরী, বারুণী, অগ্নিধাত্রী, কূর্মাণী, মৎস্যাণী, সত্যভামা (নরকাসুর মর্দিনী), জগদম্বা, সীতা, রাধা, বসুমতী, ষোড়শী, মহাত্রিপুরাগৌরী, সংকটনাশিনী, বিপত্তারিণী, ত্বরিতা, বাগ্বাদিণী, নীলা, বালা, ধূমাবতী, ভ্রামোরী, রণচণ্ডী, অন্নপূর্ণা, নন্দা, রক্তদণ্ডিকা, আতুম, বাক, নকুলা, তুলসী, ব্রক্ষ্ণাণী, মুর্গাভাণা, বিনায়িকা, গন্ধেশ্বরী, উমা, বঙ্গেশ্বরী, হুদুর দুর্গা, শচী, কার্তিকী, বরাহী, নৃসিংহী, শুভ্রলা, রুদ্রাণী, কৌমারী, কুমারী, সন্ধি, অপরাজিতা, ঐন্দ্রী, মাহেশ্বরী, সদাগৌরী, বিশ্বকর্মা, অদিতি, ষষ্ঠী, যোগমায়া, অম্বিকা, শৈবী, বৈষ্ণবী, নাগশোভিতা (নাগচণ্ডী), নারায়ণী, যোগুলাম্বা, শূলধারিণী, শৃঙ্গলাদেবী, বিমলা, মণিকাম্বা, হর্সিদ্ধি, সুগন্ধা, ফুল্লরা, মহাশিরা, হিংলাজ, ইন্দ্রাক্ষিণী, বেহুলা, মহামায়া, কমলেকামিণী, শাকম্ভরী, হৈমবতী, শীতলা, চামুণ্ডেশ্বরী, কৌষিকী, দক্ষনন্দিনী, একজটা, উগ্ৰতারা, প্রত্যাঙ্গীরা, বাশুলী, বিশালাক্ষী, ভীমা, বিষকন্ঠা, নটরানী, মহাদেবী, নার্দিনী, মনসা, ডাম্রী, শোকরহিতা, শতাক্ষী, ভাদু, ভদ্রকালী, গুহ্যকালী, শ্মশানকালী, ছিন্নমস্তা, ভৈরবী, দক্ষিণা কালী, ভবতারিণী, নলাটেশ্বরী, ধূমাবতী, কমলা, পার্বতী ইত্যাদি। এসব রূপ মাতা পার্বতীর আদ্যাশক্তির অন্তর্গত।

১.শৈলপুত্রী: নবদুর্গার প্রথম রূপ দেবী শৈলপুত্রী। দেবীর দক্ষিণ হস্তে ত্রিশূল আর বাম হস্তে পদ্ম আছে তাই দেবীর অপর নাম শুলধারিণী। দেবীর আরেক নাম বৃষরুদ্ধা কারণ তিনি বৃষের উপর চড়েছিলেন। দেবীর মস্তকে শোভা পেয়েছে অর্ধচন্দ্র। দক্ষকন্যা সতী দেহত্যাগের পরে পরজন্মে গিরিরাজ হিমালয় ও মেনকার ঘরে দেবী পার্বতী রূপে জন্মগ্রহণ করেন মহামায়া। শৈলরাজের কন্যারূপে দেবী পার্বতী হলেন শৈলপুত্রী।

দেবী শৈলপুত্রীর মন্ত্র-

ওম দেবী শৈলপুত্রায় নমঃ ॥

বন্দে বঞ্চিতালভয় চন্দ্রার্ধকৃতশেখরম্।

বৃষরুধাম শূলধারম শৈলপুত্রিম যশস্বিনিম ॥

ইয়া দেবী সর্বভূতেষু মা শৈলপুত্রী রূপেনা সংস্থিতা।

নমস্তস্যায় নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥

২. ব্রহ্মচারিণী বা তপস্যারিণী: মা পার্বতীর নবশক্তির দ্বিতীয় রূপ ব্রহ্মচারিণী। এখানে ‘ব্রহ্ম’ শব্দের অর্থ হল তপস্যা। ব্রহ্মচারিণী অর্থাৎ তপস্যারিণী--- তপাচরণিকা। কথিত আছে যে---‘বেদস্তত্ত্বং তপো ব্রহ্ম’---বেদ, তত্ত্ব এবং তপ হল ‘ব্রহ্ম’ শব্দের অর্থ। দেবী ব্রহ্মচারিণীর রূপ- জ্যোতিতে পূ র্ণ, অতি মহিমামণ্ডিত। তিনি ডান হাতে জপের মালা এবং বাঁ হাতে কমণ্ডলু ধারণ করে আছেন।পূর্বজন্মের সতী যখন হিমালয়ের কন্যারূপে মহামায়া আদি শক্তি পার্বতী রূপে জন্মেছিলেন তখন তিনি নারদের পরামর্শে ভগবান শঙ্করকে পতিরূপে লাভ করার জন্য কঠিন তপস্যা করেন। সেই কঠিন তপস্যার জন্য তাকে তপস্যারিণী বা ব্রহ্মচারিণী বলা হয়। তিনি সহস্র বর্ষ ধরে মাত্র ফল-মূলের আহার করে জীবন ধারণ করেছিলেন। শতবর্ষ তিনি শাক আহার করে জীবন নির্বাহ করেছিলেন তাই তার নাম হয় পটলবতী বা শাকাহারিণী। কিছুকাল কঠিন উপবাসে থেকে খোলা আকাশের নিচে বর্ষা ও গ্রীষ্মের দাবদাহে কাটিয়েছেন। এই কঠোর তপশ্চর্যার পরে তিন সহস্র বছর শুধুমাত্র গাছ থেকে মাটিতে ঝরে পড়া বেলপাতা আহার করে অহর্নিশ ভগবান শঙ্করের আরাধনা করেছেন। তারপর তিনি সেই শুষ্ক বেলপাতা আহার করাও পরিত্যাগ করেন। অতঃপর কয়েক সহস্র বছর নির্জলা, নিরাহারে থেকে তপস্যা করতে লাগলেন। পাতা (পর্ণ) খাওয়া পর্যন্ত পরিত্যাগ করায় তার অন্য একটি নাম হয় ‘অপর্ণা’।কয়েক সহস্র বছর এই তপস্যা করায় ব্রহ্মচারিণী দেবীর শরীর কৃশ-একদম ক্ষীণ হয়ে গেল। তিনি অতি কৃশকায় হয়ে গিয়েছিলেন। তার এই দশা দেখে মা মেন্কা অত্যন্ত দুঃখিত হলেন। তিনি তাকে এই কঠিন তপস্যা থেকে বিরত করার জন্য বললেন, ‘উ মা, না ওরে আর না!’ তখন থেকে দেবী মহামায়ার আর এক নাম হয় ‘উমা’।তার তপস্যার কঠোরতায় ত্রিলোকে হাহাকার পড়ে গেল দেবতা, ঋষি, সিদ্ধগণ, মুণি সকলেই ব্রহ্মচারিণী দেবীর এই তপস্যাকে অভূতপূর্ব পুণ্যকাজ বলে তাকে প্রশংসা করতে লাগলেন। অবশেষে পিতামহ ব্রহ্মা তাকে সম্বোধন করে প্রসন্ন হয়ে আকাশবাণীর মাধ্যমে বললেন, হে দেবী! আজ পর্যন্ত কেউ এরূপ কঠোর তপস্যা করে নি। তোমার দ্বারাই এরূপ তপস্যা সম্ভব। তোমার এই অলৌকিক কাজে চতুর্দিকে ধন্য ধন্য রব উঠেছে। তোমার মনোষ্কামনা সর্বতোভাবে পূর্ণ হবে। ভগবান চন্দ্রমৌলি শিবকে তুমি পতিরূপে পাবে। এবার তুমি তপস্যায় বিরত হয়ে গৃহে ফিরে যাও। তোমার পিতা শীঘ্রই তোমাকে নিতে আসবেন।’মা পার্বতীর এই দ্বিতীয় রূপ ভক্ত এবং সিদ্ধদের অনন্ত ফল প্রদান করে। তাঁর উপাসনা দ্বারা মানুষের স্বভাবে তপ, ত্যাগ, বৈরাগ্য, সদাচার, সংযম বৃদ্ধি পায়। জীবনের কঠিন সংঘর্ষেও তাঁর মন কর্তব্যে বিচলিত হয় না। মা ব্রহ্মচারিণী দেবীর কৃপায় তাঁর সর্বদা সিদ্ধি ও বিজয় প্রাপ্তি হয়। দুর্গাপূজার দ্বিতীয় দিনে এঁর স্বরূপেরই আরাধনা করা হয়। এই দিন সাধকের মন ‘স্বাধিষ্ঠান চক্রে’ স্থিত হয়। এই চক্রে চিত্ত-প্রতিষ্ঠ যোগী তার কৃপা ও ভক্তি লাভ করে।

৩. চন্দ্রঘণ্টা: দেবী চন্দ্রঘন্টা স্বরূপ পরম কল্যাণিকা ও সুমঙ্গলা। এঁনার মস্তকে অর্ধচন্দ্র থাকে , তাই দেবীকে চন্দ্রঘণ্টা নামে ডাকা হয়। এঁনার শরীরের রং স্বর্ণের মতো উজ্জ্বল। এই দেবী দশভুজা। এঁনার হাতে কমণ্ডলু , তরোয়াল , গদা , ত্রিশূল , ধনুর্বাণ , রক্তপদ্ম , জপমালা,ডমরু,শঙ্খ, থাকে। এঁনার বাহন সিংহ। দেবী তার ঘণ্টার ন্যায় প্রচন্ড চন্ড ধবনিতে দুরাচারী রাক্ষস , দানব , দৈত্য দের প্রকম্পিত করেন। শিব পার্বতীর বিবাহের সময় হঠাৎ অসূররাজ তারোকাসুর প্রেত পিশাচ দৈত দানব সহ আক্রমণ করে তখন দেবী পার্বতী এক দশ ভুজ রুপী মঙ্গলময় দেবী রূপে চন্দ্র সম বিশাল শুভ ঘণ্টা বাজিয়ে সকল অশুভ শক্তি কে নিরস্ত্র করেন দেবী উগ্র রূপ ধারণ করেন নি কারণ জন্মের পর দেবী পার্বতী নিজের দশ মহাবিদ্যা ও বিশ্ব রূপ হিমবান ও মহারানী মেন্কা কে দর্শন করালে মা মেনকা দেবী পার্বতী কে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ করেন যে তাদের কাছে থাকা অবস্থায় পার্বতী নিজের কোনো উগ্র রূপ প্রকাশ করবেনা ও তৃতীয় নয়ণ কে লুকিয়ে রাখবেন।

৪. কুষ্মাণ্ডা: দেবী পার্বতী তার চতুর্থ স্বরূপে "কুষ্মাণ্ডা" নামে পরিচিতা। নবরাত্রের চতুর্থদিনে, অর্থাৎ চতুর্থী তিথিতে মাতৃপ্রাণ ভক্তগণ এই কুষ্মাণ্ডারূপেই আদ্যাশক্তিকে আহ্বান করে থাকেন।

কারুণ্যে ভরপুর মায়ের সৌম্যপ্রতিমা। দেবী সিংহবাহিণী, ত্রিনয়ণী ও অষ্টভুজা। আটটি হাতে সুদর্শনচক্র, ধনুর্বাণ, রক্তপদ্ম, কমণ্ডলু, ইত্যাদি দৃষ্টিগোচর হয়। মায়ের বামহস্তে একটি অমৃতপূর্ণ কলসও রয়েছে। এখানে অমৃত ব্রহ্মের রূপক, দেবী ভগবতী পার্বতী অমৃতপূর্ণ কলস অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞানের আধার হাতে নিয়ে বসে রয়েছেন। যোগ্য সাধক আপন তপোবল ও কৃচ্ছ্রতা দ্বারা মহামায়াকে প্রসন্ন করতে পারলে তবেই মা সেই অমৃতভাণ্ডের অমৃতধারায় সাধককে স্নান করিয়ে তৃপ্ত করবেন, ব্রহ্মজ্ঞান প্রদানে কৃতার্থ করবেন।

মায়ের হাতে আরও একটি বস্তু রয়েছে, সেটি হল জপমালা। সেই জপমালা সিদ্ধমন্ত্রে মন্ত্রিত, তাহা অষ্টসিদ্ধি ও নবনিধি দান করতে সমর্থ। এবার যে ভক্ত রুচি অনুযায়ী যা চাইবে, কল্পতরু মা সেই অনুসারেই বাঞ্ছা পূর্ণ করবেন। যে সিদ্ধি ও সিদ্ধাই চাইবে, মা তাকে তাই দিয়ে ভোলাবে। আর যে পার্থিব সম্পদে অনীহা প্রকাশ করে ওই অমৃতপূর্ণ কলস, অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞান চাইবে, মা তাকেও তাই দিয়েই সন্তুষ্ট করবেন।

এবার আসি মায়ের নাম বিশ্লেষণে। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, বলিদানের মধ্যে কুমড়ো বলি মায়ের অধিক প্রিয়। কুমড়োকে সংস্কৃতে "কুষ্মাণ্ড" বলে, কুষ্মাণ্ডপ্রিয় দেবী তাই কুষ্মাণ্ডা নামে স্তুতা। এ তো গেল সহজ একটি ব্যাখ্যা, কিন্তু এর সুগভীর অর্থও রয়েছে। যেমন-

"কুৎসিত উষ্মা সন্তাপস্তাপত্রয়রূপো যস্মিন সংসারে। স সংসারে অণ্ডে উদর রূপায়াং যস্যাঃ।"

সংসার তাপযুক্ত, ত্রিবিধ তাপে জরজর। সেই সংসারকে যিনি ভক্ষণ করেন, তিনিই কুষ্মাণ্ডা। কু- কুৎসিত, উষ্মা সন্তাপত্রয়ে পূর্ণ জগৎ যাঁর অণ্ডে (উদরে) বিদ্যমান, তিনিই কুষ্মাণ্ডা।

দেবী কুষ্মাণ্ডার যেহেতু আটটি হাত, তাই তিনি "অষ্টভুজা" নামেও পরিচিতা। এনাকে "কৃষ্ণমাণ্ড" নামেও ডাকা হয়। মহাপ্রলয়ের পরে যখন সর্বত্র শুধু নিশ্ছিদ্র অন্ধকার ছেয়ে রয়েছে, তখন এই ভগবতী কুষ্মাণ্ডা "ঈষৎ হাস্য" করে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছিলেন। তাই আদ্যাশক্তি বলতে আমরা যাঁকে বুঝি, তিনিই ইনি। দেবীর বাসস্থান সৌরমণ্ডলে। ভীমাপর্বতেও দেবী নিবাস করেন বলে উল্লেখ আছে।দেবী পার্বতী সৃষ্টির রচয়িতা ব্রহ্মা ও তার স্ত্রী সরস্বতীকে চিন্তিত দেখে জিজ্ঞাসা করেন তাদের চিন্তার কারণ তখন তারা বলেন তারা বুঝতে পারছেনা সঠিক কি ভাবে সৃষ্টি কে সম্পূর্ণ রচনা করবেন দেবী তাদের চিন্তার তাপ হরণ করেন তাদের আশ্বাস দেন একদিন মহা শূন্যে উপবিত দেবী পার্বতী একাকী বসে আছেন হঠাৎ সেখানে শিবের আগমন ঘটে স্বামী কে পেয়ে দেবী মহামায়া আনন্দে হেসে ফেলেন ও সেই হাস্য তাপে সৃষ্টি হয় সূর্যাদি সৃষ্টির।

৫. স্কন্দমাতা: আমরা যেমন দেবীকে গণেশজননী হিসেবে বেশি পুজো করি, পশ্চিম ভারতে আবার দেবী মান্যতা পান কার্তিকেয়র মাতা হিসেবে। কার্তিকের অরা এক নাম স্কন্দ। নবরাত্রির পঞ্চম রাতে দেবী পার্বতী পূজিত হন স্কন্দমাতা রূপে। ত্রিনয়ণী দেবী চার হাতবিশিষ্টা। ডানদিকের উপরের হাতে ধরে আছেন শিশু কার্তিককে। প্রস্ফুটিত পদ্ম থাকে আর এক দক্ষিণ হস্তে। বাঁ দিকের একটি হাত বরাভয় দিচ্ছে। আর এক হাতে ধরে আছেন পদ্ম। এই রূপে দেবী দুর্গা সিংহ বাহনে উপবিষ্ট হন। তিনি বসে থাকেন ফুটে থাকা কমলে। পূজিত হন নবরাত্রির পঞ্চমদিনে |শিবের তেজ যখন পার্বতীর গর্ভে ধারণ করতে যাবেন সেই সময় রতির অভিশাপের প্রভাবে সেখানে অগ্নি দেব চলে আসেন শিব তেজ দেবী পার্বতী ধান করতে পারেন না ও ক্রুদ্ধ হন তারপর অগ্নি শিবের তেজ বহন করে নিয়ে গেলে দেবগণ অনুরোধে পার্বতিও গর্ভের তেজ প্রদান করেন কারণ একা পুরুষের তেজে সন্তান জন্ম হয়না পরে উভই তেজ গঙ্গা ধারণ করতে চাইলে সেও অক্ষম হয়ে সেটি পার্শ্ববর্তী সর বনে নিক্ষেপ করে ও এক পুত্রের জন্ম হয় খুদার্ত সেই শিশুকে কৃতিকা রা স্তন্য পান করালে সে কার্তিক নামে অভিহিত হয় পরে সেই শিশু কে পার্বতী নিতে চাইলে কৃতীকা গণ অস্বীকার করে দেবী রাগে বগলামূখী রূপ ধারণ করে কারণ তার তেজে সন্তান জন্ম হোয়েছে তিনি কোনো তাকে ছাড়বেন দেবী শিশু স্কন্দ কে কৈলাসে নিয়ে আসেন তার ৬ বছর বয়সী তারোকাসূরমর্দী কার্তিক মায়ের কাছে অস্ত্র শিক্ষা নিয়ে অসূররাজ তারোকাসূরবধ করে পুত্রকে অসুরের হাত থেকে সুরক্ষা করতে দেবী ভীষণ রূপ ধারণ করে। অসুররাজবধে মা ও ছেলে তারোকাসূরনাশিণী এবং তারোকাসূরমর্দীরূপে তাই একত্রে পূজিত।

৬. কাত্যায়নী: এই নাম এবং রূপের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক পৌরাণিক কাহিনি। বৈদিক যুগে কাত্যায়ন নামে এক মহাঋষি ছিলেন। এক পুত্রের পিতা কাত্যায়নের ইচ্ছে হয় একটি কন্যাসন্তান লাভ করেন। দেবী পার্বতী র তপস্যা করে তিনি অভীষ্ট পূর্ণ করেন। তার স্তবে তুষ্ট হয়ে স্বয়ং দেবী পার্বতী জন্ম নেন মহাঋষি কাত্যায়নের কন্যা সন্তানরূপে। তখন তার নাম হয় কাত্যায়নী। নবরাত্রির ষষ্ঠ দিনে আরাধিতা হন ভক্তদের কাছে।দেবী পার্বতী এই রূপ নিয়ে মহিষাসুর কে বধ করেন

৭. কালরাত্রি: এখানে দেবী কৃষ্ণবর্ণা। আলুলায়িত কেশে তিনি ধাবিত শত্রুর দিকে। তার কণ্ঠে বিদ্যুতের মালিকা। ত্রিনয়নী দেবীর শ্বাস প্রশ্বাসে বেরিয়ে আসে আগুনের হলকা। ভীষণদর্শনা দেবীর তিন হাতে অস্ত্র। এক হাতে ভক্তদের প্রতি বরাভয়। এই রূপই উপাসিত হয় কালিকা রূপে। তবে এই রূপেও দেবী ভক্তের শুভ করেন। তাই অন্যদিকে তিনি শুভঙ্করিণী। দেবীর বাহন গর্দভ। ভক্তরা তার পুজো করেন নবরাত্রির সপ্তম রাতে |

৮. মহাগৌরী: হিমায়লকন্যা ছিলেন গৌরবর্ণা। শিবের তপস্যা করে রৌদ্রে তিনি কৃষ্ণা হন। মহাদেব যখন গঙ্গাজল দিয়ে তাকে স্নান করান, তখন তিনি হয়ে ওঠেন ফর্সা। তার এই রূপের নাম হয় মহাগৌরী। প্রচলিত বিশ্বাস, নবরাত্রির অষ্টম রাতে তার পুজো করলে সব পাপ ধুয়ে যায়। সাদা পোশাক পরিহিতা, চার হাত বিশিষ্টা দেবীর বাহন ষাঁড়। দেবীর এক হাত শোভিত বরাভয় মুদ্রায়। বাকি তিন হাতে থাকে পদ্ম, ত্রিশূল এবং ডমরু|দেবী এই গৌরী রূপে অষ্ট বর্ষি বালিকা রূপে শিব কে নৃত্য করে প্রমোদ দেন পরে শিব তার পরিচয় জানতে চাইলে দেবী পার্বতী নিজের রূপ প্রকাশ করেন।

৯. সিদ্ধিদাত্রী: নবদুর্গার নবম তথা শেষ রূপ হল সিদ্ধিদাত্রী। সিংহবাহিনী দেবীর চার হাতে আশীর্বাদী মুদ্রা। তিনি সিদ্ধি দান করেন। অর্থাৎ‍ তার উপাসনায় সংসারে আসে সুখ এবং সমৃদ্ধি। সবাইকে বরাভয় দেন এই মাতৃকামূর্তি। দেবী ভগবত্‍ পুরাণে আছে, স্বয়ং মহাদেব দেবী পার্বতী কে সিদ্ধিদাত্রী রূপে পুজো করেছিলেন। এবং তার ফলে মহাদেব সকল সিদ্ধি লাভ করেন। সিদ্ধিদাত্রীর আশীর্বাদেই সর্ব সিদ্ধি লাভ করেন মহাদেব|

নবরাত্রিতে দেবী পার্বতীর দুর্গাপুজোয় যোগসাধনার যোগপদ্ধতি অত্যন্ত উচ্চ মার্গের সাধনক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত। যথা এই নবরাত্রির প্রথম দিনের পুজোয় যোগীগণ তাদের মনকে ‘মূলাধার’ চক্রে স্থিত করেন। যা মানুষের শরীরের অভ্যন্তরেই প্রতিষ্ঠিত ‘কুল্কুণ্ডলিনী’ রূপে – যিনি স্বয়ং মহাশক্তি, দৈবী ও ঐশী শক্তি, মহামায়া, মহাদুর্গা। নবদুর্গা রূপের প্রথম দিনের রূপটি হল ‘ ‘শৈলকন্যা', দ্বিতীয়ায় দ্বিতীয় রূপটি হল ‘ব্রহ্মচারিণী’। বেদ-এ এর উল্লেখ আছে। এদিন যোগী সাধক তার মনকে ‘স্বাধিষ্ঠান’ চক্রে স্থিত করেন যোগসাধনার মাধ্যমে। নবরাত্রি আরাধনার তৃতীয় দিনে মা দুর্গার তৃতীয় শক্তির নাম ‘চন্দ্রঘণ্টা’, উপাসনায় যোগী তার মনকে ‘মণিপুর’ চক্রে প্রবিষ্ট করান। মা দুর্গার চতুর্থ রূপের নাম হল ‘কুষ্মাণ্ডা’, এই চতুর্থী তিথিতে সাধকের মন ‘অনাহত’ চক্রে অবস্থান করে। মহাপঞ্চমীতে দেবী দুর্গা ‘স্কন্দমাতা’ রূপে পূজিতা হন। এই দিনে সাধক তার মনকে ‘বিশুদ্ধ’ চক্রে স্থাপন করেন। দেবী দুর্গাকে প্রথম আরাধনা করেন মহর্ষি কাত্যায়ন – কন্যারূপে। তাই দেবী দুর্গা মহাষষ্ঠীতে ‘কাত্যায়নী’ রূপে পূজিতা হন। শ্রীকৃষ্ণ-সহ সমস্ত গোপ ও গোপী দেবী কাত্যায়নীর পূজা করেন, এর উল্লেখ মহাভারতে পাওয়া যায়। দেবী কাত্যায়নীর আরাধনায় সাধক ‘আজ্ঞা’ চক্রে তার মনের উত্তরণ ঘটান। দুর্গাপূজার সপ্তম দিনে মহাসপ্তমীতে দেবী দুর্গাকে ‘কালরাত্রি’ রূপে পূজা করার বিধান। সে দিন সাধকের মন ‘সহস্রার’ চক্রে অবস্থান করে। মহাষ্টমীতে দেবী দুর্গার রূপ হয় ‘মহাগৌরী’ – সন্ত তুলসীদাস এই দেবীর উপাসনা করতেন। এই দিন সাধকের সাধনা ‘সন্ধিচক্র’-এ অধিষ্ঠিত হয়। নবদুর্গার শেষ রূপটি হল ‘সিদ্ধিদাত্রী’। ‘মার্কণ্ডেয় পুরাণে’-এ ‘সিদ্ধিদাত্রী’ অষ্টভুজা, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের শ্রীকৃষ্ণজন্ম খণ্ডে ‘সিদ্ধিদাত্রী’ অষ্টাদশভুজা। ‘সিদ্ধিদাত্রী’ চতুর্ভুজা রূপেও দেখা যায়। সেখানে তিনি শিবের আরাধ্য। এই হল নবদুর্গার চর্চিত কাহিনি।