বিপত্তারিণী
বিপত্তারিণী হলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশা রাজ্য এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে পূজিতা এক হিন্দু দেবী। তিনি দেবী সঙ্কটনাশিনী এবং দেবী দুর্গা(পার্বতী)-এর ১০৮ অবতারের অন্যতম। হিন্দুরা মূলত বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য এই দেবীর পূজা করেন।[১] আষাঢ় মাসের রথ থেকে উল্টোরথের মধ্যে মঙ্গলবার ও শনিবার-এ হিন্দু মহিলারা বিপত্তারিণী ব্রত পালন করেন।[২][৩]
কিংবদন্তি
সম্পাদনাযিনি সমগ্র বিপদ থেকে রক্ষা করেন বা যিনি বিপদসমূহ নাশ করেন তিনিই বিপদতারিনী। যিনি দুর্গা তিনিই বিপদতারিনী। তিনি পুরাণে কৌশিকীদেবী নামে খ্যাতা। আবার তিনিই জয়দুর্গা। দেবীর উৎপত্তি হয়েছিলো পরমেশ্বর ভগবান শিবের অর্ধাঙ্গিনী দেবী পার্বতীর কৃষ্ণ কোষ থেকে- তাই তিনি কৌশিকী। পুরাণ মতে শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামক দুই অসুরের হাতে দেবতারা পরাজিত হয়ে হিমালয়ে গিয়ে মহামায়ার স্তব করতে লাগলেন। সেই সময় পরমেশ্বরী ভগবতী পার্বতী সেই স্থান দিয়ে যাচ্ছিলেন। দেবী তাদের স্তব শুনে বললেন –"আপনারা এখানে কার স্তব করিতেছেন?”
সেই সময় ভগবতী পার্বতীর শরীর থেকে তার মতন দেখতে আর এক জন দেবী বের হয়ে আসলেন। সেই নব আবির্ভূতা দেবী জানালেন – “ইহারা আমারই স্তব করিতেছেন।” এই দেবী যুদ্ধে শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামক অসুরের বধ করেছিলেন। এই দেবী মোহাচ্ছন্ন শুম্ভাসুরকে অদ্বৈত জ্ঞান দান করে বলেছিলেন-
“ঐকেবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা।
পশ্যৈতাং দুষ্ট ময্যেব বিশন্তো মদবিভূতয়ঃ।।"
("এই জগতে এক আমিই আছি। আমি ছাড়া আমার সাহায্যকারিনী আর কে আছে? ওরে দুষ্ট ভালো করে দেখ, ব্রহ্মাণী প্রভৃতি শক্তি আমারই অভিন্না বিভূতি বা শক্তি। এই দেখ তারা আমার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।”)
আর একটি পৌরাণিক গাথানুসারে একদা ভগবান মহাদেব রহস্যচ্ছলে দেবী পার্বতীকে ‘কালী’ বলে উপহাস করেন। এতে দেবী ক্রুদ্ধ হয়ে তপস্যার মাধ্যমে নিজের “কৃষ্ণবর্ণা” রূপ পরিত্যাগ করলেন। সেই কৃষ্ণবর্ণা স্বরূপ দেবীই হলেন, দেবীর পার্বতীর অঙ্গ থেকে সৃষ্টা জয়দুর্গা, কৌশিকীদেবী ও বিপদতারিনীদুর্গা।
ধ্যান ও প্রণামমন্ত্র
সম্পাদনাওঁ কালাভ্রাভাং কটাক্ষৈররিকুলভয়দাং মৌলীবন্ধেন্দুরেখাম্। শঙ্খং চক্রং কৃপাণং ত্রিশিখমপি করৈরুদ্বহন্তীং ত্রিনেত্রাম্। সিংহাস্কন্ধাধিরুঢ়াং ত্রিভুবনমখিলং তেজসা পুরয়ন্তীম্। ধ্যায়েদ্দুর্গাং জয়াখ্যাং ত্রিদশপরিবৃতাং সেবিতাং সিদ্ধিকামৈঃ॥ অর্থ- কালাভ্র আভা (এর দুই প্রকার অর্থ হয়- একটি হলো স্বর্ণবর্ণা অপরটি কালো মেঘের ন্যায় বর্ণা), কটাক্ষ নিপাতে শত্রুকূলত্রাসিনী, কপালে চন্দ্রকলা শোভিতা, চার হস্তে শঙ্খ, চক্র, খড়্গ ও ত্রিশূলধারিণী, ত্রিনয়না, সিংহোপরি সংস্থিতা, সমগ্র ত্রিভুবন স্বীয় তেজে পূর্ণকারিণী, দেবগণ-পরিবৃতা। সিদ্ধসঙ্ঘসেবিতা জয় দুর্গার ধ্যান করি।
এই জয়দুর্গা বা কৌশিকীদেবী, বিপদতারিনীদুর্গা। পঞ্চদেবতার একজন। দেবীর অনেক রূপ দেখা যায়। উত্তর ভারতে অষ্টাদশ রূপের ধ্যান ও পূজা হয়, কোথাও দশভুজা রূপে পূজা হয়, কোথাও আবার চতুর্ভুজা স্বর্ণ বর্ণা আবার কোথাও কৃষ্ণ বর্ণা রূপে পূজিতা হয়। জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে মঙ্গল ও শনিবারে মায়ের পূজা হয়। যেখানে ১৩ প্রকার ফল, পুষ্প, মিষ্টি, পান, সুপারী, লবঙ্গ, এলাচ প্রভৃতি অর্পণ করা হয়। তবে, বাংলাদেশে দেবীর পূজার নিয়ম বিধি সম্পূর্ণভাবে পালন করা হয় না।
পূজা
সম্পাদনাগ্রামাঞ্চলে বিপত্তারিণী পূজা চারদিন ধরে চলে। প্রথম দিনে দেবীর “আরাধনা” (পূজা) করা হয়। মেয়েরা দণ্ডী কাটে। তারপর দুই রাত্রি ধরে রাতে বাংলা লোকগান, ভজন ও কীর্তন চলে। চতুর্থ দিনে বিসর্জন হয়।
বিপত্তারিণী পূজা উপলক্ষে মেয়েরা উপবাস করে। প্রথা অনুসারে হাতে “তাগা” (এক গুচ্ছ পবিত্র লাল সুতো ও দুর্বাঘাস) বাঁধে।[৪]
গুরুত্বপূর্ণ মন্দির
সম্পাদনা- বিপত্তারিণী মন্দির, গড়িয়া, কলকাতা
- বিপত্তারিণী মন্দির, রাজপুর, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা, পশ্চিমবঙ্গ
পাদটীকা
সম্পাদনা- ↑ "See Durga's 51 avatars under a single roof"। Indian Express। অক্টো ৪, ২০০৮।
- ↑ A town in the rural milieu Baruipur, West Bengal। Anthropological Survey of India, Ministry of Tourism and Culture, Dept. of Culture। ২০০২। পৃষ্ঠা 16। আইএসবিএন 81-85579-73-3।
- ↑ Östör, Ákos (24)। Play Of The Gods: Locality, Ideology, Structure, And Time In The Festivals Of A Bengali Town। Orient Blackswan। পৃষ্ঠা 43। আইএসবিএন 81-8028-013-6। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|তারিখ=
(সাহায্য) - ↑ Talukdar, Jaita (২০০৮)। A Sociological Study of the Culture of Fasting and Dieting of Women in Urban India। A project submitted in University of Cincinnati - Division of Research and advanced studies by Jayeeta Talukdar,। পৃষ্ঠা 90।