চেদি রাজ্য
চেদি রাজ্য (সংস্কৃত: चेदी) হলো প্রাচীন ভারতীয় সমৃদ্ধ জনপদ; আধুনিক ভারতের মধ্যপ্রদেশ রাজ্যে যমুনা নদীর দক্ষিণে বুন্দেলখণ্ড বিভাগে কেন নদীর তীরবর্তী অংশে এই রাজ্যের অবস্থান ছিল। চেদি রাজ্যের রাজধানীকে সংস্কৃত ভাষায় সুকতিমতি এবং পালি ভাষাতে সোথিবতী-নগর বলা হত। পালি ভাষায় বিরচিত বৌদ্ধ গ্রন্থগুলিতে, এটিকে ষোড়শ মহাজনপদের (উত্তর ও মধ্য ভারতের "মহান রাজ্য") অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। [১]
চেদি রাজ্য | |
---|---|
৬০০ খ্রিস্টপূর্ব–৩০০ খ্রিস্টপূর্ব | |
প্রাক-বৈদিক যুগে চেদি এবং অন্যান্য মহাজনপদ। | |
রাজধানী | শুক্তিমতি বা ষষ্ঠীবতী |
প্রচলিত ভাষা | প্রাকৃত |
সরকার | রাজতন্ত্র |
ঐতিহাসিক যুগ | প্রাচীন ভারত |
• প্রতিষ্ঠা | ৬০০ খ্রিস্টপূর্ব |
• বিলুপ্ত | ৩০০ খ্রিস্টপূর্ব |
বর্তমানে যার অংশ | ভারত |
মহাভারত অনুযায়ী চেদি রাজ্যের অন্যতম শাসক ছিলেন শিশুপাল, যিনি মগধের রাজা জরাসন্ধ এবং কুরু রাজ্যের দুর্যোধনের মিত্র ছিলেন। একদিকে শিশুপাল ছিলেন একজন অত্যাচারী শাসক ও বাসুদেব কৃষ্ণের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং অন্যদিকে তিনি ছিলেন ভগবান কৃষ্ণের পিসতুতো ভাই। পাণ্ডবরাজ যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের সময় কৃষ্ণ শিশুপালকে হত্যা করেন। ভীমের স্ত্রী ছিলেন চেদি রাজ্যের রাজকন্যা। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় বিশিষ্ট চেদি বংশীয় মানুষজনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন দমঘোষ, শিশুপাল, ধৃষ্টকেতু, সুকেতু, ভীমের স্ত্রী, নকুলের স্ত্রী করেনুমতি প্রমুখ। চেদি রাজ্য প্রথমদিকে কৌরব বংশীয় রাজাদের দ্বারা এবং পরবর্তীকালে যাদব বংশীয় রাজাদের দ্বারা শাসিত হয়েছিল।
ভূগোল
সম্পাদনাঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্বিক প্রমাণ দ্বারা রাজধানী সুকতিমতির অবস্থান নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ইতিহাসবিদ হেম চন্দ্র রায়চৌধুরী এবং এফ ই পারগিটার বিশ্বাস করেন যে এটি উত্তরপ্রদেশের বান্দার আশেপাশে ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক দিলীপ কুমার চক্রবর্তী প্রস্তাব করেছেন যে মধ্যপ্রদেশের রেওয়ার উপকণ্ঠে আধুনিক সময়ের ইটাহা নামক একটি জায়গায় সুকতিমতিকে একটি বৃহত্তর ঐতিহাসিক নগরের ধ্বংসাবশেষ হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। [১]
পৌরাণিক ইতিহাস
সম্পাদনাচেদি বংশ ও রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যাদব বংশের অন্তর্ভুক্ত বিদর্ভের পুত্র চেদি। পরে ইন্দ্রের আদেশে পৌরব রাজা ভাসু উপারিচার চেদি জয় করেন এবং শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। উপরিচারের বংশধর হলেন শিশুপাল।
বৈদিক সাহিত্যে চেদি রাজ্যের উল্লেখ
সম্পাদনামহাভারতে উল্লিখিত আছে যে পাণ্ডবদের ১৩ বছরের নির্বাসনের সময় তারা চেদি রাজ্যে অবস্থান করেছিলেন।
চতুর্থ পর্বের প্রথম অধ্যায়ে উল্লেখ পাওয়া যায় "কুরুদের রাজত্বকে ঘিরে, অনেকগুলি দেশই সুন্দর এবং প্রচুর পরিমাণে শস্য উতপাদিত হয় যেমন পাঞ্চাল, চেদি, মৎস্য, শূরসেন, পাত্তছড়া, দশার্ন, নবরাষ্ট্র, মল্ল, সালভা, যুগন্ধর, সৌরাষ্ট্র, অবন্তী এবং প্রশস্ত কুন্তিরাষ্ট্র"।
চেদিরাজ উপরিচার ভাসু এবং বংশ দন্ড উৎসব
সম্পাদনাউপারিচর ভাসু ছিলেন পুরু রাজবংশের চেদির একজন রাজা। তিনি ইন্দ্রের বন্ধু হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে চেদি রাজ্যের একটি ভাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিল এবং এখানে প্রচুর খনিজ সম্পদ ছিল, যার টানে বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রচুর বণিক এই রাজ্যে আসতেন বাণিজ্যের উদ্দেশ্য। এখানে প্রচুর পরিমাণে শস্য চাষ হত এবং শিকারের উপযোগী প্রাণীও পাওয়া যেত। রাজ্যে অনেক শহর ও নগর ছিল। চেদিরাজ ভাসু একটি বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন রথের অধিকারী ছিলেন। তিনি ইন্দ্রের সম্মানে তাঁর রাজ্যে একটি উৎসব প্রবর্তন করেছিলেন। ইন্দ্রের সম্মানে প্রতিবছর একটি বাঁশের খুঁটি লাগানো হত উতসব প্রাঙ্গনে। তারপরে সকলে এই বাশের খুঁটিটিকে সোনার কাপড় এবং সুগন্ধি, মালা এবং বিভিন্ন অলঙ্কার দ্বারা সজ্জিত করতেন। চেদিরাজ ভাসু একটি বিশাল অঞ্চল শাসন করতেন এবং ভালোভাবে রাজ্য পরিচালনার জন্যে তিনি তাঁর ছেলেদেরকে বিভিন্ন প্রদেশের রাজ্যপালক হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁর পুত্র বৃহদ্রথ (মহরত) মগধে প্রতিষ্ঠিত হন যিনি পরে সম্রাট জরাসন্ধের পিতৃপুরুষ হন। তাঁর অন্যান্য পুত্রগণ, যেমন, প্রত্যগ্রহ, কুসমাব (মণিবাহন), মাভেলা এবং ইয়াদুও বিভিন্ন স্থানে রাজ্যপাল হন। এভাবে চেদি রাজা চক্রবর্তী সম্রাটের মর্যাদা লাভ করেন এবং তাঁর রাজ্য একটি বিশাল সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। তাঁর রাজধানী-শহরে সেচ দেওয়ার জন্য তিনি সুকতিমতি নদীর জলকে ব্যবহার করেন।
তাঁর স্ত্রী গিরিকা ছিলেন কোলাহালার পাহাড়ী উপত্যকার কন্যা। গিরিকার ভাই বসুর সেনাবাহিনীর সেনাপতি পদে নিযুক্ত ছিলেন।মহারাণীর গর্ভে তার পাঁচ রাজপুত্র ছাড়াও জেলে সম্প্রদায়ের এক মহিলার গর্ভে তাঁর এক পুত্র ও কন্যার জন্ম হয়েছিল। সেই পুত্রসন্তান বড় হয়ে মৎস্য রাজ্য এবং রাজবংশ নামে অভিজাত রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। কন্যাসন্তানের সন্তানসন্ততিরা কুরু রাজ্যের সীমানায় যমুনা নদীর তীরে জেলে হিসাবে বসআবস করতেন। বিখ্যাত কুরুরাজ রাজা শান্তনুর স্ত্রী সত্যবতী ছিলেন এই জেলে সম্প্রদায়ের রাজকন্যা। মহাভারতের রচয়িতা, কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস এবং কুরু রাজারা যেমন চিত্রাঙ্গদা এবং বিচিত্রবীর্য ছিলেন সত্যবতীর পুত্র।
চেদিরাজ শিশুপাল
সম্পাদনাশিশুপাল ছিলেন রাজা দমঘোষের নৃশংস পুত্র। তাঁর আরেকটি নাম ছিল সুনীত। শিশুপালের মা শ্রুতকীর্তি ছিলেন বাসুদেব কৃষ্ণের পিতা বসুদেবের এবং পাণ্ডবদের মা কুন্তীর বোন। কুন্তী ও শ্রুতকীর্তি উভয়ই কৃষ্ণের পিসি ছিলেন। কৃষ্ণ শ্রুতকীর্তিকে কথা দেন যে তিনি শিশুপালের একশটি অপরাধ ক্ষমা করবেন। যাইহোক, বড় হওয়ার পরে শিশুপাল কৃষ্ণের সাথে শত্রুতা গড়ে তোলেন যদিও তিনি পান্ডব ভীমের প্রতি স্নেহশীল ছিলেন। পাণ্ডব রাজা যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তাঁর সামরিক প্রচারের সময়, ভীম এক মাস অতিথি হয়ে শিশুপালের রাজত্বে অবস্থান করেছিলেন। তিনি যুধিষ্ঠিরের রাজত্বের উপর আধিপত্যও মেনে নিয়েছিলেন এবং ভীমের মাধ্যমে শ্রদ্ধাও জানান। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ অনুষ্ঠানের সম্যেই শিশুপাল ও বাসুদেব কৃষ্ণের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। পাণ্ডবরা মধ্যস্থতার চেষ্টা করলেও বিরোধ মেটেনি এবং শিশুপাল পিতামহ ভীষ্মকেও অপমান করে নিজের একশত এক তম অপরাধটি করেন। কৃষ্ণ তখনি শিশুপালকে হত্যা করেন।
- শিশুপালের মৃত্যুর পরে যুধিষ্ঠির শিশুপালপুত্রকে চেদি রাজ্যের শাসক রূপে অভিষিক্ত করেন।
- শিশুপালের ভগিনীর সাথে ভীমের বিবাহের মাধ্যমে কুরু বংশের সাথে চেদি বংশের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
চেদি রাজ ধৃষ্টকেতু
সম্পাদনাশিশুপালের জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন ধৃষ্টকেতু, যিনি শিশূপালের মৃত্যুর পরে সিংহাসনে অভিষিক্ত হন।ধৃষ্টকেতুর সময়ও সুকতিমতি ছিল চেদি রাজ্যের রাজধানী। ধৃষ্টকেতু কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পাণ্ডবদের সেনাবাহিনীতে সেনাপতিও ছিলেন। তিনি চেদি, কাশি ও কারুশ বংশীয় সেনাবাহিনীর নেতা ছিলেন । ভীষ্মের বিশ্লেষণ অনুসারে তিনি একজন মহারাথ (একজন দুর্দান্ত রথচারী-যোদ্ধা) ছিলেন। ধৃষ্টকেতু দ্রোণের দ্বারা যুদ্ধে নিহত হন।
- চেদি রাজকন্যা করেণূমতীর সাথে পাণ্ডব নকুলের বিবাহ হয়েছিল, এবং রাজপুত্র নরিমিত্রা তাদের পুত্র ছিলেন। যদিও তিনি ধ্রষ্টকেতুর বোন ছিলেন কিনা তা নির্দিষ্ট ভাবে উল্লিখিত নেই।
- শিশুপালের মধ্য পুত্র সরভা ধৃষ্টকেতু মারা যাওয়ার পরে চেদির রাজা হন। তিনি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পরে সেনা প্রচারের সময় অর্জুনের হাতে যুদ্ধে নিহত হন। (14,83)
- যুদ্ধের নবম দিনে দুদূঃশাসনের হাতে শিশুপালের কনিষ্ঠ পুত্র মহিপালের মৃত্যু হয়েছিল।
অন্যান্য চেদি রাজা
সম্পাদনা- রাজা সুবাহুকে চেদি রাজা হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে যিনি নিশাদ রাজা নল এবং ভগবান রামের সমসাময়িক। নল দময়ন্তী অন্যায় ভাবে রাজ্য থেকে বিতাড়ীত হলে, তাঁর স্ত্রী, বিদর্ভের রাজকন্যা দময়ন্তী চেদি রাজধানীতে পৌঁছেছিলেন এবং রানীর সেবিকা হিসাবে জীবন অতিবাহিত করেন। (3-64,65)
- চেদি এবং মতস্য দেশীয়দের মধ্যে রাজা সহজকে তাঁর নিজের জাতি (৫,74৪) এর ধ্বংসকারী হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছিল।
আরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ Raychaudhuri, Hem Chandra (১৯২৩), Political history of ancient India, from the accession of Parikshit to the extinction of the Gupta dynasty, পৃষ্ঠা 67