যুধিষ্ঠির

মহাভারতে পঞ্চপাণ্ডবের জেষ্ঠ্য ভ্রাতা প্রাচীন ভারতীয় সম্রাট

যুধিষ্ঠির ( সংস্কৃত ভাষা: युधिष्ठिर ) হলেন পঞ্চ পাণ্ডব ভাইদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ। হিন্দুধর্মের প্রাচীন মহাকাব্য মহাভারতে তার কথা উল্লেখিত আছে। তার পিতামাতা হলেন কুরু রাজবংশের রাজা পাণ্ডুকুন্তী। যুধিষ্ঠির মহারাজ পাণ্ডুর পরবর্তীতে ইন্দ্রপ্রস্থের রাজা হন এবং তার রাজধানী ছিল হস্তিনাপুর

যুধিষ্ঠির
মহারাজ যুধিষ্ঠির এবং মহারাণী দ্রৌপদী অন্য পাণ্ডবগণ কর্তৃক বেষ্টিত হয়ে সিংহাসনে উপবিষ্ট
অন্তর্ভুক্তি
অস্ত্রবর্শা
পরিবারপিতামাতা
ভাই (কুন্তী) সৎ-ভাই (মাদ্রী)
দাম্পত্য সঙ্গী
  • দ্রৌপদী
  • দেবীকা
  • পৌরবী/দেবকী
  • মুত্তালাক্বান্নি
  • যৌধেয়ী
সন্তান
  • প্রতিবিন্ধ্য ও সুতনু(দ্রৌপদী থেকে)
  • যৌদ্ধেয় ও ১ কন্যা(দেবীকা থেকে)
  • দেবক ও সুহোত্র(পৌরবী থেকে)
  • প্রতিখামী(যৌধেয়ী থেকে)
আত্মীয়

শৈশব হতে, যুধিষ্ঠির তার কাকা বিদুর এবং পিতামহ ভীষ্ম কর্তৃক অনুপ্রাণিত হন এবং ধর্ম বা ন্যায় গুণে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি দুইজন অস্ত্রগুরু কৃপাচার্য এবং দ্রোণাচার্য থেকে অস্ত্রশিক্ষা লাভ করেন। যুধিষ্ঠির হস্তিনাপুরের যুবরাজ হয়েছিলেন। তবে, পরবর্তীতে দুর্যোধনের হঠকারিতায় যুবরাজ পদ হারান। কুন্তীর ভুলবশত আদেশের কারণে, তিনি এবং তার ভাইরা পাঞ্চালের রাজকন্যা দ্রৌপদীকে বিবাহ করেন। যুধিষ্ঠির এবং দুর্যোধন মধ্যে উত্তরাধিকার বিরোধের অবসান ঘটাতে ধৃতরাষ্ট্র, ভীষ্মের অনুরোধে হস্তিনাপুর রাজ্যকে দুই ভাগে বিভক্ত করেন। মহারাজ পাণ্ডুর জ্যেষ্ঠপুত্র হলেও যুধিষ্ঠিরকে অনুর্বর ভূমি দেওয়া হয়। পরবর্তীতে তিনি সেস্থানকে জাঁকজমক এবং মহিমান্বিত ইন্দ্রপ্রস্থ নগরীতে বিকশিত করেন।

যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞ করার পর, তার ঐশ্বর্য এবং বৈভবে ঈর্ষান্বিত হয়ে দুর্যোধন এবং মামা শকুনি পাশা খেলার জন্য হস্তিনাপুরে আমন্ত্রণ জানায়। পাশা খেলায়, দক্ষ শকুনি দুর্যোধন হয়ে যুধিষ্ঠিরের সাথে পাশা খেলে। যুধিষ্ঠির খেলায় একে একে তার রাজ্য, সম্পদ, ভাইদের স্বাধীনতা, দ্রৌপদী এবং নিজেকে পণ হিসেবে রাখেন এবং শকুনির তথা দুর্যোধনের হঠকারিতায় হেরে যান। পাশা খেলায় পরাজিত হওয়ার পর, দ্রৌপদী এবং পাণ্ডবগণকে ১৩ বছরের জন্য বনবাসে পাঠানো হয়, যেখানে ১ বছরের অজ্ঞাতবাসে ও থাকতে হবে। বনবাসকালে, ধর্মরাজ তাঁকে পরীক্ষা করেন। অজ্ঞাতবাসের সময়, তিনি কংক নাম নিয়ে মৎস্য রাজ্যের রাজার অধীনে ছিলেন।

যুধিষ্ঠির কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবপক্ষের রাজা ছিলেন এবং তিনি শল্য সহ অনেক যোদ্ধাকে পরাজিত করেন। মহাকাব্যের শেষে দেখা যায়, তিনি দ্রৌপদী এবং ভাইদের সাথে স্বর্গারোহণের জন্য গমন করেন। পথে দ্রৌপদী এবং ভাইরা একে একে ক্লান্ত হয়ে পতিত হয় এবং মারা গেলেও যুধিষ্ঠির সশরীরে স্বর্গে প্রবেশ বা স্বর্গারোহণ করেন।

মহাভারত মতে- ইন্দ্রধৈবত চন্দ্রসংযুক্ত অভিজিৎ নামক নক্ষত্রে অষ্টম মুহূর্তে মধ্যাহ্ন-সময়ে ইনি জন্মগ্রহণ করেন।

একবার একটি বনে, কিন্দম মুনি হরিণের রূপ ধারণ করে একটি হরিণীর সাথে সঙ্গম করছিলেন। ওই বনে পাণ্ডু মৃগয়া গিয়ে সঙ্গমরত হরিণের উপর শর নিক্ষেপ করে হত্যা করেন। মৃত্যুর আগে মুনি স্বমূর্তি ধারণ করে, পাণ্ডুকে অভিশাপ দিয়ে বলেন– 'মৃগভ্রমেই আমার উপর শরনিক্ষেপ করিয়াছ, এ নিমিত্ত তোমার ব্রহ্মহত্যার পাপ হইবে না, কিন্তু সঙ্গমসময়ে আমাকে বধ করাতে তোমার যে পাপ হইয়াছে, তাহার ফল অবশ্যই তোমাকে ভোগ করিতে হইবে। তুমি যে সময়ে স্ত্রীসংসর্গ করিবে, সেই সময়ে তোমার মৃত্যু হইবে। তুমি যে পত্নীর সহিত সংসর্গ করিয়া কালগ্রাসে পতিত হইবে, তিনি ভক্তিভাবে তোমার সহগামিনী হইবেন। হে রাজন! তুমি যেমন সুখের সময়ে আমাকে দুঃখ দিলে, সেইরূপ তোমাকেও সুখকালে দুঃখ পাইতে হইবে।'[] এই অভিশাপের কারণে, মাদ্রী এবং কুন্তী উভয়ই স্বামী-সংসর্গ থেকে বঞ্চিত হন। পরে কুন্তী সন্তান কামনায় পাণ্ডুর অনুরোধে তিন দেবতার সাথে মিলিত হন এবং তিনটি সন্তান লাভ করেন। কুন্তী প্রথম আহ্বান করেছিলেন ধর্ম দেবতাকে। তার আশীর্বাদে যুধিষ্ঠিরের জন্ম হয়। যুধি (যুদ্ধে) স্থির থাকতেন বলে, তার নাম হয়েছিল যুধিষ্ঠির। অবশ্য কয়েকজন আধুনিক মহাভারত বিশেষজ্ঞ বলেন, ধর্মের অবতার ছিলেন।

অস্ত্রশিক্ষা

সম্পাদনা

পাণ্ডুর মৃত্যুর পর কুন্তী নিজের তিনটি পুত্র ও মাদ্রীর দুটি পুত্র নিয়ে হস্তিনাপুরে ধৃতরাষ্ট্র-এর আশ্রয়ে আসেন। এই সময় পঞ্চপাণ্ডব ও ধৃতরাষ্ট্রের একশত সন্তান দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্রশিক্ষা লাভ করেন। যুধিষ্ঠির বর্ষাযুদ্ধ এবং রথ চালনায় বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। প্রাপ্তবয়স্ক হলে বংশের বড় সন্তান হিসাবে ধৃতরাষ্ট্র (পাণ্ডুর ভাই) তাঁকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করেন। এতে ধৃতরাষ্ট্র-এর পুত্ররা বিশেষ করে দুর্যোধন ঈর্ষান্বিত হয়ে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতে থাকেন। কিন্তু পাণ্ডবদের মধ্যে ভীম ও অর্জুন দুর্যোধনের একশত ভাইয়ের চেয়ে শক্তিশালী ও অপরাজেয় উঠলে, দুর্যোধন কৌশলে কুন্তীসহ পঞ্চপাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার জন্য জতুগৃহে পাঠান। জতুগৃহের পথে যাত্রাকালে বিদুর সাঙ্কেতিক ভাষায় যুধিষ্ঠিরকে দুর্যোধনের দুরভিসন্ধি জানিয়ে দেন। পরে কৌশলে জতুগৃহ থেকে এঁরা রক্ষা পান এবং নৌকা যোগে নদী পার হয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করেন। অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে জঙ্গলে সকলে ঘুমিয়ে পড়লে দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীম একা সকলকে পাহারা দেন। এই সময় তিনি হিড়িম্ব নামক এক রাক্ষসকে হত্যা করে পাণ্ডবদের রক্ষা করেন। পরে যুধিষ্ঠির ও কুন্তীর অনুগ্রহে ভীমের সাথে হিড়িম্বার বিবাহ হয়। এরপর যুধিষ্ঠির সবাইকে নিয়ে একচক্রা নগরীর একটি ব্রাহ্মণ পরিবারের আশ্রয়ে উঠে আসেন। এখানে ভীম বক নামক রাক্ষসকে হত্যা করেন। এই নগরীতে থাকাকালীন সময়ে পাণ্ডবরা দ্রৌপদীর স্বয়ংবর-সভার কথা জানতে পারেন। এই স্বয়ংবর সভা দেখার জন্য পাণ্ডবরা রওনা হন। পথে গন্ধর্বরাজ অঙ্গারপর্ণের সাথে অর্জুনের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে অর্জুন অঙ্গারপর্ণকে পরাজিত করে বন্দী করেন। এরপর অঙ্গারপর্ণের স্ত্রী কুম্ভীনসী যুধিষ্ঠিরের কাছে স্বামীর মুক্তির আবেদন করেন। যুধিষ্ঠিরের আদেশে অর্জুন তাঁকে ছেড়ে দেন।

বিবাহ এবং সন্তান

সম্পাদনা
 
পাঞ্চালকন্যা দ্রৌপদীর সাথে পাণ্ডবদের বিবাহ

স্বয়ংবর সভায় অর্জুন লক্ষ্যভেদ করে দ্রৌপদীকে লাভ করলে, সভায় আহুত অন্যান্যরা পাণ্ডবদের আক্রমণ করে। পাণ্ডবরা যুদ্ধে সকলকে পরাজিত করে দ্রৌপদীকে সাথে নিয়ে কুন্তীর কাছে আসেন। দ্রৌপদীকে নিয়ে পঞ্চপাণ্ডব যখন ঘরে ফেরেন, তখন কুন্তী ঘরের মধ্যে ছিলেন। পঞ্চপাণ্ডব তাঁদের মাকে উদ্দেশ্য করে বলেন যে, তারা একটি অপূর্ব সামগ্রী ভিক্ষা করে এনেছেন। কুন্তী না দেখেই বলেন, তোমরা সকলে মিলে সেই জিনিস ভোগ কর। এরপর দ্রৌপদীকে দেখে ইনি বিব্রত হয়ে পড়েন। পরে কৃষ্ণ-দ্বৈপায়নের (বেদব্যাস)-এর বিধান মতে- পঞ্চপাণ্ডব দ্রৌপদীকে বিবাহ করেন। উল্লেখ্য দ্রৌপদীর গর্ভে যুধিষ্ঠিরের প্রতিবিন্ধ্য নামক পুত্র ও সুতনু নামক কন্যা জন্মে। এছাড়া তিনি গোবাসনের কন্যা দেবিকার স্বয়ংবর সভায় উপস্থিত হয়ে দেবিকাকে লাভ করেন। এঁর গর্ভে যৌধেয় নামক এক পুত্র ও একটি কন্যা জন্মে।রাজসূয় যজ্ঞকালে তিনি শিশুপালের কন্যা পৌরবী বা দেবকীকে বিয়ে করেন এবং দেবক বা বোধন ও সুহত্র নামে দুটি পুত্র হয়।কুরুক্ষেত্রের অব্যবহিত আগে দক্ষিণ ভারতীয় আদিবাসী প্রধান মুত্তাল মহারাজার কন্যা মুত্তালাক্কানিকে বিয়ে করেন।কুরুক্ষেত্রের পরে যৌধেয়ী নামক কন্যাকে বিবাহ করে প্রতিখামী নামক পুত্রের জন্ম দেন।

রাজসূয় যজ্ঞ সম্পাদন

সম্পাদনা

নারদের পরামর্শে যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেন। মগধরাজ জরাসন্ধ এই যজ্ঞের বিঘ্ন সৃষ্টি করবেন জেনে- কৃষ্ণ, ভীম ও অর্জুন মগধ রাজ্যে যান। এখানে ভীম জরাসন্ধকে হত্যা করেন। এরপর ধৃতরাষ্ট্র নিজ উদ্যোগে পঞ্চপাণ্ডব, দ্রৌপদী এবং কুন্তীকে হস্তিনাপুর নিয়ে আসেন। পাণ্ডবরা ফিরে এসে ইন্দ্রপ্রস্থ নগর প্রতিষ্ঠা করে পৃথক রাজ্য স্থাপন করেন এবং যুধিষ্ঠির রাজা হন। রাজসূয় যজ্ঞের অর্থ আহরণের জন্য পাণ্ডবরা দিগ্বিজয়ে বের হন। যথাসময়ে এঁরা দিগ্বিজয় শেষে ফিরে এলে যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞ সম্পন্ন করেন। দ্রৌপদীকে নিয়ে যাতে ভ্রাতৃবিরোধ না ঘটে, সে কারণে নারদ নিয়ম করে দেন যে, একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য, দ্রৌপদী একজন মাত্র পাণ্ডবের সঙ্গে থাকবেন। এই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অধিকারপ্রাপ্ত পাণ্ডব ব্যতীত অন্য কোন পাণ্ডব দ্রৌপদীকে গ্রহণ করলে বা দ্রৌপদীর সাথে অধিকারপ্রাপ্ত পাণ্ডবের বিহারকালে অন্য পাণ্ডব দর্শন করলে, তাঁকে ১২ বৎসর বনবাসী থাকতে হবে। ঘটনাক্রমে- একবার এক ব্রাহ্মণকে সাহায্য করার জন্য, অর্জুন অস্ত্রাগারে প্রবেশ করলে, সেখানে যুধিষ্ঠিরের সাথে দ্রৌপদীকে এক শয্যায় দেখতে পান। এই কারণে অর্জুন ১২ বৎসর বনবাসের জন্য গৃহত্যাগ করেন। ১২ বৎসর পরে ভাইদের সাথে মিলিত হন। দুর্যোধন যজ্ঞানুষ্ঠানে এসে পাণ্ডবদের ঐশ্বর্যে ঈর্ষান্বিত হন এবং পাণ্ডবদের ক্ষতি করার জন্য শকুনি'র (দুর্যোধনের মামা) পরামর্শ নেন।

পাশা খেলা

সম্পাদনা

শকুনির পরামর্শে দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরকে পাশা খেলায় নিমন্ত্রণ করেন। যুধিষ্ঠির উক্ত খেলায় রাজী হলে, শকুনি কপট পাশাতে যুধিষ্ঠিরকে পরাজিত করেন। এই খেলায় যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীসহ রাজ্যপাট হারান। দুর্যোধনের নির্দেশে দুঃশাসন রজস্বঃলা দ্রৌপদীর চুল ধরে সভায় আনেন। দুর্যধনের পরামর্শে প্রকাশ্য সভায় দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করা শুরু করলে, দ্রৌপদীর কাতর আহ্বানে কৃষ্ণ অলৌকিকভাবে তাঁকে অশেষ কাপড় দ্বারা আবৃত করে রাখেন। পরে ধৃতরাষ্ট্র সকলকে মুক্তি দেন। দুর্যোধন ও শকুনি'র পরামর্শে ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে পুনরায় পাশা খেলায় অনুমোদন দান করেন। এবার যুধিষ্ঠির হেরে গিয়ে ১২ বৎসর বনবাস ও ১ বৎসর অজ্ঞাতবাসের শাস্তি পান। এরপর পাণ্ডবরা রাজ্য ত্যাগ করে বনবাসের পথে গেলে দ্রৌপদী তাঁদের সাথে যান। এই যাত্রায় এঁরা প্রথমে কাম্যক বনে আসেন, পরে দ্বৈতবনে এসে সরস্বতী নদীর তীরে আশ্রম নির্মাণ করে বসবাস করতে থাকেন। এই সময় দ্রৌপদী ও ভীম প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের জন্য যুধিষ্ঠিরকে উত্তেজিত করতে থাকলে, ইনি প্রতিজ্ঞায় অটল থাকেন। এই সময় অস্ত্র সংগ্রহের জন্য অর্জুন দেবালোকে যাত্রা করেন। এরপর যুধিষ্ঠির অন্যান্যদের নিয়ে নৈমিষারাণ্য, প্রয়াগ, বদরিকাশ্রম, ভৃগুতীর্থ, গঙ্গাসাগরসঙ্গম, মহেন্দ্রপর্বত, প্রভাসতীর্থ প্রভৃতি বহু তীর্থস্থান ভ্রমণ করেন।

বনবাসের একাদশ বৎসরে যমুনার উৎপত্তিস্থানের নিকটস্থ বিশাখযূপ বনে পাণ্ডবদের বসবাসকালে, একদিন ভীম মৃগয়ায় বের হন। সেখানে অগস্ত্য-শাপে অজগররূপী নহুষ ভীমকে বেষ্ঠন করে আহার করতে উদ্যত হন। যুধিষ্ঠির বিভিন্ন দুর্লক্ষণ দেখে ভীমের খোঁজে বের হয়ে, অজগররূপী নহুষের কাছে উপস্থিত হন। যুধিষ্ঠির নহুষের কাছে ভীমের মুক্তি দাবী করলে, নহুষ যুধিষ্ঠিরের কাছে কিছু প্রশ্নের উত্তর চেয়ে বলেন যে, প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিলেই তবে ভীমকে মুক্তি দেবেন। এরপর যুধিষ্ঠির নহুষের প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিয়ে ভীমকে উদ্ধার করেন। এই সময় নহুষ অভিশাপ মুক্ত হন। পাণ্ডবরা দ্বৈতবনে অবস্থানকালে দুর্যোধন মৃগয়ার অছিলায় পাণ্ডবদের দুর্দশা দেখতে এসে গন্ধর্বরাজ চিত্রসেনের দ্বারা নিগৃহীত হলে পাণ্ডবরা তাঁকে রক্ষা করেন। এই সময় আত্মগ্লানিতে দুর্যোধন প্রায়োপবেশন করেন। এরপর কাম্যকবনে পাণ্ডবরা ফিরে এসে বসবাস করতে থাকে। একদিন পাণ্ডবদের অনুপস্থিতিতে জয়দ্রথ দ্রৌপদীকে হরণ করেন। পাণ্ডবরা পরে জয়দ্রথকে ধরে এনে লাঞ্ছিত করতে থাকলে যুধিষ্ঠির তাঁকে রক্ষা করেন। কিন্তু ভীম তার মাথায় অর্ধাস্ত্র বাণদ্বারা পঞ্চচূড়া তৈরি করে পাণ্ডবদের দাসরূপে বেড়াতে আদেশ করেন। এরপরও যুধিষ্ঠির তাঁকে মুক্তি দেন।

বনবাসের দ্বাদশবর্ষে যুধিষ্ঠিরকে পরীক্ষা করার জন্য ধর্মদেবতা হরিণরূপে এক ব্রাহ্মণের অরণি-মন্থ চুরি করেন। ব্রাহ্মণ তার অগ্নিহোত্র নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় যুধিষ্ঠিরের শরণাপন্ন হন। এরপর পঞ্চপাণ্ডব উক্ত হরিণের অনুসরণ করেন। হরিণরূপী ধর্ম অদৃশ্য হলে, যুধিষ্ঠির প্রার্থী ব্রাহ্মণের বিমুখ হওয়ার আশঙ্কায় অত্যন্ত দুঃখিত হন। দীর্ঘ ভ্রমণে ক্লান্ত ও তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়লে যুধিষ্ঠির নকুলকে নিকটস্থ সরোবর থেকে জল সংগ্রহের আদেশ দেন। নকুল উক্ত সরোবর থেকে জল সংগ্রহ করতে গেলে ধর্ম, বকরূপে আকাশ থেকে তার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে জল সংগ্রহ করতে বললেন। নকুল তা অগ্রাহ্য করে অগ্রসর হলে ভূপতিত হন। এরপর যুধিষ্ঠির অন্যান্য ভাইদের পাঠালেন। প্রত্যেকেই ধর্মকে অগ্রাহ্য করে জল সংগ্রহ করতে গেলে ভূপতিত হন। এরপর যুধিষ্ঠির নিজেই সরোবরে উপস্থিত হয়ে চার ভাইয়ের অবস্থা দেখলেন। ধর্ম তার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে জল সংগ্রহ করতে বলেন। যুধিষ্ঠির সকল প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিলে ধর্ম তাঁকে যে কোন এক ভাইয়ের জীবন ভিক্ষা দিতে ইচ্ছা করলেন। উত্তরে যুধিষ্ঠির বলেন যে, কুন্তী ও মাদ্রীর অন্তত একটি করে সন্তান বেঁচে থাকুক। ধর্ম তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে অপর চার পাণ্ডবের জীবনদান করলেন। এরপর ধর্ম বর প্রার্থনা করতে বললে, যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণের অরণি-মন্থ ফিরে চাইলেন। ধর্ম অরণি-মন্থ ফিরিয়ে দিয়ে অন্য বর প্রার্থনা করতে বললেন। এরপর অজ্ঞাতবাসকালে তাদের যেন কেউ চিনতে না পারে এই বর প্রার্থনা করলে, ধর্ম সেই বর দান করেন। এরপর ধর্ম পাণ্ডবদের বিরাট রাজ্যে বাস করার উপদেশ দিয়ে প্রস্থান করেন।[]

অজ্ঞাতবাস

সম্পাদনা

যুধিষ্ঠির বিরাটরাজের সভায় কঙ্ক নামে দ্যুতনিপুণ ব্রাহ্মণ হিসাবে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সৌরন্ধ্রীরূপী দ্রৌপদীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কীচক তাঁকে বিবাহের প্রস্তাব দিলে, দ্রৌপদী তা প্রত্যাখান করেন। এরপর কীচকের বারবার অনুরোধে সুদেষ্ণা (কীচকের বোন) মদ আনার অছিলায়, দ্রৌপদীকে কীচকের ঘরে পাঠান। কীচক দ্রৌপদীকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করলে, দ্রৌপদী তাঁকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে বিরাটের রাজসভায় উপস্থিত হন। এরপর কীচক রাজসভায় এসে সর্বসমক্ষে দ্রৌপদীর চুল ধরে তাকে লাথি মারেন। বিরাট-সভায় কীচক প্রকাশ্যে দ্রৌপদীকে লাথি মারলে, আত্মপরিচয় প্রকাশের আশঙ্কায় ভীমকে প্রতিশোধ গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে বলেন। পরে দ্রৌপদীর অনুরোধে ভীম কীচককে হত্যা করেছিলেন।পাণ্ডবদের এই অজ্ঞাতবাসের শেষাংশে দুর্যোধন বিরাটরাজের গোধন হরণ করলে যুধিষ্ঠিরের ইঙ্গিতে বৃহন্নলারূপী অর্জুন কৌরব-সৈন্যদের পরাস্ত করে গোধন উদ্ধার করেন।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ

সম্পাদনা

অজ্ঞাতবাস শেষে যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের কাছে রাজ্য ফিরে চান।কিন্তু দুর্যোধন তা দিতে অস্বীকৃতি জানান। এরপর যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে দূত হিসেবে পাঠান । সকল প্রস্তাবই দুর্যোধন অগ্রাহ্য করেন। কৃষ্ণ তখন ৫ পাণ্ডবের জন্য ৫ টি গ্রাম প্রার্থনা করেন। দুর্যোধন তাতেও অসম্মত হন এবং বলেন বিনা যুদ্ধে উনি সূঁচের ডগায় যতটুকু পরিমাণ ভূমি ধরবে উনি ততটুকুও দেবেন নাএরপর যুধিষ্ঠির দুঃখিত হয়ে যুদ্ধের ব্যাপক আয়োজন সম্পন্ন করেন। যুদ্ধের আরম্ভে যুধিষ্ঠির রথ থেকে নেমে ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, শল্য প্রমুখ গুরুজনদের প্রণাম করে আশীর্বাদ ভিক্ষা করেন। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র যুযুৎসু পাণ্ডব পক্ষে যোগ দিতে ইচ্ছা করলে যুধিষ্ঠির সম্মতি দেন। যুদ্ধের ত্রয়োদশ দিনে অভিমন্যু চক্রব্যূহ ভেদ করার ইচ্ছা করলে, যুধিষ্ঠির তাঁকে বাধা দেন, পরে নিরুপায় হয়ে অভিমন্যুকে অনুমতি দেন। উল্লেখ্য উক্ত যুদ্ধে অভিমন্যু নিহত হন। দ্রোণকে যুদ্ধে নিরস্ত করার জন্য কৃষ্ণ এবং ভীমের প্ররোচনায় যুধিষ্ঠির 'অশ্বত্থামা হতঃ-ইতি গজঃ' এই মিথ্যা উচ্চারণ করেন। যুধিষ্ঠিরের এই বাক্যে দ্রোণ তার পুত্র অশ্বত্থামা'র মৃত্যু হয়েছে মনে করে অস্ত্রত্যাগ করেন। উল্লেখ্য অশ্বত্থামা নামক হাতির মৃত্যু হয়েছে এই সংবাদটাই যুধিষ্ঠির মিথ্যার আশ্রয়ে উচ্চারণ করেন। এই মিথ্যাচারের জন্য তার রথ কিছুটা ভূমির দিকে নেমে যায়।[] যুদ্ধের সপ্তদশ দিনে যুধিষ্ঠির কর্ণের কাছে পরাজিত ও লাঞ্ছিত হয়ে শিবিরে পলায়ন করেন। এই সময় অর্জুন উপস্থিত হয়ে কর্ণকে হত্যা করতে ব্যর্থ হলে যুধিষ্ঠির তাঁকে তিরস্কার করে গাণ্ডীব ত্যাগ করতে বলেন। এতে অর্জুন ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত হয়ে যুধিষ্ঠিরকে হত্যা করতে উদ্যত হলে কৃষ্ণ তাঁকে নিবারণ করেন। পরে অবশ্য কর্ণকে অর্জুনই হত্যা করেছিলেন। যুদ্ধের অষ্টাদশ দিনে যুধিষ্ঠির শল্যকে হত্যা করেন। যুদ্ধের শেষে দুর্যোধন দ্বৈপায়ন হ্রদে আত্মগোপন করলে, যুধিষ্ঠির তাঁকে তীক্ষ্ণবাক্যে উত্তেজিত করেন। পরে ভীমের সাথে দুর্যোধনের গদা যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে ভীম অন্যায়ভাবে দুর্যোধনের উরু ভেঙে দেন। যুদ্ধের শেষে ক্রুদ্ধ গান্ধারী যুদ্ধক্ষেত্রে এলে ইনি তার ক্রোধ প্রশমিত করার জন্য গান্ধারীর পায়ে ধরেন। এ সময় গান্ধারী বস্ত্রাবরণের আড়াল থেকে শুধুমাত্র যুধিষ্ঠিরের নখগুলি দেখতে পান। ফলে যুধিষ্ঠিরের নখগুলো বিকৃত হয়ে যায়।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর পাণ্ডবরা সবার মৃতদেহ সৎকারের সময় কুন্তী তাঁদের কাছে কর্ণের জন্মবৃত্তান্ত বর্ণনা করে তার উদ্দেশ্যেও তর্পণ করতে অনুরোধ করেন। এতে যুধিষ্ঠির ক্ষিপ্ত হয়ে অভিশাপ দেন যে, স্ত্রী জাতি কোন বিষয়ই গোপন রাখতে পারবে না।

যুদ্ধ শেষে যুধিষ্ঠিরের রাজ্যাভিষেক হয়। এই সময় যুধিষ্ঠির আত্মীয়-স্বজনের মৃত্যুর জন্য অনুতপ্ত হয়ে রাজপদ ত্যাগ করতে উদ্যত হন। কিন্তু কৃষ্ণ, কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন, অনুনয় করে তাঁকে রাজ্য গ্রহণে সম্মত করান। রাজ্যগ্রহণের পর ইনি শরশয্যাশায়ী ভীষ্মের কাছে উপস্থিত হন। ভীষ্ম তাঁকে বহু পরামর্শ দিয়ে দেহত্যাগ করেন। এরপর ইনি আত্মীয়-স্বজন হত্যাজনীত অপরাধ থেকে উদ্ধারের জন্য ব্যাসদেবের পরামর্শে অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন। এরপর যুধিষ্ঠির ৩৬ বৎসর রাজত্ব করেন। এই সময় ইনি ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর সেবা করার ব্যবস্থা করেন।

মহাপ্রস্থান

সম্পাদনা

যদুবংশ ধ্বংসের পর যুধিষ্ঠির অভিমন্যুর পুত্র পরীক্ষিৎ-কে রাজ্যে অভিষিক্ত করেন এবং যুযুৎসু'র উপর রাজ্যের ভার অর্পণ করে ৪ ভাই ও দ্রৌপদীসহ মহাপ্রস্থানের প্রস্তুতি নেন। এই সময় তাঁদের সাথে ধর্মদেবতা কুকুররূপে সঙ্গ নেন। পথিমধ্যে চার ভাই ও দ্রৌপদীর পতন ঘটে। এরপর একমাত্র কুকুরকে সঙ্গী করে ইনি স্বর্গদ্বারে উপস্থিত হন। কিন্তু ইন্দ্র যুধিষ্ঠিরকে বলেন যে, তিনি কুকুরসহ স্বর্গে প্রবেশ করতে দিবেন না। উত্তরে ইনি বলেন যে, প্রভুভক্ত কুকুর ছাড়া স্বর্গে প্রবেশ করলে, তা নির্দয়তা হবে। সুতরাং কুকুর ছাড়া তিনি স্বর্গে প্রবেশ করবেন না। এরপর ধর্ম কুকুরের রূপ পরিত্যাগ করে যুধিষ্ঠিরকে বলেন যে, যুধিষ্ঠির তোমার সমান স্বর্গে কেউ নেই। স্বর্গে প্রবেশ করে তিনি তার ভাইদের দেখতে চান। দেবদূতরা তাঁকে নরকে নিয়ে যান। সেখানে ভাইদের দেখতে পেয়ে স্বর্গে ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানালে, ইন্দ্র তাঁকে বলেন যে, যুধিষ্ঠির অশ্বত্থামার মৃত্যু সংবাদ দিয়ে দ্রোণাচার্যের সাথে প্রতারণা করেন বলে, তাঁকে কৌশলে নরক দর্শন করান হয়েছে। এরপর যুধিষ্ঠির পাণ্ডবদের নিয়ে স্বর্গে প্রবেশ করেন।

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. [মহাভারত, আদিপর্ব: অষ্টাদশাধিকশততম অধ্যায়। পাণ্ডুর প্রতি মৃগরূপী মুনির শাপ]
  2. http://www.ksforum.org/কে-ছিলেন-যুধিষ্ঠির/[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  3. http://ebela.in/entertainment/how-many-lies-did-yudhishthira-tell-in-the-mahabharata-dgtl-1.436286

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা