কে বোঝে সাঁইয়ের লীলাখেলা

'কে বোঝে সাঁইয়ের লীলাখেলা' লালন শাহ রচিত বাউল সঙ্গীত। লালন সাধারণত মুখে মুখে গান রচনা করতেন, দিন তারিখ সহ লিপিবদ্ধ হতো না; তাই এইগানের প্রথম রচনাকাল অজানা।[১][২] এটি মূদ্রণ মাধ্যমে প্রকাশিত লালনের প্রথম গান। ১৮৮৫ সালে (১২৯২ বঙ্গাব্দে) হরিনাথ মজুমদার তার 'ব্রহ্মাণ্ডবেদ' সাময়িকীর প্রথম ভাগের প্রথম সংখ্যায় গানটির প্রাথমিক সংস্করণ প্রকাশ করেছিলেন।[৩][৪][৫][৬][৭] পরবর্তীতে ১৯৫৮ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে মতিলাল দাশ ও পীযূষকান্তি মহাপাত্রর সম্পাদনায় লালন-গীতিকায় গানটি প্রমিত বাংলা ভাষায় সংকলিত হয়।[৮]

"কে বোঝে সাঁইয়ের লীলাখেলা"
লালন কর্তৃক বাউল সঙ্গীত
ভাষাবাংলা
মুক্তিপ্রাপ্ত১৮৮৫ (প্রথম মূদ্রণ)
গান লেখকলালন
সুরকারলালন
বাংলা-এর সঙ্গীত
বাউল, বাংলার আধ্যাত্মিক গান
ধরন
নির্দিষ্ট ধরন
ধর্মীয় সঙ্গীত
জাতিগত সঙ্গীত
ঐতিহ্যবাহি সঙ্গীত
মিডিয়া এবং কর্মক্ষমতা
সঙ্গীত মিডিয়াবেতার

টেলিভিশন

ইন্টারনেট

লালন এগানে তৎকালীন সামন্তদের ছলনার মাধ্যমে বঙ্গের সাধারণ জনগণকে অর্থনৈতিক শোষণ এবং শোষণ বুঝতে না পারা মানুষের অজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন।[৭]

গীতি সম্পাদনা

১৮৮৫ সালে প্রথম মূদ্রণের পর, ১৯৫৮ সালে লালন-গীতিকায় সংকলিত হয়। লালন গীতিকায় মূল গীতের বাক্য শৈলীর পরিবর্তন হলুদ রঙে আলোকপাত কৃতঃ[৮]

ব্রহ্মাণ্ডবেদ, ১৮৮৫ লালন-গীতিকা, ১৯৫৮

কে বোঝে সাঁইয়ের লীলা খেলা;
সে যে, আপ্নি গুরু হয়, আপ্নি চেলা ॥

সপ্ত তলার উপর সে,
নিরূপ রয় অচিন দেশে,
প্রকাশ্য রূপ লীলা বাসে,
চেনা যায় না লেগে বেদের খেলা ॥

অঙ্গের অবয়বে সৃষ্টি,
করিল সে পরমেষ্টি,
তবে কেনে আকার নাস্তি,
বলে না জেনে সে ভেদ নিরালা ॥

যদি কারু হয় চক্ষুদান,
সেই দেখে রূপ বর্ত্তমান,
লালন বলে তার
জ্ঞান ধ্যান হবে দেখিয়ে সব পুঁথির পালা ॥

কে বোঝে সাঁইর লীলা খেলা।
ও সে আপনি হয় গুরু আপনি চেলা॥
সপ্ত-তালার উপরে সে,
নিরূপ রয় অচিন দেশে,
প্রকাশ্য রূপ লীলা
চেনা যায় না লেগে বেদের ঘোলা

অঙ্গের অবয়বে সৃষ্টি,
করিল সে পরম ইষ্টি,
তবে কেন আকার নাস্তি
বলে, না জেনে সেই ভেদ নিরালা।

যদি কারো হয় চক্ষু দান
তবে সেরূপ দেখে বর্তমান,
লালন বলে, তাহার জ্ঞান ধ্যান
হরে দেখিয়ে সব পুথির পালা॥

প্রভাব সম্পাদনা

হরিনাথ মজুমদার এইগানের কথায় মুগ্ধ ও প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি ১৮৮৯ সালে (১২৯৬ বঙ্গাব্দে) তার ব্রহ্মাণ্ডবেদ-৩য় ভাগ, ৬ষ্ঠ সংখ্যায় এগানের সুরে বাঁধা তার নিজের কয়েকটি গান উদ্ধৃত করেন।[১][৯]

ভাবার্থ সম্পাদনা

এই গানে তৎকালীন সামন্ত অর্থনীতির শিকারে পর্যদুস্ত বঙ্গের সাধারণ জনগণের অসহায়ত্বের হাহাকার প্রকাশ পেয়েছে। এছাড়া জনগণের অজ্ঞতার কারণে সামন্ত শোষণে অসহায়ত্ব বর্ণিত হয়েছে। এখানে ‘সাঁই’ স্বার্থান্বেষী মহলের তৈরি করা কৃত্রিম অর্থ সংকট এবং ‘লীলাখেলা’ সেই সংকটের সৃষ্ট বিচিত্র অস্থিতিশীলতা। তাদের কৃত্রিম সংকটের অবস্থান এত উপরে যে তা সাধারণের ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায়। সামন্ত শক্তি যার আধিপত্যে সদা চঞ্চল ও ছলনায় পরিপূর্ণ; অথচ সাধারণ জনগণের বিত্তশক্তি কখনো নৈর্ব্যক্তিক, কখনো বা ব্যক্তিক। সামন্তবাদী অর্থনৈতিক শোষণের কৌশল এত গভীর যে কেতাবি বিদ্যায় তা আয়ত্ব হয় না, কেবল কৌশলী মানুষই এর রহস্য বুঝতে পারে।[৭]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. চৌধুরী, আবুল আহসান (২০১৬-১০-১৩)। "তিন পাগলের মেলা"প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৭-১০ 
  2. "লালন থেকে নেওয়া"প্রথম আলো। ২০১৯-১০-১১। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৩-২৮ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  3. "গানের কোকিল লালন ফকির"অধিকার। ২০১৯-১০-১৭। ২০২২-১২-০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১২-০৯ 
  4. মজুমদার, হরিনাথ (১৮৮৫)। ব্রহ্মাণ্ডবেদ: ১ম ভাগ (১ম (বঙ্গাব্দ ১২৯২) সংস্করণ)। 
  5. "লালনসাঁই"আনন্দবাজার পত্রিকা। ২০১৬-০২-২৭। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৭-১০ 
  6. "গানের কোকিল লালন ফকির"দৈনিক অধিকার। ২০১৯-১০-১৭। ২০২২-১২-০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০২-০৩ 
  7. সরকার, মিলন (২০২০-০৭-০৫)। "'খুলবে কেনে সে ধন ও তার গাহেক বিনে'"গ্লোবাল টেলিভশন। ২০২৪-০২-০৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০২-০৩ 
  8. দাস, মতিলাল; পীযূষকান্তি, মহাপাত্র, সম্পাদকগণ (১৯৫৮)। লালন-গীতিকা (লালন শাহ ফকিরের গান)কলকাতা: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস। পৃষ্ঠা ১১। 
  9. আলম, মো. অলীউল (২০২১-১০-১৭)। "মানবতাবাদী লালন সাঁইজি"দৈনিক সমকাল। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৭-১০