কামদেব

ভালবাসা ও কামনার হিন্দু দেবতা

কামদেব (সংস্কৃত: कामदेव) হিন্দু প্রেমের দেবতা।[২] তার অন্যান্য নামগুলি হল রাগবৃন্ত (প্রেমের অঙ্কুর), অনঙ্গ[৩](দেহহীন), কন্দর্প[৪](দেবগণেরও কামনা সৃষ্টিকারী),[৫][৬] মন্মথ (মন মন্থনকারী)[৭], মনসিজ (মন হইতে জাত, সংস্কৃতে বলা হয় সঃ মনসঃ জাত), মদন (নেশা সৃষ্টিকারী)[৮], রতিকান্ত (রতির পতি), পুষ্পবাণ, পুষ্পধন্বা (পুষ্পবাণধারী) এবং কাম (কামনা)। কামদেব হিন্দু দেবী শ্রীর পুত্র। অন্যদিকে তিনি শ্রীকৃষ্ণের পুত্র প্রদ্যুম্নের অবতার।[২] তার স্ত্রী হলো আকাঙ্ক্ষার দেবী রতিবৈষ্ণবরা তার আধ্যাত্মিক সত্ত্বাটিকে কৃষ্ণের সমরূপ মনে করেন।

কামদেব
প্রেম, কামনাবাসনা
অষ্টাদশ শতাব্দীর কাঠখোদাই
অন্যান্য নামকন্দর্প, স্মর, মীনকেতু, অনঙ্গ, অতনু
দেবনাগরীकाम देव
তামিল লিপিகாம தேவன்
অন্তর্ভুক্তিপ্রদ্যুম্ন, বাসুদেব
আবাসকেতুমালা বর্ষ
মন্ত্রকামগায়ত্রী[১]

ব্যুৎপত্তি সম্পাদনা

সংস্কৃত কাম-দেব শব্দটির অর্থ 'দিব্য প্রেম' বা 'প্রেমের দেবতা'। অর্থাৎ মানুষের মনে কাম দেন যে সত্তা। দেব শব্দের অর্থ দিব্য বা স্বর্গীয়; কাম শব্দের আক্ষরিক অর্থ ইচ্ছা, কামনা বা বাসনা, বিশেষত শারীরিক প্রেম বা যৌনতার ক্ষেত্রে। বিষ্ণুপুরাণভাগবত পুরাণে (৫।১৮।১৫) দেবতা কাম্যদেব বিষ্ণুর অপর নাম কামদেব। শব্দটি কখনও কখনও দেবতা মদনশিবের নাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আবার সংস্কৃত গ্রন্থ প্রায়শ্চিত পদ্যত-এর রচয়িতার নামও কামদেব। অন্যদিকে কৃষ্ণের অপর নাম কামদেব; কখনও কখনও আবার শব্দটি কৃষ্ণের উপাধি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। অগ্নির অপর নাম কাম। এই নামটি ঋগ্বেদেও ব্যবহৃত হয়েছে (ঋগ্বেদ ৯, ১১৩।১১)।[৬] অথর্ববেদে 'কাম' যৌনাকাঙ্ক্ষা অর্থে নয় বরং 'সমস্ত পৃথিবীর মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা' অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

মূর্তিতত্ত্ব সম্পাদনা

কামদেবকে এক পক্ষধারী সুদর্শন যুবকরূপে কল্পনা করা হয়। কামদেবের নাসিকা সুচারু, ঊরু, কটি ও জঙ্ঘা সুবৃত্ত; কেশ নীলাভ ও কুঞ্চিত। তার বক্ষ সুবিশাল। তার চক্ষু, মুখ পদতল ও নখ রক্তাভ। গায়ে বকুলের ঘ্রাণ। মকর এর বাহন। তার হাতে থাকে ধনুর্বাণ। তার ধনুকটি ইক্ষুনির্মিত এবং সেই ধনুকের গুণটি মৌমাছি দিয়ে তৈরি। তার বাণ পাঁচ প্রকারের সুগন্ধী পুষ্পনির্মিত।[৯][১০] এই পাঁচ প্রকার পুষ্প হল : অশোক, শ্বেত ও নীল পদ্ম, মল্লিকা ও আম্রমঞ্জরী। ভারতের উত্তরপ্রদেশের মথুরা সংগ্রহশালায় একটি প্রাচীন পোড়ামাটির কামদেব মূর্তি রক্ষিত আছে।[১১]

পৌরাণিক উপাখ্যান সম্পাদনা

ঋগ্বেদঅথর্ববেদের বিভিন্ন শ্লোক থেকে কামদেব সংক্রান্ত নানা চিত্র ও কাহিনি পাওয়া যায়। যদিও বিভিন্ন পুরাণে বর্ণিত তার প্রধান ও অপ্রধান উপাখ্যানগুলোই অধিক পরিচিত।[৯]

কামদেবের জন্মকাহিনি বিভিন্ন পুরাণে বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে।[১২] কোনো কোনো উপাখ্যানে বলা হয়েছে যে তিনি সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার মন থেকে জাত হন।[১৩] অন্যমতে, তিনি দেবী শ্রীর পুত্র। কখনও কখনও কামদেব ইন্দ্রের সেবায় সম্পূর্ণ নিয়োজিতপ্রাণ এক দেবতার রূপে চিত্রিত হন।[১৪] তার স্ত্রী রতি। রতি মৃণালায়ত বাহুযুক্তা এবং চক্র ও পদ্মধারিণী।[১৫] কামদেব সংক্রান্ত একাধিক প্রাচীন নাটকের একটি অপ্রধান চরিত্র হলেন রতি। তার মধ্যেও প্রেমের দেবতার কিছু কিছু গুণ বিদ্যমান।[১৬] দেবী বসন্ত সর্বদা কামদেবকে সঙ্গ দেন। তবে তিনি হতাশার দীর্ঘশ্বাস থেকে উৎসারিত হন; রতির মতো বাসনা থেকে নয়।[১৭] কামদেব বিভিন্ন পৌরাণিক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। যোদ্ধা হিসেবে তার সেনাদলেরও প্রয়োজন পড়ে।[১৮]

মৎস্যপুরাণ অনুসারে, বিষ্ণু-কৃষ্ণ এবং কামদেবের মধ্যে একটি ঐতিহাসিক সম্পর্ক বিদ্যমান।[১০] গৌড়ীয় ঐতিহ্যে কৃষ্ণ কখনও কখনও কামদেবরূপে পূজিত হন। কৃষ্ণকেন্দ্রিক গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মে মনে করা হয়, শিব কর্তৃক ভস্মীভূত হওয়ার পর কামদেব বাসুদেব কৃষ্ণের অংশে পরিণত হন। এই রূপে কামদেব স্বর্গীয় উদ্ভিদের উপদেবতা; যিনি দৈহিক কামনা উজ্জীবনে সক্ষম। এই রূপে কামদেব কৃষ্ণের স্ত্রী রুক্মিণীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করে প্রদ্যুম্ন নাম ধারণ করেন। যদিও কেউ কেউ মনে করেন ইনি বিষ্ণু শ্রেণির প্রদ্যুম্ন নন। তাই বৈষ্ণবগণ তাকে জীবতত্ত্ব শ্রেণি থেকে সম্ভূত মনে করেন। যদিও উপদেবতারূপে নিজের বিশেষ শক্তি প্রদর্শন করে তিনি বিষ্ণু শ্রেণির প্রদ্যুম্নের অংশীভূত হয়েছেন। ষড়গোস্বামীদের মতে, কামদেব শিবের ক্রোধে ভস্ম হয়ে বাসুদেবের শরীরের অংশীভূত হন। পরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন রুক্মিণীর গর্ভে। এই কারণে মনে করা হয়, তিনি যেহেতু কৃষ্ণের ঔরসে জাত, সেহেতু তার মধ্যে কৃষ্ণের গাত্রবর্ণ, চেহারা ও গুণাবলি প্রকট।[১৯]

 
কামদেব

উপদেবতারূপে কামদেবের বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ : তার সঙ্গীরা হল একটি কোকিল, একটি পারাবত, ভ্রমরের দল, বসন্ত ঋতু ও মলয় বাতাস। এগুলো সবই বসন্তের প্রতীক। কামদেবের উৎসব হল হোলি, হোলিকা বা বসন্ত।

শিবপুরাণ মতে, কামদেব সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার পুত্র। স্কন্দপুরাণ সহ অন্যান্য সূত্রের মতে, কামদেব প্রসূতির ভ্রাতা; তারা দুজনেই ব্রহ্মাসৃষ্ট শতরূপার সন্তান। পরবর্তীকালের প্রক্ষিপ্তাংশ থেকে জানা যায় যে তিনি বিষ্ণুর পুত্র।[২০] তবে সকল সূত্র এই ব্যাপারে একমত যে তিনি প্রসূতিদক্ষের কন্যা রতিকে বিয়ে করেছিলেন।

পূজা সম্পাদনা

কামদেব গায়ত্রী মন্ত্র

ক্লীং কামদেবায় বিদ্মহে পুষ্পবাণায় ধীমহি তন্নোহনঙ্গ প্রচোদয়াৎ ।।

কামদেব পূজা মন্ত্র

ক্লীং কামদেবায় নমঃ ।

আরও দেখুন সম্পাদনা

পাদটীকা সম্পাদনা

  1. "History of Dharmaśāstra" 
  2. Sanford, A.W. (২০০৫)। "Shifting the Center: Yak&sdotu; as on the Margins of Contemporary Practice"। Journal of the American Academy of Religion73 (1): 89–110। ডিওআই:10.1093/jaarel/lfi005 
  3. মহাদেব কর্তৃক ভস্মে পরিণত হওয়ায় এর নাম 'অনঙ্গ'।
  4. মহাদেবের দর্প চূর্ণ করেছিলেন বলে নাম 'কন্দর্প'।
  5. Edgerton, F. (১৯১২)। "A Hindu Book of Tales: The Vikramacarita"American Journal of Philology33 (3): 249–284। ডিওআই:10.2307/288995। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৭-০৬ 
  6. Monier-Williams Sanskrit-English Dictionary
  7. ব্রহ্মা ও অন্যান্য মুনিদের চিত্ত মথিত করেছিরেন বলে নাম 'মন্মথ'।
  8. জগতের সকল লোককে মত্ত করতেন বলে এর নাম 'মদন'।
  9. "A study of Kamadeva in Indian story literature"। ২০০৯-০১-১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৭-০৬ 
  10. Sanford, A.W. (২০০২)। "Painting words, tasting sound: visions of Krishna in Paramanand's sixteenth-century devotional poetry"। Journal of the American Academy of Religion70 (1): 55–81। ডিওআই:10.1093/jaar/70.1.55 
  11. History of Indian Theatre By M. L. Varadpande. p.188. Published 1991, Abhinav Publications, আইএসবিএন ৮১-৭০১৭-২৭৮-০.
  12. Benton 2006, p. 23
  13. Benton 2006, p. 36
  14. Benton 2006, p. 44
  15. Benton 2006, p. 31
  16. Benton 2006, p. 32
  17. Benton 2006, p. 33
  18. Benton 2006, p. 34
  19. Prabhupada, A.C.B.S. (১৯৭২)। Kṛṣṇa, the Supreme Personality of Godhead। পৃষ্ঠা Ch. 55: Pradyumna Born to Kṛṣṇa and Rukmiṇī। 
  20. The Book of Hindu Imagery: Gods, Manifestations and Their Meaning By Eva Rudy Jansen p. 93

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  • Benton, Catherine (২০০৬), God of desire: tales of Kamadeva in Sanskrit story literature, Albany, N.Y: State University of New York Press, পৃষ্ঠা 236, আইএসবিএন 0-7914-6565-9 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা