হোসেন আলী তালুকদার
মোঃ হোসেন আলী তালুকদার (১ জুলাই ১৯৪০ – ১ জুলাই ২০২২) একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ‘‘সৈনিক’’ পদে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর সাহসিকতা পূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ‘‘বীর প্রতীক’’ খেতাবে ভূষিত করেন।[২]
মো: হোসেন আলী তালুকদার | |
---|---|
জন্ম | চর দশসিকা, কামারখন্দ, সিরাজগঞ্জ, ব্রিটিশ ভারত | ১ জুলাই ১৯৪০
মৃত্যু | ১ জুলাই ২০২২ শহীদ এম. মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ, সিরাজগঞ্জ, বাংলাদেশ[১] | (বয়স ৮২)
আনুগত্য | পাকিস্তান (১৯৭১ পর্যন্ত) বাংলাদেশ (১৯৭১ থেকে) |
সেবা/ | পাকিস্তান সেনাবাহিনী (১৯৫৮ – ১৯৭১) বাংলাদেশ সেনাবাহিনী (১৯৭১ – ১৯৮৩) |
কার্যকাল | ১৯৫৮-১৯৮৩ |
পদমর্যাদা | সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার |
ইউনিট | ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট |
যুদ্ধ/সংগ্রাম | |
পুরস্কার | বীর প্রতীক |
দাম্পত্য সঙ্গী | সুফিয়া বেগম |
সন্তান | মোঃ মোহসীন আলী তালুকদার, মোঃ শাহ আলম তালুকদার, সালেহা পারভীন, দিলারা পারভীন |
ব্যক্তি জীবন
সম্পাদনাহোসেন আলী তালুকদার ১৯৪০ সালের ১ জুলাই সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দ থানার চরদশসিকা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৮ সালের জুলাই মাসে তিনি তার ফুফাতো বোন ডাঃ আনিছুর রহমানের বড় কন্যা সুফিয়া বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৭০ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে তাদের প্রথম সন্তান মোঃ মোহসীন আলী তালুকদার এর জন্ম। তার বাকি তিন সন্তান হলেন- মোঃ শাহ আলম তালুকদার, সালেহা পারভীন এবং দিলারা পারভীন।
কর্ম জীবন
সম্পাদনাহোসেন আলী তালুকদার ১৯৫৮ সালের জুলাই মাসের শেষের দিকে সিরাজগঞ্জ জেলা স্টেডিয়াম হতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে নির্বাচিত হন। অতঃপর একই বছর ১৮ অক্টোবর প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম সেনানিবাসস্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যোগদান করেন। সেখান থেকে ৬ মাসের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে কুমিল্লা সেনানিবাসে ১ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করেন।
১৯৬৩ সালে ১ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে কুমিল্লা সেনানিবাস হতে পশ্চিম পাকিস্তানের বারনু সেনানিবাসে বদলী করা হয়। ১ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত থাকায় তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে গমন করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের বারনু সেনানিবাস থেকে পরবর্তীতে লাহোর সেনানিবাসে বদলি হয়ে আসেন। লাহোর সেনানিবাসে অবস্থান কালে ১৯৬৫ সালের ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
হোসেন আলী তালুকদার এ যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের কছুর শহরের সীমান্ত পাঞ্জাবের খেমকারান সেক্টরে সম্মুখ যুদ্ধে ১ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। এই যুদ্ধে ১ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট জয় করে সর্বোচ্চ সংখ্যক বীরত্বপূর্ণ সামরিক খেতাব। এসময় তার ব্যাটালিয়ান অধিনায়ক ছিলেন লেঃ কর্নেল এ টি কে খায়রুল হক। তিনি চাটাওয়ালা গ্রাম বেদিয়া হেড ১ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আলফা কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন। এ সময় কোম্পানী কমান্ডার ছিলেন জিয়াউর রহমান। আলফা কোম্পানী ১৩টি সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে সাহসিকতার সাথে যুদ্ধের পাশাপাশি একটি ভারতীয় ট্যাংক দখল করতে সক্ষম হয়। সিপাহী জয়নাল ও সিপাহী হারুন-অর-রশিদ নামে দুই সৈনিক গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। যুদ্ধ শেষে ব্যারাকে ফিরে তিনি আবার নিয়মিত সৈনিক জীবনে ফিরে আসেন।
বারনু সেনানিবাস থেকে রাওয়ালপিন্ডি লাহোর হয়ে ১৯৬৬ সালে ১ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পূর্ব পাকিস্তানের যশোর সেনানিবাসে বদলী হয়ে আসে। ইতঃমধ্যে তিনি হাবিলদার (বর্তমান সার্জেন্ট) পদে পদোন্নতি লাভ করেন। যশোর সেনানিবাসে তার কর্মজীবনের সবচেয়ে ঘটনাবহুল সময় অতিবাহিত হয়েছে। এখানে কর্মরত থাকাকালেই তিনি জাতির সবচেয়ে গৌরবউজ্জ্বল ইতিহাস ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান
সম্পাদনা১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষনে বাঙালী সৈনিক ও সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয় যে আমরা আর পাকিস্তানি শাসনের অধীনে থাকবো না।
বাঙালী জাতী এবার তাদের প্রাপ্য অধিকার আদায় করে নেবে। হোসেন আলী তালুকদারসহ সব দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকগন শুধুমাত্র নির্দেশের অপেক্ষায় ছিলেন।
এর মধ্যে ১ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে যশোরের চৌগাছায় জগদীশপুরে সেনাবাহিনীর নিয়মিত প্রশিক্ষণের জন্য ফিল্ড ট্রেনিং এ পাঠিয়ে দেয়া হয়। এদিকে ২৫ মার্চ কাল রাত্রে বাঙালীর কন্ঠরোধে ঘৃন্য বর্বরোচিত গনহত্যা শুরু হয়। ১ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ফিল্ড ট্রেনিংয়ে ব্যস্ত থাকায় এ ঘটনা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে থেকে যায়। অন্ধকারে থেকে যায় না বলে তাদের সুকৌশলে অন্ধকারে রাখা হয় বলা ভালো। তখন ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়ান অধিনায়ক ছিলেন লেঃ কর্নেল রেজাউল জলিল। তিনি অন্যান্য বাঙ্গালী অফিসারদের অনুরোধ উপক্ষো করে সৈনিকদের গনহত্যা সম্পর্কে জানতে দেননি। তার নিস্ক্রিয় ভূমিকার সুযোগে ১ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে কৌশলে যশোর সেনানিবাসে ফিরিয়ে আনা হয়। শুধুমাত্র পদোন্নতির লোভে দেশ মাতার সাথে বেইমানী করে লেঃ কর্নেল রেজাউল জলিল ১ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সকল অফিসার ও সৈনিকদের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে বলিদান করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানি শোষকদের সেই দোষরের মনোবাসনা পূরণ হতে দেয়নি দেশপ্রেমিক ১ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকেরা। তারা ঘটনা আচ করতে পেরে সাহসিকতার সাথে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং বিদ্রোহ করে। ৩০ মার্চ সকালে বাঙালী সৈনিকদের নিরস্ত্র করা হলে গনহত্যা ও তাদের হত্যার ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে সৈন্যরা জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে অস্ত্রাগার লুট করে আত্নরক্ষামূলক পজিশন নেয়। এসময় ২৫ বেলুচ রেজিমেন্ট ও ২২ ফ্রন্টিয়ার্স তিন দিক থেকে আক্রমণ শুরু করলে বাঙালী সৈন্যরা দৃঢ়তা ও দক্ষতার সাথে তাদের প্রতিহত করে।
লেঃ কর্নেল রেজাউল জলিল নেতৃত্ব দানে অস্বীকার করেন এবং তার অফিসেই বসে থাকেন। এসময় ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন এবং লেঃ আনোয়ার বাঙ্গালী সৈনিকদের নেতৃত্ব গ্রহণ করে পাকসেনাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকেন। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত পাকসেনাদের একের পর এক আক্রমণ বীর বাঙ্গালী সৈনিকেরা দৃঢ়তার সাথে প্রতিহত করতে থাকে। বারবার আক্রমনে ব্যর্থ হয়ে পাকবাহিনী মর্টার সাপোর্টে আবার আক্রমণ শুরু করে। পাকবাহিনী ঘেরাওয়ের মধ্যে প্রতিরোধহীন মৃত্যুর চেয়ে এখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে যুদ্ধ করাই শ্রেয়। এজন্য চৌগাছায় একত্রিত হবার লক্ষ্যে বাঙালী সৈন্যরা ছোট ছোট গ্রপে বিভক্ত হয়ে কাভারিং ফায়ারের সাহায্যে বেরিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়া সেই সময় কাভারিং ফায়ার দিচ্ছিলেন লেঃ আনোয়ার সহ আরও বেশ কয়েকজন সাহসী মুক্তিসেনা। ঘেরাও থেকে সবাই বের হতে পারলেও পাক সেনাদের বুলেটের আঘাতে শহীদ হন লেঃ আনোয়ার। পাকবাহিনীর সাথে এই প্রতিরোধ যুদ্ধে সুবেদার মোজাম্মেল হক, সুবেদার রোকনুদ্দিন, হাবিলদার আজিজ, হাবিলদার নুর মোহাম্মদ সহ আরোও বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত বরন করেন। পরবর্তীতে হোসেন আলী তালুকদার সহ অন্যান্য বাঙালী সৈনিকরা চৌগাছায় সীমান্ত বিওপি মাসলিলায় অবস্থান নেন এবং ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর সহায়তায় বিস্ফোরক সংগ্রহ করে বেশ কিছু ব্রিজ, কালভার্ট ধ্বংস করে দেন। পাশাপাশি বিভিন্ন্ স্থানে রেইড-অ্যামবুশ ও আক্রমণ পরিচালনা করে হত্যা করেন বেশ কিছু পাকসেনা। ২১ এপ্রিল রাতে নাভারন বাজারে পাকবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের উপর আক্রমণ চালিয়ে শক্র পক্ষের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করতে সমর্থ হন। ২৩ এপ্রিল মুক্তিবাহিনীর কাগজ পুকুর অবস্থানের উপর পাকসেনারা আক্রমণ চালায় । অধিনায়ক ক্যাপ্টেন হাফিজের দৃঢ়তায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পাকবাহিনী ফিরে যেতে বাধ্য হয়। ১৮ মে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতির নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধারা বেনাপোল এলাকায় চলে যায়। সেখানে ইয়ুথ ক্যাম্পের মাধ্যমে ৬০০ জনকে রিক্রুটে সহায়তা করে। সেখানে থেকে মে মাসের শেষের দিকে মুক্তিযোদ্ধারা মেঘালয়ের তেলঢালায় চলে যায়। জুলাই মাস পর্যন্ত সেখানে অবস্থানের পর জেড ফোর্সে যোগদান করেন।
জেড ফোর্সে যোগদানের পর হোসেন আলী সহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা দমদম বিমানবন্দর দিয়ে মাইনকার চড়ে এসে উপস্থিত হন। সেখানে ১ম, ২য় ও ৮ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট একত্রিত হয়। ৩১ জুলাই ইতিহাস বিখ্যাত ধানুয়া কামালপারের যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
৩১ বেলুচ রেজিমেন্টের ২টি কোম্পানী তখন কামালপুরে ঘাটি গেড়ে অবস্থান করছিল। মেজর জিয়া পাকসেনাদের দূর্ভেদ্য ঘাটি কামালপুর আক্রমনের জন্য মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরীকে নির্দেশ দেন। পাক হানাদার বাহিনীর উপর আক্রমনের জন্য পরিকল্পনা অনুযায়ী রাত ৩.৩০ ঘটিকায় মুক্তিযোদ্ধারা কামালপুরের উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করে। বৃষ্টি আর ঘন অন্ধকারের কারনে এফইউপিতে পৌছাতে বিলম্ব হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী আক্রমণ শুরু হতেও বিলম্ব হয়। বৈরী পরিবেশ এবং নির্দেশনার বিষয়াদী আদান প্রদানে ব্যাঘাত সৃষ্টি হওয়ায় এসল্ট ফরমেশনের আগেই শক্র বাহিনী এমনকি নিজ বাহিনীর আর্টিলারির গোলা মুক্তিবাহিনীর উপর এসে পড়তে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে হতাহতের ঘটনা ঘটতে থাকে। বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে শুরু করে। আক্রমনের গতি ধীর হয়ে আসতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর পজিশনের ডানে অবস্থানে করছিল বি কোম্পানী আর বামে ডি কোম্পানী। বি কোম্পানীর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন হাফিজ। বি কোম্পানীর ৪নং প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন হোসেন আলী তালুকদার। ডি কোম্পানীর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ। ওয়ারলেস যোগাযোগের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনী নিজেদের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে প্রচন্ড শক্তিতে ঝাপিয়ে পড়ে পাক হানাদার বাহিনীর উপর। এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবতারনা হয়। বেশ কজন মুক্তিযোদ্ধা শক্র ক্যাম্পে ঢুকে পড়তে সমর্থ হয়। হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় কমিউনিটি সেন্টারের সামনে। অবস্থা বেগতিক দেখে পিছু হটতে বাধ্য হয় পাকহানাদার বাহিনী আর তাদের দেশীয় রাজাকার দোসররা। শক্রর আর্টিলারি গোলার আঘাতে ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদের হাতে থাকা স্টেনগান উড়ে যায় এবং তিনি আহত হয়ে পিছনে চলে যান। হোসেন আলী তালুকদার তার প্লাটুন নিয়ে বীরদর্পে যুদ্ধ করছিলেন। তার পজিশনের পাশেই শক্রর ছোড়া শেলের আঘাতে প্রান হারান ৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান তিনি। এই যুদ্ধে ৩০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। আহত হন ৬৯ জন বীর বাঙ্গালী সন্তান। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন ডি কোম্পানী কমান্ডার ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ। আহতদের মধ্যে ছিলেন সিপাহী রবিউল, সিপাহী জাহাঙ্গীর, ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহাম্মদ, মেজর মান্নান, ইউঃকমন্ডার লিয়াকত আলীসহ আরো অনেকে অতঃপর মুক্তিযোদ্ধারা মিলিটারী কনভয়ে শিলং হয়ে ভারতের আগরতলায় পৌছায়। আগরতলা গিয়ে ক্যাম্প করলেন মুক্তিযোদ্ধারা। আগরতলা ক্যাম্প থেকে নিয়মিত বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গল ও মৌলভীবাজারে পাকবাহিনীর অবস্থানের উপর গেরিলা আক্রমণ অব্যাহত থাকে। এসময় যেসব যুদ্ধে হোসেন আলী তালুকদার সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ১৯ অক্টোবর চম্পারায় চা ফ্যাক্টরি রেইড, ২৮ অক্টোবর পাত্রখোলা চা ফ্যাক্টরী আক্রমণ ও ১ নভেম্বর ধলাই বিওপি আক্রমন। এছাড়া ২৮ নভেম্বর,৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের আক্রমণ প্রতিরোধ করে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে।
পরবর্তীতে ইউনিট কমান্ডার মেজর জিয়া উদ্দিনের নেতৃত্বে ভারতের করিমগঞ্জ, বাংলাদেশের জকিগঞ্জ- তামাবিল হয়ে মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থান কালে মিত্র বাহিনীর রসদ সরবরাহের কথা থাকলেও তিন ৩ দিন পর্যন্ত তা সম্ভবপর হয়নি। এই ৩ দিন গাছের পাতা, কলার মুচি, কাঁচা চাল খেয়ে জীবনযাপন করতে হয়েছে হোসেন আলীসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের। এমনকি ক্ষুধার তাড়নায় একবার ফার্মের একটি গরু জবাই করে কোন প্রকার মসলা ছাড়া আধাসিদ্ধ করে খেতে হয়েছিল। বোয়ামপুর কানাইঘাটে মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকহানাদার বাহিনীর তুমুল যুদ্ধ হয়। মুক্তিবাহিনী ১৩ জন পাক সেনাকে আটক করে। পরে তাদের ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারে হস্তান্তর করা হয়। বি এস এম আব্দুল হাকিমসহ বেশ কজন মুক্তিযোদ্ধা মিলে রাজাকারদের একটি দলকে আটক করে। কিন্ত তাদের নিয়ে ফেরার পথে পাকিস্তানি শেলের আঘাতে আব্দুল হাকিমসহ তার সাথে থাকা প্রায় সব মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত বরন করেন।
১৪ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে হোসেন আলী সিলেট এম,সি কলেজের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। উদ্দ্যেশ্য ছিল এম,সি কলেজে পাকববাহিনীর ঘাটি দখল করা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শক্ত প্রতিরোধ বুহ্যের অবস্থান করছিল। মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর প্রতিরোধ ভাঙ্গার জন্য পানির ট্যাংকির কাছে অবস্থান নেয়। মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে পাকবাহিনী প্রচন্ড গুলি বর্ষণ শুরু করে। মুক্তিসেনারাও বীরদর্পে পাল্টা জবাব দিতে থাকে। প্রচন্ড সে যুদ্ধে ৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত বরন করে। তাদের সিলেট এম,সি কলেজের পাশেই সমাহিত করা হয়। ১৯ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। আহতদের মধ্যে ছিলেন হাবিলদার নুরুল হক, সিপাহী নুর নবী, সিপাহী ছাইদুল সহ আরো অনেকে। সুবেদার ফয়েজ আহমেদসহ কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হেভী মেশিনগান পরিচালনা করছিল। তারা সবাই শাহাদত বরন করেন। মুক্তিবাহিনী পজিশন উইড্রো করার সময় ক্যাপ্টেন হাফিজ হোসেন আলীকে ডেকে বলেন, হোসেন এই অস্ত্রটা রেখে গেলে চলবে না, এটা আমাদের নিয়ে যেতে হবে। মেশিনগানটি আনার এজন্য প্রয়োজন ছিল যে, এ ধরনের অস্ত্র মুক্তিবাহিনীর কাছে খুবই কম ছিল। প্রচন্ড সে যুদ্ধের মধ্যে হোসেন আলী, হাবিলদার হেলাল উদ্দিন এবং নায়েক আফসার কে সাথে নিয়ে মেশিগানটি আনার জন্য অগ্রসর হতে থাকেন। বলে রাখা ভালো মেশিনগানটির ওজন ছিল প্রায় ৮৯ কেজি। কিছু দুর যাওয়ার পর নায়েক আফসার গুলিবিদ্ধ হয়। প্রচন্ড গোলাগুলির মধ্যে হাবিলদার হেলালও হোসেন আলীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দুই পক্ষের গোলাগুলির মাঝখানে চোখ তুলে তাকানোর মতো অবস্থা ছিল না। এ অবস্থায় হোসেন আলী ব্যাংকারে গিয়ে দেখেন সুবেদার ফয়েজ সহ অন্যান্যদের রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে। সে এক বিভৎস বর্ননাতীত দৃশ্য। সেসব পাশ কাটিয়ে ৮৯ কেজি ওজনের সেই হেভিওয়েট, মেশিনগানটি কাঁধে তুলে নেন তিনি। নিজের দলের দিকে আবার ফিরে আসতে থাকেন। পাকিস্তানিরা তাকে দেখতে পেয়ে তার দিকে গুলিবর্ষন করতে থাকে এবং তাকে ধরার জন্য অগ্রসর হতে থাকে। হোসেন আলী কে সাহায্যকারী দুজন সহযোদ্ধা আগেই ঘায়েল হয়েছেন। তদুপরি তিনি একা হেভিওয়েট মেশিনগানটি নিয়ে প্রানপনে তার দলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ইতিমধ্যে মুক্তিবাহিনী দূরে ছোট টিলার পিছনে অবস্থান নেয়। পাকবাহিনী তাকে ধরার জন্য গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে আসে। তার চারপাশে গাছের পাতা ঝরে পড়ছিল গুলির আঘাতে। সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে শক্রর গুলির আঘাতে ঘায়েল না হয়েই হোসেন আলী তার দলের জন্য হেভিমেশিগানটি উদ্ধারে সমর্থ হন। হোসেন আলী কে দেখতে পেয়ে ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। আর বলেন,‘‘হোসেন তুই বেঁচে আছিস! আমরা মনে করছি পাকবাহিনী তোকে ধরে নিয়ে গেছে কিংবা তুই মারা গেছিস।’’
পাকবাহিনী আত্নসমর্পনের পর হবিগঞ্জে কিছুদিন অবস্থানের করে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার দেবার জন্য অন্য সেনাসদস্যদের সাথে হোসেন আলী ঢাকায় আসেন। বনানী চেয়ারম্যান বাড়ী সেনানিবাসে অবস্থান করেন।
পুরস্কার
সম্পাদনামুক্তিযুদ্ধে তার সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে "বীর প্রতীক" খেতাবে ভূষিত করে।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "জন্মদিনের দিনই চলে গেলেন বীর প্রতীক"। সময়ের আলো। ১ জুলাই ২০২২। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জানুয়ারি ২০২২।
- ↑ ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত বাংলাদেশ সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত গেজেট, গেজেট নং-৮/২৫/ডি-১/৭২-১৩৭৮