হিন্দু জাতীয়তাবাদ

ভারতীয় জাতীয়তাবাদ

হিন্দু জাতীয়তাবাদ বলতে বোঝায় ভারতের দেশীয় আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক প্রথা ও রীতিনীতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তাধারার এক সামগ্রিক অভিপ্রকাশ। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন 'হিন্দু রাষ্ট্র' অর্থে 'হিন্দু জাতীয়তাবাদ' শব্দটি একটি সরল অনুবাদ; তাই 'হিন্দু রাষ্ট্রসমাজ' (Hindu polity) শব্দটির মাধ্যমেই এই ধারণাটি অধিকতর পরিস্ফুট হয়।[]

ভারতের ইতিহাসের নানা পর্বে ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার নিজস্ব পরিচিত সৃষ্টির ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল এদেশের দেশীয় চিন্তাধারা।[] এই চিন্তাধারা থেকেই ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে ভারতবাসীর মনে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়।[] ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের উদ্দেশ্যে সংঘটিত সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম,[] অহিংস আন্দোলন[] এবং সকল প্রকার শক্তিশালী রাজনৈতিক চেতনা[] এই দেশীয় চিন্তাধারা থেকেই অনুপ্রেরণা লাভ করে।

উত্তর-মার্ক্সীয় পাশ্চাত্য বুদ্ধিজীবী মহলে 'জাতীয়তাবাদ' শব্দটির সঙ্গে যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি জড়িত আছে, ভারতে সেরকম কিছু দেখা যায় না। বরং এই শব্দটি এদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার উচ্ছেদের লক্ষ্যে সংঘটিত স্বাধীনতা আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।[]

ইতিহাস

সম্পাদনা
 
সম্রাট কৃষ্ণদেবরায়; ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্রাট যিনি "হিন্দুরায় সুরতন" নামে নন্দিত ছিলেন
 
শিবাজীর শাসনকে বলা হত "হিন্দভি স্বরাজ্য" (দেশীয়দের স্বরাজ্য)

"হিন্দু" শব্দটির উৎপত্তি ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত সিন্ধু নদের ফার্সি নাম থেকে। খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে আরব, পারসিক ও আফগানরা উক্ত অঞ্চলের অধিবাসীদের প্রথম "হিন্দু" নামে অভিহিত করে।[] মধ্যযুগীয় ভারতের ঐতিহাসিক বিবরণীগুলি থেকে দেশীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার বর্ণনায় "হিন্দু" শব্দটির প্রয়োগের কথা জানা যায়। এই সব রচনা থেকে প্রমাণিত হয়, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদের পূর্বাবধি "হিন্দু" শব্দটি ধর্মের বদলে দেশীয় জনগণ অর্থেই অধিকতর প্রযোজ্য ছিল।[]

খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সঙ্গম রাজারা ছিলেন দাক্ষিণাত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হিন্দু শাসকগোষ্ঠী। এঁরা "হিন্দুরায় সুরতন" (হিন্দু শাসকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম) নামে অভিহিত ছিলেন।[১০] সঙ্গম শাসকরা বিজাপুর সুলতানির বিরুদ্ধে উপর্যুপরি সংঘাতে লিপ্ত হন। এই সময় তাদের উপাধির "হিন্দু" শব্দাংশটি স্থানীয় শাসক হিসেবে তাদের স্বতন্ত্র এক পরিচিতি দান করে। কারণ সুলতানদের "বিদেশি বংশোদ্ভূত মনে করা হত"। কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন "হিন্দুরা" শুধুমাত্র বিদেশি শাসনের বিরোধিতা করা ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে নিজেদের একক ধর্মীয় সত্তার কথা কল্পনা করেনি। উদাহরণ স্বরূপ, সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে রচিত তেলুগু "রায়বচকমু" গ্রন্থে মুসলমান শাসকদের নিন্দা করা হয়েছে মুখ্যত বিদেশি ও বর্বর শাসক হিসেবে এবং গৌণত মুসলমান শাসক হিসেবে।[১১]

পদ্মনাভ রচিত "কাহ্নবাদে-প্রবন্ধ" মহাকাব্যে জালোরের চৌহান নায়কদের "হিন্দু" বলে গৌরবান্বিত করা হয়েছে। এই কাব্যের রচনাকাল ১৪৫৫ খ্রিষ্টাব্দ। মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আপোসহীন সংগ্রামের জন্য রাজপুত শাসক মহারাণা প্রতাপ "হিন্দু-কুল-কমল-দিবাকর" উপাধিতে ভূষিত হন।[১২] সপ্তদশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক শিবাজীর শাসনের আদর্শ ছিল "হিন্দভি স্বরাজ্য"; মারাঠি ভাষায় যার অর্থ "হিন্দুদের স্বরাজ্য"। তবে এই "হিন্দভি" শব্দটির ভারতীয়দের স্বাধীনতার পন্থা হিসেবেই প্রযোজ্য ছিল; কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠীর শাসন হিসেবে নয়।[]

ঊনবিংশ শতাব্দীর হিন্দু নবজাগরণ

সম্পাদনা

অধিকাংশ হিন্দু সংস্কার আন্দোলনেরই সূত্রপাত হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে। এই সকল আন্দোলনে প্রাচীন উপনিষদ ও বেদান্ত শাস্ত্রের এক নূতনতর ব্যাখ্যা প্রদত্ত হয় এবং মনোযোগ দেওয়া হয় সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে।[] এই সকল আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ভারতের তদনীন্তন ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের পাশ্চাত্য শ্রেষ্ঠত্ব ও শ্বেতাঙ্গ প্রাধান্যের ধারণাকে খর্ব করা। এবং এই চেতনা থেকেই একটি দেশাত্মবোধক চেতনার সৃষ্টি হয়; যা থেকে জন্ম নয় স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক আদর্শের।[]

 
রাজা রামমোহন রায় প্রাচীন ঔপনিষদিক গ্রন্থগুলি থেকে একটি আধুনিক যুক্তিবাদী ভারতের চিত্রকল্প কল্পনা করেন।

ব্রাহ্মসমাজ

সম্পাদনা

ব্রাহ্মসমাজ ছিল ব্রিটিশ ভারতের প্রথম যুগের হিন্দু সংস্কার আন্দোলনগুলির অন্যতম। বাঙালি সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় এই আন্দোলনের সূচনা করেন। রামমোহন রায় প্রাচীন ঔপনিষদিক গ্রন্থগুলি থেকে একটি যুক্তিবাদী 'আধুনিক' ভারতের রূপকল্প অঙ্কণ করেছিলেন। তিনি সনাতন হিন্দুধর্মের পৌত্তলিকতা ও আনুষ্ঠানিকতার তীব্র বিরোধিতা করে একটি একেশ্বরবাদী ধর্মমত প্রচার করেন। তবে তিনি মূলত জোর দেন সমাজ সংস্কারের উপর। তিনি জাতিভেদ প্রথার বিপক্ষে ও নারীর সমানাধিকারের সপক্ষে লড়াই করেন।[১৩] তবে ব্রাহ্মরা ব্রিটিশ সরকার ও উচ্চশিক্ষিত হিন্দু সমাজের দাক্ষিণ্য লাভে সমর্থ হলেও, তাদের বৈদান্তিক মতবাদ ও একেশ্বরবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সাধারণ জনমানসে আলোড়ন সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়। তবে প্রাচীন ভারতীয় ধর্মগ্রন্থগুলি সম্পর্কে যুক্তিবাদী ব্যাখ্যাপ্রদান ও হিন্দু আধ্যাত্মিকতার শৃঙ্খলায়ণে তাদের অবদান ছিল অনস্বীকার্য।[]

আর্যসমাজ

সম্পাদনা

আর্য সমাজ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগের অন্যতম প্রধান হিন্দু সংস্কার আন্দোলনের নাম। আর্যসমাজের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী পৌত্তলিকতা, বর্ণভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা ও বাল্যবিবাহের বিরোধিতা করেন এবং নারীর সমমর্যাদার সপক্ষে মত প্রকাশ করেন। তিনি যতটা ইসলাম ও খ্রিষ্টধর্মের বিরোধী ছিলেন, ততটাই বিরোধী ছিলেন ব্রাহ্মণবাদের। তিনি মনে করতেন, বৈদিক জ্ঞানের অপব্যাখ্যার ক্ষেত্রে প্রধানত ব্রাহ্মণ্যবাদই দায়ী।[] আর্যসমাজ একটি সামাজিক আন্দোলন হলেও রামপ্রসাদ বিসমিল,[১৪] শ্যামজি কৃষ্ণ বর্মা, ভাই পরমানন্দ, লালা লাজপত রায় প্রমুখ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক বিপ্লবী ও রাজনৈতিক নেতা এই মতবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন।[১৫]

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

সম্পাদনা
 
ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের চিত্রণ

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ঊনবিংশ শতকের একজন বিশিষ্ট বাঙালি শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও গদ্যকার। সংস্কৃত ভাষাসাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য সংস্কৃত কলেজ থেকে ১৮৩৯ সালে তিনি বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন।

বিদ্যাসাগর মহাশয় ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক। নারীমুক্তির আন্দোলনেও তার অবদান উল্লেখযোগ্য। বিধবা বিবাহ ও স্ত্রীশিক্ষার প্রচলন, বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক অভিশাপ দূরীকরণে তার অক্লান্ত সংগ্রাম আজও স্মরিত হয় যথোচিত শ্রদ্ধার সঙ্গে। বাংলার নবজাগরণের এই পুরোধা ব্যক্তিত্ব দেশের আপামর জনসাধারণের কাছে পরিচিত ছিলেন ‘দয়ার সাগর’ নামে। দরিদ্র, আর্ত ও পীড়িত কখনোই তার দ্বার থেকে শূন্য হাতে ফিরে যেত না। এমনকি নিজের চরম অর্থসঙ্কটের সময়ও তিনি ঋণ নিয়ে পরোপকার করেছেন‌। তার পিতামাতার প্রতি তার ঐকান্তিক ভক্তি ও বজ্রকঠিন চরিত্রবল বাংলায় প্রবাদপ্রতিম। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন প্রাচীন ঋষির প্রজ্ঞা, ইংরেজের কর্মোদ্যম ও বাঙালি মায়ের হৃদয়বৃত্তি।

বাঙালি সমাজে বিদ্যাসাগর মহাশয় আজও এক প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুরে তার স্মৃতিরক্ষায় স্থাপিত হয়েছে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়। রাজধানী কলকাতার আধুনিক স্থাপত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বিদ্যাসাগর সেতু তারই নামে উৎসর্গিত।

স্বামী বিবেকানন্দ

সম্পাদনা
 
বিশ্বধর্ম মহাসভার মঞ্চে স্বামী বিবেকানন্দ

স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন একজন হিন্দু সন্ন্যাসী, দার্শনিক, লেখক, সংগীতজ্ঞ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় অতীন্দ্রিয়বাদী রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রধান শিষ্য। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রইউরোপে হিন্দুধর্ম তথা ভারতীয় বেদান্তযোগ দর্শনের প্রচারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। অনেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে বিভিন্ন ধর্মমতের মধ্যে পারস্পরিক সুসম্পর্ক স্থাপন এবং হিন্দুধর্মকে বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধর্ম হিসেবে প্রচার করার কৃতিত্ব বিবেকানন্দকে দিয়ে থাকেন। ভারতে হিন্দু পুনর্জাগরণের তিনি ছিলেন অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। সেই সঙ্গে ব্রিটিশ ভারতে তিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ধারণাটি প্রবর্তন করেন। বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ মঠরামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। তার সবচেয়ে বিখ্যাত বক্তৃতাটি হল, "আমেরিকার ভাই ও বোনেরা ...," ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোয় বিশ্ব ধর্ম মহাসভায় প্রদত্ত চিকাগো বক্তৃতা, যার মাধ্যমেই তিনি পাশ্চাত্য সমাজে প্রথম হিন্দুধর্ম প্রচার করেন। রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর বিবেকানন্দ ভারতীয় উপমহাদেশ ভালোভাবে ঘুরে দেখেন এবং ব্রিটিশ ভারতের আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্জন করেন। পরে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের বিশ্ব ধর্ম মহাসভায় ভারত ও হিন্দুধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ডইউরোপে তিনি হিন্দু দর্শনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে অসংখ্য সাধারণ ও ঘরোয়া বক্তৃতা দিয়েছিলেন এবং ক্লাস নিয়েছিলেন। তার রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য চিকাগো বক্তৃতা, কর্মযোগ, রাজযোগ, জ্ঞানযোগ, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বেদান্ত, ভারতে বিবেকানন্দ, ভাববার কথা, পরিব্রাজক, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, বর্তমান ভারত, বীরবাণী (কবিতা-সংকলন), মদীয় আচার্যদেব ইত্যাদি।

ভারতে বিবেকানন্দকে ‘বীর সন্ন্যাসী’ নামে অভিহিত করা হয় এবং তার জন্মদিনটি ভারতে জাতীয় যুব দিবস হিসেবে পালিত হয়।

শ্রীঅরবিন্দ

সম্পাদনা

শ্রী অরবিন্দ বা অরবিন্দ ঘোষ (১৫ আগস্ট ১৮৭২ – ৫ ডিসেম্বর ১৯৫০) ভারতীয় বাঙালি রাজনৈতিক নেতা, আধ্যাত্মসাধক এবং দার্শনিক।[১][২] তার পিতা কৃষ্ণধন ঘোষ এবং মাতামহ রাজনারায়ণ বসু। অরবিন্দ ঘোষ বাল্যকালে ইংল্যান্ডে লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে গমন করেন এবং কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় হতে ট্রাইপস পাস করেন। দেশে ফিরে এসে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার অনুজ বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে বিপ্লবী মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তিনি কংগ্রেসের চরমপন্থী গ্রুপের নেতৃত্বে থাকাকালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে (১৯০৫–১৯১১) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

অরবিন্দ ঘোষ জন্মগ্রহণ করেন কোলকাতায় ৷ তিনি অধুনা পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার কোন্নগর এর প্রাচীন ঘোষবংশের সন্তান৷[৩] তাঁর বাবা কৃষ্ণধন ঘোষ ছিলেন তৎকালীন বাংলার রংপুর জেলার জেলা সার্জন। মা স্বর্ণলতা দেবী, ব্রাহ্ম ধর্ম অনুসারী ও সমাজ সংস্কারক রাজনারায়ণ বসুর কন্যা। সংস্কৃতে "অরবিন্দ" শব্দের অর্থ "পদ্ম"। বিলেতে থাকাকালীন সময়ে অরবিন্দ নিজের নাম "Aaravind", বারোদায় থাকতে "Aravind" বা "Arvind" এবং বাংলায় আসার পর "Aurobindo" হিসেবে বানান করতেন। পারিবারিক পদবির বানান ইংরেজিতে সাধারণত "Ghose" হলেও অরবিন্দ নিজে "Ghosh" ব্যবহার করেছেন।[৪][৫] রংপুরে তার বাবা ১৮৭১ এর অক্টোবর থেকে কর্মরত ছিলেন, অরবিন্দ রংপুরে জীবনের প্রথম পাঁচ বছর পার করেন। ড ঘোষ এর আগে বিলেতের কিংস কলেজে চিকিৎসা শাস্ত্রে লেখাপড়া করেন। তিনি সন্তানদের ইংরেজি পন্থায় এবং ভারতীয় প্রভাবমুক্ত শিক্ষাদানের মনোভাব পোষণ করতেন। তাই ১৮৭৭ সালে দুই অগ্রজ সহোদর মনমোহন ঘোষ এবং বিনয়ভূষণ ঘোষ সহ অরবিন্দকে দার্জিলিংয়ের লোরেটো কনভেন্টে পাঠান হয়।

স্বাধীনতা সংগ্রাম

সম্পাদনা

বিপ্লবী আন্দোলন

সম্পাদনা

ভারতের বিপ্লবী স্বাধীনতা আন্দোলন বা ভারতের স্বাধীনতার বিপ্লবী আন্দোলন বা বিপ্লবী আন্দোলন সাধারণ ভাবে গুপ্ত সমিতি দ্বারা পরিচালিত হতো। এই বিপ্লবী আন্দোলন বাংলা, মহারাষ্ট্র ও পাঞ্জাবে গড়ে উঠেছিল।

অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর

সম্পাদনা

অনুশীলন সমিতি ছিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অনুশীলন তত্ত্বের আদর্শে গঠিত বাংলার একটি সশস্ত্র ব্রিটিশ-বিরোধী সংগঠন।[১][২] মূলতঃ ঢাকা ও কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করে এই দলটি বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে সংগঠিত হয়। তবে কলকাতায় প্রথম অনুশীলন সমিতির আখড়াগুলি ১৯০২ সালেই শুরু হলেও পরবর্তীকালে ঢাকায় তা আরও বিস্তৃত হয়।[৩] অনুশীলন দল ও তার সহযোগী যুগান্তর দল শহরের প্রান্তভাগে ব্যায়ামের আখড়ার আড়ালে থাকা কাজকর্ম চালাত। অনুশীলন দলের উদ্দেশ্য ছিল সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ। অনুশীলন দল রাজনৈতিক ডাকাতি, বোমা তৈরি, অস্ত্র প্রশিক্ষণ, ব্রিটিশ রাজকর্মচারী ও তাদের বিচারে বিশ্বাসঘাতক তকমা-পাওয়া ভারতীয়দের হত্যার কাজে নিযুক্ত ছিল।[৪] বাংলার গ্রামাঞ্চলেও অনুশীলন দলের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। সারা বাংলা ও ভারতের অন্যান্য স্থানেও এর শাখা প্রসারিত হয়েছিল।

বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ১৯০৫ সালে ঢাকায় বিপিনচন্দ্র পালের জ্বালাময়ী বক্তৃতার পরেই ১৯০৬ সালে ঢাকা সরকারি কলেজের শিক্ষক এবং পরবর্তী সময়ে ঢাকা 'ন্যাশনাল স্কুল' এর প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক পুলিনবিহারী দাসের নেতৃত্বে ৮০ জন্য হিন্দু যুবক গঠন করে ঢাকা অনুশীলন সমিতি। অনুশীলন সমিতির প্রতিটি শাখা সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিল, তবে অনুশীলন সমিতির সাথে ঢাকার শাখার প্রতিষ্ঠাতা পুলিনবিহারী দাসের সরাসরি সংযোগ ছিল। ভারতবর্ষের প্রখ্যাত ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকারী যশোরের শচীন্দ্রপ্রসাদ বসু ঢাকা অনুশীলন সমিতির পরিদর্শক ছিলেন।

ইন্ডিয়া হাউস

সম্পাদনা

১৯০৫-১০ সালের ভারতীয় জাতীয়তাবাদী সংগঠন জন্য, ইন্ডিয়া হাউস দেখুন। লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশন হল যুক্তরাজ্যে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের কূটনৈতিক দূতাবাস। এটি লন্ডলের অল্ডউইচে বুশ হাউস ও পূর্বতন মারকোনি হাউসের (অধুনা সিটিব্যাংক ও অস্ট্রেলীয় হাইকমিশন, লন্ডন) মধ্যবর্তী ইন্ডিয়া হাউস-এ অবস্থিত।[১] লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিকস ও কিংস কলেজ লন্ডন ইন্ডিয়া হাউসের সামনে অবস্থিত। ১৯২৫ সালে তদনীন্তন ভারতীয় হাইকমিশনার স্যার অতুলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ইন্ডিয়া হাউস গঠনের প্রস্তাব দেন। স্যার হারবার্ট বেকার এই ভবনটির নকশা প্রস্তুত করেন। ১৯৩০ সালে ইন্ডিয়া হাউসের নির্মাণকার্য সমাপ্ত হয়।[২] ১৯৩০ সালের ৮ জুলাই তৎকালীন রাজা-সম্রাট পঞ্চম জর্জ এই ভবনটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।[২] ভবনটির বাইরের দেওয়ালের সাজসজ্জায় ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের সংস্কৃতি প্রতিফলিত হয়েছে। জন মেজর ১৯৯১ সালে এখানে জওহরলাল নেহেরুর একটি আবক্ষ মূর্তি উন্মোচন করেন।[২] ১৯৮১ সালে এটি একটি গ্রেড টু লিস্টেড বিল্ডিং।[৩]

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস

সম্পাদনা

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের একটি জাতীয় রাজনৈতিক দল। এই দল সাধারণভাবে কংগ্রেস নামে পরিচিত। কংগ্রেস দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলদুটির একটি (অপর দলটি হল ভারতীয় জনতা পার্টি)। এটি একটি ভারতের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক সংগঠন।[১][২][৩] ১৮৮৫ সালে থিওজোফিক্যাল সোসাইটির কিছু "অকাল্ট" সদস্য কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন।[৪] এঁরা হলেন অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম, দাদাভাই নওরোজি, দিনশ এদুলজি ওয়াচা, উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মনমোহন ঘোষ, মহাদেব গোবিন্দ রানাডে ও উইলিয়াম ওয়েডারবার্ন প্রমুখ।[৫] ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতীয় কংগ্রেস নেতৃত্ব দান করেছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা অর্জন করলে, কংগ্রেস দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। সেই থেকে মূলত নেহেরু-গান্ধী পরিবারই কংগ্রেসকে নেতৃত্ব দান করতে থাকেন।

লাল-বাল-পাল

সম্পাদনা

লাল বাল পাল (লালা লাজপত রায়, বাল গঙ্গাধর তিলক, এবং বিপিন চন্দ্র পাল) ১৯০৬ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ব্রিটিশ শাসিত ভারতে জাতীয়তাবাদী ছিলেন।১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময় ১৯০৭ সালে শুরু হওয়া সমস্ত আমদানিকৃত আইটেম বর্জন এবং ১৯০৫ সালে ভারতীয় তৈরি জিনিসপত্র ব্যবহারের সাথে জড়িত স্বদেশী আন্দোলনের পক্ষে তারা সমর্থন জানিয়েছিল।

ভারত বিভাগ

সম্পাদনা

আদর্শগত প্রতিশব্দের উদ্ভব

সম্পাদনা

হিন্দুত্ব ও হিন্দুরাষ্ট্র

সম্পাদনা

সাভারকর

সম্পাদনা

বিনায়ক দামোদর সাভারকর (মারাঠি: विनायक दामोदर सावरकर বিনায়ক দামোদর সাবরকর) (মে ২৮, ১৮৮৩ – ফেব্রুয়ারি ২৬, ১৯৬৬) ।[১][২] লন্ডনে থাকাকালীন সাভারকর ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। সাভারকরকে হিন্দুত্ব রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রবক্তা বলে গণ্য করা হয়। তিনি নাৎসিবাদকে প্রশংসা করেছিলেন।[৩][৪] তিনি দেশদ্রোহী মুসলিমদের বিরোধী এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী আদর্শের প্রবক্তা ছিলেন।[৫] আধুনিক হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলগুলো সাভারকরকে পরম পূজনীয় হিসাবে সম্মান করে থাকে। বীর সাভারকর অভিনব ভারত সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি হিন্দু মহাসভার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি হিন্দু সমাজের কুখ্যাত জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা করেন।

আরও দেখুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. The Hindu Phenomenon by Girilal Jain, আইএসবিএন ৮১-৮৬১১২-৩২-৪
  2. Chatterjee Partha (1986)
  3. Peter van der Veer, Hartmut Lehmann, Nation and religion: perspectives on Europe and Asia, Princeton University Press, 1999
  4. Li Narangoa, R. B. Cribb Imperial Japan and National Identities in Asia, 1895-1945, Published by Routledge, 2003
  5. Vidya Dhar Mahajan, Constitutional history of India, including the nationalist movement, Published by S. Chand, 1971
  6. Chetan Bhatt (2001)
  7. page 21, Elst Koenraad, Decolonizing the Hindu mind, Rupa Co 2001
  8. Origin of Hinduism
  9. On Understanding Islam: Selected Studies, By Wilfred Cantwell Smith, Published by Walter de Gruyter, 1981, আইএসবিএন ৯০-২৭৯-৩৪৪৮-৭, 9789027934482
  10. Carla M. Sinopoli, The political economy of craft production: crafting empire in South India, c. 1350-1650, Published by Cambridge University Press, 2003
  11. Gabriel Palmer-Fernandez, Hinduism Modern, Encyclopedia of religion and war
  12. M. G. Chitkara, Hindutva, Published by APH Publishing, 1997, আইএসবিএন ৮১-৭০২৪-৭৯৮-৫, 9788170247982
  13. Thomas R. Metcalf, A Concise History of India, Cambridge University Press, 2002
  14. Bhagat Singh, Why I am an atheist, Selected Writings of Shaheed Bhagat Singh by Bhagat Singh, Shiv Verma, National Book Centre, 1986
  15. Michael Francis O'Dwyer, India as I knew it, 1885-1925, Published by Constable, 1926

গ্রন্থপঞ্জি

সম্পাদনা
  • Walter K. Andersen. ‘Bharatiya Janata Party: Searching for the Hindu Nationalist Face’, In The New Politics of the Right: Neo–Populist Parties and Movements in Established Democracies, ed. Hans–Georg Betz and Stefan Immerfall (New York: St. Martin’s Press, 1998), pp. 219–232. (আইএসবিএন ০-৩১২-২১১৩৪-১ or আইএসবিএন ০-৩১২-২১৩৩৮-৭)
  • Partha Banerjee, In the Belly of the Beast: The Hindu Supremacist RSS and BJP of India (Delhi: Ajanta, 1998). ওসিএলসি 43318775
  • Bhatt, Chetan, Hindu Nationalism: Origins, Ideologies and Modern Myths, Berg Publishers (2001), আইএসবিএন ৯৭৮-১-৮৫৯৭৩-৩৪৮-৬.
  • Blank, Jonah (১৯৯২)। Arrow of the Blue-Skinned God 
  • Elst, Koenraad (২০০৫)। Decolonizing the Hindu mind। India: Rupa। আইএসবিএন 81-7167-519-0 
  • Ainslie T. Embree, ‘The Function of the Rashtriya Swayamsevak Sangh: To Define the Hindu Nation’, in Accounting for Fundamentalisms, The Fundamentalism Project 4, ed. Martin E. Marty and R. Scott Appleby (Chicago: The University of Chicago Press, 1994), pp. 617–652. (আইএসবিএন ০-২২৬-৫০৮৮৫-৪)
  • Gandhi, Rajmohan (১৯৯১)। Patel: A Life 
  • Savarkar, Vinayak Damodar (১৯২৩)। Hindutva। Delhi, India: Bharati Sahitya Sadan। 

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা