দয়ানন্দ সরস্বতী
দয়ানন্দ সরস্বতী (গুজরাতি દયાનંદ સરસ્વતી; ; ১২ ফেব্রুয়ারি ১৮২৪, মৌরভী, টঙ্কর, সৌরাষ্ট্র, গুজরাত[১] – ৩০ অক্টোবর ১৮৮৩, আজমীর[২]) একজন গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু ধর্মগুরু, সমাজ সংস্কারক এবং আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। পশ্চিম ভারতের কাথিয়াওয়াড়ের মোরভি শহরে এক ধনাঢ্য নিষ্ঠাবান সামবেদী ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার গার্হস্থ্যাশ্রমের নাম মূলশংকর। বাল্যশিক্ষা পিতার কাছেই লাভ করেন। ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ না হওয়ায় প্রথম থেকেই তিনি সংস্কৃতশাস্ত্র উত্তমরূপে আয়ত্ত্ব করেন এবং ধীরে ধীরে সমগ্র যজুর্বেদ ও আংশিকভাবে অপর তিন বেদ, ব্যাকরণ, তর্ক ও দর্শনশাস্ত্র, কাব্য, অলংকার, স্মৃতি প্রভৃতিতে যথেষ্ট বুৎপত্তি অর্জন করেন। ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে বিখ্যাত কাশী শাস্ত্রার্থে তিনি তৎকালীন পন্ডিতবর্গকে পরাজিত করে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিলেন। হিন্দু সমাজ হতে কুসংস্কার দুর করতে এবং বেদ প্রতিষ্ঠা করতে বেদভাষ্য প্রণয়ন করেন এবং গড়ে তুলেন আর্য সমাজ। তার বিখ্যাত একটি গ্রন্থ সত্যার্থ প্রকাশ যা ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রভাব রেখেছিল।
দয়ানন্দ সরস্বতী | |
---|---|
ব্যক্তিগত তথ্য | |
জন্ম | মূলশঙ্কর তিওয়ারি বা মূলশঙ্কর কর্ষণদাস তিওয়ারি/ব্রহ্মচর্যের সময় শুদ্ধ চৈতন্য ১২ ফেব্রুয়ারি ১৮২৪ |
মৃত্যু | ৩০ অক্টোবর ১৮৮৩ | (বয়স ৫৯)
ধর্ম | সনাতন ধর্ম |
জাতীয়তা | ব্রিটিশ ভারতীয় |
এর প্রতিষ্ঠাতা | আর্য সমাজ |
দর্শন | চার বেদ সংহিতার উপর গড়ে ওঠা ত্রৈতবাদী বৈদিক দর্শন এবং এটি ষড় দর্শনের পাশাপাশি নিরুক্ত ও নিঘণ্টুতেও পাওয়া যায় যা পাণিনিয় ব্যাকরণ সমর্থিত। |
ঊর্ধ্বতন পদ | |
গুরু | বিরজানন্দ দন্ডী |
সম্মান | Sindhi Marhu |
যারা দয়ানন্দের মতাদর্শে প্রভাবিত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে আছেন, রাই সাহেব পুরান চাঁদ, ম্যাডাম কামা, পণ্ডিত লেখ রাম, স্বামী শ্রদ্ধানন্দ,[৩] শ্যামজি কৃষ্ণ বর্মা, কিষান সিং, ভগত সিং, বিনায়ক দামোদর সাভারকর, ভাই পরমানন্দ, লালা হরদয়াল, মদন লাল ধিংরা, রাম প্রসাদ বিসমিল, মহাদেব গোবিন্দ রানাডে, আশফাক উল্লাহ খান,[৪] মহাত্মা হংসরাজ, লালা লাজপত রায়,[৫][৬] এবং যোগমায়া নৃপানে।[৭]
বাল্যজীবন (২২বছর; ১৮৪৬ পর্যন্ত)
সম্পাদনাদয়ানন্দ সরস্বতী ১২ ফেব্রুয়ারি ১৮২৪ সাল একটি সভ্রান্ত হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে কাথিয়াবাড় অঞ্চলে (বর্তমানে গুজরাতের মৌরভী জেলা) জন্মগ্রহণ করেছিলেন।[৮][৯][১০] তার পিতৃ-প্রদত্ত নাম ছিল ‘মূলশঙ্কর তিওয়ারী’। তার পিতার নাম কর্ষণজী লাল তিওয়ারী, এবং মাতার নাম যশোদাবাই। পিতা কর্ষণজী ছিলেন সরকারের রেভিনিউ কালেক্টর।
আট বছর বয়সে, যজ্ঞোপবীত সংস্করণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তার আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় প্রবেশের সূচনা হয়। বাল্যশিক্ষা পিতার কাছেই লাভ করেন। তিনি ছিলেন ঔদীচ্যকূলের সামবেদী ব্রাহ্মণ। ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ না হওয়ায় প্রথম থেকেই তিনি সংস্কৃতশাস্ত্র উত্তমরূপে আয়ত্ত্ব করেন এবং সামবেদী ব্রহ্মণ হওয়া সত্ত্বেও ধীরে ধীরে সমগ্র যজুর্বেদ ও আংশিকভাবে অপর তিন বেদ, ব্যাকরণ, তর্ক ও দর্শনশাস্ত্র, কাব্য, অলংকার, স্মৃতি প্রভৃতিতে যথেষ্ট বুৎপত্তি অর্জন করেন।
তার পিতা ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান শৈব। শিবভক্ত পিতার মতো বাল্যকালে দয়ানন্দও শিবভক্ত ছিলেন। একবার শিবরাত্রির উপবাস থাকাকালে তিনি কিছু ইঁদুরকে শিবমূর্তির উপর দিয়ে দৌড়াতে ও ভক্তের দেওয়া নৈবেদ্য খেতে দেখেন। তখন তার মনে সংশয় হয়, “শিব যদি ইঁদুরের বিরুদ্ধে নিজেকে রক্ষা করতে না পারেন, তাহলে তিনি কীভাবে পৃথিবীর ত্রাণকর্তা হতে পারেন?”[১১]
বাল্যকালে তার ছোট বোন ও কাকা কলেরায় মৃত্যুবরণ করেন। ব্যাথিত মূলশঙ্কর তখন মৃত্যুচিন্তা এবং অমরত্ব লাভের উপায় অনুসন্ধান শুরু করেন। ফলে তার চিন্তা-ভাবনায় বৈরাগ্যভাব আসে। এই অবস্থা দেখে তার পিতা-মাতা তাকে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করেন। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নেন, বিয়ে তার জন্য নয়। ১৮৪৬ সালে ২২ বছর বয়েসে বিয়ের দিন তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে যান।[১২][১৩]
স্বামী দয়ানন্দের সত্যান্বেষণ (৪২বছর; ১৮৬৬ পর্যন্ত)
সম্পাদনাদয়ানন্দ সরস্বতী ১৮৪৬ থেকে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৫ বছর সত্যান্বেষণ ও অমৃতের সন্ধানে নর্মদা নদীর অরণ্য সঙ্কুল তীরভূমি হতে আরম্ভ করে হিমালয়ের বরফাচ্ছন্ন শিখর দেশ পর্যন্ত বিভিন্ন মঠে, মন্দিরে সাধুসঙ্গে ও যোগসাধনায় অতিবাহিত করেন। এ সময়ে তার সাথে বিভিন্ন সাধু-সন্ন্যাসীর পরিচয় হয়।
এক ব্রহ্মচারীর নিকট তিনি ব্রহ্মচর্যের দীক্ষা নেন। তখন তার নাম হয় ‘ব্রহ্মচারী শুদ্ধাচৈতন্য’। একদিন ব্রহ্মচারীবেশে সিদ্ধপুরের মেলায় অবস্থান কালে তার পিতা সন্ধান পেয়ে তাকে বাড়ি নিয়ে আসেন। কিন্তু বাড়ি হতে তিনি পুনরায় পলায়ন করেন। এরপর তিনি পূর্ণানন্দ সরস্বতী নামে এক সন্ন্যসীর নিকট সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তখন তার নাম হয় ‘দয়ানন্দ সরস্বতী’। জোয়ালানন্দ পুরী ও শিবানন্দ গিরির নিকট তিনি যোগবিদ্যা শিক্ষা নেন। এসব ঘটনা ১৮৫৫ সালের মাঝে সম্পন্ন হয়েছিল।
১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে, মথুরায় তিনি গুরু বিরজানন্দ দণ্ডীর শিষ্য হন। বিরজানন্দ বিশ্বাস করতেন যে, হিন্দুধর্ম তার মূল ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে এবং এর অনেক অনুশীলন অশুদ্ধ হয়ে গেছে। তার নিকট ছয়(?) বছর অধ্যয়ন করেন। অধ্যয়ন শেষে ১৯৬৩(?) সালে দয়ানন্দ সরস্বতী বিরজানন্দকে দক্ষিণাস্বরূপ প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি বেদবিদ্যা ও আর্যজ্ঞানের প্রচার এবং হিন্দু বিশ্বাসে বেদের যথাযথ স্থান পুনরুদ্ধারে নিজেকে উৎসর্গ করবেন।[১৪]
মতবাদ প্রচার (৫৯বছর; ১৮৮৩ পর্যন্ত)
সম্পাদনাকুম্ভেমেলায় যাত্রা
সম্পাদনাবিরজানন্দের নিকট শিক্ষা গ্রহণের পর তিনি বৈদিক মত প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ান। তৎকালীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে হিন্দু পণ্ডিতেদের দ্বারা বৈদিক শাস্ত্র পাঠে সাধারণ মানুষদের নিরুৎসাহিত করা হতো এবং গঙ্গা স্নান ও শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে ব্রাহ্মণ ভোজনের মতো আচার-অনুষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করা হতো। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে হরিদ্বারে কুম্ভমেলায় অবস্থান করে তিনি মূর্তিপূজা, বেদবিরুদ্ধ আচারসমূহকে কুসংস্কার বা স্ব-পরিচর্যা প্রথা বলে প্রতিবাদ করেছিলেন। পুরাণাদি শাস্ত্রসমূহ স্বার্থপর পণ্ডিতদের রচনা বলে প্রচার করেন। তিনি বামমার্গী, শৈব ও বৈষ্ণব মতকে ভ্রান্ত বলে তাদের কুসংস্কারমূলক ধরাণা প্রত্যাখ্যান করার পরামর্শ দিতেন এবং তাদের ভস্মলেপন, রুদ্রাক্ষ ও তিলক ধারণ করার প্রথাকে অপ্রয়েজনীয় মনে করতেন। তিনি বলতেন, “সাধনার জন্য বাহ্যিক চিহ্ন ধারণ করার প্রয়োজন নেই, ইহা পশুবৎ মানুষের কর্ম।”[১৫] সে সময় বহু পণ্ডিতের সাথে এ বিষয়ে তার ধর্মীয় বিতর্ক হয়। তার যুক্তি এবং সংস্কৃত ও বেদ জ্ঞানের শক্তির দ্বারা তিনি বারবার বিজয়ী হন।[১৬] এসব কারণে তিনি অনেকের শূলদৃষ্টির কারণ হন।
কাশী শার্স্ত্রার্থ
সম্পাদনা১৮৬৯ সালে ১৭ই নভেম্বর বারাণসীর কাশীতে অবস্থান কালে ২৭ জন বিদ্বান এবং ১২ জন বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতের সাথে তার বিতর্কের আয়োজন হয়। বিতর্কের মূল বিষয় ছিল, ”বেদ মূর্তিপূজা সমর্থন করে?”[১৭] বিতর্কে ৫০,০০০ এরও বেশি লোকের উপস্থিতি হয়েছিল বলে শুনা যায়। সেই বিতর্কেও স্বামী দয়ানন্দ কাশীর পণ্ডিতদের পরাজিত করেছিলেন।
বিতর্ক পাশাপাশি তিনি বহু সমাবেশে বক্তৃতা রাখতেন, এবং তার ব্যাখ্যান শুনতে বহু লোকের সমাগম হতো, যার ফলে বহু লোক বৈদিক মতবাদে প্রভাবিত হয়।[১৭] দয়ানন্দ সরস্বতী নিরাকার একেশ্বরবাদি মত প্রচার করেছিলেন। তিনি বেদ ভিত্তিক বৈদিক সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন।[১৫] নারীদের সমান অধিকার ও সম্মানের কথা তিনি বলেন। বলিপ্রথা, বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধেও তিনি কথা বলেছেন।[১৫][১৮] লিঙ্গ, বর্ণ নির্বিশেষে সকল শিশুর বেদ শিক্ষার পক্ষে মত দিয়েছেন। বৈদিক শাস্ত্রের প্রতি মানুষের বিমূখতার জন্য তিনি বৈদিক বিদ্যালয়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন এবং বিভিন্ন স্থানে বৈদিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন।[১৭]
বৈদিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা
সম্পাদনা১৮৬৯ থেকে ১৮৭৩ এর মধ্যে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী ভারতে তার প্রথম সংস্কার প্রচেষ্টা চালান। এই প্রচেষ্টা ছিল মূলত “বৈদিক বিদ্যালয়” বা “গুরুকুল” স্থাপনের লক্ষ্যে যা শিক্ষার্থীদের বৈদিক জ্ঞান, সংস্কৃতি ও ধর্মের গুরুত্ব প্রদান করে। প্রথম বিদ্যালয়টি ১৮৬৯ সালে ফররুখাবাদে মাত্র ৫০ জন শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রারম্ভিক সাফল্যের দরুন মির্জাপুর (১৮৭০), কাসগঞ্জ (১৮৭০), চালিসার (আলীগড়) (১৮৭০) এবং বারাণসী (১৮৭৩)-তে দ্রুত বেশ কিছু বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। বৈদিক বিদ্যালয় সমূহ মূলত স্বামী দয়ানন্দের সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারের প্রায়োগিক প্রয়াসকেই তুলে ধরে। বিদ্যালয়গুলো সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পেয়েছিল। একদিকে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মূর্তিপূজা করার পরিবর্তে তাদের প্রতিদিন দুইবার সন্ধ্যোপাসনা ও অগ্নিহোত্র যজ্ঞ করতে হতো। অন্যদিকে তাদের সমস্ত খাবার, বাসা, পোশাক এবং বই বিনামূল্যে দেয়া হতো এবং অ-ব্রাহ্মণরাও সংস্কৃত পাঠ করতে পারতো। তারা ছিল শৃঙ্খলাবদ্ধ। তাদেরকে প্রধানত বেদ শিক্ষা দেয়া হত। বৈদিক বিদ্যালয়সমূহ দ্রুতই বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়।
পরবর্তিতে রোহতকের মহর্ষি দয়ানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়, আজমীরের মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী বিশ্ববিদ্যালয়, জলন্ধরের D.A.V বিশ্ববিদ্যালয় (দয়ানন্দ অ্যাংলো-বৈদিক স্কুল সিস্টেম) তার নামানুসারে প্রতিষ্ঠিত। আজমীরের দয়ানন্দ কলেজ সহ দয়ানন্দ অ্যাংলো-বৈদিক কলেজ পরিচালনা কমিটির অধীনে ৯০০ টিরও অধিক স্কুল এবং কলেজ রয়েছে। শিল্পপতি নানজি কালিদাস মেহতা মহর্ষি দয়ানন্দ বিজ্ঞান কলেজ নির্মাণ করেন এবং দয়ানন্দ সরস্বতীর নামে নামকরণ করে পোরবন্দরের শিক্ষা সমিতিকে দান করেন।
কলকাতা যাত্রা
সম্পাদনা১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে মত প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি কলকাতা আসেন। তখন কেশবচন্দ্র সেনের আমন্ত্রণে তিনি সংস্কৃত এবং হিন্দিতে ব্যাখ্যান শুরু করেন। কলকাতায় বেদ-পাঠশালা স্থাপনের জন্য দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে প্রস্তাব করেছিলেন কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। এর পর ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই এপ্রিল তিনি কলকাতা থেকে প্রস্থান করেন।
আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠা
সম্পাদনাজাতিকে বৈদিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা এবং বৈদিক জীবনধারায় অনুসরণ করানোর লক্ষে তিনি একটি সংগঠন তৈরির গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। বোম্বাইয়ে অবস্থান কালে প্রার্থনা সমাজের সাথে দয়ানন্দের পরিচয় হয়। দয়ানন্দের মতাদর্শনের সাথে প্রার্থনা সমাজের বিশেষ বিরোধ না থাকায় তিনি এই সভার নাম পরিবর্তন করে আর্য সমাজ রাখার প্রস্তাব দেন। কিন্তু প্রস্তাব গ্রহণ না হলেও তিনি আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠায় পিছু পা হন না। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ই মার্চ তারিখে ২৩ জন সদস্য নিয়ে বোম্বায়ে তিনি প্রথম আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। গিরিধারীলাল দয়ালদাস ছিলেন বোম্বাই আর্য সমাজের সভাপতি এবং কর্ষণদাস সম্পাদক পদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রথমে ২৮টি মূলনীতির উপর এবং পরে ১০টি মূলনীতিতে আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠত হয়েছিল। সংগঠনের কার্যক্রমে হিন্দি ভাষা প্রাধান্য পায়। পরবর্তীতে ১৮৭৭ সালে লাহোরে, ১৮৭৮ সালে মুলতানে ও মিরাটে, ১৮৮১ সালে আগ্রা ইত্যাদি স্থানে তিনি আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রাহ্ম সমাজের অনেক অনুসারীই সেসময় আর্য সমাজে যোগ দান করেন।
বেদ ভাষ্য প্রণয়ন
সম্পাদনাতিনি মনে করতেন ব্রাহ্মণরা বেদ হতে বিচ্যুত হয়ে পড়ায় হিন্দু সমাজ ধ্বংস হয়ে পড়ছে। সায়ণ, মহীধর, উব্বট, ম্যাক্স মুলার প্রভৃতি বেদ ভাষ্যকাররা বেদের যথার্থ অর্থ নিরূপন করতে সমর্থ হননি।[১৭][১৯] তাই তিনি বেদ ভাষ্য প্রণয়নের সংকল্প নিয়ে ১৮৭৬ সালে (১৯৩৩ বিক্রমাব্দ, ভাদ্রমাসের শুক্ল প্রতিপদ তিথি, রবিবার) “ঋগ্বেদাদিভাষ্য ভূমিকা” রচনা শুরু করেন।[১৯] তার জীবদ্দশায় তিনি সম্পূর্ণ যজুর্বেদ ও ঋগ্বেদের (প্রথম থেকে ৭/৬১/২ পর্যন্ত) ভাষ্য রচনা করেছিলেন। তিনি সেই ভাষ্যে কোনো প্রকার স্বকপোলকল্পিত বক্তব্য সংযুক্ত না করে, প্রাচীন আর্ষ শাস্ত্র অনুসারেই বেদের ভাষ্য প্রণয়ন করেন।[১৯] তথাপি তার ভাষ্য তৎকালীন পৌরাণিক ব্রাহ্মণদের মাঝে গৃহীত হয়নি।[১৭]
ভারত স্বাধীনতা আন্দোলনে স্বামী দয়ানন্দের প্রভাব
সম্পাদনাভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে প্রভাবিত করার জন্য দয়ানন্দ সরস্বতীর অবদান উল্লেখযোগ্য। যোগব্যায়াম, আসন, শিক্ষা, প্রচার, উপদেশ এবং লেখার মাধ্যমে তিনি হিন্দু জাতিকে স্বরাজ্য, জাতীয়তাবাদ এবং আধ্যাত্মিকতার আকাঙ্ক্ষায় অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তিনি সকলকে মাংস ভক্ষণ করতে নিষেধ করেন। হিন্দু জাতির জাতীয় সমৃদ্ধির জন্য গাভী ও কৃষির গুরত্ব অনুভব করেন এবং গোহত্যা বন্ধ করার জন্য তিনি ‘গোকরুণানিধি’ রচনা করেন। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে ‘গোকৃ্ষ্যাদি রক্ষিণী সভা’ নামে একটি সংগঠন তৈরির প্রস্তাবও করেছিলেন। জাতীয় সংহতি স্থাপনের জন্য তিনি হিন্দিকে জাতীয় ভাষা এবং লিপিতে দেবনাগরী হিসেবে ব্যবহারের আহ্বান জানান। তার সত্যার্থ প্রকাশ রচনাটিও তিনি হিন্দিতে প্রকাশ করেন। তার প্রচারের ফলে স্বদেশি ভাষা হিসেবে হিন্দির ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। যোধপুর এবং পরবর্তীকালে বর্তমান রাজস্থানও হিন্দিকে প্রধান ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছিল।[২০] দয়ানন্দ তার জীবনকালে যেসব স্থান ভ্রমণ করেছিলেন সেগুলি প্রায়ই ফলস্বরূপ সাংস্কৃতিকভাবে পরিবর্তিত হয়েছিল।
তার মতাদর্শ এবং লেখনি বিভিন্ন লেখক ব্যবহার করেছেন। এদের মধ্যে শ্যামজী কৃষ্ণ বর্মা সহ সুভাষ চন্দ্র বসু; লালা লাজপত রায়; ম্যাডাম কামা; বিনায়ক দামোদর সাভারকর; লালা হরদয়াল; মদন লাল ধিংরা; রাম প্রসাদ বিসমিল; মহাদেব গোবিন্দ রণাদে; স্বামী শ্রদ্ধানন্দ; এস সত্যমূর্তি; পণ্ডিত লেখ রাম; মহাত্মা হংসরাজ প্রমুখ। অন্যান্য প্রশংসকদের মধ্যে ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ,[২১] রামকৃষ্ণ,[২২] বিপিন চন্দ্র পাল,[২৩] বল্লভভাই প্যাটেল,[২৪] শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি এবং রোমান রোল্যান্ড, যারা স্বামী দয়ানন্দকে অসাধারণ ও অনন্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচনা করতেন।[২৫]
জীবনের অন্তিম সময়গুলো
সম্পাদনাজীবনের অন্তিম বর্ষগুলোতে অধিক সময় তিনি রাজস্থানের রাজাদের স্বদেশি চেতনা জাগ্রত করার কাজ করেছিলেন। তিনি তাদের ধর্মশিক্ষা, সদাচারণ, রাজনীতি শিক্ষার পাশাপাশি স্বদেশ, স্বভাষা ও সংস্কৃতির অভিমান জাগিয়ে তুলতেন। গেয়ালিয়র, মসূদা, জয়পুর, উদয়পুর ইত্যাদি স্থানে উপদেশের পর ১৮৮৩ সালে যোধপুরে উপস্থিত হন। যোধপুরের মহারাজা দ্বিতীয় যশবন্ত সিং স্বামী দয়ানন্দকে তার প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানান। তিনি স্বামী দয়ানন্দের শিষ্য হতে আগ্রহী ছিলেন। একদিন বিশ্রামাগারে মহারাজাকে ‘নান্হী জান’ নামে এক গণিকার সাথে দেখে স্বামী দয়ানন্দ তাকে ভর্ৎসনা করেন এবং নারী ও সমস্ত অনৈতিক কাজ ত্যাগের উপদেশ দেন। তাকে প্রকৃত আর্যের মতো আচরণ করতে বলেন। স্বামী দয়ানন্দের এই পরামর্শে নান্হী ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ২৯ সেপ্টেম্বর, নান্হী ঘুষ দিয়ে রাঁধুনি জগন্নাথের দ্বারা বিষ ও কাচের গুঁড়ো মেশানো দুধ পরিবেশন করেছিলেন। বিষ পানের পর বেশ কয়েক দিন স্বামী দয়ানন্দ শয্যাশায়ী হয়ে তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করেন।
মহারাজ দ্রুত তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ডাক্তার আসার সময়, তার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়, এবং তার প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। তখন দয়ানন্দের কষ্ট দেখে রাঁধুনি জগন্নাথ দয়ানন্দের কাছে নিজ অপরাধ স্বীকার করেন। মৃত্যুশয্যায় থাকা স্বামী দয়ানন্দ তাকে ক্ষমা করে দেন, এবং তাকে এক ব্যাগ অর্থ দিয়ে মহারাজের লোকেদের হতে পড়ার আগে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
এরপর, মহারাজা স্বামী দয়ানন্দকে রেসিডেন্সির পরামর্শ অনুযায়ী মাউন্ট আবুতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। আবুতে কিছু সময় থাকার পর, উন্নত চিকিৎসার জন্য ২৬ অক্টোবর তাকে আজমীর পাঠানো হয়। এতে তার স্বাস্থ্যের কোন উন্নতি হয়নি এবং ১৮৮৩ সালের ৩০ অক্টোবর দীপাবলির সন্ধ্যায় মন্ত্র জপ করতে করতে তিনি মারা যান।
রচিত গ্রন্থের তালিকা
সম্পাদনাদয়ানন্দ সরস্বতী সব মিলিয়ে ৬০ টিরও বেশি রচনা লিখেছিলেন। তার রচিত সাহিত্যসমূহ প্রকাশনার জন্য তিনি ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে প্রথমে এলাহাবাদে “বৈদিক যন্ত্রালয়” স্থাপন করেন এবং পরে তা আজমীরে স্থানান্তর করেন। তিনি একটি সংস্থা “পরোপকারিণী সভা”-কে নিজের উত্তরাধিকারী করে যান।
|
|
|
আরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "Tankara"। www.tankara.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২৯।
- ↑ "Maharishi Swami Dayanand Saraswati - VCC"। www.vedicculturalcentre.com। ২০১১-০৭-১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২৯।
- ↑ "Gurudatta Vidyarthi"। Aryasamaj। ৬ জানুয়ারি ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ ডিসেম্বর ২০১২।
- ↑ "Mahadev Govind Ranade: Emancipation of women"। Isrj.net। ১৭ মে ১৯৯৬। ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১২।
- ↑ "Life History of Lala Lajpat Rai"। www.culturalindia.net (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২৯।
- ↑ Lala Lajpat Rai (Indian writer, politician and Escort) – Britannica Online Encyclopedia
- ↑ Neupane, Dr. Kedar (২০১৪)। बहुमुखी व्यक्तित्वकी धनी योगमाया by Pawan Alok। Nepal Shrastha Samaj। পৃষ্ঠা 15–21। আইএসবিএন 978-9937-2-6977-3।
- ↑ Robin Rinehart (২০০৪)। Contemporary Hinduism: Ritual, Culture, and Practice। ABC-CLIO। পৃষ্ঠা 58–। আইএসবিএন 978-1-57607-905-8।
- ↑ "Devdutt Pattanaik: Dayanand & Vivekanand"। ১৫ জানুয়ারি ২০১৭।
- ↑ ઝંડાધારી – મહર્ષિ દયાનંદ – Gujarati Wikisource
- ↑ "History of India"। indiansaga.com। সংগ্রহের তারিখ ৫ অক্টোবর ২০১৮।
- ↑ "Dayanand Saraswati"। iloveindia.com। সংগ্রহের তারিখ ১৪ জানুয়ারি ২০১৬।
- ↑ "Swami Dayanand Saraswati"। culturalindia.net। সংগ্রহের তারিখ ১৪ জানুয়ারি ২০১৬।
- ↑ "Sarasvati, Dayananda – World Religions Reference Library"। World Religions Reference Library – via HighBeam Research (সদস্যতা প্রয়োজনীয়) । ১ জানুয়ারি ২০০৭। ১০ জুন ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ সেপ্টেম্বর ২০১২।
- ↑ ক খ গ সত্যার্থ প্রকাশ। দয়ানন্দ সরস্বতী।
- ↑ "Swami Dayananda Sarasvati by V. Sundaram"। Boloji। ১৩ ডিসেম্বর ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৪ জানুয়ারি ২০১৬।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ দয়ানন্দচরিত। শ্রীদেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।
- ↑ সংস্কারবিধি। দয়ানন্দ সরস্বতী।
- ↑ ক খ গ ঋগ্বেদাদিভাষ্য ভূমিকা। দয়ানন্দ সরস্বতী।
- ↑ Regina E. Holloman; S. A. Aruti︠u︡nov (১৯৭৮)। Perspectives on ethnicity। Mouton। পৃষ্ঠা 344–345। আইএসবিএন 978-90-279-7690-1।
- ↑ Basant Kumar Lal (১৯৭৮)। Contemporary Indian Philosophy। Motilal Banarsidass। পৃষ্ঠা 3। আইএসবিএন 978-81-208-0261-2।
- ↑ Christopher Isherwood (১৯৮০)। Ramakrishna and His Disciples। Vedanta Press। পৃষ্ঠা 159। আইএসবিএন 978-0-87481-037-0।
- ↑ Narendra Nath Bhattacharyya (১৯৯৬)। Indian religious historiography। Munshiram Manoharlal Publishers। পৃষ্ঠা 58। আইএসবিএন 978-81-215-0637-3।
- ↑ Krishan Singh Arya, P. D. Shastri (1987) Swami Dayananda Sarasvati: A Study of His Life and Work. manohar. p. 327. আইএসবিএন ৮১৮৫০৫৪২২৩
- ↑ Sisirkumar Mitra; Aurobindo Ghose (১৯৬৩)। Resurgent India। Allied Publishers। পৃষ্ঠা 166।
- ↑ Swami Dayanand Saraswati। Bhagwat Khandan - Swami Dayanand Saraswati।
- ↑ "Maharshi Dayanand Jivan Charitra"। www.aryasamajjamnagar.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১১-০৭।