সরদার জয়েনউদ্দীন
সরদার জয়েনউদ্দীন (১৯১৮ - ২২ ডিসেম্বর, ১৯৮৬) একজন বাংলাদেশী লেখক, ঔপন্যাসিক, গল্পকার ও সম্পাদক।[১] তিনি বাংলাদেশে বইমেলার প্রবর্তক।[২] বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৬৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও আদমজী সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৯৪ সালে মরণোত্তর বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদক-এ ভূষিত হন।[৩]
সরদার জয়েনউদ্দীন | |
---|---|
জন্ম | মুহম্মদ জয়েনউদ্দীন বিশ্বাস ১৯১৮ কামারহাট গ্রাম, নাজিরগঞ্জ ইউনিয়ন, সুজানগর উপজেলা, পাবনা জেলা, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমান বাংলাদেশ) |
মৃত্যু | ২২ ডিসেম্বর ১৯৮৬ ঢাকা, বাংলাদেশ | (বয়স ৬৭–৬৮)
পেশা | লেখক, সম্পাদক |
ভাষা | বাংলা |
জাতীয়তা | বাংলাদেশী |
নাগরিকত্ব | বাংলাদেশ |
শিক্ষা | উচ্চ মাধ্যমিক |
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান | এডওয়ার্ড কলেজ |
ধরন | গল্প, উপন্যাস, শিশুসাহিত্য |
বিষয় | সামাজিক |
উল্লেখযোগ্য রচনাবলি |
|
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার | বাংলা একাডেমি পুরস্কার একুশে পদক |
সক্রিয় বছর | ১৯৫২–১৯৮০ |
প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা
সম্পাদনাজয়েনউদ্দীন ১৯১৮ সালে ব্রিটিশ ভারতের (বর্তমান বাংলাদেশ) পাবনার সুজানগর উপজেলার নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের কামারহাট গ্রামের একটি সম্ভান্ত্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার আসল নাম মুহম্মদ জয়েনউদ্দীন বিশ্বাস। তিনি ১৯৩৯ সালে খলিলপুর হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে আইএ পর্যন্ত পড়াশুনা করেন।[১]
কর্মজীবন
সম্পাদনাকর্মজীবনের প্রথমে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনী এর সক্রিয় সামরিক সদস্য হিসাবে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তিনি এই চাকরি ছেড়ে দেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকায় এসে পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার বিজ্ঞাপন বিভাগে যোগ দেন। ১৯৫১ সালে দৈনিক সংবাদে বিজ্ঞাপন বিভাগে ম্যানেজার পদে নিয়োগ পান। এরপর তিনি দৈনিক ইত্তেফাকে যোগ দেন। ১৯৫৫-৫৬ সালে তিনি পাকিস্তান কোঅপারেটিভ বুক সোসাইটির শিশুকিশোর ম্যাগাজিন 'সেতারা' ও 'শাহীন'-এর সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।[৩] ১৯৬২ সালে তিনি বাংলা একাডেমির সহকারী প্রকাশনা কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করেন। সে সময় গ্রন্থমেলা আয়জনের ব্যাপারে তিনি চিন্তা-ভাবনা করেন। সেখান থেকে তিনি ১৯৬৪ সালে ন্যাশনাল বুক সেন্টারে (বর্তমানে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র) গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান ও পরে পরিচালক হন।[৪] পরিচালক হওয়ার পর তিনি ইউনেস্কোর শিশুসাহিত্য বিষয়ক উপকরণ সংগ্রহের কাজ করছিলেন। সেই সংগৃহীত উপকরণগুলো প্রদর্শনীর লক্ষে তিনি ১৯৬৫ সালে সেন্ট্রাল পাবলিক লাইব্রেরীতে (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার) শিশুগ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। এটাই ছিল বাংলাদেশের গ্রন্থমেলার সূচনা। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জে আরেকটি গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন।[৫] ১৯৭২ সালকে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ ঘোষণা করলে ডিসেম্বর মাসের ২০-২৫ তারিখ পর্যন্ত বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমির বাইরে প্রগতি প্রকাশনী, মুক্তধারা ও বর্ণমিছিলের প্রকাশকরা স্টল বসিয়ে অনানুষ্ঠানিক বইমেলার স্থাপন করেন। পরে মুক্তধারা প্রকাশনীর চিত্তরঞ্জন সাহার নেতৃত্বে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত এই অনানুষ্ঠানিক বইমেলা চলতে থাকে। ১৯৮৪ সাল থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা আনুষ্ঠানিকভাবে আয়োজিত হয়ে আসছে। সেইদিক থেকে সরদার জয়েনউদ্দীন বাংলাদেশে গ্রন্থমেলার প্রবর্তক।[২] সর্বশেষ তিনি বাংলাদেশ টেক্সট বুক বোর্ডের ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ পদে যোগ দেন। সেখানে থাকাকালীন তিনি ১৯৮০ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।[১]
সাহিত্যকর্ম
সম্পাদনাজয়েনউদ্দীন ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী ছিলেন। তার লেখনীতে তিনি গ্রামীণ সমাজের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র তুলে ধরেছেন। ১৯৫২ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ নয়ান ঢুলী প্রকাশিত হয়। এতে তিনি সমকালীন সামাজিক সংকট, মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, গ্রামের অবহেলিত মানুষের সুখ-দুঃখের চিত্র, জমিদার-জোতদারদের শোষণ-নিপীড়ন তুলে ধরেছেন। গল্পগ্রন্থটি তাকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা এনে দেয়। এরপর তার রচিত অন্যান্য গল্পগ্রন্থের মধ্যে বীর কণ্ঠীর বিয়ে, খরস্রোত, বেলা ব্যানার্জীর প্রেম ও অষ্টপ্রহর উল্লেখযোগ্য।[৩] তার রচিত প্রথম উপন্যাস আদিগন্ত ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয়। এ উপন্যাসে তিনি তৎকালীন হিন্দুসমাজের দুরবস্তার কথা তুলে ধরেছেন। তার অন্যান্য উপন্যাসগুলোর মধ্যে পান্নামতি, নীল রং রক্ত, অনেক সূর্যের আশা, বিধ্বস্ত রোদের ঢেউ উল্লেখযোগ্য।[৬] অনেক সূর্যের আশা উপন্যাসের পটভূমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত। কবি রহমতের স্মৃতিকথায় দেশবিভাগ ও তার পর বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি চিত্রায়িত হয়েছে। তিনি দেখিছেন কীভাবে দেশবিভাগের পর বাংলার বাঙালি মুসলিমেরা তাদের স্বপ্ন ও আবেগ থেকে বারবার বিচ্যুত হয়েছে।
মৃত্যু
সম্পাদনাজয়েনউদ্দীন ১৯৮৬ সালের ২২ ডিসেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
গ্রন্থতালিকা
সম্পাদনাগল্পগ্রন্থ
- নয়ান ঢুলী (১৯৫২)
- বীর কণ্ঠীর বিয়ে (১৯৫৫)
- খরস্রোত (১৯৫৫)
- বেলা ব্যানার্জীর প্রেম (১৯৬৮)
- অষ্টপ্রহর (১৯৭৩)
উপন্যাস
- নীল রং রক্ত (১৯৫৬)
- পান্নামতি (১৯৬৪)
- আদিগন্ত (১৯৬৫)
- অনেক সূর্যের আশা (১৯৬৬)
- বেগম শেফালী মির্জা (১৯৬৮)
- বিধ্বস্ত রোদের ঢেউ (১৯৭৫)
শিশুসাহিত্য
- উল্টো রাজার দেশ
- আমরা তোমাদের ভুলব না
- অবাক অভিযান
পুরস্কার ও সম্মাননা
সম্পাদনা- বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৭)
- আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৭)
- একুশে পদক (১৯৯৪, মরণোত্তর)
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ "ব্যক্তিত্ব: সরদার জয়েনউদ্দীন"। দৈনিক কালের কণ্ঠ। ঢাকা, বাংলাদেশ। ২২ ডিসেম্বর ২০১৪। সংগ্রহের তারিখ ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬।
- ↑ ক খ খান মাহবুব (১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬)। "বইমেলার রূপ-রূপান্তর"। দৈনিক ইত্তেফাক। ঢাকা, বাংলাদেশ। সংগ্রহের তারিখ ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬।
- ↑ ক খ গ আশরাফ উদ্দীন আহমদ। "গাল্পিক সরদার জয়েনউদ্দীন ও নয়ান ঢুলী"। কালি ও কলম। সংগ্রহের তারিখ ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬।
- ↑ সৈয়দ আবুল মকসুদ (২৫ ডিসেম্বর ২০১৫)। "পথ নির্মাতাদের কথা-তিন"। দৈনিক যুগান্তর। ঢাকা, বাংলাদেশ। সংগ্রহের তারিখ ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬।
- ↑ শামসুজ্জামান খান (২৯ জানুয়ারি ২০১৬)। "চেতনাই আমাদের পাহারাদার"। দৈনিক সমকাল। ঢাকা, বাংলাদেশ। সংগ্রহের তারিখ ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ রাব্বানী চৌধুরী (৮ জানুয়ারি ২০১৬)। "Bengali novelists and novels"। দ্য ডেইলি নিউ ন্যাশন (ইংরেজি ভাষায়)। ঢাকা, বাংলাদেশ। ১৮ জুন ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬।