সৈয়দ আবুল মকসুদ
সৈয়দ আবুল মকসুদ (২৩ অক্টোবর,১৯৪৬–২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১[১]) ছিলেন একজন বাংলাদেশী সাংবাদিক, কলামিস্ট, গবেষক, প্রাবন্ধিক ও লেখক। তিনি তার গবেষণাধর্মী প্রবন্ধের জন্য সুপরিচিত।[২] তিনি নিয়মিত দৈনিক প্রথম আলোয় কলাম লিখতেন। তার প্রবন্ধসমূহ দেশের রাজনীতি, সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেয়। তিনি বিখ্যাত সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদদের জীবনী ও কর্ম নিয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখেছেন। পাশাপাশি কাব্যচর্চাও করেছেন। তার রচিত বইয়ের সংখ্যা চল্লিশের উপর। জার্নাল অব জার্মানি তার লেখা ভ্রমণকাহিনী। বাংলা সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য তিনি ১৯৯৫ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ | |
---|---|
জন্ম | ২৩ অক্টোবর ১৯৪৬ এলাচিপুর, মানিকগঞ্জ জেলা, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমান বাংলাদেশ) |
মৃত্যু | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | (বয়স ৭৪)
পেশা | সাংবাদিক, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, কবি, লেখক |
ভাষা | বাংলা |
জাতীয়তা | বাংলাদেশী |
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় |
ধরন | প্রবন্ধ, জীবনী, কবিতা, ভ্রমণকাহিনী |
বিষয় | রাজনীতি, সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি |
সাহিত্য আন্দোলন | গান্ধীবাদী সত্যাগ্রহ |
উল্লেখযোগ্য রচনাবলি | ভাসানী কাহিনী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্য পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ |
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার | বাংলা একাডেমি পুরস্কার |
সক্রিয় বছর | ১৯৬১-২০২১ |
প্রাথমিক জীবন
সম্পাদনাসৈয়দ আবুল মকসুদ ১৯৪৬ সালের ২৩ অক্টোবর ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমান বাংলাদেশ) মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলার এলাচিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সৈয়দ আবুল মাহমুদ ও মা সালেহা বেগম। তার জন্মের দুই বছর পর ১৯৪৮ সালের ২০ নভেম্বর তার মা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে ধনুষ্টঙ্কারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার মায়ের মৃত্যুর পর তার বিমাতা বেগম রোকেয়া আখতার তাকে সন্তান স্নেহে লালনপালন করেন। তিনিও ১৯৮০ সালে মারা যান। তার বাবা কাব্যচর্চা করতেন। তাই শৈশব থেকে তিনি দেশি বিদেশি বিভিন্ন পত্রিকা পড়ার সুযোগ পান। তার বাবা বাড়িতে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা, দ্য স্টেটসম্যান ও ইত্তেহাদ এবং পরে ঢাকার দৈনিক আজাদ, দৈনিক ইত্তেফাক ও মর্নিং নিউজ পত্রিকা রাখতেন।[৩]
শিক্ষাজীবন
সম্পাদনাআবুল মকসুদের শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি হয় তাদের বাড়ির নাপিত লোকনাথ শীলের কাছে। তিনি তাকে 'বর্ণবোধ' ও 'আদর্শলিপি'র পাঠ দিতেন। এরপর তিনি পড়েন তাদের ডাক্তার নিবারণচন্দ্র সাহা পোদ্দারের কাছে। তিনি সপ্তাহে তিন-চার দিন তাকে পড়াতেন। তিনি ঝিটকা আনন্দমোহন হাই স্কুলে একেবারে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-এ পড়াশুনা করেছেন।[৩]
কর্মজীবন
সম্পাদনাতার কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৬৪ সালে এম আনিসুজ্জামান সম্পাদিত সাপ্তাহিক নবযুগ পত্রিকায় সাংবাদিকতার মাধ্যমে। এটি ছিল পাকিস্তান সোস্যালিস্ট পার্টির মুখপত্র। পরে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সমর্থিত সাপ্তাহিক 'জনতা'য় কাজ করেন কিছুদিন। পরে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ বার্তা সংস্থায় যোগ দেন। ২০০৮ সালের ২ মার্চ বার্তা সংস্থার সম্পাদকীয় বিভাগের চাকরি ছেড়ে দেন।[৩] পরবর্তীতে তিনি দৈনিক প্রথম আলোর একজন নিয়মিত কলামিস্ট ছিলেন। এই দৈনিকে 'সহজিয়া কড়চা' এবং 'বাঘা তেঁতুল' শিরোনামে তিনি সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে কলাম লিখতেন।[৪]
সাহিত্যিক জীবন
সম্পাদনাসৈয়দ আবুল মকসুদের সাহিত্যচর্চা শুরু হয় ষাটের দশকে কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ দিয়ে। তখন তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় লিখতেন। ১৯৮১ সালে তার কবিতার বই বিকেলবেলা প্রকাশিত হয়। ১৯৮৭ সালে তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ দারা শিকোহ ও অন্যান্য কবিতা প্রকাশিত হয়। মানবাধিকার, পরিবেশ, সমাজ ও প্রেম নিয়ে তিনি কবিতা লিখেছেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের ক্ল্যাসিকধর্মী গবেষকদের মধ্যে অন্যতম। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসু, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী প্রমুখ প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদদের জীবনী ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করেছেন।[৫] আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে নিয়ে তিনি লিখেছেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানীর জীবন, কর্মকাণ্ড, রাজনীতি ও দর্শন (১৯৮৬) ও ভাসানী কাহিনী (২০১৩)। ভাসানী কাহিনীতে তিনি ভাসানীর বৈচিত্র্যময় ও ঘটনাবহুল দীর্ঘ জীবন এবং তার রাজনৈতিক দর্শন বর্ণনা করেছেন।[৬] সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে নিয়ে লিখেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্য (২০১১) ও স্মৃতিতে ওয়ালীউল্লাহ (২০১৪)। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্য গ্রন্থে তিনি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও তার সাহিত্যকর্ম নিয়ে লিখেছেন। এছাড়া তৎকালীন সময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দিকগুলো তুলে ধরেছেন।[৭] স্মৃতিতে ওয়ালীউল্লাহ গ্রন্থে তিনি তাকে চিনতেন এবং জানতেন এমন সব মানুষদের কাছ থেকে নানা উপাদান সংগ্রহ করেছেন। তথ্য সংগ্রহের জন্য তিনি ফ্রান্সের প্যারিসে ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে এবং পাকিস্তানে গিয়েছিলেন।[৮]
পারিবারিক জীবন
সম্পাদনাআবুল মকসুদের স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন অগ্রণী স্কুল অ্যান্ড কলেজ -এ। তাদের দুই সন্তান। মেয়ে জিহান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স এবং মাস্টার্স করে ব্যাংকে চাকরি করছেন। ছেলে নাসিফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স এবং মাস্টার্স করে দুই বছর ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি এবং স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়েছেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ করে ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডে সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে চাকরি করছেন।[৩]
মৃত্যু
সম্পাদনাসৈয়দ আবুল মকসুদ ২৩ ফেব্রুয়ারি , ২০২১, মঙ্গলবার বিকেলে অসুস্থ হওয়ার পর হাসপাতালে নেওয়ার পথেই তার মৃত্যু হয়। স্কয়ার হাসপাতালের জরুরি আবাসিক মেডিকেল অফিসার ফয়সাল হক জানিয়েছেন, সৈয়দ আবুল মকসুদকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। তারপরও নিশ্চিত হতে প্রয়োজনীয় পরীক্ষার পর মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাতটা ৯ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। [৯])
গ্রন্থতালিকা
সম্পাদনাকবিতা
- বিকেলবেলা (১৯৮১)
- দারা শিকোহ ও অন্যান্য কবিতা (১৯৮৭)
- সৈয়দ আবুল মকসুদের কবিতা (২০১২)
প্রবন্ধ
- গণআন্দোলন ১৯৮২-৯০ (১৯৯১)
- যুদ্ধ ও মানুষের মূর্খতা (১৯৮৮)
- গান্ধী, নেহেরু ও নোয়াখালী (২০০৮)
- ঢাকার বুদ্ধদেব বসু (২০১১)
- রবীন্দ্রনাথের ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন, প্রভৃতি (২০১২)
- প্রতীচ্য প্রতিভা
- কাজী ইমদাদুল হক রচনাবলী
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা
- অরণ্য বেতার
- বাঙালি জাতি বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ
- রাজনীতি ও ধর্মীয় রাজনীতি
- রবীন্দ্র রাজনীতি
- নির্বাচিত প্রবন্ধ
জীবনী
- মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানীর জীবন, কর্মকাণ্ড, রাজনীতি ও দর্শন (১৯৮৬)
- সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্য (২০১১)
- ভাসানী কাহিনী (২০১৩)
- স্মৃতিতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (২০১৪)
- গান্ধী মিশন ডায়েরি
- পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ
- বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দশ দার্শনিক
- পথিকৃৎ নারীবাদী খায়রুন্নেসা খাতুন
- মোতাহের হোসেন চৌধুরী জীবন ও সাহিত্য
- হরিশচন্দ্র মিত্র
ভ্রমণকাহিনী
- জার্নাল অব জার্মানি
- ভ্রমণ সমগ্র
কলাম সংকলন
- সহজিয়া কড়চা
পুরস্কার ও সম্মাননা
সম্পাদনা- বাংলা একাডেমি পুরস্কার - ১৯৯৫ (সামগ্রিক অবদান)
- প্রথম আলো বর্ষসেরা বই (১৪২২)
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "কলামিস্ট, গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ আর নেই"। The Daily Star Bangla। ২০২১-০২-২৩। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০২-২৩।
- ↑ সেলিনা হোসেন, নুরুল ইসলাম ও মোবারক হোসেন, সম্পাদক (২০০০)। Bangla Academy Dictionary of Writers। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলা একাডেমি। পৃষ্ঠা ১৮৩। আইএসবিএন 984-07-4052-0।
- ↑ ক খ গ ঘ [সাপ্তাহিকে সৈয়দ আবুল মকসুদের আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকার: আমার আমি - সৈয়দ আবুল মকসুদ]
- ↑ "সৈয়দ আবুল মকসুদ"। বাণী চিরন্তণী। ৯ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩১ অক্টোবর ২০১৬।
- ↑ এমরান কবির (অক্টোবর ২৩, ২০১৬)। "শুভ জন্মদিন সৈয়দ আবুল মকসুদ"। চিন্তাসূত্র। সংগ্রহের তারিখ ৩১ অক্টোবর ২০১৬।
- ↑ "সৈয়দ আবুল মকসুদ - ভাসানী কাহিনী"। দৈনিক ইত্তেফাক। ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৩। সংগ্রহের তারিখ ৩১ অক্টোবর ২০১৬।
- ↑ ওয়াসিফ ওয়াহিদ (১ অক্টোবর ২০১১)। "A literary life in retrospect"। দ্য ডেইলি স্টার। সংগ্রহের তারিখ ৩১ অক্টোবর ২০১৬।
- ↑ বিশ্বজিৎ ঘোষ (জুন ৬, ২০১৪)। "ওয়ালীউল্লাহকে নিয়ে যত কথা"। দৈনিক প্রথম আলো। ৩১ মে ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩১ অক্টোবর ২০১৬।
- ↑ "সৈয়দ আবুল মকসুদ আর নেই"। বাংলাদর্পণ। ২০২১-০২-২৩। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০২-২৪।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]