ম্যাজিস্ট্রেট
ম্যাজিস্ট্রেট হচ্ছেন আইন প্রয়োগ ও বিচারিক[১] দায়িত্বপালনকারী একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা।[২] ২০০৭ সালের ১লা নভেম্বর বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের[৩] পর বাংলাদেশে বর্তমানে ম্যাজিস্ট্রেটগণ ফৌজদারি অভিযোগ আমলে গ্রহণ ও বিচার করেন। Magistrate শব্দটি ল্যাটিন Magistratus শব্দ থেকে এসেছে যার মানে Administrator বা শাসক। ফৌজদারি কার্যবিধির (২০০৭ সালে সংশোধিত) ৪ক ধারা অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট বলতে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে বোঝাবে।[৪][৫]
![]() বাংলাদেশ সরকারের সীল |
চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হচ্ছেন বাংলাদেশের জেলার প্রধান ম্যাজিস্ট্রেট।[৬] অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জেলাতে দ্বিতীয় প্রধান ম্যাজিস্ট্রেট। এছাড়াও এক বা একাধিক সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট উপজেলার প্রধান ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে আমলী আদালতের দায়িত্ব পালন করেন। জেলার ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের বিভিন্ন পর্যায়ের ম্যাজিস্ট্রেটগণ হচ্ছেন:
- (১) চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট
- (২) অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট
- (৩) সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট/ প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট
- (৪) জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট
অপরদিকে, মেট্রোপলিটন এলাকার ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের অধিকর্তা হলেন চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট। অতিরিক্ত চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মহানগরের ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড। পাশাপাশি মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিভিন্ন আমলী আদালতের দায়িত্ব পালন করেন।[৭] মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের বিভিন্ন স্তরের ম্যাজিস্ট্রেটগণ হচ্ছেন:
- (১) চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট
- (২) অতিরিক্ত চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট
- (৩) মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট/ প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট
চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট/চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বা তার দ্বারা নির্ধারিত আমলী আদালতের অধিক্ষেত্রের প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০(১) ধারার বিধান মোতাবেক তার এখতিয়ারাধীন অঞ্চলে সংঘটিত যেকোনও অপরাধ আমলে নিতে পারেন। তিনি তার অধিক্ষেত্রের মধ্যে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং অপরাধ দমন করার জন্য যেকোনও আদেশ দিতে পারেন। পুলিশ তদন্ত সহ আইনের প্রয়োগ সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যকলাপের বিবরণ সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট দাখিল করে।[৮]
জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসম্পাদনা
"ম্যাজিস্ট্রেট" নামে বিসিএসে কোনো ক্যাডার নেই। বিসিএস এডমিনিস্ট্রেশন ক্যাডারে যারা নিয়োগ পান, তারা সহকারী কমিশনার হিসেবে যোগদান করেন। আমলাতান্ত্রিক দায়িত্ব পালন করাই তাদের মূল কাজ এবং তাদের পদ হলো সহকারী কমিশনার, ম্যাজিস্ট্রেট নয়। তবে ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ১০(৫) অনুযায়ী সরকার চাইলে এডমিনিস্ট্রেশন ক্যাডারের কর্মকর্তাদেরকে সীমিত আকারে ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা অর্পণ করতে পারে। তাদেরকে তখন বলা হয় “নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট”। ১০(৫) ধারা হুবহু এরকম – “The Government may, if it thinks expedient or necessary, appoint any persons employed in the Bangladesh Civil Service (Administration) to be an Executive Magistrate and confer the powers of an Executive Magistrate on any such member.” অর্থাৎ সরকার যদি সমীচীন বা প্রয়োজনীয় মনে করে, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে (এডমিন) নিযুক্ত যেকোনো ব্যক্তিকে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ দিতে পারে এবং এই ধরনের যেকোনো সদস্যকে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা প্রদান করতে পারে। কাজেই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাদের মূল পদ নয় বরং অর্পিত দায়িত্ব (Delegated duty)। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই ধারায় লেখা হয়েছে, The Government may...। আইনে Shall এবং May শব্দ দুটির মাঝে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। যখন “May” শব্দটি ব্যবহৃত হয়, তখন সেই কাজটি ঐচ্ছিক হিসেবে গণ্য হয়। “Shall” ব্যবহৃত হলে কাজটি করা বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। সুতরাং এডমিনিস্ট্রেশন ক্যাডারের কর্মকর্তাদেরকে ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দিতে সরকার বাধ্য নয়। একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সর্বোচ্চ ২ বছরের কারাদণ্ড যোগ্য অপরাধের বিচার করতে পারেন। যেহেতু জেলা প্রশাসক একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তিনিও ২ বছরের বেশি কারাদণ্ড দিতে পারেন না। এই বিচারের শর্ত হল উক্ত অপরাধমূলক কাজ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সংঘটিত বা উদঘাটিত হতে হবে এবং অভিযুক্ত কর্তৃক তার কৃত অপরাধ লিখিতভাবে স্বীকার করতে হবে। তা না হলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাকে কোনো দণ্ড দিতে পারবেন না। (ধারা-৬, ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন, ২০০৯)। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মূল কাজ হল লাইসেন্স প্রদান, লাইসেন্স বাতিলকরণ, প্রসিকিউশন অনুমোদন বা প্রত্যাহারকরণ ইত্যাদি যেসব কাজের প্রকৃতি আমলাতান্ত্রিক বা নির্বাহী ধরনের তা সম্পাদন করা।
ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৪ক(১)(ক) অনুযায়ী “ম্যাজিস্ট্রেট” বলতে শুধুমাত্র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে বোঝায়।[৯] ৪ক(১)(ক) ধারায় স্পষ্টতই বলা হয়েছে যে, “Without any qualifying word, to a "Magistrate", shall be construed as a reference to a Judicial Magistrate.” অর্থাৎ কেউ যদি বলেন, “আমি ম্যাজিস্ট্রেট।” এর অর্থ হল তিনি জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। কোনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিজেকে শুধুমাত্র “ম্যাজিস্ট্রেট” হিসেবে পরিচয় দিতে পারেন না। জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের মূল কাজ অপরাধ আমলে নেওয়া ও বিচার করা। আমলী আদালতের (Cognizance Court) অধিক্ষেত্রের জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০(১) ধারা অনুযায়ী তার এখতিয়ারাধীন অঞ্চলে সংঘটিত যেকোনও অপরাধ আমলে নিতে পারেন। তিনি তার অধিক্ষেত্রের মধ্যে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং অপরাধ দমন করার জন্য যেকোনও আদেশ দিতে পারেন। পুলিশ, র্যাব ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তদন্ত সহ আইনের প্রয়োগ সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যকলাপের বিবরণ সংশ্লিষ্ট জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট দাখিল করে। জেলার ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রধান হচ্ছেন চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সর্বোচ্চ ৭ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড প্রদান করতে পারেন। পাশাপাশি তিনি অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড সহ আইনে উল্লিখিত যে কোনোও দন্ড প্রদান করতে পারেন। একমাত্র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটগণ প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জেলার প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটদের আমলী আদালতের অধিক্ষেত্র নির্ধারণ করেন।
নির্বাহী বিভাগের বিভিন্ন উপবিভাগের মধ্যে অন্যতম হল জনপ্রশাসন (Public Administration)। বিসিএসের মাধ্যমে যারা প্রশাসন ক্যাডারে যোগদান করেন তাদের পদ হলো সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। সহকারী পুলিশ সুপার পদমর্যাদার ব্যক্তিদেরকে কিংবা বিভিন্ন বোর্ড পরীক্ষায় দায়িত্ব পালনের সময় সরকারি কলেজের শিক্ষকদেরকেও (বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার) সরকার ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা অর্পণ করতে পারে যাকে স্পেশাল নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বলে। তবে তারা কিন্তু নিজেদেরকে ম্যাজিস্ট্রেট পরিচয় দিতে পারেন না। যখন বলা হচ্ছে,”অমুক একজন ম্যাজিস্ট্রেট।” তার অর্থ - তিনি হলেন বিচার বিভাগে নিযুক্ত একজন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (Judicial Magistrate)।
জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের বেতন স্কেল শুরুতে ৬ষ্ঠ গ্রেড (বেসিক ৩০,৯৩৫ টাকা)। আর যিনি বিসিএসের মাধ্যমে সহকারী কমিশনার হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন, তার বেতন স্কেল শুরুতে ৯ম গ্রেড (বেসিক ২২,০০০ টাকা)। উভয়ই প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড অফিসার। কোনো সহকারী কমিশনারকে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে পরিচয় দিতে হলে অবশ্যই বলতে হবে তিনি “নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা Executive Magistrate”। শুধুমাত্র "ম্যাজিস্ট্রেট” বলা যাবে না। কোনো সহকারী কমিশনার যখন ভূমি অফিসের দায়িত্ব পালন করেন, তখন তাকে বলা হয় Assistant Commissioner of Land বা সহকারী কমিশনার ভূমি (প্রচলিত AC Land)। এরপর সহকারী কমিশনারগণ প্রমোশন পেতে পেতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (UNO), জেলা প্রশাসক (DC) হন। ডিসি এবং ইউএনও গণও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, কোনোভাবেই ম্যাজিস্ট্রেট নন। একটি জেলার মুখ্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে বলা হয় জেলা প্রশাসক। অনেকেই সদ্য যোগদান করা সহকারী কমিশনারকে ম্যাজিস্ট্রেট বলে ভুল করেন। জেলা প্রশাসক পদোন্নতি পেয়ে বিভাগীয় কমিশনার, মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব ইত্যাদি পদ অর্জন করেন। বলা বাহুল্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদ সচিব এবং মন্ত্রণালয়ের প্রধান হলেন মন্ত্রী। সরকারের মন্ত্রণালয়ের কিছু সিদ্ধান্ত সচিব হয়ে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসক হয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং সহকারী কমিশনারের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়িত হয়। আবার কিছু কিছু সিদ্ধান্ত বিসিএসের অন্যান্য ক্যাডার সার্ভিস যেমন পুলিশ, স্বাস্থ্য, গণপূর্ত, কর, শুল্ক ও আবগারি, তথ্য, পররাষ্ট্র, হিসাব ও নিরীক্ষা, কৃষি, শিক্ষা, মৎস্য, খাদ্য, সমবায়, বানিজ্য, বন, সড়ক ও জনপথ, রেলওয়ে, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল, আনসার, ডাক, পরিবার পরিকল্পনা ইত্যাদির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়।
মোবাইল কোর্ট সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপীল করতে হয় জেলা প্রশাসকের নিকটে। জেলা প্রশাসকের আদেশের বিরুদ্ধে আপীল শোনেন জেলা ও দায়রা জজ। অর্থাৎ জেলা প্রশাসকের মোবাইল কোর্ট সংশ্লিষ্ট যেকোনও সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিতে পারেন জেলা ও দায়রা জজ। (ধারা-১৩(৩), ভ্রাম্যমান আদালত আইন, ২০০৯) প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট পদোন্নতি পেয়ে এক সময়ে চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এবং জেলা ও দায়রা জজ হন। আবার কেউ কেউ সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি হন। একটি জেলার সর্বোচ্চ বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা হলেন জেলা ও দায়রা জজ। অন্যদিকে, চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হচ্ছেন জেলার প্রধান ম্যাজিস্ট্রেট। জেলা ও দায়রা জজের পদমর্যাদা প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদ সচিবের সমমানের এবং চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের পদমর্যাদা সচিব মর্যাদাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের সমান। অন্যদিকে, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ক্যাডার হতে পদোন্নতিপ্রাপ্ত উপসচিবগণের মধ্য হতে জেলা প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। বাংলাদেশের পদমর্যাদা ক্রম (Warrant of Precedence) অনুযায়ী জেলা ও দায়রা জজের পদক্রম ১৬, চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের পদক্রম ১৭ এবং জেলা প্রশাসকের পদক্রম ২৪ নম্বরে অবস্থিত।[১০][১১][১২]
জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা ম্যাজিস্ট্রেট হতে হলে অবশ্যই আইন ব্যাকগ্রাউন্ড থাকতে হবে এবং এরপর বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস (BJS) পরীক্ষা দিতে হবে। সহকারী কমিশনার যেকোনও সাবজেক্টে পড়ে হওয়া যায়, তবে ম্যাজিস্ট্রেট হতে হলে আইন বিষয়ে ডিগ্রি থাকা বাধ্যতামূলক। বিসিএস প্রশাসনে সদ্য সুপারিশ প্রাপ্ত বা নিয়োগ প্রাপ্ত ব্যক্তির পদবীকে সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা প্রচলিত অর্থে প্রশাসন ক্যাডার বলা যায়, কোনো অর্থেই ম্যাজিস্ট্রেট নয়। ম্যাজিস্ট্রেট বলতে শুধুমাত্র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে বোঝায়।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক মোবাইল কোর্ট (ভ্রাম্যমাণ আদালত) পরিচালনা ইতিমধ্যে সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ অবৈধ ঘোষণা করেছে। বর্তমানে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে। আপীল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের রায় বহাল রাখলে পার্লামেন্ট ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন সংশোধন করবে। এরপর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা যাবে না এবং এ স্থলে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হবে।
ম্যাজিস্ট্রেট এবং পুলিশের সম্পর্কসম্পাদনা
প্রত্যেক পুলিশ অফিসার সকল ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করবে - এটা আইনগত বাধ্যবাধকতা। শুধু তাই নয়, কোনো পুলিশ অফিসার প্রকাশ্যে কোনো আদালত কিংবা ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রতি কোনো ধরনের কটাক্ষ করতে পারবে না, এমনকি প্রকাশ হতে পারে এমন কোনো প্রতিবেদন বা দলিলে আদালত কিংবা ম্যাজিস্ট্রেটদের কোনো ধরনের সমালোচনাও করতে পারবে না। (প্রবিধান ৩০, পুলিশ রেগুলেশনস অব বেঙ্গল)
তাছাড়া, পুলিশ আইনের ২৩ ধারাতে পুলিশ অফিসার কর্তৃক অবশ্য পালনীয় দায়িত্বসমূহের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। উক্ত ধারার বিধান অনুযায়ী অন্যান্য অনেক দায়িত্বের পাশাপাশি প্রত্যেক পুলিশ অফিসার শীঘ্রই ম্যাজিস্ট্রেটের সকল নির্দেশ মানতে এবং বাস্তবায়ন করতে আইনত বাধ্য।[১৩]
আইনের সুস্পষ্ট বাধ্যবাধকতামূলক ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও কোনো পুলিশ অফিসার যদি ম্যাজিস্ট্রেটের কোনো আদেশ বাস্তবায়ন না করে কিংবা করতে অনীহা প্রকাশ করে এবং ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়, তাহলে তা যথাক্রমে পুলিশ আইনের ২৩ ধারা মতে নির্ধারিত পুলিশ কর্তৃক অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব ও কর্তব্যের লংঘন এবং পুলিশ রেগুলেশনস অব বেঙ্গল (পিআরবি) এর ৩০ প্রবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কোনো পুলিশ অফিসার আদালত কিংবা ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন না করলে, ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ পালন না করলে তার শাস্তির বিধান আছে পুলিশ আইনের ২৯ ধারায়।
কোনো পুলিশ অফিসার কর্তৃক কোনো অসদাচরণের অভিযোগ থাকলে ম্যাজিস্ট্রেট নিজেই ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০(১)সি ধারা মোতাবেক অপরাধ আমলে গ্রহণ করতে পারেন। (প্রবিধান ২৫ক, পিআরবি)[১৪]
এখতিয়ার ও ক্ষমতাসম্পাদনা
চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করতে পারেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ২৯(গ) ধারায় বলা হয়েছে, সরকার হাইকোর্ট বিভাগের সাথে পরামর্শক্রমে চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটকে মৃত্যুদন্ড ছাড়া সকল অপরাধের বিচার করার ক্ষমতা অর্পণ করতে পারবে। উক্ত আইনের ৩৩(ক) ধারায় উল্লেখ আছে যে, ২৯(গ) ধারা ক্ষমতাবলে চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মৃত্যুদন্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা ৭ বছরের অধিক কারাদণ্ড ব্যতীত আইনে অনুমোদিত যেকোনও কারাদণ্ড প্রদান করতে পারবেন। অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও অতিরিক্ত চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের সাজা প্রদানের ক্ষমতা চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট/চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের সমান। অর্থাৎ তারাও সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করতে পারেন। সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ৫ বছর পর্যন্ত কারাদন্ডের আদেশ দিতে পারেন। জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ৩ বছর পর্যন্ত কারাদন্ডে প্রদানে সক্ষম। অপরদিকে, জেলা প্রশাসক সহ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ ২ বছরের বেশি কারাদণ্ড দিতে পারেন না।[১৫][১৬]
অপরাধ আমলে গ্রহণসম্পাদনা
ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০(১)সি ধারা অনুযায়ী প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট কোনো অভিযোগ ছাড়াই স্বত:প্রণোদিতভাবে যেকোনো অপরাধ আমলে নিতে পারেন। থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আমল যোগ্য অপরাধের সংবাদ পেলে তাকে এজাহার হিসেবে রেকর্ড করেন। আমল অযোগ্য অপরাধ হলে সেটার জন্য সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয় এবং প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট অনুমতি দিলে পুলিশ তদন্ত করতে পারে। অন্যদিকে, আদালতে কেউ সরাসরি অভিযোগ নিয়ে আসলে এবং সেটা গুরুতর প্রকৃতির হলে সংশ্লিষ্ট প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট সেটিকে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৬(৩) ধারা অনুযায়ী এজাহার হিসেবে রেকর্ড করার জন্য থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিতে পারেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ২০০ ধারা অনুসারে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট অভিযোগকারীকে পরীক্ষা করে অপরাধ আমলে নিতে পারেন বা ২০২ ধারা মোতাবেক পুলিশ বা অন্য যে কাউকে তদন্তের নির্দেশ দিতে পারেন। রিপোর্ট প্রাপ্তির পর সংশ্লিষ্ট ধারায় অপরাধ আমলে গ্রহণ করতে পারেন।[১৭]
রিমান্ডসম্পাদনা
বাংলাদেশের সংবিধান এর ৩৩(২) অনুচ্ছেদ এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ৬১ ধারা অনুযায়ী পুলিশ কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের সময় হতে ২৪ ঘন্টার মধ্যে জেলার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট/চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক নির্ধারিত আমলী আদালতের অধিক্ষেত্রের প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট সম্মুখে উপস্থাপন করবে। সংশ্লিষ্ট প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট গুরুতর বা সূত্রবিহীন (Clueless) অপরাধের ক্ষেত্রে আসামীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭(১) ধারা মোতাবেক ১৫ দিন পর্যন্ত পুলিশ রিমান্ডের আদেশ দিতে পারেন।
ইতিহাস ও উৎপত্তিসম্পাদনা
২০০৭ সালের ১লা নভেম্বর বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের[১৮] মাধ্যমে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট পদটি সৃষ্টি করা হয়। এর ফলশ্রুতিতে জেলা প্রশাসকের সকল প্রকার বিচারিক ক্ষমতা পৃথক করে চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের ওপর অর্পণ করা হয়। প্রাচীন রোমে ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন একজন অন্যতম উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যার নির্বাহী ও বিচারিক[১৯] উভয় ধরনের ক্ষমতাই ছিল।
নিয়োগসম্পাদনা
বাংলাদেশের সংবিধানের[২০] ১১৫ ও ১৩৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দিয়ে থাকেন। আইন মন্ত্রণালয়[২১][২২] সুপ্রীম কোর্টের[২৩] সাথে পরামর্শক্রমে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের পদায়ন ও বদলি করে থাকে।[২৪]
জাস্টিস অব পিসসম্পাদনা
ফৌজদারি কার্যবিধির ২৫ ধারার বিধান মোতাবেক চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট পদাধিকার বলে নিজ অধিক্ষেত্রের মধ্যে জাস্টিস অব পিস বা শান্তি রক্ষাকারী বিচারপতি হিসেবে ক্ষমতা প্রয়োগ করেন।
পদমর্যাদাসম্পাদনা
বাংলাদেশের পদমর্যাদা ক্রম অনুযায়ী চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের পদক্রম ১৭, অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও অতিরিক্ত চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের পদক্রম ২১ এবং সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের পদক্রম ২৫ নম্বরে অবস্থিত।[২৫][২৬][২৭][২৮][২৯]
আরও দেখুনসম্পাদনা
তথ্যসূত্রসম্পাদনা
- ↑ "বিচার বিভাগ জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেছে"।
- ↑ "বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা"।
- ↑ "সরকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে"।
- ↑ "ফৌজদারি কার্যবিধি"।
- ↑ "Legal system of Bangladesh"। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জুন ২০১৬।
- ↑ "জেলা আদালত"।
- ↑ "বিচার বিভাগের ইতিহাস"।
- ↑ "বাংলাদেশের আদালতসমূহ"। ২০১৫-০৯-২৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৭-০৭।
- ↑ "বিচার বিভাগ"।
- ↑ "জেলা ও দায়রা জজের পদমর্যাদা এখন ৮ ধাপ ওপরে"।
- ↑ "জেলা ও দায়রা জজের পদমর্যাদা ১৬ এবং চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের পদমর্যাদা ১৭ তে উন্নীত"।
- ↑ "Supreme Court releases full verdict on Warrant of Precedence"।
- ↑ "পুলিশ আইন, ১৮৬১"।
- ↑ "পুলিশ রেগুলেশনস অব বেঙ্গল (পিআরবি), ১৯৪৩"।
- ↑ "বিচার বিভাগীয় বাতায়ন"।
- ↑ "দন্ডবিধি, ১৮৬০"।
- ↑ "ক্রিমিনাল রুলস এন্ড অর্ডারস, ২০০৯"।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ "বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ"।
- ↑ "বিচার বিভাগ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা"।
- ↑ "বাংলাদেশের সংবিধান"।
- ↑ "আইন ও বিচার বিভাগ"।
- ↑ "শেখ হাসিনা বিচার বিভাগকে আপন করে নিয়েছেন"।
- ↑ "২৩তম প্রধান বিচারপতি হলেন হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী"।
- ↑ "বাংলাদেশের সংবিধানে বিচার বিভাগ"।
- ↑ "দশ পদের পদমর্যাদা পরিবর্তন"।
- ↑ "জেলা জজের পদমর্যাদা সচিব ও চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের পদমর্যাদা সচিব মর্যাদাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের সমান"।
- ↑ "পদমর্যাদার ক্রম রিটের সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ"।
- ↑ "জেলা জজের পদক্রম ১৬ এবং চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের পদক্রম ১৭ তে উন্নীত"।
- ↑ "পদমর্যাদার ক্রম মামলায় সর্বোচ্চ আদালতের রায় প্রকাশ"।