বাংলায় মারাঠা আক্রমণ (১৭৪৫–১৭৪৯)

বাংলায় মারাঠা আক্রমণ (১৭৪৫–১৭৪৯) বলতে মারাঠা সাম্রাজ্য কর্তৃক ১৭৪৫ সাল থেকে ১৭৪৯ সাল পর্যন্ত বাংলা আক্রমণ এবং এর ফলে বাংলার নবাবের সঙ্গে মারাঠাদের সংঘর্ষকে বোঝানো হয়। ১৭৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলার নবাব আলীবর্দী খানের আফগান সৈন্যরা বিদ্রোহ করে[১] এবং এ সুযোগে মারাঠারা বাংলা আক্রমণ করে। চার বছরব্যাপী তীব্র সংঘর্ষের পর ১৭৪৯ সালের জুনে নবাব মারাঠাদের বাংলা থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হন[১][২]

বাংলায় মারাঠা আক্রমণ (১৭৪৫–১৭৪৯)
মূল যুদ্ধ: বর্গির হাঙ্গামা
তারিখ১৭৪৫ – মে ১৭৪৯[১]
অবস্থান
ফলাফল

বাংলার নবাবের বিজয়[১][২]

  • ১৭৪৮ সালে আফগান সৈন্যদের বিদ্রোহের অবসান ঘটে[১]
  • বাংলায় মারাঠা আক্রমণ ব্যর্থ হয়[১]
  • মারাঠারা বাংলা থেকে সমস্ত সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়[১][২]
অধিকৃত
এলাকার
পরিবর্তন
অপরিবর্তিত
বিবাদমান পক্ষ
বাংলা Flag of the Maratha Empire.svg মারাঠা সাম্রাজ্য
নবাবের বিদ্রোহী আফগান সৈন্যদল[১] (১৭৪৫–১৭৪৮)
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
আলীবর্দী খান
মীর জাফর
আতাউল্লাহ খান
রায় দুর্লভ আত্মসমর্পণকারী
সমশের খান (১৭৪৫–১৭৪৬)
সরদার খান (১৭৪৫–১৭৪৬)
হাজি আহমদ 
জৈনুদ্দিন আহমদ 
মোস্তফা খান বাহাদুর
মুসাইব খান মোহমান্দ 
সৈয়দ আহমদ খান
আব্দুস সালাম

Flag of the Maratha Empire.svg প্রথম রঘুজী ভোঁসলে
Flag of the Maratha Empire.svg জানুজী ভোঁসলে
Flag of the Maratha Empire.svg সাবাজী ভোঁসলে
Flag of the Maratha Empire.svg মীর হাবিব
সমশের খান  (১৭৪৮)
সরদার খান  (১৭৪৮)


গোলাম মুস্তফা খান 
মুর্তজা খান
আব্দুর রসুল খান
শক্তি
১০,০০০+ (১৭৪৭ সালে) Flag of the Maratha Empire.svg ২৪,০০০[১] (১৭৪৫ সালে)
৪০,০০০[৩]–৪৫,০০০[৪] (১৭৪৭ সালে)
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
অজ্ঞাত Flag of the Maratha Empire.svg অজ্ঞাত, তবে প্রচুর[১]

পটভূমিসম্পাদনা

১৭৪২, ১৭৪৩ এবং ১৭৪৪ সালে মারাঠা নেতা রঘুজী ভোঁসলে পরপর তিন বার বাংলা আক্রমণ করেন[১][২]। কিন্তু প্রতিবারই তার আক্রমণ ব্যর্থ হয়[১]। ১৭৪৫ সালে বাংলায় অভ্যন্তরীণ গোলযোগের সুযোগ নিয়ে রঘুজী আবার বাংলা আক্রমণ করেন[১]

আফগান সৈন্যদের বিদ্রোহ এবং মারাঠা আক্রমণসম্পাদনা

১৭৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে নবাব আলীবর্দীর সৈন্যবাহিনীর আফগান সৈন্যরা নবাবের আফগান সেনাপতি গোলাম মুস্তফা খানের নেতৃত্ব বিদ্রোহ ঘোষণা করে[১][২]। মারাঠারা এ গণ্ডগোলের সুযোগ গ্রহণ করে এবং চতুর্থ বারের মত বাংলা আক্রমণ করে।

মারাঠাদের উড়িষ্যা দখলসম্পাদনা

নবাব যখন আফগানদের বিদ্রোহ দমন করতে ব্যস্ত ছিলেন, তখন প্রথম রঘুজী ভোঁসলেমীর হাবিব ২৪,০০০ মারাঠা সৈন্যসহ আবার উড়িষ্যা আক্রমণ করেন[১][২] এবং উড়িষ্যার নবনিযুক্ত প্রাদেশিক শাসনকর্তা রায় দুর্লভকে পরাজিত ও বন্দি করেন। রায় দুর্লভ ৩ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে মুক্তিলাভ করেন[১]

মারাঠাদের বাংলা আক্রমণসম্পাদনা

উড়িষ্যা দখলের পর মারাঠা বাহিনী মেদিনীপুর, বর্ধমানবীরভূমে লুটপাট ও উপদ্রব করে এবং বিহারের দিকে অগ্রসর হয়। তারা বিহারেও লুটতরাজ করে এবং নবাবের বিদ্রোহী আফগান সৈন্যদের সঙ্গে যোগ দেয়[১]। মারাঠাদের অনুসরণ করে আলীবর্দী বিহারে আসেন এবং ১৭৪৫ সালের ১৪ নভেম্বর মুহিব-আলীপুরের যুদ্ধে মারাঠা ও আফগানদের সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করেন[১]

বাংলায় মারাঠাদের পরাজয়সম্পাদনা

এদিকে মীর হাবিবের পরামর্শে রঘুজী নবাবের অনুপস্থিতির সুযোগে মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করার জন্য যাত্রা করেন। আলীবর্দীও ত্বরিতগতিতে তাকে অনুসরণ করে ঠিক সময়মতো রাজধানীতে পৌঁছান এবং রঘুজীর দুরভিসন্ধি ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হন[১]। নবাব পলায়নরত মারাঠাদের অনুসরণ করেন, এবং ১৭৪৫ সালের ডিসেম্বরে কাটোয়ার নিকটে তাদের আবার পরাজিত করেন ও তাদের দ্রব্যসামগ্রী হস্তগত করেন[১]। রঘুজী নাগপুরে প্রত্যাবর্তন করেন এবং মীর হাবিব মেদিনীপুরের দিকে পালিয়ে যান[২]। ক্লান্ত সৈন্যদের বিশ্রাম প্রদানের জন্য আলীবর্দী ফিরে আসেন।

নবাব শিবিরে বিশ্বাসঘাতকতাসম্পাদনা

কয়েক মাস পর নবাব আবার মারাঠাদের বিরুদ্ধে রওয়ানা হন এবং ১৭৪৬ সালের এপ্রিলের মধ্যে বাংলার মূল ভূখণ্ড থেকে তাদের বিতাড়িত করেন। কিন্তু উড়িষ্যা পুনরুদ্ধারের কার্য তাকে স্থগিত রাখতে হয়। কারণ, নবাবের দুইজন আফগান সেনাপতি সমশের খান ও সর্দার খান মারাঠাদের সঙ্গে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন[১]। নবাব তাদের পদচ্যুত করেন এবং নতুন সৈন্যবৃদ্ধির ব্যবস্থা করেন[১]

পেশোয়ার হস্তক্ষেপের প্রচেষ্টাসম্পাদনা

এই সময়ে মারাঠা পেশোয়া বালাজী বাজী রাও মুঘল সম্রাটের সঙ্গে এ মর্মে চুক্তি করেন যে, বাংলার মূল ভূখণ্ডের জন্য ২৫ লক্ষ টাকা এবং বিহারের জন্য ১০ লক্ষ টাকা চৌথ রূপে রাজা সাহুকে দেয়া হলে এর বিনিময়ে তিনি বাংলাকে রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন[১]। কিন্তু ১৭৪৬ সালের অক্টোবরে নবাব পেশোয়ার পূর্বের অঙ্গীকার ভঙ্গের কথা উল্লেখ করে মুঘল সম্রাটকে জানান যে, মারাঠাদের প্রতিশ্রুতির কোনো মূল্য নেই এবং তিনি তার দেশকে রক্ষা করার জন্য নিজের বাহুবলের ওপর নির্ভর করতে কৃতসংকল্প হয়েছেন[১][২]

মারাঠাদের বিরুদ্ধে নবাবের অভিযানসম্পাদনা

নবাবের মেদিনীপুর পুনরুদ্ধারসম্পাদনা

১৭৪৬ সালের নভেম্বরে মীর হাবিবের কাছ থেকে উড়িষ্যা উদ্ধারের জন্য আলীবর্দীর অভিযান শুরু হয়। নবাবের সেনাপতি মীর জাফর মেদিনীপুরের নিকটে একটি যুদ্ধে মীর হাবিবের সেনাপতি সাঈদ নূর-কে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করেন[১][২]। আলীবর্দী মীর জাফরকে উড়িষ্যার প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন এবং মীর জাফরকে সহায়তা করার জন্য আতাউল্লাহ খানকে প্রেরণ করেন[১]

মারাঠাদের মেদিনীপুর পুনর্দখলসম্পাদনা

কিন্তু মীর হাবিব বালাসোরের দক্ষিণ দিক থেকে অগ্রসর হন এবং শীঘ্রই রঘুজীর ছেলে জানুজী ভোঁসলের নেতৃত্বে মারাঠারা তার সঙ্গে যোগদান করে। আক্রমণকারী মারাঠা বাহিনীতে ছিল ৪০ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য। এটি ছিল বাংলা আক্রমণকারী সর্ববৃহৎ মারাঠা বাহিনী। পরিস্থিতির পরিবর্তনের সংবাদ পেয়ে মীর জাফর এবং আতাউল্লাহ খান মেদিনীপুর পরিত্যাগ করে বর্ধমানে পালিয়ে যান[১][২] এবং সেখানে নবাব আলীবর্দীর পৌঁছানোর অপেক্ষা করতে থাকেন।

নবাব শিবিরে অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রসম্পাদনা

মারাঠাদের প্রতিরোধ করার জন্য অগ্রসর না হয়ে মীর জাফর এবং আতাউল্লাহ খান আলীবর্দীকে হত্যা করে নিজেদের মধ্যে রাজ্য ভাগ করে নেয়ার ষড়যন্ত্র করতে থাকেন[১][২]। এ পরিস্থিতিতে নবাব স্বয়ং মারাঠাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। মীর জাফর অনুতপ্ত না হয়ে নবাবের প্রতি উদ্ধত আচরণ করেন। নবাব মীর জাফর এবং আতাউল্লাহকে পদচ্যুত করেন[১]

বর্ধমানের যুদ্ধসম্পাদনা

১৭৪৭ সালের মার্চে বর্ধমানের নিকটে আলীবর্দী এবং মারাঠাদের মধ্যে একটি তীব্র যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মারাঠারা এ যুদ্ধের সময়ে আলীবর্দীকে ঘিরে ফেলেছিল। কিন্তু আলীবর্দীর রণকৌশলের নিকট তারা আবারও শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়[১][২]

আফগান বিদ্রোহ এবং মারাঠা অগ্রাভিযানসম্পাদনা

বর্ধমানের যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ার পর ব্যর্থ মারাঠা সৈন্যরা মেদিনীপুরে পালিয়ে যায়। মুর্শিদাবাদ এবং বর্ধমান জেলা মারাঠামুক্ত হয়।

বিহারে আফগান বিদ্রোহসম্পাদনা

কিন্তু ইতোমধ্যে এক নতুন সঙ্কট দেখা দেয়। বিহারের প্রাদেশিক শাসনকর্তা জৈনুদ্দিন আহমদ (নবাবের ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা) সৈন্য বৃদ্ধির জন্য সমশের খান ও সরদার খান-কে (যাঁদেরকে নবাব আলীবর্দী পদচ্যুত করেছিলেন) নিজ সৈন্যদলে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ১৭৪৮ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি তারা বিশ্বাসঘাতকতা করে জৈনুদ্দিন ও তার পিতা হাজী আহমদকে হত্যা করেন এবং জৈনুদ্দিনের স্ত্রী আমেনা বেগম (নবাবের কন্যা) ও সন্তানদেরকে বন্দি করেন[১][২]। এই মর্মান্তিক ঘটনার সংবাদ পেয়ে আলীবর্দী বিহার অভিমুখে যাত্রা করেন। মীর হাবিবের অধীনস্থ মারাঠা সৈন্যরা বিদ্রোহী আফগানদের সঙ্গে যোগ দেয়ার জন্য অগ্রসর হচ্ছিল। ভাগলপুরের যুদ্ধে নবাব তাদেরকে পরাজিত করেন[১][২]

এরপর ১৭৪৮ সালের ১৬ এপ্রিল বিহারের রাজধানী পাটনার ২৬ মাইল দূরে কালাদিয়ারা নামক স্থানে নবাবের সৈন্যদের সঙ্গে মারাঠা ও আফগানদের সম্মিলিত বাহিনীর তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে নবাব মারাঠা ও আফগানদের বিধ্বস্ত করে[১] তার কন্যা ও দৌহিত্রদের মুক্ত করেন এবং বিহার পুনরুদ্ধার করেন। এরপর নবাব তার দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলাকে বিহারের প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন এবং রাজা জানকীরামকে সিরাজের নায়েব নিযুক্ত করেন।

নবাবের উড়িষ্যা পুনরুদ্ধারসম্পাদনা

বিহারে আফগান বিদ্রোহ দমনের পর নবাব রাজধানীতে ফিরে যান এবং পুরো বর্ষাকাল সেখানে অবস্থান করেন। পুরো ১৭৪৮ সাল জুড়ে উড়িষ্যা এবং মেদিনীপুর পর্যন্ত অঞ্চল নিরবচ্ছিন্নভাবে মারাঠাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে[২]

১৭৪৯ সালের মার্চে আলীবর্দী উড়িষ্যা পুনর্দখলের জন্য যাত্রা করেন। তিনি মেদিনীপুর থেকে জঙ্গলাকীর্ণ পথে মীর হাবিব ও মারাঠাদের অনুসরণ করে উড়িষ্যায় উপস্থিত হন[১][২]। ১৭৪৯ সালের মে মাসে তিনি মারাঠাদেরকে পরাজিত করে উড়িষ্যার রাজধানী কটক ও অন্যান্য স্থান পুনরুদ্ধার করেন[১]। কয়েকটি ছোটোখাটো সংঘর্ষের পর মারাঠারা আর যুদ্ধ না করে কেবলই পালাতে থাকে। ১৭৪৯ সালের জুনের মাঝামাঝি উড়িষ্যা পুনর্দখল সম্পূর্ণ হয়[১][২]

ফলাফলসম্পাদনা

উড়িষ্যা পুনর্দখলের পর নবাব আব্দুস সালাম নামক তার একজন সেনাপতিকে উড়িষ্যার প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন[১][২] এবং বিজয়ী রূপে মুর্শিদাবাদে প্রত্যাবর্তন করেন। বাংলায় মারাঠা আক্রমণের সাময়িক অবসান ঘটে। কিন্তু নবাবের প্রত্যাবর্তনের এক সপ্তাহ পরেই মারাঠারা আবার বাংলা আক্রমণ করে[১]

আরো দেখুনসম্পাদনা

তথ্যসূত্রসম্পাদনা

  1. ড় ঢ় য় কক কখ ড. মুহম্মদ আব্দুর রহিম, (বাংলাদেশের ইতিহাস), আলীবর্দী ও মারাঠা আক্রমণ, পৃ. ২৯৩–২৯৯
  2. মোহাম্মদ শাহ (২০১২)। "মারাঠা হামলা"ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743 
  3. http://en.m.wikipedia.org/wiki/Alivardi_Khan#Battle_of_Burdwan
  4. "A site dedicated to Alivardi Khan"। ৯ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ এপ্রিল ২০১৭