বর্ধমানের যুদ্ধ (১৭৪৭)
বর্ধমানের দ্বিতীয় যুদ্ধ ১৭৪৭ সালের মার্চে বর্ধমানে মারাঠা বাহিনী এবং বাংলার নবাবের বাহিনীর মধ্যে সংঘটিত হয়[১][২]। তীব্র যুদ্ধের পর নবাবের বাহিনীর নিকট মারাঠারা সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়[১][২]।
বর্ধমানের দ্বিতীয় যুদ্ধ | |||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|
মূল যুদ্ধ: বর্গির হাঙ্গামা এবং বাংলায় মারাঠা আক্রমণ (১৭৪৫–১৭৪৯) | |||||||
| |||||||
বিবাদমান পক্ষ | |||||||
বাংলা | মারাঠা সাম্রাজ্য | ||||||
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী | |||||||
আলীবর্দী খান মোস্তফা খান বাহাদুর মুসাইব খান মোহমান্দ † |
জানুজী ভোঁসলে মীর হাবিব | ||||||
শক্তি | |||||||
~১০,০০০[৩] | ৪০,০০০[৩]–৪৫,০০০[৪] | ||||||
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি | |||||||
অজ্ঞাত | অজ্ঞাত, তবে প্রচুর[১][২] |
পটভূমি
সম্পাদনা১৭৪৫ সালে মারাঠা নেতা রঘুজী ভোঁসলে বাংলা আক্রমণ করে উড়িষ্যা থেকে মেদিনীপুর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে নেন[১]। ১৭৪৬ সালের ডিসেম্বরে বাংলার নবাব আলীবর্দী খানের সেনাপতি মীর জাফর মেদিনীপুর পুনরুদ্ধার করেন[২], কিন্তু উড়িষ্যা থেকে আগত প্রায় ৪০,০০০ সৈন্যের নতুন মারাঠা বাহিনী মেদিনীপুর পুনর্দখল করে নেয়[২][৩]। এরপর নবাব নিজেই সসৈন্যে মারাঠাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন।
যুদ্ধের ঘটনাবলি
সম্পাদনানবাবের সমরসজ্জা
সম্পাদনাবিশাল মারাঠা বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য আলীবর্দী পর্যাপ্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ১০,০০০ সৈন্যের একটি সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলেন। এই বাহিনীটির অধিকাংশ সৈন্য ছিল বাঙালি, কিন্তু তার পাশাপাশি বহুসংখ্যক পশতুন, তুর্কি, আর্মেনীয়, ইরানি, জর্জীয়, কিজিলবাস এবং আবিসিনীয় সৈন্যও এই বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত ছিল[১][৩]। তবে তা সত্ত্বেও আলীবর্দীর সংগৃহীত বাহিনীর তুলনায় মারাঠাদের লোকবল ছিল চারগুণ[৩]।
এই অভিযানে আলীবর্দী খান তার গোলন্দাজ বাহিনীর কামান বহনের জন্য ষাঁড়ের টানা এক প্রকার নতুন ধরনের বাহন ব্যবহার করেছিলেন। এর ফলে দ্রুতগতিতে কামান বহন করা সম্ভব হয়েছিল[৩]। চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণের পর আলীবর্দী খান সসৈন্যে মুর্শিদাবাদ থেকে বর্ধমানের দিকে রওনা হন এবং তিনদিন প্রায় অবিরাম চলার পর বর্ধমানের নিকটে পৌঁছেন[৩]।
নবাব বাহিনীর প্রাথমিক বিপর্যয়
সম্পাদনাএই অভিযানে আলীবর্দী খানের সঙ্গে তার স্ত্রী শরফুন্নেসাও এসেছিলেন। তিনি ছিলেন আলীবর্দীর বাহিনীর সম্মুখভাগে। তার সুরক্ষার দায়িত্বে ছিল আলীবর্দীর বাহিনীর ক্ষুদ্র 'ভ্যানগার্ড' বা সম্মুখরক্ষী বাহিনীর ওপর। এই বাহিনীর প্রধান ছিলেন মুসাইব খান মোহমান্দ। তিনি ছিলেন আলীবর্দীর একজন সেনাপতি উমর খান মোহমান্দের ছেলে।
বর্ধমানের কাছাকাছি পৌঁছানোর পর মারাঠা সৈন্যদের একটি বৃহৎ দল নবাবের সৈন্যবাহিনীর সম্মুখরক্ষী বাহিনীর ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়[৩]। তাদের অতর্কিত আক্রমণে ক্ষুদ্র বাহিনীটির অধিকাংশ সৈন্যই প্রাণ হারায়। এসময় বেগম শরফুন্নেসা একটি হাতির পিঠে উপবিষ্ট ছিলেন। মারাঠা সৈন্যরা হাতিটিকে টেনে মারাঠা শিবিরের দিকে নিয়ে যেতে থাকে[৩]।
কিন্তু তরুণ মুসাইব খান বীরত্ব ও সাহসিকতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন[৩]। পালিয়ে না গিয়ে তিনি অবশিষ্ট সৈন্যদের নিয়ে বিশাল মারাঠা বাহিনীকে আক্রমণ করেন এবং ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে বেগম শরফুন্নেসাকে মুক্ত করে আনেন[৩]। কিন্তু, মারাঠাদের পাল্টা আক্রমণে মুসাইব খান তার স্বল্পসংখ্যক সৈন্যসহ নিহত হন। শরফুন্নেসা বেঁচে যাওয়া কয়েকজন সৈন্যের সহযোগিতায় নিরাপদ দূরত্বে চলে যেতে সক্ষম হন এবং মূল বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেন। আলীবর্দী খান এই সংবাদ পাওয়ার পর অত্যন্ত দু:খিত হন[৩]।
নবাব অবরুদ্ধ
সম্পাদনাযখন শরফুন্নেসা আলীবর্দীর মূল বাহিনীর নিকটে পৌঁছেন, ততক্ষণে মারাঠা সৈন্যরা নবাবের বাহিনীকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে। কিন্তু মারাঠা সৈন্যরা সংখ্যায় নবাবের সৈন্যদের চারগুণ হওয়া সত্ত্বেও নবাবের সৈন্যদেরকে সরাসরি আক্রমণ করার সাহস পায় নি। মুসাইব খানের নেতৃত্বে নবাবের সৈন্যদের সাহসিকতা মারাঠা সৈন্যদের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরিয়েছিল[৩]। এজন্য তারা আলীবর্দীর বাহিনীকে সরাসরি আক্রমণ না করে অবরোধ করে রাখে। তারা নবাবের সৈন্যদের চতুর্দিকে পরিখা খনন করে নিজেদেরকে নিরাপদ অবস্থানে রাখে। এদিকে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ায় নবাবের সৈন্যদের রসদ সরবরাহ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়, ফলে তারা ক্রমেই অনাহারে ভুগতে থাকে[৩]।
তবে এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতেও নবাব হতবুদ্ধি হন নি। তিনি চাতুর্যের সঙ্গে যুদ্ধের পরিকল্পনা প্রস্তুত করেন। পরিকল্পনা মোতাবেক তিনি তার সৈন্যবাহিনীর মাঝামাঝি অবস্থানে অবশিষ্ট রসদপত্র জড়ো করেন, আর এর চতুর্দিকে গোলন্দাজ বাহিনী মোতায়েন করেন। নবাবের সেনাপতি মোস্তফা খান বাহাদুর তার অশ্বারোহী বাহিনীকে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত করেন। ইতোমধ্যে নবাবের আরেক সেনাপতি সৈয়দ আহমদ খান মুর্শিদাবাদ থেকে নতুন একদল সৈন্য এবং প্রচুর রসদপত্র নিয়ে পৌঁছেন[৩]।
মারাঠাদের পরাজয়
সম্পাদনাএরপর আলীবর্দী খান তার পরিকল্পনা অনুযায়ী মূল্যবান গালিচা, রেশম, সোরাহি প্রভৃতিসমেত একটি পণ্যবহর মারাঠা সৈন্যব্যূহের নিকটে পাঠান[৩]। মারাঠা সৈন্যরা যথারীতি পণ্যবহর লুট করার জন্য অগ্রসর হয়। এর ফলে তারা নবাবের গোলন্দাজ বাহিনীর গোলার আওতার মধ্যে এসে পড়ে। মোস্তফা খানের অশ্বারোহী সৈন্যরা ডান ও বাম দিক থেকে মারাঠা বাহিনীকে আক্রমণ করে[৩]। নবাবের গোলন্দাজ ও অশ্বারোহী সৈন্যদের নিকট জানুজী ভোঁসলের বিশাল মারাঠা বাহিনী সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়[৩]।
ফলাফল
সম্পাদনাবর্ধমানের যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ার পর ব্যর্থ মারাঠা সৈন্যরা মেদিনীপুরে পালিয়ে যায়[১][২][৩]। ফলে মুর্শিদাবাদ এবং বর্ধমান জেলা মারাঠামুক্ত হয়[২]।
আরো দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ ড. মুহম্মদ আব্দুর রহিম, (বাংলাদেশের ইতিহাস), আলীবর্দী ও মারাঠা আক্রমণ, পৃ. ২৯৩–২৯৯
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ "Forgotten Indian history: The brutal Maratha invasions of Bengal"।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ ঞ ট ঠ ড ঢ ণ ত থ দ ধ http://en.m.wikipedia.org/wiki/Alivardi_Khan
- ↑ "A site dedicated to Alivardi Khan"। ৯ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ এপ্রিল ২০১৭।