নোবেল পুরস্কার

১৮৯৫ সালে আলফ্রেড নোবেল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত উচ্চমর্যাদাবহ বার্ষিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার সংগ্রহ

নোবেল পুরস্কার ( সুয়েডীয় ভাষায়: Nobelpriset–নোবেল্‌প্রীসেৎ) ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে প্রবর্তিত একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার, যা ঐ বছর থেকে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সফল ও অনন্য সাধারণ গবেষণাউদ্ভাবন বা মানবকল্যাণমূলক তুলনারহিত কর্মকাণ্ডের জন্য প্রদান করা হচ্ছে। মোট পাঁচটি বিষয়ে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। বিষয়গুলো হলো: পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা শাস্ত্র, সাহিত্য, এবং শান্তি[] নোবেল পুরস্কারকে এ সব ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।[] নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তদের ইংরেজিতে নোবেল লরিয়েট (Nobel Laureate) বলা হয়।[] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত পুরস্কার প্রদান বন্ধ ছিল।

নোবেল পুরস্কার
A golden medallion with an embossed image of Alfred Nobel facing left in profile. To the left of the man is the text "ALFR•" then "NOBEL", and on the right, the text (smaller) "NAT•" then "MDCCCXXXIII" above, followed by (smaller) "OB•" then "MDCCCXCVI" below.
বিবরণপদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, সাহিত্য, বিশ্ব শান্তি, চিকিৎসায় এবং অর্থনীতিতে মানবজাতির জন্য অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ
দেশসুইডেন,
নরওয়ে (শুধুমাত্র শান্তিতে পুরস্কার)
পুরস্কারদাতাসুয়েডীয় একাডেমি
সুইডিশ বিজ্ঞান একাডেমি
নোবেল কমিটি অফ কারোলিন্সকা ইনষ্টি্টিউট
নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি
প্রথম পুরস্কৃত১৯০১
১৯৬৯ (অর্থনৈতিক বিজ্ঞান)
ওয়েবসাইটnobelprize.org

সুয়েডীয় বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের ১৮৯৫ সালে করে যাওয়া একটি উইলের মর্মানুসারে এই পুরস্কার প্রচলন করা হয়। নোবেল মৃত্যুর পূর্বে উইলের মাধ্যমে এই পুরস্কার প্রদানের ঘোষণা করে যান। শুধুমাত্র শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয় নরওয়ের অসলোতে। বাকি সব ক্ষেত্রে সুইডেনের স্টকহোমে এই পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।

আলফ্রেড নোবেল তার উইলে অর্থনীতিতে পুরস্কারের কথা উল্লেখ করেননি। নোবেল পুরস্কার ১৯০১ সাল প্রবর্তিত হলেও অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান শুরু হয় ১৯৬৯ সালে। নোবেল পুরস্কারের একই মানদণ্ডে অর্থনীতিতে পুরস্কার দেওয়া হলেও এর অন্য নাম দি সেভেরিজেস রিক্সব্যাঙ্ক প্রাইজ ইন ইকনমিক সায়েন্সেস ইন মেমোরি অব আলফ্রেড নোবেল[]

১৯০১ থেকে ২০২৩ এর মধ্যে ১০০০ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। নোবেল পুরস্কার মৃত কোনো ব্যক্তিকে দেওয়া হয় না। লরিয়েটকে অবশ্যই পুরস্কার প্রদানের সময় জীবিত থাকতে হবে। [] কিন্তু এর কিছু ব্যতিক্রম আছে। অতি গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য মরণোত্তর পুরস্কারও দেওয়া হয়।

প্রতি বছর পুরস্কারপ্রাপ্তদের প্রত্যেকে একটি স্বর্ণপদক, একটি সনদ এবং নোবেল ফাউন্ডেশন কর্তৃক উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ পেয়ে থাকেন। ২০২৩ সালে এ অর্থের পরিমাণ ছিল ৯.৮৬ লক্ষ সুইডিশ ক্রোনা অর্থ্যাৎ প্রায় ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার[]

ইতিহাস

সম্পাদনা
 
দ্য মার্চেন্ট অফ ডেথ ইজ ডেড শিরোনামে ফরাসি সংবাদপত্রে আলফ্রেড নোবেল তার নিজের মৃত্যুবিষয়ক সংবাদ পাঠের পর বিস্মিত হয়েছিলেন।

আলফ্রেড নোবেল (শুনুন), ২১ অক্টোবর ১৮৩৩ সালে সুইডেনের স্টকহোমে একটি প্রকৌশল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে রসায়নবিদ, প্রকৌশলী ও একজন উদ্ভাবক ছিলেন। ১৮৯৪ সালে তিনি একটি বফর লোহা ও ইস্পাত কারখানা ক্রয় করেন, যা পরবর্তীতে একটি অন্যতম অস্ত্র তৈরির কারখানায় পরিণত করেন। তিনি ব্যালিস্টিক উদ্ভাবন করেন, যা সারা বিশ্বব্যাপী ধোঁয়াবিহীন সামরিক বিস্ফোরক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তার ৩৫৫ টি উদ্ভাবনের মাধ্যমে তিনি জীবদ্দশায় প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক হন, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল ডিনামাইট[]

১৮৮৮ সালে তিনি মৃতদের তালিকা দেখে বিস্মত হন, যা একটি ফরাসি পত্রিকায় এ মার্চেন্ট অব ডেথ হু ডেড প্রকাশিত হয়। যেহেতু নোবেলের ভাই লুডভিগ মারা যায়, এই নিবন্ধটি তাকে ভাবিয়ে তোলে এবং খুব সহজেই বুঝতে পারেন যে ইতিহাসে তিনি কীভাবে স্মরণীয় হতে চান। যা তাকে তার উইলটি পরিবর্তন করতে অনুপ্রাণিত করে।[] ১০ ডিসেম্বর ১৮৯৬ সালে আলফ্রেদ নোবেল তার নিজ গ্রাম স্যান রিমো, ইতালিতে মৃত্যুবরণ করেন। সেই সময় তার বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর[]

নোবেল তার জীবদ্দশায় অনেকগুলো উইল লিখে গিয়েছিলেন। সর্বশেষটা লেখা হয়েছিল তার মৃত্যুর মাত্র এক বছর আগে ২৭ নভেম্বর ১৮৯৫ সালে প্যারিসে অবস্থিত সুইডিশ-নরওয়ে ক্লাবে।[১০][১১] বিস্ময় ছড়িয়ে দিতে, নোবেল তার সর্বশেষ উইলে উল্লেখ করেন যে, তার সকল সম্পদ পুরস্কার আকারে দেয়া হবে যারা পদার্থ, রসায়ন, চিকিৎসা, শান্তিসাহিত্যে বৃহত্তর মানবতার স্বার্থে কাজ করবেন[১২]। তিনি তার মোট সম্পদের (৩১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনা) ৯৪ শতাংশ এই পাঁচটি পুরস্কারের জন্য উইল করেন।[১৩] ২৬ এপ্রিল ১৮৯৭’র পূর্বাবধি সন্দেহের কারণে নরওয়ে থেকে এই উইল অনুমোদন করা হয় নি।[১৪] তার উইলের সমন্বয়কারী রগনার সোলম্যান ও রুডলফ লিলজেকুইস্ট নোবেল ফাউন্ডেশন তৈরি করেন, যার কাজ তার সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ ও নোবেল পুরস্কার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা।[১৫]

১৮৯৭ সালে আলফ্রেদ নোবেলের উইল অনুমোদন হবার অব্যববহিত পরে নোবেল পুরস্কার প্রদানের জন্য নরওয়েজীয় নোবেল কমিটি নামক একটি সংস্থা গঠন করা হয়। দ্রুত নোবেল পুরস্কার প্রদানের অন্যান্য সংস্থাগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যেমন ৭ জুন ক্যারোলিংস্কা ইনিস্টিটিউট, ৯ জুন সুইডিশ একাডেমি এবং ১১ জুন রাজকীয় সুয়েডীয় বিজ্ঞান একাডেমি[১৬]। নোবেল ফাউন্ডেশন কীভাবে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়, তার একটি নীতিমালায় পৌছায় এবং ১৯০০ সালে নোবেল ফাউন্ডেশন নতুনভাবে একটি বিধি তৈরি করে যা রাজা অস্কার কর্তৃক জারি হয়। [১২] ১৯০৫ সালে সুইডেননরওয়ের মধ্যে বন্ধন বিলুপ্ত হয়। তারপর থেকে নরওয়েজীয় নোবেল কমিটি শুধু মাত্র শান্তিতে নোবেল পুরস্কার এবং সুইডেনের প্রতিষ্ঠানগুলো অন্যান্য পুরস্কারগুলো প্রদানের দায়িত্ব পায়।[১৪]

আলফ্রেদ নোবেলের উইল

সম্পাদনা

সুইডেনের রসায়নবিদ ও শিল্পপতি আলফ্রেদ নোবেলের উইল অনুসারে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। নোবেল ডিনামাইট আবিষ্কার করেছিলেন, যার ফলে তার প্রচুর আয় হয়। উইলে তিনি এই আয়ের অর্থ দ্বারাই পুরস্কার প্রদানের কথা বলে যান। জীবদ্দশায় নোবেল অনেকগুলো উইল লিখেছিলেন। এর মধ্যে সর্বশেষটি লিখেন তার মৃত্যুর মাত্র এক বছর আগে নভেম্বর ২৭, ১৮৯৫ তারিখে। নোবেলের উদ্ভাবনটি ছিল অনেকাংশেই একটি বিস্ফোরক যা প্রভূত ক্ষতির কারণ হতে পারত। তাই যুদ্ধক্ষেত্রে এই ডিনামাইটের ব্যবহার তাকে শঙ্কিত করে তোলে। নোবেল পাঁচটি ক্ষেত্রে পুরস্কার দেয়ার জন্য তার মোট সম্পত্তির শতকরা ৯৪ ভাগ দান করে যান। এর মোট পরিমাণ ৩১ মিলিয়ন এসইকে (৩.৪ মিলিয়ন ইউরো, ৪.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)।

"The whole of my remaining realizable estate shall be dealt with in the following way:
The capital shall be invested by my executors in safe securities and shall constitute a fund, the interest on which shall be annually distributed in the form of prizes to those who, during the preceding year, shall have conferred the greatest benefit on mankind. The said interest shall be divided into five equal parts, which shall be apportioned as follows: one part to the person who shall have made the most important discovery or invention within the field of physics; one part to the person who shall have made the most important chemical discovery or improvement; one part to the person who shall have made the most important discovery within the domain of physiology or medicine; one part to the person who shall have produced in the field of literature the most outstanding work of an idealistic tendency; and one part to the person who shall have done the most or the best work for fraternity among nations, for the abolition or reduction of standing armies and for the holding and promotion of peace congresses.
The prizes for physics and chemistry shall be awarded by the Swedish Academy of Sciences; that for physiological or medical works by the Caroline Institute in Stockholm; that for literature by the Academy in Stockholm; and that for champions of peace by a committee of five persons to be elected by the Norwegian Storting. It is my express wish that in awarding the prizes no consideration whatever shall be given to the nationality of the candidates, so that the most worthy shall receive the prize, whether he be Scandinavian or not."

— আলফ্রেদ নোবেল[১৭]

যদিও আলফ্রেদ নোবেল এই পুরস্কারের প্রচলন করেছেন, তথাপি তিনি এর কার্যক্রম দেখে যেতে পারেননি। কারণ তার পরিকল্পনাটি সম্পূর্ণ ছিল না। এছাড়াও অন্যান্য বেশ কিছু কারণে নোবেল ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠায় কিছুটা দেরি হয়। প্রথম নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় ১৯০১ সালের ডিসেম্বর ১০ তারিখে।[১৮]

প্রথম পুরস্কার

সম্পাদনা

যখন নোবেল ফাউন্ডেশন ও তার নীতিমালাগুলো চূড়ান্ত হলো তখন থেকেই নোবেল কমিটি প্রথম পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন সংগ্রহ করা শুরু করে। পরবর্তীতে তারা প্রাথমিক নির্বাচিত প্রার্থীদের একটি তালিকাও পুরস্কার প্রদানকারী সংস্থাগুলোকে দেয়। প্রকৃতপক্ষে নরওয়েজীয় নোবেল কমিটি জরজেন লভল্যান্ড, জর্ন স্টার্ন জর্নসন এবং জোহানিজ স্টিনের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের নোবেল শান্তি পুরস্কারের প্রদানের জন্য নিয়োগ দেয়।[১৯] সেই কমিটি বিখ্যাত দুই জনকে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান করে, যারা ১৯ শতকের শেষের দিকে শান্তি আন্দোলনকে বেগবান করেছিল। তারা ছিলেন আন্তঃসংসদীয় ইউনিয়নের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফেদ্রিক পাসিরেড ক্রসের প্রতিষ্ঠাতা অঁরি দ্যুনঁ[২০][২১][২২]১৯০১ সালে প্রথম নোবেল বিজয়ীদের তালিকা :

           
পদার্থবিজ্ঞান রসায়ন চিকিৎসা সাহিত্য শান্তি
ভিলহেল্ম র‌ন্টগেন ফান্ট হফ এমিলি ভন বেরিং স্যুলি প্র্যুদম অঁরি দ্যুনঁ ফ্রেদেরিক পাসি

নোবেল কমিটির পদার্থের পুরস্কারের জন্য মনোনীতের তালিকায় ছিলেন এক্স রশ্মি আবিষ্কারের জন্য ভিলহেল্ম কনরাড র‌ন্টগেন এবং ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে কাজ করার জন্য ফিলিপ লেনার্ড। পরে বিজ্ঞান একাডেমি রন্টগেনকে নির্বাচিত করে।[২৩][২৪] ১৯ শতকের শেষ দশকে অনেক রসায়নবিদ উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। তাই রসায়নে পুরস্কার দেবার ক্ষেত্রে একাডেমি এতজন বিজ্ঞানীর মধ্যে কাকে পুরস্কৃত করা যায় তা নিয়ে সামান্য সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন।[২৫] একাডেমি ২০টি মনোনয়ন পায়। তার মধ্যে ১১টিকেই ছিল ফান্ট হফের নাম।[২৬] রাসায়নিক তাপগতিবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করার জন্য তিনি এই পুরস্কারে ভূষিত হন। [২৭]

সুইডিশ একাডেমি সাহিত্যে প্রথম নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করে কবি সূলি প্রুধমকে। লেখক, কবি ও সাহিত্য সমালোচকদের ৪২ জনের একটি দল এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে যারা এর জন্য লিও টলস্তয়কে প্রত্যাশা করছিল।[২৮] বার্টন ফেল্ডম্যানের মতো অনেকেই এই পুরস্কারের সমালোচনা করেছিল কারণ তারা প্রুধমকে মধ্যমসারির কবি মনে করত। ফেল্ডম্যানের ব্যাখ্যানুযায়ী, একাডেমির অধিকাংশ সদস্যই ছিলেন ভিক্টোরিয়ান সাহিত্যের ভক্ত। তাই তারা সেরকম একজন কবিকেই বেছে নিয়েছেন। [২৯] চিকিসায় প্রথম নোবেল পুরস্কার পান জার্মান চিকিৎসক ও অনুপ্রাণবিজ্ঞানী এমিলি ভন বেরিংকে। ১৮৯০ এর দশকে তিনি ডিপথেরিয়া প্রতিরোধক তৈরি করেন, যা আজ পর্যন্ত প্রতি বছর হাজার লোকের জীবন রক্ষা করে চলছে। [৩০][৩১]

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ

সম্পাদনা
মূল নিবন্ধ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ

১৯৩৮ ও ১৯৩৯ সালে এডলফ হিটলার জার্মানির তিন জন পুরস্কারপ্রাপ্তকে (রিচার্ড কুন, গার্হার্ড ডোমাগএডলফ ফ্রেদরিক জোহান বুতেন্ড) তাদের পুরস্কার নেয়া থেকে বিরত থাকতে বলেন। [৩২] পরবর্তীতে তাদের সকলেই পদক ও সনদ গ্রহণ করতে পেরেছিলেন। [৩৩] যদিও সুইডেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিরপেক্ষ ভূমিকায় ছিল, তারপরও সে সময় নোবেল পুরস্কার অনিয়মিতভাবে দেয়া হয়েছিল। ১৯৩৯ সালে শান্তি পুরস্কার প্রদান করা হয়নি। নরওয়ের উপর জার্মানির অন্যায্য অধিকারের জন্য এই ক্ষেত্রে ১৯৪০-৪২ সাল পর্যন্ত কোনো পুরস্কার প্রদান করা হয় নি। এই বছরগুলোতে সাহিত্যশান্তি ছাড়া বাকি সব বিষয়গুলোতে পুরস্কার প্রদান করা হয়।[৩৪]

নরওয়ে দখল থাকা অবস্থায়, নরওয়েজীয় নোবেল কমিটির তিনজন সদস্যকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। বাকি সদস্য এই নির্যাতন থেকে তখনই মুক্তি লাভ করেন যখন নোবেল ফাউন্ডেশন এই বিবৃতি দিয়ে বলে যে, অসলোতে গঠনকৃত কমিটি সুইডেনের আওতাধীন। সেই সকল সদস্যরা কমিটির কার্যক্রম সচল রেখেছিল যদিও কোনো পুরস্কার প্রদান করা হয় নি। ১৯৪৪ সালে নোবেল ফাউন্ডেশন তিন নির্বাসিত সদস্যসহ নিশ্চিত করে যে পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন নেয়া হয়েছিল এবং আবারও পুরস্কার প্রদান করা যেতে পারে।[৩২]

অর্থনীতিতে পুরস্কার প্রদান

সম্পাদনা
 
দেশ অনুযায়ী নোবেল বিজয়ীদের মানচিত্র

১৯৬৮ সালে সুইডিশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার প্রতিষ্ঠার ৩০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে নোবেল ফাউন্ডেশনকে একটি বিরাট অঙ্কের অর্থ দান করে। এর উদ্দেশ্য ছিল আলফ্রেদ নোবেলের সম্মানে একটি নতুন পুরস্কার প্রদান প্রবর্তন করা। পরের বছরে অর্থনীতিশাস্ত্রে প্রথমবারের মতো নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। অর্থনীতিতে পুরস্কারের জন্য উপযুক্ত অর্থনীতিবিদ নির্বাচনের দায়িত্ব রাজকীয় সুয়েডীয় বিজ্ঞান একাডেমির ওপর অর্পণ করা হয়।

অর্থনীতিতে প্রথমবারের মতো নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন জ্যান টিনবার্গেনরাগনার ফ্রিশ। অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে গতি তত্ত্ব প্রয়োগ ও উন্নয়ন সাধনের জন্য তাদের এই সম্মানে ভূষিত করা হয়।[৩৫][৩৬] নাম ভিন্ন হলেও এটিকে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার হিসেবে গণ্য করা হয়। সুইডিশ নোবেল পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে অন্যান্য বিষয়ে পুরস্কার প্রাপ্তদের সাথে তাদের নাম ঘোষণা করা হয়।[৩৭]

মনোনয়ন ও নির্বাচন পদ্ধতি

সম্পাদনা
 
নোবেল শান্তি পুরস্কারের পদক, যা রিগোবার্তা মেনচুকে দেওয়া হয়েছিল এবং এটি মেক্সিকো সিটির টেম্পলো মেয়র জাদুঘরে সুরক্ষিত আছে।

অন্যান্য পুরস্কারের তুলনায় নোবেল পুরস্কারের মনোনয়ন ও নির্বাচন পদ্ধতি বেশ দীর্ঘ এবং কঠোর। এই কারণেই নোবেল পুরস্কার পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কারের মর্যাদা পেয়েছে।

২০০৯ সালে রসায়নে নোবেল বিজয়ীর নাম ঘোষণা করছেন রাজকীয় সুয়েডীয় বিজ্ঞান একাডেমির স্থায়ী সচিব গানার ওকুইস্ট
২০০৯ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ীর নাম ঘোষণা করছেন পিটার এঙ্গল্যান্ড, সুইডেন, ইংরেজি এবং জার্মান

মনোনয়ন

সম্পাদনা

নোবেল পুরস্কারের মনোনয়ন গ্রহণের জন্য নির্দিষ্ট মনোনয়নপত্র রয়েছে। সমগ্র বিশ্ব থেকে নির্বাচিত ৩০০০ জনকে এই মনোনয়নপত্র দেয়া হয় যাতে তারা তা পূরণ করে পুরস্কারের আবেদন করতে পারে। নোবেল শান্তি পুরস্কার নির্বাচনের জন্য এমন সব ব্যক্তিদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয় যারা এ বিষয়ে বিশেষ কর্তৃত্বের দাবীদার। যে বছর পুরস্কার প্রদান করা হবে তার ৩১ শে জানুয়ারী মনোনয়ন পত্র প্রদানের শেষ তারিখ।[৩৮][৩৯] নোবেল কমিটি তাদের মধ্যে সম্ভাব্য ৩০০ জনকে মনোনীত করে। [৪০] মনোনীতদের নাম প্রকাশ করা হয় না এমনকি তাদেরকে জানানোও হয় না যে তারা মনোনীত হয়েছেন। মনোনয়নের এসব নথি পুরস্কার প্রদান থেকে ৫০ বছরের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। ১৯৬৩ সালে জানা সম্ভবপর হয় যে ব্রিটিশ সাহিত্যিক স্টার্জ মুর ১৯১৩ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য বাঙ্গালী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মনোনয়ন দিয়ে ছিলেন।[৪১]

নির্বাচন

সম্পাদনা

তারপর নোবেল কমিটি সম্পর্কিত বিষয়সমূহের বিশেষজ্ঞদের মতামতের উপর ভিত্তি করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রাথমিকভাবে বাছাইকৃত প্রার্থীদের তালিকাসহ এই প্রতিবেদনটি নোবেল পুরস্কার প্রদানের সংস্থাগুলোকে পাঠানো হয়।[৪২] সংস্থাগুলোকে আধিক্য ভোটের মাধ্যমে প্রত্যেকটি বিষয়ে বিজয়ী নির্বাচিত করতে হয়। ভোটের ঠিক পরপরই তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হয়।[৪৩] একটি পুরস্কার সর্বোচ্চ তিনজন এবং দুটি ভিন্ন কাজের জন্য দেয়া যায়। নোবেল শান্তি পুরস্কার যে কোন সংস্থাকে প্রদান করা যায় তাছাড়া সকল পুরস্কার শুধু মাত্র জীবন্ত ব্যক্তিকে দেয়া হয়ে থাকে।[৪৪] যদি শান্তি পুরস্কার দেয়া না হয় তবে তার অর্থ বিজ্ঞানের অন্যান্য পুরস্কারে সমান ভাগে ভাগ করে দেয়া হয়। অদ্যাবধি ১৯ বার এরকমটি ঘটেছে।[৪৫]

মরণোত্তর পুরস্কার

সম্পাদনা

যদিও মৃত্যুপরবর্তী মনোনয়ন অনুমোদিত নয়, তথাপিও যদি প্রার্থীর মৃত্যু মনোনয়ন প্রদান ও নোবেল কমিটির পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্যবর্তী সময়ে হলে তবে তা নির্বাচিত হবার যোগ্য হবে। ইতিহাসে এমনটি দুইবার ঘটেছে: ১৯৩১ সালে সাহিত্যে এরিক এক্সেল কার্লফেল্ড এবং ১৯৬১ সালে শান্তিতে জাতিসংঘের মহাসচিব ড্যাগ হেমার্শেল্ড। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত এমনটি ভাবা হত যে অক্টোবরের ঘোষণা পর্যন্ত বিজয়ী বেঁচে থাকবেন। উইলিয়াম ভিক্রী নামক একজন নোবেল বিজয়ী ১৯৯৬ সালে পুরস্কার (অর্থনীতিতে) ঘোষণার পর কিন্তু প্রদানের আগে মারা যান।[৪৬] ৩ অক্টোবর ২০১১ চিকিৎসায় নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়; তদ্যাবধি কমিটি জানতো না যে বিজয়ীদের একজন রালফ স্টেইনম্যান তিন দিন আগে মারা গেছেন। কমিটিতে রালফ স্টেইনম্যানের পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক চলছিল কারণ মরণোত্তর পুরস্কার নিয়মের পরিপন্থী। পরবর্তীতে এই সিদ্ধান্ত অক্ষুণ্ন রাখার হয়।[৪৭]

পুরস্কারের ক্ষেত্রসমূহ

সম্পাদনা
পদক বিষয় বৈশিষ্ট্যসমূহ
  পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার রাজকীয় সুয়েডীয় বিজ্ঞান একাডেমি (Kungliga Vetenskapsakademien ভেতেন্‌স্কাপ্‌স্‌আকাদেমিয়েন) কর্তৃক নির্ধারিত। "পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বা উদ্ভাবন করবেন তাকে এই পুরস্কার দেয়া হবে।"
  রসায়নে নোবেল পুরস্কার রাজকীয় সুয়েডীয় বিজ্ঞান একাডেমি কর্তৃক নির্ধারিত। "যিনি রসায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বা উন্নয়ন করবেন তাকে এই পুরস্কার দেয়া হবে।"
  চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ীদের তালিকা কারোলিন্‌স্কা সমিতি (Karolinska Institutet কারোলিন্‌স্কা ইন্‌স্তিতেৎ) কর্তৃক নির্ধারিত। "যিনি চিকিৎসা অথবা জীব বিজ্ঞানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করবেন তাকে এই পুরস্কার দেয়া হবে।".
  সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার সুয়েডীয় একাডেমি (Svenska Akademien স্‌ভেন্‌স্কা আকাদেমিয়েন) কর্তৃক নির্ধারিত। "যিনি সাহিত্যের জগতে সবচেয়ে বিশিষ্ট রচনাটি সৃষ্টি করবেন যা অবশ্যই কোন আদর্শের জন্ম বা লালন করবে তাকে এই পুরস্কার দেয়া "
  শান্তিতে নোবেল পুরস্কার নরওয়েজীয় নোবেল সমিতি কর্তৃক নির্ধারিত। "যিনি জাতিসমূহের বন্ধুত্ব রক্ষা এবং বৃদ্ধি, যুদ্ধের জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত সেনাবাহিনীর অপসারণ বা হ্রাস এবং শান্তি প্রক্রিয়া ত্বরান্বিতকরণে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখবেন তাকে এই পুরস্কার দেয়া "
  অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার এই পুরস্কারটিকে মূলত আলফ্রেড নোবেল স্মৃতি রক্ষার্থে অর্থনীতিতে ভেরিজ রিক্সবাঙ্ক পুরস্কার নামে ডাকা হয়। এটি প্রদান করার ব্যাপারে আলফ্রেদ নোবেল তার উইলে কিছু বলে যাননি বরং সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর প্রচলন করে। রাজকীয় সুয়েডীয় বিজ্ঞান একাডেমি কর্তৃক নির্ধারিত।

পুরস্কার প্রদানের আনুষ্ঠানিকতা

সম্পাদনা
 
নোবেল বিজয়ীরা পুরস্কার স্বরূপ একটি সুদৃশ ডিপ্লোমা, স্বর্ণপদক ও নগদ অর্থ পেয়ে থাকেন। এখানে রসায়নে নোবেল বিজয়ী ফ্রিজ হাবারের ডিপ্লোমা দেখানো হয়েছে

পুরস্কার প্রদানের দায়িত্বে যে প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়োজিত তারা সবাই ঠিক অক্টোবর মাসে লরিয়েটদের নাম ঘোষণা করে। ঘোষণার পর ১০ ডিসেম্বর তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে পদক প্রদান করা হয়। এই দিনটি আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকী।

নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান পূর্বে নরওয়েজীয় নোবেল সমিতি (১৯০৫ - ১৯৪৬) এবং অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের আউলা-তে (অডিটোরিয়াম) (১৯৪৭ - ১৯৯০) অনুষ্ঠিত হতো। বর্তমানে অসলো সিটি হলে এই অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এটি ছাড়া অন্য পুরস্কারগুলো প্রদান করা হয় স্টকহোম কনসার্ট হলে[৪৮]

প্রতি বছর একই বিষয়ে সর্বোচ্চ তিনজনকে পুরস্কার দেয়া যায়। নোবেল লরিয়েটদের প্রত্যেককে দেয়া হয় একটি স্বর্ণপদক, একটি ডিপ্লোমা, সুইডেনের নাগরিকত্ব এবং একটি মোটা অঙ্কের অর্থ। বর্তমানে এই অর্থের পরিমাণ হচ্ছে ১০ মিলিয়ন সুয়েডীয ক্রোনার (১ মিলিয়ন ইউরোর সামান্য বেশি/ ১.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)।[৪৯][৫০] এই অর্থ প্রদানের মূল কারণ এই যে, লরিয়েটরা যেন পুরস্কার পাবার পর তাদের আরো উচ্চতর গবেষণা চালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু বর্তমানে যে সময় নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয় সে সময় দেখা যায় অধিকাংশ লরিয়েটই অবসর জীবন যাপন করছেন।

১৯০২ সাল থেকে সুইডেনের রাজা স্টকহোমে পুরস্কার বিতরণ করে আসছেন। প্রথম বছর সুইডেনের রাজা ছিলেন রাজা ২য়অস্কার; তিনি এতো মর্যাদাসম্পন্ন পুরস্কার বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়ার বিরোধী ছিলেন। এজন্য তিনি পু্রষ্কার প্রদানে সম্মত হননি। পরবর্তীতে অবশ্য জনপ্রিয়তা রক্ষার জন্য এবং সুইডেনের সম্মান রক্ষার খাতিরেই তাকে মত পরিবর্তন করতে হয়েছে।

১৯০৪ সালে নরওয়েজীয় নোবেল কমিটি গঠিত হয়। এর আগে নরওয়ের রাষ্ট্রপতি নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদানের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতার দায়িত্ব পালন করতেন। গঠনের পর কমিটির ৫ জন সদস্য শান্তি পুরস্কার দেবার জন্য গবেষণামূলক কার্যক্রমের দায়িত্ব পালন করে। তাদেরকে নরওয়েজীয় আইনসভা মনোনয়ন দেয়, তথাপি তারা সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং কারো কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়। নরওয়ের আইনসভার সদস্যরা এই কমিটিতে অংশ নিতে পারেন না।

উল্লেখযোগ্য নোবেল বিজয়ীবৃন্দ

সম্পাদনা
 
মারি ক্যুরি, ইতিহাসে দুইবার করে নোবেল বিজয়ী পাঁচজনের একজন

নোবেল পুরস্কার প্রদানের ইতিহাসে মাত্র পাঁচজন ব্যক্তি দুইবার নোবেল বিজয়ের সম্মান লাভ করেছেন। তাঁরা হলেন:

  • মারি ক্যুরি
    • পদার্থবিজ্ঞান: ১৯০৩ (তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার)
    • রসায়ন: ১৯১১ (বিশুদ্ধ রেডিয়াম পৃথকীকরণ)
  • লিনাস পাউলিং
    • রসায়ন: ১৯৫৪ (অরবিটাল সংকরণ তত্ত্ব)
    • শান্তি: ১৯৬২ (নিউক্লিয় শক্তির পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ আইনের বাস্তবায়নের জন্য প্রচেষ্টা)
  • জন বারডিন
    • পদার্থবিজ্ঞান: ১৯৫৬ (ট্রানসিস্টর আবিষ্কার)
    • পদার্থবিজ্ঞান: ১৯৭২ (অতিপরিবাহিতার তত্ত্ব)
  • ফ্রেডরিক স্যাঙ্গার
    • রসায়ন: ১৯৫৮ (ইনসুলিন অণুর গঠন আবিষ্কার)
    • রসায়ন: ১৯৮০ (ভাইরাসের নিউক্লিওটাইডের ধারা আবিষ্কার)
  • ব্যারি শার্পলেস


এছাড়া আরও কয়েকজন নোবেল লরিয়েট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কয়েকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য চিহ্নিত হয়ে আছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন:

সমালোচনা

সম্পাদনা

অন্যান্য অনেক সমালোচনার মধ্যে নোবেল কমিটির রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হওয়া এবং যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিকেও বাদ দেয়া অন্যতম। তাদের ইউরোপীয়দের প্রতি পক্ষপাতদুষ্টের অভিযোগ রয়েছে, বিশেষ করে সাহিত্যে পুরস্কার প্রদান করার ক্ষেত্রে।

শান্তি পুরস্কার

সম্পাদনা
 
যুক্তরাষ্ট্রের ৪৪তম রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার ২০০৯ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয় কঠোরভাবে সমালোচিত হয়।

শান্তি পুরস্কারের মধ্যে সবচেয়ে সমালোচিত ছিল লি ডাক থো এবং হেনরি কিসিঞ্জারকে পুরস্কার প্রদান। লি ডাক থো পরবর্তীতে পুরস্কার প্রত্যাক্ষান করে।[৫১] যা নরওয়েজীয় নোবেল কমিটির দুইজন সদস্যের পদত্যাগের কারণ হয়ে দাড়ায়। জানুয়ারি, ১৯৭৩ সালে উত্তর ভিয়েতনামমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার যুদ্ধ বিরতি এবং সেখান থেকে আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের প্রেক্ষাপটে তাদেরকে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। যদিও পুরস্কার প্রদানের মুহুর্তে দেশ দুটি যুদ্ধে লিপ্ত ছিল।[৫২] অনেক সমালোচকদের মতে হেনরি কিসিঞ্জার শান্তিকামী নয় বরং একজন যুদ্ধবাজ ছিলেন।[৫৩][৫৪]

ইয়াসির আরাফাত, সাইমন পেরেস, ইয়াতজাক রবিন ১৯৯৪ সালে ইসরাইলফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নোবেল পান।[৫৫] যদিও ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের অঙ্গীকারের বিষয়টি অমিমাংসিতই ছিল এবং শেষ পর্যন্ত কোন চুক্তিতে পৌছাতে পারে নাই।[৫৬][৫৭] পুরস্কার ঘোষণার পরপরই নরওজীয় নোবেল কমিটির একজন আরাফাতকে সন্ত্রাসি বলে আখ্যা দেয় এবং পদত্যাগ করেন।[৫৮] আরাফাতের ব্যাপারে অতিরিক্ত সন্দেহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে।[৫৯]

২০০৯ সালে বারাক ওবামার নোবেল বিজয় ইদানীং কালের সবচেয়ে সমালোচিত পুরস্কার।[৬০] রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণের মাত্র ১১ দিন পর মনোনয়ন[৬১] বন্ধ করা হয়, যদিও সত্যিকারের মুল্যায়ন করা হয়েছিল পরবর্তী ৮ মাস ধরে।[৬২] ওবামা নিজেই বলেন যে, তিনি তাকে এই পুরস্কাররের যোগ্য মনে করেন না।[৬৩] পূর্ববর্তী নোবেল বিজয়ীরা এই তর্কে বিভক্ত হয়ে পড়ে, একদল মনে করে ওবামা এই পুরস্কারের যোগ্য কিন্তু অন্য দল তাকে এই পুরস্কারের যোগ্য মনে করে না।[৬৪]

সাহিত্য পুরস্কার

সম্পাদনা

বিংশ শতাব্দীর বেশ কয়েকজন জগৎখ্যাত সাহিত্যিক নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হননি। এর মধ্যে অন্যতম হলেন বোরহেস। কেউ কেউ নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন যেমন ফ্রান্সের জঁ-পল সার্ত্র। তিনি নোবল ঘোষণার আগেই সুইডিশ একাডেমিকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন যে তাকে যেন নোবেল পুরস্কারের জন্য বিবেচনা করা না হয়। সুইডীশ একাডেমির একজন সদস্য নাট আহলান্ড ২০০৪ সাল এলফ্রিডে ইয়েলিনেকের সাহিত্য পুরস্কারের বিরোধিতা করেন। পরবর্তীতে তিনি এই বলে পদত্যাগ করেন যে, এটা প্রগতিশীল শক্তির বিরুদ্ধে এক অপূরণীয় ক্ষতি এবং শিল্পকলায় সাহিত্যের দৃষ্টিভঙ্গীকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। তিনি ইয়েলিনেকের কাজকর্মকে শিল্পকলা বহির্ভূত সাহিত্যকর্ম বলে অভিহিত করেন।[৬৫][৬৬] ২০০৯ সালে হের্টা মুলারের পুরস্কার সমালোচিত হয়। দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এর মতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ সাহিত্য সমালোচক এবং অধ্যাপকদের কাছে তার লেখার গ্রহণযোগ্যতা নেই।[৬৭] এসকল সমালোচনা পুরস্কারটিকে একটু ইউরোপীয় পক্ষপাতদুষ্ট বলে প্রমাণ করে।[৬৮] ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন গায়ক বব ডিলানকে সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কার দিলে বিশ্বব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে। বব ডিলানই প্রথম গায়ক ও গীতিকার যাকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করে নোবেল কমিটি। এর আগে দার্শনিক বারট্রান্ড রাসেল এবং ব্রিটেনের প্রধান মন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদান করায় সমালোচনা হয়েছিল। ২০১৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়নি। ২০১৯-এ পোল্যান্ডের লেখক ওলগা তোকার্তুক কে ২০১৮ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। ২০১৯ সালের সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার লাভ করেন অস্ট্রিয়ার সাহিত্যিক পেটার হান্ড‌কে[৬৯]

বিজ্ঞান পুরস্কার

সম্পাদনা

১৯৪৯ সালে পর্তুগীজ স্নায়ু বিশেষজ্ঞ আন্তোনিও এগাস মনিজ প্রিফ্রন্টাল লিউকোটমির উন্নয়নের জন্য চিকাৎসায় নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। তার পূর্ববর্তী বছরে ডঃ ওয়ালটার ফ্রীম্যান একই পদ্ধতির একটি সংস্করন উন্নয়ন ঘটান যা আরও দ্রুত ও সহজ। মূল পদ্ধতির প্রচারগত সল্পতার কারণে ফ্রীম্যানের উদ্ভাবন সঠিকভাবে বিবেচিত হয়নি অথবা আধুনিক চিকিৎসা মুল্যবোধের সাথে যায় নি। দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন এর মত সাময়িকীতে প্রকাশনা পাওয়ায় লিউকোটমি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। মনিজের পুরস্কার প্রাপ্তির পরবর্তী তিন বছর শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রে ৫,০০০ এর মত লোবোটমি হয়।[৭০][৭১]

আরও দেখুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. "কোন দেশে সবচেয়ে মেধাবীরা থাকে? 8 October 2010. Retrieved 6 December 2011."। ১৮ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ নভেম্বর ২০১২ 
  2. Shalev, Baruch Aba (2005). 100 years of Nobel prizes
  3. [Why are they called Nobel Prize laureates?]
  4. https://www.nobelprize.org/prizes/economic-sciences/ The Sveriges Riksbank Prize in Economic Sciences in Memory of Alfred Nobel 2023
  5. নোবেল পুরস্কার পাবার আগেই মৃত্যু 3 October 2011. Retrieved 3 October 2011.
  6. [Nobel Prize award raised to nearly $1 million for 2023]
  7. Levinovitz, Agneta Wallin (2001). Nils Ringertz. ed.নোবেল পুরস্কার: প্রথম ১০০ বছর
  8. Golden, Frederic (16 October 2000) "The Worst And The Brightest" ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১১ নভেম্বর ২০২০ তারিখে
  9. Sohlman, Ragnar (1983). p. 13. The Legacy of Alfred Nobel – The Story Behind the Nobel Prizes
  10. Sohlman, Ragnar (1983). p. 7. The Legacy of Alfred Nobel – The Story Behind the Nobel Prizes
  11. von Euler, U. S. (6 June 1981)."The Nobel Foundation and its Role for Modern Day Science" ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৪ জুলাই ২০১১ তারিখে
  12. a b AFP (5 October 2009). "Alfred Nobel's last will and testament". The Local. Retrieved 11 June 2010.
  13. Abrams, Irwin (2001) p.7. The Nobel Peace Prize and the Laureates. Watson Publishing International
  14. Levinovitz, Agneta Wallin (2001) pp. 13–25.. Nils Ringertz. ed. The Nobel Prize: The First 100 Years
  15. Abrams, Irwin (2001). pp. 7–8. Abrams, Irwin (2001). The Nobel Peace Prize and the Laureates. Watson Publishing International. আইএসবিএন ০-৮৮১৩৫-৩৮৮-৪
  16. Crawford, Elizabeth T. (1984). p. 1. The Beginnings of the Nobel Institution – The Science Prizes, 1901–1915
  17. আলফ্রেদ নোবেলের উইল, নোবেল ফাউন্ডেশনের দাপ্তরিক ওয়েবসাইট থেকে নেয়া, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০০৭
  18. The History Channel, This Day in History"First Nobel Prizes: December 10, 1901"। সংগ্রহের তারিখ July 30  অজানা প্যারামিটার |accessyear= উপেক্ষা করা হয়েছে (|access-date= ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে) (সাহায্য); এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |সংগ্রহের-তারিখ= (সাহায্য)[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  19. Abrams, Irwin (2001). pp. 39–41. The Nobel Peace Prize and the Laureates
  20. Levinovitz, Agneta Wallin (2001). pp. 166–168.The Nobel Prize: The First 100 Years]
  21. Crawford, Elizabeth T. (1984). p. 266. The Beginnings of the Nobel Institution – The Science Prizes, 1901–1915
  22. Feldman, Burton (2001). p. 297. The Nobel prize: a history of genius, controversy, and prestige
  23. Feldman, Burton (2001). p. 134. The Nobel prize: a history of genius, controversy, and prestige
  24. Leroy, Francis (2003). pp. 117–118. A century of Nobel Prizes recipients: chemistry, physics, and medicine
  25. Levinovitz, Agneta Wallin (2001). p. 77. The Nobel Prize: The First 100 Years
  26. Crawford, Elizabeth T. (1984). p. 118. The Beginnings of the Nobel Institution – The Science Prizes, 1901–1915
  27. Feldman, Burton (2001). p. 205. The Nobel prize: a history of genius, controversy, and prestige
  28. Levinovitz, Agneta Wallin (2001). p. 144. The Nobel Prize: The First 100 Years
  29. Feldman, Burton (2001). p. 69. The Nobel prize: a history of genius, controversy, and prestige
  30. Feldman, Burton (2001). pp. 242–244. The Nobel prize: a history of genius, controversy, and prestige.
  31. Leroy, Francis (2003).p. 233. A century of Nobel Prizes recipients: chemistry, physics, and medicine
  32. Levinovitz, Agneta Wallin (2001). p. 23. The Nobel Prize: The First 100 Years
  33. Wilhelm, Peter (1983). p. 85. The Nobel Prize. Springwood Books. আইএসবিএন ৯৭৮-০-৮৬২৫৪-১১১-৮.
  34. All Nobel Laureates". Nobel Foundation. Retrieved 15 January 2010.
  35. Feldman, Burton (2001). p. 343. The Nobel prize: a history of genius, controversy, and prestige
  36. Levinovitz, Agneta Wallin (2001). p. 207. The Nobel Prize: The First 100 Years
  37. ""Nobel Prize in Economic Science Awarded to Oliver E. Williamson""। ২৭ অক্টোবর ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৩ নভেম্বর ২০১২ 
  38. Feldman, Burton (2001). pp. 16–17.The Nobel prize: a history of genius, controversy, and prestige
  39. Levinovitz, Agneta Wallin (2001). p. 26. The Nobel Prize: The First 100 Years
  40. Abrams, Irwin (2001). p. 15. The Nobel Peace Prize and the Laureates.
  41. Literature / editor's pick
  42. Feldman, Burton (2001). p. 52. The Nobel prize: a history of genius, controversy, and prestige
  43. Levinovitz, Agneta Wallin (2001). pp. 25–28. The Nobel Prize: The First 100 Years
  44. Abrams, Irwin (2001). p. 8. The Nobel Peace Prize and the Laureates
  45. Philp, Catherine (10 October 2009). "How the Nobel Peace Prize winner is decided" ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে. The Times (London: Times Newspapers Limited). Retrieved 25 May 2010.
  46. Abrams, Irwin (2001). p. 9. The Nobel Peace Prize and the Laureates
  47. "Ralph Steinman Remains Nobel Laureate". নোবেল ফাউন্ডেশন. 3 October 2011. Retrieved 8 October 2012.
  48. Levinovitz, Agneta Wallin (2001). pp. 21–23. Nils Ringertz. ed. The Nobel Prize: The First 100 Years.
  49. "The Nobel Prize Amounts". Nobel Foundation. 2009. Retrieved 15 January 2010
  50. "Video - Breaking News Videos from CNN.com". CNN. 11 October 2009. Retrieved 15 January 2010.
  51. de Sousa, Ana Naomi (9 October 2009). "Top ten Nobel Prize rows" ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে. The Times (London: Times Newspapers Limited). Retrieved 25 May 2010.
  52. Abrams, Irwin (2001). p. 219. The Nobel Peace Prize and the Laureates
  53. Feldman, Burton (2001). p. 315. The Nobel prize: a history of genius, controversy, and prestige
  54. Abrams, Irwin (2001). p. 315. The Nobel Peace Prize and the Laureates
  55. Levinovitz, Agneta Wallin (2001). p. 183.
  56. Frost, Caroline (5 July 2002) "Yasser Arafat:Profile" ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৩০ অক্টোবর ২০১১ তারিখে
  57. Miller, Judith (11 November 2004). "Yasir Arafat, Father and Leader of Palestinian Nationalism, Dies at 75" The New York Times
  58. Feldman, Burton (2001). pp. 15–16. The Nobel prize: a history of genius, controversy, and prestige
  59. Abrams, Irwin (2001). pp. 302–306. The Nobel Peace Prize and the Laureates
  60. "Surprise Nobel for Obama Stirs Praise and Doubts"
  61. -, বৈজয়ন্তী মুখোপাধ্যায়; -, সুমিতা চক্রবর্তী (২০২৪-০৯-২২)। "বাংলা কথাসাহিত্যে মহামারি ,কোভিড ১৯ এবং কয়েকটি বাংলা ছোটোগল্প"International Journal For Multidisciplinary Research6 (5)। আইএসএসএন 2582-2160ডিওআই:10.36948/ijfmr.2024.v06i05.27777 
  62. ". "How the Nobel Peace Prize winner is decided""। ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ নভেম্বর ২০১২ 
  63. "Obama is surprise winner of Nobel Peace Prize"
  64. "^ "Remarks by the President on winning the Nobel Peace Prize""। ১০ এপ্রিল ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ ডিসেম্বর ২০১২ 
  65. "Who deserves Nobel prize? Judges don’t agree". Associated Press. 11 October 2005. Retrieved 1 April 2010.
  66. "Nobel judge steps down in protest". BBC News (BBC). 11 October 2005. Retrieved 1 April 2010.
  67. Jordan, Mary (9 October 2009)."Author's Nobel Stirs Shock-and-'Bah'". The Washington Post. Retrieved 1 April 2010.
  68. "NOBEL PRIZE WINNER: Herta Muller". The Huffington Post. 8 October 2009. Retrieved 31 March 2010.
  69. প্রথম আলো পত্রিকার প্রতিবেদন
  70. Feldman, Burton (2001).The Nobel prize: a history of genius, controversy, and prestige pp. 286–289.
  71. Day, Elizabeth (12 January 2008). "He was bad, so they put an ice pick in his brain...". The Guardian (London: Guardian Media Group). Retrieved 31 March 2010.

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা