দুবলার চর
দুবলার চর বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবনের দক্ষিণে, কটকার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং হিরণ পয়েন্টের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত একটি দ্বীপ যা চর নামে হিন্দুধর্মের পূণ্যস্নান, রাসমেলা এবং হরিণের জন্য বহুল পরিচিত। কুঙ্গা ও মরা পশুর নদের মাঝে এটি একটি বিচ্ছিন্ন চর।[১] এই চরের মোট আয়তন ৮১ বর্গমাইল। আলোরকোল, হলদিখালি, কবরখালি, মাঝেরকিল্লা, অফিসকিল্লা, নারকেলবাড়িয়া, ছোট আমবাড়িয় এবং মেহের আলির চর নিয়ে দুবলার চর গঠিত। দুবলার চরে শুধু মাত্র টেলিটক এর নেটওয়ার্ক রয়েছে।
ভূগোল | |
---|---|
অবস্থান | বঙ্গোপসাগরl |
স্থানাঙ্ক | ২১°৪৩′২২″ উত্তর ৮৯°৩৬′১০″ পূর্ব / ২১.৭২২৭৮° উত্তর ৮৯.৬০২৭৮° পূর্ব |
আয়তন | ৬৬.৫ বর্গকিলোমিটার (২৫.৭ বর্গমাইল) |
দৈর্ঘ্য | ১৫ কিমি (৯.৩ মাইল) |
প্রস্থ | ৫.৫ কিমি (৩.৪২ মাইল) |
প্রশাসন | |
Division | খুলনা বিভাগ |
District | Bagerhat District |
জনপরিসংখ্যান | |
জনসংখ্যা | 3000 (২০২০) |
ভাষা | বাংলা |
জাতিগত গোষ্ঠীসমূহ | বাঙালি |
বিবরণ
সম্পাদনাদুবলার চর মূলত জেলে গ্রাম। মাছ ধরার সঙ্গে চলে শুঁটকি শোকানোর কাজ। বর্ষা মৌসুমের ইলিশ শিকারের পর বহু জেলে চার মাসের জন্য সুদূর কক্সবাজার, চট্টগ্রামসহ, বাগেরহাট, পিরোজপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা থেকে ডেরা বেঁধে সাময়িক বসতি গড়ে সেখানে। মেহেরআলীর খাল, আলোরকোল, মাঝেরচর, অফিসকেল্লা, নারিকেলবাড়িয়া, মানিকখালী, ছাফরাখালী ও শ্যালারচর ইত্যাদি এলাকায় জেলে পল্লী স্থাপিত হয়। এই চার মাস তারা মাছকে শুঁটকি বানাতে ব্যস্ত থাকেন। এখান থেকে আহরিত শুঁটকি চট্টগ্রামের আসাদগঞ্জের পাইকারী বাজারে মজুদ ও বিক্রয় করা হয়। সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের সদর দপ্তর বাগেরহাট থেকে মাছ সংগ্রহের পূর্বানুমতিসাপেক্ষে বহরদার ও জেলেরা দুবলার চরে প্রবেশ করে থাকেন। দুবলার চর থেকে সরকার নিয়মিত হারে রাজস্ব পেয়ে থাকে। প্রতি বছর বিএলসি বা বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট, ডিএফসি বা ডেইলি ফুয়েল (জ্বালানি কাঠ) কন্যাম্পশন ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় বন বিভাগকে রাজস্ব প্রদান করে মৎস্য ব্যবসায়ীগণ সুন্দরবনে ঢোকার অনুমতি পান, এছাড়া আহরিত শুঁটকি মাছ পরিমাপ করে নিয়ে ফিরে আসার সময় মাছভেদে প্রদান করেন নির্ধারিত রাজস্ব।[২]
শুটকি শিল্প
সম্পাদনাদুবলার চর সুন্দরবনের দক্ষিণ প্রান্তে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে অবস্থিত একটি মৌসুমি জেলে পল্লী, যা বাংলাদেশে শুঁটকি উৎপাদনের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। প্রতিবছর বর্ষার মৌসুম শেষে অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে, যেমন খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার থেকে হাজারো জেলে এখানে এসে সাময়িক বসতি স্থাপন করেন। এই জেলেরা মূলত মাছ শিকার এবং শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজে ব্যস্ত থাকেন। মাছ শিকারের অনুমতি নিতে তারা সুন্দরবনের পূর্ব বন বিভাগের নিয়মিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করেন, যার মধ্যে রয়েছে বিএলসি (বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট) এবং ডিএফসি (জ্বালানি কাঠের জন্য প্রতিদিনের ফি)।[৩]
মেহেরআলীর খাল, আলোরকোল, মাঝেরচর, নারিকেলবাড়িয়া, মানিকখালী এবং শ্যালারচরসহ বিভিন্ন স্থানে জেলেরা পল্লী গড়ে তোলেন। শুঁটকি প্রক্রিয়ার জন্য লইট্টা, তেলফ্যাসা, ছুরি, চাকা চিংড়ি, বৈরাগী এবং রূপচাঁদার মতো মাছ শুকানো হয়। শিকারের পর মাছগুলো বাছাই করে শুকাতে দেওয়া হয়, যা প্রস্তুত হতে তিন থেকে পাঁচ দিন সময় লাগে। শুকনো মাছ চট্টগ্রামের আসাদগঞ্জ পাইকারি বাজারে পাঠানো হয়, যেখানে তা সারা দেশে বিতরণ করা হয়।[৩]
এই শুঁটকি শিল্প স্থানীয় অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। শুটকি উৎপাদন এবং সরবরাহ প্রক্রিয়া থেকে সরকারের উল্লেখযোগ্য রাজস্ব আয় হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ অঞ্চল থেকে ৪,১০৫ টন শুঁটকি উৎপাদিত হয়েছিল, যা থেকে সরকার ২.৬৮ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহ করে। পরবর্তী সময়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে উৎপাদন বেড়ে ৫,১০০ টনে পৌঁছায় এবং রাজস্ব আয় দাঁড়ায় ৬.৬৮ কোটি টাকা।[৩]
দুবলার চরের এই মৌসুমি কার্যক্রমে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ সরাসরি জড়িত থাকেন। জেলেদের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর জন্য চর এলাকায় অস্থায়ী বাজার গড়ে ওঠে, যেখানে খাদ্য, পোশাক এবং দৈনন্দিন ব্যবহার্য সামগ্রী পাওয়া যায়। এই অস্থায়ী গ্রামে জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুতের সীমিত ব্যবস্থাও থাকে। তবে খাবার পানি এবং স্বাস্থ্যসেবার অভাব এখানকার মানুষের জন্য বড় একটি সমস্যা।[৩]
শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণের পাশাপাশি দুবলার চর ঐতিহ্যবাহী রাস উৎসবের জন্যও পরিচিত, যা প্রতিবছর আলোরকোলে আয়োজন করা হয়। মাছ শিকার, শুঁটকি প্রস্তুতি এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংমিশ্রণে দুবলার চর বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।[৩]
রাসমেলা
সম্পাদনাপ্রতি বছর কার্ত্তিক মাসে (খ্রিস্টীয় নভেম্বর) হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের রাসমেলা এবং পূণ্যস্নানের জন্যও দ্বীপটি বিখ্যাত। যদিও বলা হয়ে থাকে, ২০০ বছর ধরে এ রাসমেলা হয়ে চলেছে[৪] তবে জানা যায়, ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে হরিচাঁদ ঠাকুরের এক বনবাসী ভক্ত, নাম হরিভজন (১৮২৯—১৯২৩), এই মেলা চালু করেন।[৫] প্রতিবছর অসংখ্য পুণ্যার্থী রাসপূর্ণিমাকে উপলক্ষ করে এখানে সমুদ্রস্নান করতে আসেন। দুবলার চরে সূর্যোদয় দেখে ভক্তরা সমুদ্রের জলে ফল ভাসিয়ে দেন। কেউবা আবার বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে ভজন-কীর্তন গেয়ে মুখরিত করেন চারপাশ। দুবলার চরের রাসমেলায় স্থানীয় লোকজন ছাড়াও দূর-দূরান্তের শহরবাসী এমনকি বিদেশি পর্যটকেরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়ে থাকেন। তিনদিনব্যাপী এ মেলায় অনেক বিদেশী পর্যটকেরও সমাগম হয়।[৩]
জীববৈচিত্র্য
সম্পাদনাদুবলার চরে লাল বুক মাছরাঙা, মদনটাক পাখির দেখা পাওয়া যায়। পশুদের মধ্যে আছে হরিণ।[৬]
অন্যান্য
সম্পাদনাদুবলার চরের জেলে পল্লীতে বনদস্যুদের উৎপাত, খাবার পানির অভাব, স্বাস্থ্য সেবা সংকট, বাঘ ও কুমিরের আক্রমণ, নিম্ন মজুরি ইত্যাদি প্রায় প্রতি মৌসুমের নৈমিত্তিক ঘটনা। এছাড়া বড়সড় ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছাসে বিপর্যস্থ হয় দুবলার চরের জেলে পল্লী। বনদস্যুদের উৎপাত ঠেকাতে নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, র্যাব, পুলিশ ও বন বিভাগের প্রহরীরা থাকলেও সমন্বিত উদ্যোগের অভাব ছিল। অবশেষে ২০১২ সালে র্যাব মহাপরিচালককে প্রধান করে সুন্দরবনের জলদস্যু দমনের জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন হয়েছিল। সাংবাদিক মোহসীন-উল-হাকীমের মধ্যস্থতায় ২০১৬ সালের ৩১ মে মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে সুন্দরবনের দস্যুমুক্তকরন শুরু হয় এবং ১ নভেম্বর ২০১৮ জলদস্যুদের সর্বশেষ ৬ টি বাহিনী আত্মসমর্পণের মাধ্যমে সুন্দরবনের প্রায় ৪০০ বছরের জলদস্যুতার অবসান ঘটে। দুবলার চরে শুধু টেলিটক(আমাদের ফোন) এর নেটওয়ার্ক রয়েছে। [২]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "দারুণ ১০ সুন্দর: দুবলার চর", শতদল সেন যিশু; A টু Z, পৃ্ষ্ঠা ৮-৯, দৈনিক কালের কণ্ঠ;২৭ সেপ্টেম্বর ২০১০।
- ↑ ক খ নাসিম আলী (অক্টোবর ৬, ২০০৯)। "..."। পৃষ্ঠা .., দৈনিক ইত্তেফাক।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ রায়, দীপংকর (২০২৪-১১-২৪)। "দুবলার চরের শুটকি বাণিজ্য"। The Daily Star Bangla (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১১-২৪।
- ↑ রিদওয়ান আক্রাম (ফেব্রুয়ারি ১, ২০১০)। "দুবলার চর"। পৃষ্ঠা ৯, অন্য কোনোখানে, দৈনিক কালের কন্ঠ।
- ↑ সাইমন জাকারিয়া (ডিসেম্বর ৪, ২০০৯)। "হেমন্তের উৎসব"। দৈনিক প্রথম আলো।
- ↑ "বনে দোলে রাধা-কৃষ্ণ", সীমান্ত দীপু; A টু Z, পৃ্ষ্ঠা ৯, দৈনিক কালের কণ্ঠ;২৭ সেপ্টেম্বর ২০১০।