ওরা ১১ জন
ওরা ১১ জন ১৯৭২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি বাংলাদেশী চলচ্চিত্র।[৪] ১৯৭১ এ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত, স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে চলচ্চিত্রায়িত প্রথম চলচ্চিত্র।[৫] ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দেন, চলচ্চিত্রের গল্পে সেই ঐতিহাসিক ভাষনের কিছু অংশ দেখানো হয়েছে। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন বিখ্যাত পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম।
ওরা ১১ জন | |
---|---|
পরিচালক | চাষী নজরুল ইসলাম |
প্রযোজক | মাসুদ পারভেজ |
রচয়িতা | আল মাসুদ |
চিত্রনাট্যকার | কাজী আজিজ আহমেদ |
শ্রেষ্ঠাংশে | |
সুরকার | খন্দকার নুরুল আলম |
চিত্রগ্রাহক | আবদুস সামাদ |
সম্পাদক | বশীর হোসেন |
প্রযোজনা কোম্পানি |
|
পরিবেশক | স্টার ফিল্ম ডিসট্রিবিউটার্স |
মুক্তি |
|
স্থিতিকাল | ১১৭ মিনিট |
দেশ | বাংলাদেশ |
ভাষা | বাংলা |
নির্মাণব্যয় | ৳৫ লক্ষ[২] |
আয় | ৳৪০ লক্ষ[৩] |
চলচ্চিত্রটিতে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অভিনয় করেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন খসরু, মুরাদ, হেলাল ও নান্টু। এছাড়াও চলচ্চিত্রটির প্রধান চরিত্রগুলোতে অভিনয় করেছেন রাজ্জাক, শাবানা, নূতন, সৈয়দ হাসান ইমাম, আলতাফ, বেবী জামান, আবু, খলিলউল্লাহ খান সহ অনেকে।
কাহিনী সংক্ষেপ
সম্পাদনাখসরু (খসরু) ও তার বোন মিতা (শাবানা) ঢাকায় মামাবাড়িতে থেকে লেখাপড়া করেন। প্রতিবেশী শীলার (নূতন) সঙ্গে খসরুর বিয়ে ঠিক হয়। অন্যদিকে মেডিকেল কলেজের ছাত্রী মিতার সঙ্গে শীলার প্রকৌশলী ভাই পারভেজের (রাজ্জাক) সম্পর্ক রয়েছে। সবকিছু স্বাভাবিক চলছিল কিন্তু এরই মাঝে হঠাৎ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। খসরু চলে যায় যুদ্ধে । আরো দশজন সঙ্গীকে নিয়ে গড়ে তুলে গেরিলা বাহিনী। বাহিনীটির নেতৃত্ব দেন খসরু। পারভেজ মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করায় পাকিস্তানীদের হাতে বন্দী হয়। পারভেজের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর বের করতে না পারায় তার সামনেই মা আর ছোটভাইকে হত্যা করে পাক বাহিনী। বোন শীলা নির্যাতনের শিকার হয়। মিতা বিক্রমপুরে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় সেখানকার চিকিৎসক দলের সঙ্গে যোগদান করে। একদিন সেও পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্যাতনের শিকার হয়। শত্রুবাহিণীর আত্মসমর্পণ আর মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়োল্লাসের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শেষ হয়। যুদ্ধ শেষে অনেকেই ঘরে ফিরে। কারো জন্য পরিবারের সদস্যরা পথ চেয়ে থাকে। কিন্তু তার আর ফেরা হয়না। কেউবা ফিরে এসে পরিবারের খোঁজ পায়না।
শ্রেষ্ঠাংশে
সম্পাদনা- খসরু - খসরু
- রাজ্জাক - পারভেজ
- শাবানা - মিতা
- নূতন - শীলা
- সৈয়দ হাসান ইমাম - ডাঃ চৌধুরী
- আলতাফ - মিজান
- মুরাদ - মুরাদ
- সিদ্দিক জামাল নান্টু - নান্টু
- বেবী জামান - জামান
- আবু - আবু
- এটিএম শামসুজ্জামান - বেজার আলী (রাজাকার)
- খলিলউল্লাহ খান - পাকিস্তানি সামরিক অফিসার
- আতা - আতা
- অলীন - অলীন
- হেলাল - হেলাল
- মঞ্জু - মঞ্জু
- ফিরোজ - ফিরোজ
- রাজু আহমেদ
নির্মাণ নেপথ্য
সম্পাদনাবাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পরে ১৯৭১ সালের ১৯শে ডিসেম্বর চলচ্চিত্রটি নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। পরিচালক হিসেবে চাষী নজরুল ইসলামের প্রথম চলচ্চিত্র ছিল এটি। তার আগে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি। ওরা ১১ জন চলচ্চিত্রটি সেই সময় খ্যাতিমান পরিচালক মুস্তাফিজ বিনা পারিশ্রমিকে করে দিতে চেয়েছিলেন, তবে চলচ্চিত্র প্রযোজক সোহেল রানা বিনয়ের সঙ্গে তাঁকে ‘না’ করে বলেন, বন্ধু চাষী নজরুল ইসলামকে তিনি কথা দিয়েছেন। স্টার ফিল্মসের সঙ্গে পাঁচ বছরের চুক্তি করা হয়। ১৯৭২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে চার মাস ব্যাপী জয়দেবপুর, গাজীপুর সেনানিবাস, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থাসহ বিভিন্ন স্থানে চলচ্চিত্রটির শুটিং করা হয়।
ওরা ১১ জন চলচ্চিত্রে সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধাদেরও দেখানো হয়েছে। তবে অভিনয়ের যতটুকু দৃশ্য আছে, সেগুলো অভিনয়শিল্পীরা করেছেন। শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়েই সিনেমাটি নির্মাণের পরিকল্পনা থাকলেও স্টার ফিল্মসের আবদারে রাজ্জাক, শাবানাদের মতো তারকাদের সিনেমায় যুক্ত করা হয়। মুক্তির আগেই হলমালিকদের কাছ থেকে অগ্রিম অর্থ নিয়ে সিনেমার লগ্নি করা টাকা উঠে এসেছিল বলে জানা যায়।
ওরা ১১ জন চলচ্চিত্রটি শুরু হয় সাইফুল ইসলামের কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত ‘ও আমার দেশের মাটি’ দিয়ে। শেষ হয় সাবিনা ইয়াসমিনের ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ দিয়ে।
ছবিটি মুক্তির পর ব্যবসায়িকভাবে যেমন সাফল্য পেয়েছে, তেমনি সমালোচকদের প্রশংসাও পেয়েছিল।
বিশেষত্ব
সম্পাদনামুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র ও গোলাবারুদও সিনেমার শুটিংয়ে ব্যবহার করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমানের সহায়তায় পাকিস্তান বাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্র ও রসদ দিয়ে যুদ্ধের দৃশ্যধারণ করা হয়। চলচ্চিত্রে ব্যবহারের জন্য গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে আর্মস ও অ্যামুনেশন সরবরাহ করা হয়। মূলত যুদ্ধের দৃশ্যগুলো আরও বাস্তবিক করে তুলতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। চলচ্চিত্রটিতে গাজীপুর সেনানিবাসের সেনা সদস্যরাও অভিনয় করেছেন। সত্যিকারের অস্ত্র ব্যবহারের ফলে ছবির শ্যুটিংয়ে বেশ ঝুঁকিও পোহাতে হয়। একটি মেয়েকে পাকিস্তানী হানাদাররা তাড়া করবে এবং গুলি ছুড়তে থাকবে কিন্তু মেয়েটির গায়ে কোন গুলি লাগবেনা। যেহেতু আসল গুলি তাই দৃশ্যটি ধারণ খুব ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। গুলি করলে মেয়েটির গায়ে লাগার সম্ভাবনাই বেশি। গুলির ছোড়ার দায়িত্বটি কেউই নিতে চাইলেন না। এমনকি চিত্রগ্রাহক আবদুস সামাদও দৃশ্যটি ধারণ করতে অস্বীকৃতি জানালেন। শেষ পর্যন্ত খসরু গুলি ছোড়ার দায়িত্ব নিলেন। দৃশ্যটি ধারণ শুরু হল। মেয়েটি দৌড়াচ্ছে আর খসরু একে একে ৩০টি গুলি ছুড়লেন। গুলি মেয়েটির খুব কাছ দিয়ে চলে গেল, কয়েকটা জামাও স্পর্শ করল কিন্তু একটাও শরীরে লাগলনা। সফলভাবে দৃশ্যটি ধারণ শেষে সবাই আনন্দে খসরুকে জড়িয়ে ধরে।
চলচ্চিত্রে রাজাকার হত্যার একটি দৃশ্য ছিল। দৃশ্যের প্রয়োজনে ইকবাল হলে আটক কয়েকজন রাজাকারকে ধরে শুটিংয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সোহেল রানা জানান, পানিতে গুলি করে রাজাকারদের বলা হয়েছিল মৃত্যুর অভিনয় করতে। অপর একটি দৃশ্যে সত্যিকারের পাকিস্তানি সৈন্যরাও অভিনয় করেছেন। দৃশ্যটি ছিলো ধরা পড়ে যাওয়া পাকিস্তানি সৈন্যকে মেরে ফেলার। মুক্তিযুদ্ধের সময় আটকে পড়া দুই পাকিস্তানি সৈন্য তখন চলচ্চিত্রটির ইউনিটের কাছে বন্দী ছিল। তাদেরকে তখনও বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। এই দুই সৈন্যকে দিয়েই দৃ্শ্যটিতে অভিনয় করানো হয়। এরপর তাদেরকে সেনানিবাস কর্তৃপক্ষের কাছে সোপর্দ করা হয়।
সম্মাননা
সম্পাদনা- শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৭২)
সংগীত
সম্পাদনাওরা ১১ জন ছবির সংগীত পরিচালনা করেন খোন্দকার নুরুল আলম।
গানের তালিকা
সম্পাদনাট্র্যাক | গান | কণ্ঠশিল্পী | পর্দায় | নোট |
---|---|---|---|---|
১ | ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা | খসরু | রবিন্দ্র সংগীত | |
২ | আমায় একটি খুদিরাম দাও বলে কাঁদিশ না মা | খসরু ও সহ অভিনেতারা | ||
৩ | এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলা স্বাধীনতা আনলে যাঁরা | সাবিনা ইয়াসমিন | খসরু ও নূতন সহ অনেকে |
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ আলাউদ্দীন মাজিদ ০১-ওরা ১১ জন দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৫ ডিসেম্বর, ২০১২
- ↑ "'ওরা ১১ জন' এর পেছনের গল্প"। Jamuna TV। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১২-১৬।
- ↑ World of Next Education। ২০১১।
- ↑ "'ওরা ১১ জন' চলচ্চিত্র (১৯৭২)"। ২৩ মার্চ ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ জানুয়ারি ২০১৯।
- ↑ "সংগ্রাম"। ইত্তেফাক। ২০২০-১২-০৮। ২০২২-০২-২৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০২-২৫।
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- ইন্টারনেট মুভি ডেটাবেজে ওরা ১১ জন (ইংরেজি)
- ওরা ১১ জন দৈনিক আমার দেশ, ১৭ ডিসেম্বর ২০০৯
- ওরা ১১ জন ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০১৭-০৯-০৫ তারিখে দৈনিক প্রথম আলো, ৯ ডিসেম্বর ২০১০