ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহ

পৃথিবীর আদি ভাষা পরিবারের একটি
(Indo-European languages থেকে পুনর্নির্দেশিত)

ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহ হল ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর অঞ্চল, ইরানীয় মালভূমিইউরোপের অধিকাংশ অঞ্চলে প্রচলিত একটি ভাষাপরিবার। এই ভাষাপরিবারের অন্তর্গত ইউরোপীয় ভাষা ইংরেজি, ফরাসি, পর্তুগিজ, রাশিয়ান, ওলন্দাজস্পেনীয় আধুনিক যুগে যথাক্রমে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, পর্তুগাল, রাশিয়া, হল্যান্ডস্পেনের উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রসারিত হয়েছে এবং বর্তমান কালে এগুলি বিভিন্ন মহাদেশে কথিত হয়ে থাকে। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাপরিবার বিভিন্ন শাখা বা উপ-পরিবারে বিভক্ত। এই শাখাগুলির মধ্যে যে আটটি শাখায় জীবিত ভাষার সন্ধান পাওয়া যায় সেগুলি হল আলবেনীয়, আর্মেনীয়, বাল্টো-স্লাভীয়, কেল্টীয়, জার্মানীয়, হেলেনীয়, ইন্দো-ইরানীয়ইতালীয় শাখা। অপর নয়টি শাখা এখন বিলুপ্ত

ইন্দো-ইউরোপীয়
ভৌগোলিক বিস্তারবিশ্বব্যাপী
ভাষাগত শ্রেণীবিভাগবিশ্বের প্রাথমিক ভাষাপরিবারগুলির অন্যতম
প্রত্ন-ভাষাপ্রত্ন-ইন্দো-ইউরোপীয়
উপবিভাগ
আইএসও ৬৩৯-২/ine
গ্লটোলগindo1319[]
{{{mapalt}}}
ইউরেশিয়া অঞ্চলে বর্তমান যুগে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহের অবস্থান:
  অ-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহ
বিন্দুযুক্ত/ডোরাকাটা অঞ্চলগুলিতে বহুভাষিকতা প্রচলিত (মানচিত্রটি পরিবর্ধন করলে স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে)।
নোটসমূহ
  • নির্দেশ করছে ভাষাপরিবারের এই শাখাটি এখন অবলুপ্ত

বর্তমান যুগে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাপরিবারের সর্বাধিক কথিত ভাষাগুলি হল ইংরেজি, স্পেনীয়, পর্তুগিজ, রাশিয়ান, হিন্দুস্তানি, বাংলা, ফরাসি ও জার্মান। কিন্তু এই পরিবারের অনেক ভাষাই অল্পসংখ্যক জনগোষ্ঠী দ্বারা কথিত হয় এবং বেশ কয়েকটি ভাষা প্রায় বিলুপ্তির পথে রয়েছে।

সামগ্রিকভাবে বর্তমান বিশ্বের জনসংখ্যার ৪২ শতাংশেরও বেশি (৩০০ কোটি লোক) কোনো না কোনো ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাকে প্রথম ভাষা হিসেবে স্বীকার করেন, যে সংখ্যাটি যে কোনো ভাষাপরিবারের মধ্যে সর্বাধিক। এথনোলগ কৃত একটি হিসাব অনুযায়ী, ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাপরিবারের অন্তর্গত জীবিত ভাষার সংখ্যা প্রায় ৪৪৫, যার দুই-তৃতীয়াংশই (৩১৩টি) ইন্দো-ইরানীয় শাখার অন্তর্গত ভাষা।[]

সকল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাই একটি একক প্রাগৈতিহাসিক ভাষা থেকে উৎসারিত। ভাষাগতভাবে পুনর্নির্মিত এই ভাষাটির নাম দেওয়া হয়েছে প্রত্ন-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষানব্য প্রস্তর যুগ ও আদি ব্রোঞ্জ যুগে এই ভাষাটি কথিত হত। প্রত্ন-ইন্দো-ইউরোপীয়ভাষী জনগোষ্ঠীর আদিনিবাস ঠিক কোথায় ছিল, তা নিয়ে অনেক পরস্পরবিরোধী মত প্রচলিত আছে। এই মতগুলির মধ্যে কুরগান প্রকল্পনার সঙ্গে গবেষকদের একটি বড়ো অংশ একমত হয়েছেন। এই মত অনুযায়ী, ইন্দো-ইউরোপীয়দের আদিনিবাস ছিল অধুনা ইউক্রেনদক্ষিণ রাশিয়া অঞ্চলের অন্তর্গত পন্টিক-ক্যাস্পিয়ান স্তেপ। এই অঞ্চলটি খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের গোড়া পর্যন্ত ইয়াম্নায়া সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। লিখন প্রণালীর আবিষ্কারের আগেই ইউরোপ, দক্ষিণ এশিয়াপশ্চিম এশিয়ার এক বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলির মধ্যে অসংখ্য ভাষার বিবর্তন ঘটে গিয়েছিল। ব্রোঞ্জ যুগে ইন্দো-ইউরোপীয়দের লিখিত প্রমাণ পাওয়া যায় মাইসিনীয় গ্রিক এবং হিট্টীয়লুউইয়ানদের আনাতোলীয় ভাষাসমূহের আকারে। প্রাচীনতম লিখিত প্রমাণ হল কয়েকটি বিচ্ছিন্ন হিট্টীয় শব্দ ও নাম। যে রচনাগুলি থেকে এই শব্দ ও নামগুলি পাওয়া যায় সেগুলি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাপরিবারের সঙ্গে সম্পর্কহীন সেমিটিক আক্কাদীয় ভাষায় খ্রিস্টপূর্ব বিংশ শতকে পূর্ব আনাতোলিয়ায় অ্যাসিরীয় উপনিবেশ কুলতেপে অঞ্চলে রচিত হয়েছিল।[] মূল প্রত্ন-ইন্দো-ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর কোনো লিখিত প্রমাণ পাওয়া না গেলেও তাদের সমাজধর্মবিশ্বাসের কিছু কিছু দিক উপজাত সংস্কৃতিগুলির পরবর্তীকালের প্রমাণ থেকে পুনর্নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছে।[] আফ্রো-এশীয় মিশরীয় ভাষাসেমিটিক ভাষাগুলির পরেই জ্ঞাত ভাষাপরিবারগুলির মধ্যে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাপরিবার দ্বিতীয় দীর্ঘতম নথিবদ্ধ ইতিহাসের অধিকারী। এই কারণে এই ভাষাপরিবারটি ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলির পারিবারিক সম্পর্কের বিশ্লেষণ এবং সেগুলির সাধারণ উৎসের পুনর্নির্মাণ ঊনবিংশ শতকে একটি আকাদেমিক শাখা হিসেবে ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের নিয়ম ও পদ্ধতিগুলির বিকাশে কেন্দ্রীয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।

ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাপরিবারের সঙ্গে অন্যান্য ভাষাপরিবারের কোনো জিনগত সম্পর্ক আছে কিনা, তা নিয়ে ভাষাবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতৈক্য হয়নি। যদিও এই বিষয়ে বেশকয়েকটি বিতর্কিত প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবিজ্ঞানের ইতিহাস

সম্পাদনা

ষোড়শ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশে আগত ইউরোপীয়রা প্রথম ইন্দো-আর্য, ইরানীয়ইউরোপীয় ভাষাগুলির মধ্যে কিছু সাদৃশ্য লক্ষ্য করতে শুরু করেন। ১৫৮৩ সালে ইংরেজ জেসুইট ধর্মপ্রচারক ও কোঙ্কণী-বিশারদ টমাস স্টিফেনস গোয়া থেকে তাঁর ভাইকে লেখা একটি চিঠিতে ভারতীয় ভাষাগুলির সঙ্গে গ্রিকলাতিনের সাদৃশ্যের বিষয়টি উল্লেখ করেন। অবশ্য এই চিঠিটি বিশ শতকের আগে প্রকাশিত হয়নি।[]

১৫৪০ সালে ফ্লোরেন্স শহরে জন্মগ্রহণকারী বণিক ফিলিপো সাসেতি ভারতীয় উপমহাদেশে এসেছিলেন। ১৫৮৫ সালে তিনি সংস্কৃতইতালীয়ের মধ্যে কিছু সাদৃশ্যের কথা লেখেন, যার মধ্যে ছিল দেবঃ/dio "দেবতা", সর্পঃ/serpe "সাপ", সপ্ত/sette "সাত", অষ্ট/otto "আট", ও নব/nove "নয়" ইত্যাদি শব্দগুলি।[] তবে স্টিফেনস বা সাসেতির পর্যবেক্ষণ নিয়ে গবেষকেরা সেই সময় অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠেননি।[]

১৬৪৭ সালে ওলন্দাজ ভাষাবিজ্ঞানী ও গবেষক মার্কাস জুয়ারিয়াস ভ্যান বোহর্ন কোনো কোনো এশীয় ও ইউরোপীয় ভাষার মধ্যে সাদৃশ্য লক্ষ্য করেন। তিনি এই তত্ত্ব উপস্থাপনা করেন যে, এই ভাষাগুলি একটি আদিম সাধারণ ভাষা থেকে উৎসারিত। ভ্যান বোহর্ন সেই সাধারণ ভাষাটির নামকরণ করেছিলেন সিথীয় ভাষা।[] এই তত্ত্বে আলোচিত ভাষাগুলির মধ্যে তিনি প্রথমে ওলন্দাজ, আলবেনীয়, গ্রিক, লাতিন, ফারসিজার্মান ভাষাকে অন্তর্ভুক্ত করেন এবং পরে যুক্ত করে নেন স্লাভীয় ভাষাসমূহ|স্লাভীয়]], কেল্টীয়বাল্টীয় ভাষাগুলিকেও। যদিও তাঁর প্রস্তাবটি বহুল প্রচার লাভ করেনি এবং তাঁর তত্ত্ব উপস্থাপনার অব্যবহিত পরে কোনো গবেষণার অনুপ্রেরণাও জোগায়নি।

অটোম্যান তুর্কি পর্যটক ইভলিয়া কেলেবি এক কূটনৈতিক দৌত্যের কাজে ১৬৬৫-১৬৬৬ সালে ভিয়েনায় এসেছিলেন। তিনি জার্মানফারসি ভাষার শব্দগুলির মধ্যে কিছু সাদৃশ্য লক্ষ্য করেছিলেন। একই রকম সাদৃশ্যের কথা বলেন গাস্তোন কোরদু ও অন্যান্যরাও। ১৭৬০-এর দশকের শেষভাগে কোরদু সংস্কৃত, লাতিন ও গ্রিক ভাষায় ধাতুরূপের এক বিস্তারিত তুলনামূলক আলোচনা করে সেই বিষয়ে একটি তত্ত্ব উপস্থাপনা করেছিলেন। অন্যদিকে মিখাইল লোমোনোসোভও স্লাভীয়, বাল্টীয় ("কুরল্যান্ডীয়"), ইরানীয় ("মেডীয়"), ফিনীয়, চীনা, "হটেনটট" (খোখো) ও অন্যান্য ভিন্ন ভিন্ন শাখার তুলনামূলক আলোচনা করে বলেন যে লাতিন, গ্রিক, জার্মান ও রাশিয়ান সহ সম্পর্কিত ভাষাগুলি নিশ্চিতভাবেই প্রাচীনকালে একটি সাধারণ পূর্বজ ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল।[]

অষ্টাদশ শতকে পরিচিত প্রাচীনতম তিন ভাষা লাতিন, গ্রিক ও সংস্কৃতের মধ্যে লক্ষণীয় সাদৃশ্যের কথা ১৭৮৬ সালে স্যার উইলিয়াম জোনস একটি বক্তৃতায় উল্লেখ করলে এক উপপ্রমেয়টি আবার জনসমক্ষে আসে। উল্লিখিত ভাষা তিনটির সঙ্গে তিনি পরীক্ষামূলকভাবে গথিক, কেল্টীয়ফারসি ভাষাকেও যুক্ত করেছিলেন।[] অবশ্য জোনসের বর্গীকরণের মধ্যে কিছু ভুলভ্রান্তি রয়ে গিয়েছিল এবং কিছু তথ্য বাদও পড়েছিল।[] ১৭৮৬ সালেই এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গলে প্রদত্ত একটি বক্তৃতায় জোনস প্রাগুক্ত ভাষাগুলির একটি পূর্বসূরি ভাষার কথা অনুমান করেন। এই ভাষাটিকে তিনি একটি "সাধারণ উৎস" বলে অভিহিত করলেও এর কোনো নির্দিষ্ট নামকরণ করেননি। জোনসের বক্তব্যটি ভাষাবিজ্ঞানের ইতিহাসে বিখ্যাততম উদ্ধৃতিগুলির একটি:

সংস্কৃত যত প্রাচীন ভাষাই হোক না কেন এটির গঠনবৈশিষ্ট্য বিস্ময়কর। এই ভাষা গ্রিক ভাষার থেকেও বেশি নিখুঁত, লাতিন ভাষার থেকেও বেশি প্রাচুর্যপূর্ণ এবং শেষোক্ত দুই ভাষার থেকেও সুন্দরভাবে পরিমার্জিত। তবু এই দুই ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতের এক ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্যের চিহ্ন বিদ্যমান। এই সাদৃশ্য যেমন ক্রিয়াপদের ধাতুর দিক থেকে, তেমনই ব্যাকরণের রূপটির দিক থেকেও। এই পরিমাণ সাদৃশ্য নিছক কাকতালীয় হওয়া সম্ভব নয়। এই সাদৃশ্যের বিষয়টি এতটাই ঘনিষ্ঠ যে কোনো ভাষাবিজ্ঞানীই এগুলিকে একটি সাধারণ উৎসভাষা থেকে উৎসারিত ভাষা ধরে না নিয়ে এই তিন ভাষাকে পরীক্ষা করতে পারবেন না। উল্লিখিত উৎসভাষাটির অস্তিত্ব বর্তমানে সম্ভবত আর নেই। (মূল: The Sanscrit [সিক] language, whatever be its antiquity, is of a wonderful structure; more perfect than the Greek, more copious than the Latin, and more exquisitely refined than either, yet bearing to both of them a stronger affinity, both in the roots of verbs and the forms of grammar, than could possibly have been produced by accident; so strong indeed, that no philologer could examine them all three, without believing them to have sprung from some common source, which, perhaps, no longer exists.)[টীকা ১]

— স্যার উইলিয়াম জোনস, থার্ড অ্যানিভার্সারি ডিসকোর্স ডেলিভার্ড ২ ফেব্রুয়ারি ১৭৮৬, ইলেকট্রনিক লাইব্রেরি অফ হিস্টোরিওগ্রাফি[১০]

১৮১৩ সালে টমাস ইয়াং প্রথম ইংরেজিতে "ইন্ডো-ইউরোপিয়ান" ("Indo-European") অর্থাৎ "ইন্দো-ইউরোপীয়" শব্দটি ব্যবহার করেন। এই শব্দটি এই ভাষাপরিবারের ভৌগোলিক সীমা পশ্চিম ইউরোপউত্তর ভারতের দ্যোতক। [১১][১২] "ইন্দো-ইউরোপীয়" শব্দটিরই আরেকটি প্রতিশব্দ হল ইংরেজি "ইন্ডো-জার্মানিক" (ইংরেজি: "Indo-Germanic"; Idg. বা IdG.) অর্থাৎ "ইন্দো-জার্মানীয়"। এই শব্দটির মাধ্যমে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাপরিবারের দক্ষিণপূর্ব ও উত্তরপশ্চিম সীমায় অবস্থিত শাখাগুলিকে নির্দেশ করা যায়। ১৮১০ সালে কনরাড মাল্টে-ব্রুন ফরাসি ভাষায় এই শব্দটি (indo-germanique) প্রথম ব্যবহার করেন। অধিকাংশ ভাষায় ইন্দো-জার্মানীয় শব্দটি এখন অচলিত বলে গণ্য হয় অথবা ইন্দো-ইউরোপীয় শব্দটির তুলনায় কম প্রচলিত। অবশ্য জার্মান ভাষায় indogermanisch শব্দটি একটি প্রামাণ্য বৈজ্ঞানিক পরিভাষা। বেশ কয়েকটি অন্য সমার্থক পারিভাষিক শব্দও ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

 
ফ্রানৎস বপ ছিলেন তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞান অধ্যয়নের ক্ষেত্রে এক অগ্রণী ব্যক্তি।

ফ্রানৎস বপ ১৮৯৬ সালে অন দ্য কনজুগেশনাল সিস্টেম অফ দ্য সংস্কৃত ল্যাংগুয়েজ কমপেয়ারড উইথ দ্যাট অফ গ্রিক, ল্যাটিন, পার্সিয়ান অ্যান্ড জার্মানিক[১৩] এবং ১৮৩৩ থেকে ১৮৫২ সালের মধ্যে কমপেয়ারেটিভ গ্রামার রচনা করেন। এই দুই বইয়ের মাধ্যমেই একটি আকাদেমিক শাখা হিসেবে ইন্দো-ইউরোপীয় অধ্যয়নের সূচনা ঘটে। এই দুই গ্রন্থ থেকে শুরু করে অগস্ট শ্লেইশার রচিত কমপেন্ডিয়াম (১৮৬১) এবং কার্ল ব্রুগমানের গ্রুন্ড্রিস ডের ভার্গলেশেনডেন গ্রামাটিক ডের ইন্ডোজার্মানিশেন স্প্রাচেন (১৮৮০-এর দশক) ছিল ইন্দো-ইউরোপীয় তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের ধ্রুপদি পর্যায়। এই প্রসঙ্গে ব্রুগমানের নব্যব্যাকরণিয়া পুনর্মূল্যায়ন এবং ফার্দিনন্দ দ্য স্যসুরের স্বরযন্ত্রীয় তত্ত্ব সম্ভবত "আধুনিক" ইন্দো-ইউরোপীয় অধ্যয়নের সূচনা হিসেবে গণ্য হতে পারে। ১৯৫৬ সালে জারজি ক্যুরিলোইকজের অ্যাপোফোনি ইন ইন্ডো-ইউরোপিয়ান গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর বিশ শতকের মধ্য ও শেষভাগে কালভার্ট ওয়াটকিনস, জোকেম শিন্ডলার, হেলমুট রিক্স প্রমুখ ইন্দো-ইউরোপীয়বাদীরা রূপতত্ত্ব ও অপশ্রুতির বিষয়গুলির উপর আরও ভালোভাবে আলোকপাত করেন। উল্লেখ্য, ক্যুরিলোইকজই ১৯২৭ সালে হিট্টীয় ব্যঞ্জনবর্ণ ḫ-এর অস্তিত্বের কথা নির্দেশ করেছিলেন।[১৪]

 
ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাপরিবারের শাখা-উপশাখা এবং ভাষাসমূহ

ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাপরিবারের ১০ টি শাখা রয়েছে।

১.ইন্দো-ইরানীয়, প্রোটো-ইন্দো-ইরানীয় (খ্রিস্টপূর্ব 3য় সহস্রাব্দের শেষের দিকে)[১৫]

  • ইন্দো-আর্য, আনাতোলিয়া থেকে প্রাপ্ত ১৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ এর ইন্দো-আর্য শব্দের চিহ্ন হতে প্রত্যয়িত। খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীর অশোকের এডিক্টস এ প্রাকৃত আকারে এপিগ্রাফিকলি আছে। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের বৈদিক ঋগ্বেদ সংস্কৃত আকারে মৌখিক ঐতিহ্যের মাধ্যমে অক্ষত রেকর্ড সংরক্ষণ করেছে বলে ধারণা করা হয়। হিন্দুস্তানি (হিন্দি, উর্দু), বাংলা, ওড়িয়া, অসমীয়া, পাঞ্জাবি, কাশ্মীরি, গুজরাটি, মারাঠি, সিন্ধি এবং নেপালি, সেইসাথে শ্রীলঙ্কার সিংহলা সহ উত্তর ভারত, মালদ্বীপের দিভেহি এবং মিনিকয়পূর্ব পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের আধুনিক ভাষা এর অন্তর্ভুক্ত। ।
  • ইরানী বা ইরানিক- মোটামুটি ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ এর আবেস্তা থেকে প্রমাণিত। প্রাচীন ফার্সি (বেহিস্তুন শিলালিপি) আকারে ৫২০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে এপিগ্রাফিকভাবে। ফার্সি, পশতু, কুর্দি, বেলোচি, লুরি এবং ওসেশিয়ান এর অন্তর্ভুক্ত।
  • নুরিস্তানি- কামকাটা-ভরি, ভাসি-ভরি, আসকুনু, ওয়াইগালি, ত্রেগামি এবং জেমিয়াকি অন্তর্ভুক্ত।


২. আর্মেনীয় ভাষাপরিবার - খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে প্রত্যয়িত। বর্তমানে শুধু একটি সদস্য রয়েছে। যথা - আর্মেনীয় ভাষা

৩. আলবেনীয় ভাষাপরিবার (১৩০০ খ্রীষ্টাব্দের দিকে প্রথম অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়[১৬])- বর্তমানে শুধু একটি সদস্য রয়েছে। যথা - আলবেনীয় ভাষা

৪. ইতালিক ভাষাপরিবার - দক্ষিণ ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকায় অবস্থিত ভাষা ও উপভাষা।

৫. ইন্দো-ইরানীয় ভাষাপরিবার - ইরান, শ্রীলঙ্কা, ও উত্তর ভারত উপমহাদেশে অবস্থিত ভাষা ও উপভাষা।

৬. কেল্টীয় ভাষাপরিবার - পশ্চিম ইউরোপের কয়েকটি এলাকায় অবস্থিত ভাষা ও উপভাষা।

৭. গ্রিক ভাষাপরিবার[১৭] - বর্তমানে শুধু একটি সদস্য (গ্রিক) রয়েছে।

৮.জার্মানীয় ভাষাপরিবার - উত্তর ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, ও অশেনিয়ায় অবস্থিত ভাষা ও উপভাষা।

৯.বাল্টীয় স্লাভীয় ভাষাপরিবার - উত্তর-পূর্ব ইউরোপে অবস্থিত ভাষা ও উপভাষা।রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে অবস্থিত ভাষা ও উপভাষা।

১০. আনাতোলিয়ান ভাষাপরিবার- লেট অ্যান্টিকুইটি দ্বারা বিলুপ্ত, আনাতোলিয়ায় কথিত, যা খ্রিস্টপূর্ব ২০ এবং ১৯ শতকের সেমেটিক ওল্ড অ্যাসিরিয়ান গ্রন্থে লুভিয়ান/হিট্টি পরিভাষায় উল্লিখিত, প্রায় ১৬৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ এর হিট্টাইট গ্রন্থ থেকে প্রত্যয়িত ।[১৮]

উপরে তালিকাভুক্ত ধ্রুপদী দশটি শাখা ছাড়াও, বেশ কিছু বিলুপ্ত ও স্বল্প-পরিচিত ভাষা এবং ভাষা-গোষ্ঠীর অস্তিত্ব রয়েছে :

  1. প্রাচীন বেলজিয়ান ভাষাপরিবার
  2. তোখারীয় ভাষাপরিবার
  3. ডাসীয় ভাষাপরিবার
  4. থ্রাসীয় ভাষাপরিবার
  5. ফ্রিজীয় ভাষাপরিবার
  6. সিমেরিয়ান ভাষাপরিবার
  7. প্রাচীন মেসিডোনিয়ান ভাষাপরিবার
  8. ইলিরিয়ান ভাষাপরিবার
  9. লিবার্নিয়ান ভাষাপরিবার
  10. লিগুরিয়ান ভাষাপরিবার
  11. লুসিটানিয়ান ভাষাপরিবার

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. হ্যামারস্ট্রোম, হারাল্ড; ফোরকেল, রবার্ট; হাস্পেলম্যাথ, মার্টিন, সম্পাদকগণ (২০১৭)। "Indo-European"গ্লোটোলগ ৩.০ (ইংরেজি ভাষায়)। জেনা, জার্মানি: মানব ইতিহাস বিজ্ঞানের জন্য ম্যাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউট। 
  2. "এথনোলগ রিপোর্ট ফর ইন্দো-ইউরোপিয়ান"। এথনোলগ। 
  3. ব্রাইস, ট্রেভর (২০০৫)। কিংডম অফ দ্য হিট্টাইটস (নতুন সংস্করণ)। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। পৃষ্ঠা ৩৭। আইএসবিএন 978-0-19-928132-9 
  4. ম্যালোরি, জে. পি. (২০০৬)। দি অক্সফোর্ড ইন্ট্রোডাকশন টু প্রোটো-ইন্ডো-ইউরোপিয়ান অ্যান্ড দ্য প্রোটো-ইন্ডো-ইউরোপিয়ান ওয়ার্ল্ড। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। পৃষ্ঠা ৪৪২। আইএসবিএন 978-0-19-928791-8 
  5. অরোক্স ২০০০, পৃ. ১১৫৬।
  6. বিকেস ২০১১, পৃ. ১২
  7. এম. ভি. লোমোনোসোভ (রাশিয়ান গ্রামার গ্রন্থের খসড়া, প্রকাশকাল ১৭৫৫)। মূল: সম্পূর্ণ সংস্করণ, মস্কো, ১৯৫২, খণ্ড ৭, পৃ. ৬৫২–৫৯ ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১ আগস্ট ২০২০ তারিখে: Представимъ долготу времени, которою сіи языки раздѣлились. ... Польской и россійской языкъ коль давно раздѣлились! Подумай же, когда курляндской! Подумай же, когда латинской, греч., нѣм., росс. О глубокая древность! [কল্পনা করুন সেই সময়ের গভীরতা যখন এই ভাষাগুলি পৃথক হয়েছিল!... পোলিশ ও রাশিয়ান ভাষা অনেক আগে পৃথক হয়ে গিয়েছিল! এখন ভাবুন কত আগে [এটা হয়েছিল] কারল্যান্ডীয় [ভাষার ক্ষেত্রে]! ভাবুন যখন [এটা হয়েছিল] লাতিন, গ্রিক, জার্মান ও রাশিয়ান [ভাষার ক্ষেত্রে]! আহা, অতি প্রাচীন কালে!]
  8. পোজার, উইলিয়াম জে.; ক্যাম্পবেল, লাইল (১৯৯২)। "ইন্দো-ইউরোপিয়ান প্র্যাকটিশ অ্যান্ড হিস্টোরিক্যাল মেথডোলজি"। প্রসিডিংস অফ দি এইটটিনথ অ্যানুয়াল মিটিং অফ দ্য বার্কলে লিঙ্গুইস্টিকস সোসাইটি: জেনেরাল সেশন অ্যান্ড প্যারাসেসশন অন দ্য প্লেস অফ মরফোলজি ইন আ গ্রামার১৮। বার্কলে লিঙ্গুইস্টিকস সোসাইটি। পৃষ্ঠা ২২৭–২২৮। ডিওআই:10.3765/bls.v18i1.1574। সংগ্রহের তারিখ ৭ ডিসেম্বর ২০২২ 
  9. রজার ব্লেঞ্চ (২০০৪)। "আর্কিওলজি অ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ: মেথডস অ্যান্ড ইস্যুজ" (পিডিএফ)। জন বিন্টলিফ। আ কমপ্যানিয়ন টু আর্কিওলজি। Oxford: ব্ল্যাকওয়েল পাবলিশিং। পৃষ্ঠা ৫২–৭৪। ১৭ মে ২০০৬ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৯ মে ২০১০  ব্লেঞ্চ ভুলক্রমে মিশরীয়, জাপানিচীনা ভাষাকে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেন, কিন্তু হিন্দিকে বাদ দিয়ে দেন।
  10. জোনস, উইলিয়াম (২ ফেব্রুয়ারি ১৭৮৬)। "দ্য থার্ড অ্যানিভার্সারি ডিসকোর্স"ইলেকট্রনিক লাইব্রেরি অফ হিস্টোরিওগ্রাফি। ইউনিভারসিটা ডেগলি স্টাডি ফিরেঞ্জে,  মূল গ্রন্থ: শোর (লর্ড টিগমাউথ), জন (১৮০৭)। দ্য ওয়ার্কস অফ স্যার উইলিয়াম জোনস। উইথ আ লাইফ অফ দি অথর। তৃতীয়। জন স্টকডেল অ্যান্ড জন ওয়াকার। পৃষ্ঠা ২৪–৪৬। ওসিএলসি 899731310 
  11. Robinson, Andrew (২০০৭)। দ্য লাস্ট ম্যান হু নিউ এভরিথিং: টমাস ইয়াং, দি অ্যানোনিমাস জিনিয়াস হু প্রুভড নিউটন রঙ অ্যান্ড ডেসিপার্চড দ্য রোজেটা স্টোন, অ্যামং আদার সারপ্রাইজিং ফিটস । পেংগুইন। আইএসবিএন 978-0-13-134304-7 
  12. মূল লন্ডন কোয়ার্টারলি রিভিউ দশ/২ ১৮১৩; তুলনীয় জেমেরেনি, জোনস এবং জোনস ১৯৯৯, পৃ. ১২ পাদটীকা ৬
  13. Franz Bopp (২০১০) [1816]। Über das Conjugationssystem der Sanskritsprache : in Vergleichung mit jenem der griechischen, lateinischen, persischen und germanischen Sprache। Documenta Semiotica : Serie 1, Linguistik (2 সংস্করণ)। Hildesheim: Olms। 
  14. Kurylowicz, Jerzy (১৯২৭)। "ə indo-européen et ḫ hittite"। Taszycki, W.; Doroszewski, W.। Symbolae grammaticae in honorem Ioannis Rozwadowski1। পৃষ্ঠা 95–104। 
  15. Indian History. Allied Publishers. 1988. p. 114. ISBN 978-81-8424-568-4.
  16. Elsie, Robert (২০০৫)। "Theodor of Shkodra (1210) and Other Early Texts"। Albanian Literature: A Short History। New York/Westport/London: I.B.Tauris.। পৃষ্ঠা 5। 
  17. "Tablet Discovery Pushes Earliest European Writing Back 150 Years"Science 2.0। ৩০ মার্চ ২০১১। 
  18. The peaks and troughs of Hittite". www.leidenuniv.nl. 2 May 2006. Archived from the original on 3 February 2017. Retrieved 25 November 2013.

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা
  • Dyen, Isidore; Kruskal, Joseph; Black, Paul (১৯৯৭)। "Comparative Indo-European"। wordgumbo। সংগ্রহের তারিখ ১৩ ডিসেম্বর ২০০৯ 
  • "Indo-European"। LLOW Languages of the World। ১০ অক্টোবর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৪ ডিসেম্বর ২০০৯ 
  • "Indo-European Documentation Center"। Linguistics Research Center, University of Texas at Austin। ২০০৯। ৩ সেপ্টেম্বর ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৪ ডিসেম্বর ২০০৯ 
  • Lewis, M. Paul, সম্পাদক (২০০৯)। "Language Family Trees: Indo-European"। Ethnologue: Languages of the World, Online version (Sixteenth সংস্করণ)। Dallas, Tex.: SIL International। .
  • "Indo-European Etymological Dictionary (IEED)"। Leiden, Netherlands: Department of Comparative Indo-European Linguistics, Leiden University। ৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৪ ডিসেম্বর ২০০৯ 
  • "Indo-European Roots Index"। The American Heritage Dictionary of the English Language (Fourth সংস্করণ)। Internet Archive: Wayback Machine। আগস্ট ২২, ২০০৮ [2000]। Archived from the original on ২৬ জুলাই ২০০৮। সংগ্রহের তারিখ ৯ ডিসেম্বর ২০০৯ 


উদ্ধৃতি ত্রুটি: "টীকা" নামক গ্রুপের জন্য <ref> ট্যাগ রয়েছে, কিন্তু এর জন্য কোন সঙ্গতিপূর্ণ <references group="টীকা"/> ট্যাগ পাওয়া যায়নি