ইরাক যুদ্ধ
ইরাক যুদ্ধ (মার্কিন অপারেশন ইরাকি ফ্রিডম নামেও পরিচিত; অন্য নাম: অপারেশন টেলিক, ইরাক দখল) একটি চলমান যুদ্ধ যা ২০০৩ সালের ২০শে মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পরিচালিত বাহিনীর ইরাক আগ্রাসনের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল।[১][২] এই আগ্রাসী বাহিনীতে অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, পোল্যান্ড এবং অন্যান্য কয়েকটি জাতির সৈন্যদল অংশ নিয়েছিল।
ইরাক যুদ্ধ | |||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|
ঘড়ির কাটার দিকে, উপরে বাম থেকে শুরু করে: সামারাতে একটট যুগ্ম প্রহরা; ফিরদোস স্কয়ারে সাদ্দাম হোসেনের মূর্তি উপরে ফেলা; আক্রমণের আগে এক ইইইকী সৈন্য তার রাইফের প্রস্তুত করছে; দক্ষিণ বাগদাদে একটি আইইডি বিস্ফোরিত হচ্ছে। | |||||||
| |||||||
বিবাদমান পক্ষ | |||||||
ইরাকের বাথ পার্টি কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি |
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ক | ||||||
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী | |||||||
সাদ্দাম হুসাইন যু. বন্দী মুরাত কারাইলান |
জর্জ ডব্লিউ বুশ ইয়াসার বুয়ুকানিত | ||||||
শক্তি | |||||||
ইরাকি (সাদ্দাম হুসাইনের নেতৃত্বে): বাথ সরকারের পতনের পর, বিভিন্নমুখী সংঘাত: পিকেকে: ~৪,০০০ |
কোয়ালিশন তুর্কী সশস্ত্র বাহিনী: ~৩,০০০-১০,০০০ | ||||||
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি | |||||||
ইরাকি যোদ্ধাদের হতাহতের পরিমাণ (আগ্রাসন যুগ): ৭,৬০০-১০,৮০০ অভ্যুত্থানকারীদের হতাহতের পরিমাণ (সাদ্দামের পরে): ১৬,৯৭৮-২২,৮০৭ এই প্রতিবেদন প্রতি আটক-বন্দী: ৪৩,০০০ পিকেকে: ৪১২ মৃত্যু (তুর্কী সরকারের দাবী) ৯ মৃত্যু (পিকেকে'র দাবী) |
ইরাকি নিরাপত্তা বাহিনী (সাদ্দাম-উত্তর, কোয়ালিশন মৈত্রী) পুলিশ/সৈন্যের মৃত্যু: ১০,৫৫৪ কোয়ালিশন মৃত্যু (৪,০৬১ যুক্তরাষ্ট্র, ১৭৬ যুক্তরাজ্য, ১৩৩ অন্যান্য): ৪,৩৭০ কোয়ালিশন নিখোঁজ বা ধৃত (যুক্তরাষ্ট্র): ৩ কোয়ালিশন আহত:২৯,৭৮০ যুক্তরাষ্ট্র, ~৩০০ যুক্তরাজ্য কোয়ালিশন আহত, রোগাক্রান্ত বা অন্য মেডিকেল সমস্যা:**২৮,৬৪৫ যুক্তরাষ্ট্র, ১,১৫৫ যুক্তরাজ্য কনট্রাক্টর মৃত্যু (মার্কিন ২৪২): ১,০২৫ কনট্রাক্টর নিখোঁজ বা ধৃত (মার্কিন ৪): ১৮ কনট্রাক্টর আহত: ১০,৫৬৯ জাগরণ সৃষ্টিকারী কাউন্সিল: তুর্কী সশস্ত্র বাহিনী: ২৭ মৃত্যু | ||||||
সকল ইরাকির নৃশংস মৃত্যু, অপিনিয়ন রিসার্চ বিজনেস আগস্ট ২০০৭ পর্যন্ত: ১,০৩৩,০০০ (৯৪৬,০০০-১,১২০,০০০)। কারণ; গুলিবিদ্ধ (৪৮%), গাড়ি বোমা (২০%), উপর থেকে নিক্ষেপিত বোমা (৯%), দুর্ঘটনা (৬%), অন্য বিস্ফোরণ/অর্ডন্যান্স (৬%) ***সর্বমোট মৃত্যু (সকল অতিরিক্ত মৃত্যু) জন্স হপকিন্স (ল্যান্সেট) - জুন ২০০৬ পর্যন্ত: ৬৫৪,৯৬৫ (৩৯২,৯৭৯-৯৪২,৬৩৬)। ৬০১,০২৭ সহিংস মৃত্যু (৩১% কোয়ালিশন দ্বারা, ২৪% অন্যান্যের দ্বারা, ৪৬% অজানা) সকল ইরাকিদের সহিংস মৃত্যু। ইরাকের স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের হতাহতের জরিপ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জন্য। জুন ২০০৬ পর্যন্ত: ১৫১,০০০ (১০৪,০০০ থেকে ২২৩,০০০) |
ইরাক আক্রমণ করার জন্য তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশ ও কোয়ালিশন বাহিনী যে কারণ দেখিয়েছিল তা হল: ইরাক ১৯৯০ সালের চুক্তি অমান্য করে গণবিধ্বংসী অস্ত্র নির্মাণ করছে এবং তাদের কাছে এ ধরনের অস্ত্রের মজুদও আছে। তখন সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছিল, ইরাক যুক্তরাষ্ট্র, এর জনগণ এবং মিত্র রাষ্ট্রগুলোর জন্য বড় ধরনের হুমকি। পরবর্তীতে এএ সমর্থক কর্মকর্তাদের প্রচণ্ড সমালোচনা করা হয়। কারণ আগ্রাসনের পরে পরিদর্শকরা ইরাকে গিয়ে কোন ধরনের গণবিধ্বংসী অস্ত্র খুঁজে পায়নি। তারা জানায়, ইরাক ১৯৯১ সালেই গণবিধ্বংসী অস্ত্র নির্মাণ ত্যাগ করেছে, ইরাকের উপর থেকে আন্তর্জাতিক অনুমোদন সরিয়ে নেয়ার আগ পর্যন্ত তাদের নতুন করে গণবিধ্বংসী অস্ত্র নির্মাণের কোন পরিকল্পনাও ছিল না। এখানে সেখানে ছড়িয়ে থাকা যা কিছু অস্ত্র পাওয়া গেছে আগেরগুলোরই ভগ্নাবশেষ। এগুলোর জন্য মার্কিন বাহিনী ইরাক আক্রমণ করেনি। কোন কোন মার্কিন কর্মকর্তা দাবী করেন যে, সাদ্দাম হোসেন আল-কায়েদাকে সহযোগিতা করছেন, কিন্তু এর পক্ষেও কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তার পরও আগ্রাসনের কিছু কারণ দেখানো হয়েছে। যেমন: ফিলিস্তিনের আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী পরিবারকে আর্থিক সহায়তা করা, ইরাকি সরকার কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা এবং ইরাকের তেল সম্পদ অধিগ্রহণ করা। অবশ্য সর্বশেষ কারণটির কথা মার্কিন কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করেছে।
আগ্রাসী বাহিনী আক্রমণ করার পরপরই ইরাকি সামরিক বাহিনী পরাজিত হয়। রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হোসেন পালিয়ে বেড়ায়, অবশেষে ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে তাকে আটক করা হয়। ২০০৬ এর ডিসেম্বরে সাদ্দামের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। মার্কিন কোয়ালিশন বাহিনী ইরাক দখল করে সেখানে একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের চেষ্টা চালায়। কিন্তু আগ্রাসনের পরপরই কোয়ালিশন বাহিনীর বিরুদ্ধে এবং ইরাকের বিভিন্ন পন্থী দলগুলোর মধ্যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে অপ্রতিসম বিভিন্নমুখী আক্রমণের মাধ্যমে ইরাকি অভ্যুত্থানের সূচনা ঘটে। সুন্নি এবং শিয়া দলগুলোর মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় এবং আল-কায়েদা ইরাকে তাদের কার্যক্রম ত্বরান্বিত করে। এই যুদ্ধে মৃতের সংখ্যা আনুমানিক ১৫০,০০০ থেকে ১০ লক্ষের বেশি। যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় হয়েছে ৮৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চেয়েও বেশি, আর যুক্তরাজ্যের ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন ইউরো। উল্লেখ্য এই সময়ে মার্কিন অর্থনীতির মোট ব্যয়ের পরিমাণ ৩ থেকে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের মধ্যে। এক পর্যায়ে কোয়ালিশনের বেশ কিছু রাষ্ট্র ইরাক থেকে সৈন্য প্রত্যাহার শুরু করে। গণ অসন্তোষ এবং ইরাকি বাহিনীর প্রতিরক্ষার দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নেয়ার কারণেই এই প্রত্যাহার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
১৯৯১-২০০৩: জাতিসংঘ পরিদর্শক এবং নো-ফ্লাই জোন
সম্পাদনা১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধ শেষ হবার পর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ রিজলিউশন ৬৮৭ সংশোধনের মাধ্যমে আদেশ জারি করে যে, ইরাকের সকল ধরনের রাসায়নিক, জৈব, নিউক্লীয় এবং দূর পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র প্রোগ্রাম অবিলম্বে বন্ধ করে দিতে হবে। জাতিসংঘ বিশেষ কমিশন কন্ট্রোলের (ইউএনএসকম) মাধ্যমে এই আদেশ প্রচার করা হয়। জাতিসংঘ পরিদর্শকদের উপস্থিতিতে ইরাক বিপুল পরিমাণ গণবিধ্বংসী অস্ত্র ধ্বংস করে, তার পরও কিছু বস্তুনিষ্ঠ ইস্যুর সমাধান হয়নি। ১৯৯৮ সালে পরিদর্শক দল ইরাক ত্যাগ করে, কারণ কমিশন কন্ট্রোলের প্রধান রিচার্ড বাটলার বুঝতে পারছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সামরিক মহড়া আসন্ন। পরিদর্শকেরা চলে আসার পরপরই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ৪ দিনব্যাপী বোমা বিস্ফোরণের মহড়া চালায়।
জাতিসংঘ পরিদর্শনের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য (১৯৯৮ পর্যন্ত ফ্রান্স) উত্তর ও দক্ষিণ ইরাকের নো-ফ্লাই জোনে ইরাকের সাথে ছোটোখাটো যুদ্ধে লিপ্ত হয়। উপসাগরীয় যুদ্ধের পর উত্তর ও দক্ষিণ ইরাকের শিয়া অঞ্চলের কুর্দিস্তান রক্ষার জন্য এই নো-ফ্লাই জোন তৈরি করা হয়েছিল। ইরাক সরকার এটাকে ইরাকের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন বলে মনে করতো। সেখানে ইরাক আকাশ-প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাথে মার্কিন ও ব্রিটিশ আকাশ পেট্রোলের নিয়মিত ছোট আকারের গোলাবারুদ বিনিময় চলতো।
২০০১ সালের এপ্রিলে বুশের কেবিনেট ইরাকে সামরিক হস্তক্ষেপের ব্যাপারে সম্মত হয়, কারণ ইরাক মধ্যপ্রাচ্য থেকে আন্তর্জাতিক তেল বাজারে একটা অস্থিতিশীল প্রভাব বিস্তার করেছিল। ১১ই সেপ্টেম্বর হামলার অনেক আগেই নিওকনজারভেটিভেরা ইরাকের তেল ক্ষেত্রগুলো আয়ত্তে আনার জন্য একটি ক্যু এর পরিকল্পনা করেছিল। তারা আশা করছিল, "একটি নতুন সরকার ইরাকের তেল ব্যবহার করে ওপেক কোটা থেকে বেশি তেল উৎপাদনের মাধ্যমে ওপেক বাণিজ্য-জোট ভেঙে দিতে সক্ষম হবে।" কিন্তু আগ্রাসনের পরপরই এ পরিকল্পনা ভেস্তে যায়, কারণ শেল অয়েল কোম্পানির তৎকালীন সিইও ফিলিপ ক্যারল (যাকে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল) ইরাকি তেল কারখানাগুলো ব্যক্তি মালিকানায় নিয়ে আসার সাথে জড়িত হতে চাচ্ছিলেন না, যেহেতু জড়িত হলে মার্কিন ফার্মগুলো বর্জন করতে হতে পারে। রাজ্য পরিচালিত তেল মন্ত্রনালয়ের অবশ্য এ ভয় ছিল না, তাই তারা ইরাকে তেল আগ্রাসন চালাতে উদ্যত হয়। মার্কিন তেল বাণিজ্য উপদেষ্টা ফালাহ্ আলজিবারি দাবী করেছেন, ২০০১ সালে বুশ ক্ষমতা পাওয়ার পরপরই ওয়াশিংটন, মধ্যপ্রাচ্য ও ক্যালিফোর্নিয়াতে ইরাকের বর্তমান সরকার উচ্ছেদ বিষয়ে গোপন মিটিং শুরু করেছিলেন। আলজিবারি বিবিসি-কে বলেছেন, তিনি বুশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাদ্দাম হুসাইনের প্রভাবশালী উত্তরসূরীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন।
অপারেশন ইরাকি ফ্রিডম এর এক বছর আগেই যুক্তরাষ্ট্র অপারেশন সাউদার্ন ফোকাস শুরু করেছিল, এর সাড়া দানের কৌশল পরিবর্তনের জন্য। তারা নির্বাচিত লক্ষ্যবস্তু অনেকাংশে বৃদ্ধি এবং ইরাকের নো-ফ্লাই জোনে ঢুকে পড়ার মত কাজকর্মের মাধ্যমে ইরাকের নিয়ন্ত্রণ কাঠামোতে বিঘ্ন সৃষ্টি করার চেষ্টা করছিল। ইরাকে নিক্ষেপিত বোমার ভর ২০০২ সালের মার্চে ছিল ০, এপ্রিলে হয়েছে ০.৩, আর মে-আগস্টে গিয়ে তা হয়েছে ৮-১৪ টনের মত। যুদ্ধের আগে সবচেয়ে বেশি বোমাবর্ষণ ঘটেছিল সেপ্টেম্বরে, সপ্তাহ প্রতি ৫৪.৬ টন।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "The Iraq War"। Council on Foreign Relations (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৮-১৭।
- ↑ "Iraq War | Summary, Causes, Dates, Combatants, Casualties, & Facts | Britannica"। www.britannica.com (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২৩-০৬-১৯। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৮-১৭।