হরিধন মুখোপাধ্যায়
হরিধন মুখোপাধ্যায় (১০ নভেম্বর ১৯০৭ - ২৬ ডিসেম্বর ২০০৪) পশ্চিমবঙ্গের বাংলা চলচ্চিত্রের অত্যন্ত জনপ্রিয় অভিনেতা এবং গায়ক। তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের পাশাপাশি বাংলা থিয়েটারে তার কাজের জন্য পরিচিত। তাঁর বহুমুখী অভিনয়ের প্রতিভার জন্য চরিত্রগুলিকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন।
হরিধন মুখোপাধ্যায় | |
---|---|
জন্ম | দীনবন্ধু মুখোপাধ্যায় ১০ নভেম্বর ১৯০৭ |
মৃত্যু | ২৬ ডিসেম্বর ২০০৪ | (বয়স ৯৭)
পেশা | অভিনেতা, গায়ক |
সন্তান | সুনীল মুখোপাধ্যায় |
প্রাথমিক জীবন
সম্পাদনাহরিধন মুখোপাধ্যায় ১৯০৭ সালের ১০ই নভেম্বর ব্রিটিশ ভারতের ২৪ পরগণার গোবরডাঙ্গার কাছে খাতুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।[১] তাঁর আসল নাম ছিল দীনবন্ধু মুখোপাধ্যায়। তাঁর পিতার নাম ভুবনমোহন এবং মাতার নাম গিরিবালা দেবী। তাঁর বাবা খুব অল্প বয়সে মারা যান, তাঁর মা দুই ভাইকে বড় করে তোলেন। তিনি শ্যামবাজার এ ভি স্কুলে পড়াশোনা করেন। চরম আর্থিক অনটনের জন্য তিনি স্কুলে বন্ধুদের কাছে লজেন্স বিক্রি করতেন। অল্প কিছু দিনের মধ্যে ৩০ টাকা জমিয়ে তিনি সাবান, পাউডার করতে লাগল তারপর চাল ব্যবসা করলেন সে ব্যবসাও চলল না । দাদার বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে শুরু করলেন হাতিবাগানে আলু বিক্রি করতেন। তিনি স্কুলের নাটকে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করতেন এবং একদিন ঐ স্কুলের সেক্রেটারি নাট্যকার অমৃতা লাল বসুর প্রশংসা পেয়েছিলেন।[১]
কর্মজীবন
সম্পাদনাহরিধন মুখোপাধ্যায় এর ছেলেবেলা দরিদ্র ও কষ্টের জীবন তবুও সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন তাঁর শক ছিল গান আর অভিনয় করা। তাই তিনি দিনের বেলা আলু বিক্রি করতেন আর রাতের বেলা থিয়েটার, কবিগান, রামায়ণ, পাঁচালির আসরে হাজির থাকতেন। অভিনয় আর রামায়ণ গান ছেলেবেলা থেকে নেশা একবার শুনলেই মনে রাখতে পারতেন। নবদ্বীপ ব্রজবাসীর কাছে কীর্তনও শিখেছিলেন। তাঁর গানে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ও কাশিমবাজারের মহারাজা মনিন্দ্রচন্দ্র নন্দী মুগ্ধ হয়েছিলেন।[২] এছাড়াও তাঁর গান শুনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে একটি কাঁথা স্টিচের চাঁদর উপহার দিয়েছিলেন। এমনকি গান্ধীজী কেও তিনি গান শুনিয়ে ছিলেন। তিনি এখানেই থেমে থাকেন নি তারপর শুরু হল নাটকে অভিনয় করা তাও আবার নারী চরিত্রে, বহু নাটকে তিনি নারী চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন যেমন পথের শেষে, বিবাহ বিভ্রাট, আলিবাবা ইত্যাদি।[২]
অমৃতলাল বসুর নাটক নিয়ে প্রথম ছবি খাসদখল এ হরিধন মোসায়েবের চরিত্র পেয়েছিলেন।[৩] তারপর ১৯৪৩ সালে তিনি তৎকালীন বিখ্যাত পরিচালক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের শহর থেকে দূরে ছবিতে ছোট্ট বাউল চরিত্রে সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর লিপে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের কণ্ঠে ‘রাধে, ভুল করে তুই চিনলি না তোর প্রেমের শ্যামরায়’ গানটি খুব জনপ্রিয় হল। তারপর পরিচালক দেবকী কুমার বসুর হাত ধরে হরিধন বাবুর চলচ্চিত্রে নতুন জন্ম হল। ১৯৪৪ সালে দেবকী কুমার বসু ছবি সন্ধি আর সেই ছবিতেই জন্ম হল কমেডিয়ান হরিধন বাবুর।[৩] তাঁর মুখে ‘জয় মা জাপানযাপিনী’ ডায়ালগ তুমুল হিট! সাড়ে চুয়াত্তর ছবিতে রোম্যান্টিক জুটি উত্তম কুমার-সুচিত্রা সেনের অভিষেক। আর খিটখিটে মেস সদস্যর ভূমিকায় হরিধন মুখোপাধ্যায়। এছাড়াও বহু চলচ্চিত্রে যেমন সাহেব বিবি গোলাম ছবিতে মেজো বাবুর শাগরেদ, বসন্ত বিলাপ ছবিতে মহিলা মেসের বাড়িওয়ালা, মিস প্রিয়ংবদা ছবিতে মামাবাবু, মৌচাক ছবিতে ডাক্তারের চরিত্রে হাস্যরসময় অভিনয় করেছিলেন।[৪] এছাড়া পরশ পাথর, ফুলেশ্বরী, ধন্যি মেয়ে, ভোলা ময়রা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন এবং তাঁর শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র টুনি বৌ (১৯৮৭)। তাঁর অভিনয়জীবনে ১৪০টিরও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তিনি নীরেন লাহিড়ী, দেবকী কুমার বসু, সত্যজিৎ রায়, নির্মল দে, তরুণ মজুমদার, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, হীরেন নাগ প্রমুখ পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করেছেন।[৫]
চলচ্চিত্র ছেড়ে তিনি থিয়েটার করতে শুরু করলেন, 'থিয়েটার তাঁর প্রান ছিল' তিনি কবি, উল্কা, আদর্শ হিন্দু হোটেল, আমি মন্ত্রী হব, কৃষ্ণকান্তের উইল, সমাধান, দেবদাস, সাহেব বিবি গোলাম, রামের সুমতি প্রভৃতি নাটকে অভিনয় করেছিলেন। তিনি প্রায় বাইশ বছর রঙমহলে এবং শেষ আঠারো বছর স্টার থিয়েটারে অভিনয় করেন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ডাকে আকাশবাণীতে রেডিয়ো নাটক করেন। ১৯৯১ সালে স্টার থিয়েটারে পাশের বাড়ি নাটকে তাঁর শেষ অভিনয় ওই বছরই স্টার থিয়েটার পুড়ে যায়। শেষ বয়সে তিনি অনেকগুলি সম্মান-পুরস্কার পেয়েছিলেন যেমন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বিএফজেএ, পশ্চিমবঙ্গ নাট্য অ্যাকাডেমি, ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ় অব ইন্ডিয়া, যোগেশ মাইম অ্যাকাডেমি ইত্যাদি। রাজ্যপাল রঘুনাথ রেড্ডি তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমির পুরস্কার।[৬][২]
সল্টলেকের বাড়িতে পড়ে গিয়ে কোমর ভেঙ্গে যায় এবং শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। ২০০৪ সালে ২৬শে ডিসেম্বর তিনি মারা যান।[৬]
ফিল্মগ্রাফি
সম্পাদনাবছর | চলচ্চিত্র |
---|---|
১৯৪৩ | শহর থেকে দূরে |
১৯৪৪ | সন্ধি |
১৯৫০ | বিদ্যাসাগর |
১৯৫০ | মর্যাদা |
১৯৫৩ | রাজা কৃষ্ণচন্দ্র |
১৯৫৩ | সাড়ে চুয়াত্তর |
১৯৫৫ | জয় মা কালী বোর্ডিং |
১৯৫৬ | শ্যামলী |
১৯৫৭ | হরিশ্চন্দ্র |
১৯৫৮ | পরশ পাথর |
১৯৫৮ | যমলায় জীবন্ত মানুষ |
১৯৬২ | কাঞ্চনজঙ্ঘা |
১৯৬৩ | পলাতক |
১৯৬৫ | মহাপুরুষ |
১৯৬৫ | অভয় ও শ্রীকান্ত |
১৯৬৭ | বালিকা বধূ |
১৯৬৭ | অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি |
১৯৬৮ | গুপি গাইন বাঘা বাইন |
১৯৬৯ | বিবাহ বিভ্রাট |
১৯৭১ | ধন্যি মেয়ে |
১৯৭৩ | বসন্ত বিলাপ |
১৯৭৩ | শ্রীমান পৃথ্বীরাজ |
১৯৭৪ | ঠগিনি |
১৯৭৪ | ফুলেশ্বরী |
১৯৭৫ | অগ্নিশ্বর |
১৯৭৭ | ভোলা ময়রা |
১৯৭৯ | ঘটকালি |
১৯৮০ | হীরক রাজার দেশে |
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ "Bangla Cinema 100"। banglacinema100.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১২-২৯।
- ↑ ক খ গ Bangla, Jago (২০২৩-০৩-০৪)। "রসরাজ"। JagoBangla: (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১২-২৯।
- ↑ ক খ "ফিমেল রোল ছেড়ে কমেডিতে অনন্য হয়ে উঠলেন হরিধন"। www.anandabazar.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১২-২৯।
- ↑ "কমেডির জাদুকর হরিধন মুখোপাধ্যায়, তাঁর 'মা কালী হ' সংলাপ আজও হিট"। TheWall। ২০২০-১১-১০। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১২-২৯।
- ↑ Ray), প্রদীপ কুমার রায়। (Pradip Kumar। মানবতার পূজারী স্বল্প পরিচিত ভারতীয়ের কাহিনী। Pradip Kumar Ray। আইএসবিএন 978-93-5407-770-8।
- ↑ ক খ "Haridhan Mukherjee – The 'Mama' of Bengali cinema who fought poverty since age of 11"। Get Bengal (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১২-২৯।
- ↑ "Haridhan Mukherjee on Moviebuff.com"। Moviebuff.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১২-২৯।