শরণীয়া কাছাড়ি জনগোষ্ঠী
শরণীয়া কাছাড়ি আসাম-এর একটি জনজাতীয় গোষ্ঠী। ১৮৮১ এবং ১৮৯১ সালের জনগণনাত বিশেষকরে উপজাতি শ্রেণীতে বিভক্ত করা শরণীয়ারা নিম্ন আসামে শরণীয়া কাছাড়ি বলে পরিচিত। আসামের বাক্সা, বরপেটা, নলবাড়ি, কামরূপ, বঙাইগাঁও, ওদালগুড়ি, দরং, শোণিতপুর, লখিমপুর, ধেমাজি, কামরূপ মহানগর, মরিগাঁও, কোকরাঝার ইত্যাদি জেলায় বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকা শরণীয়া কাছাড়িরা বৃহত্তর মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর বড়ো, রাভা, সোনোয়াল কাছাড়ি, ঠেঙাল কাছাড়ি, মেচ কাছাড়ি, মিসিং, মরাণ, মটক, তিওয়া-লালুং, হাজং, কার্বি, ডিমাচা, হোজাই, বরাহী, আহোম, চুতীয়া, কোচ, মদাহি ইত্যাদি জনগোষ্ঠীয় গোষ্ঠীসমূহের দরেই সাংস্কৃতিক পরম্পরায় সমৃদ্ধ একটি জনজাতীয় জনগোষ্ঠী। আসামের এই জনগোষ্ঠীটির জনসংখ্যা প্রায় চার লাখের কাছে। তাঁরা বিভিন্ন জেলায় বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকা জন্য সেই জেলাগুলির লোকভাষা এবং সংস্কৃতির প্রভাবো তাঁদের উপর পড়েছে। শরণীয়া, মহলীয়া, ডেকা, কাছাড়ি, চৌধুরী, দাস, বরুয়া, কাকতি, শইকীয়া, বর্মণ, মজুমদার, হাজারিকা, লহকর, মহন্ত ইত্যাদি উপাধিরে পরিচিত শরণীয়া কাছাড়িরা হাজার বছর আগে হিন্দু ধর্মে শরণ নিয়ে অসমীয়া ভাষাকে মাতৃভাষারূপে গ্রহণ করলেও বিহুকেন্দ্রিক এবং ধর্মীয় উৎসবমূলক গান-নাচে জনজাতীয় প্রভাব আংশিক পরিমাণে হলেও রয়ে গিয়েছে।[১]
উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যার অঞ্চল | |
---|---|
ধর্ম | |
হিন্দু ধর্ম · খ্রিস্টান ধর্ম | |
সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী | |
বড়ো, কাছাড়ি |
উৎসব / অনুষ্ঠান
সম্পাদনাএদের সাংস্কৃতিক পরম্পরাগুলির মধ্যে আছে বিভিন্ন ধরনের কৃষিমূলক রীতি-নীতিভিত্তিক উৎসব-অনুষ্ঠান, ধর্মকেন্দ্রিক সেবামূলক অনুষ্ঠান, ভাদ্রমাসের বাম্বোলপিটা বা হেপরপিটা উৎসব, বাঁশ-গোঁসাঁই উৎসব ইত্যাদি। এর বাঁশ-গোঁসাঁই উৎসব হল ব'হাগ মাসের পরম্পরাগত লোক-উৎসব। অন্য উৎসব বিভিন্ন প্রসঙ্গে বিভিন্ন সময় আয়োজন করা হয়।
শরণীয়া কাছাড়িদের জীবনধারা কৃষিকর্ম এবং লোকশিল্পকলার সাথে জড়িত। কাছাড়িমূলীয় এই জনগোষ্ঠীটি জনজাতীয় ধর্মীয় পরম্পরা ছেড়ে প্রথমে বৈদিক বামুণীয়া পরম্পরা এবং পনেরো-ষোল শতকে শঙ্করী ধর্মীয় পরম্পরা গ্রহণ করে শরণীয়া পরিচিতি লাভ করার পরো তাঁদের লোকজীবনের স্বকীয় সাংস্কৃতিক পরম্পরা অব্যাহত থাকে। মূলতঃ বড়ো, কোচ, রাভা মাদাহি ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর জীবনধারার সাথে সম্পর্কিত শরণীয়া কাছাড়িরা যে সাংস্কৃতিক পরম্পরা পালন করে সেখানে কৃষি এবং ঘরুবা শিল্পকর্মের সাথে বাঁশে গুরুত্ব লাভ করে আসছে। সেজন্য শরণীয়া কাছাড়ি বিহুর বিভিন্ন পরম্পরা এবং পরিবেশন পদ্ধতির সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে আসা ছাড়াও বাঁশকে মুখ্যস্থান দিয়ে ধর্মীয় পরম্পরাভিত্তিক বাঁশ-গোঁসাঁই উৎসব পালন করে আসছে।
বড়োরা যে তেরো দেবতাকে সেবা অর্চনা করে আসছে তার তেরো নম্বর হল নবাব বাদসাহ। অন্য বারটি হল ক্রমে-বাথৌ বরাই, আইলেং, আগ্রাং, খইলা, রাজখন্দ্রা, সংরাজা, আলাই খুঙ্গী, ভঁরালী, রণচণ্ডী, বুল্লি-বুরি এবং লাউঁচুার গোঁসাঁই। নৃতাত্ত্বিক গবেষণার থেকে জানা যায় যে, আসামের বড়ো এবং শরণীয়া কাছাড়িরা একই কাছাড়ি মূলের মানুষ। সেজন্য পূর্বে বড়োদের মতোই শরণীয়া কাছাড়িদের মধ্যেও ধর্মনিরপেক্ষ লোকপরম্পরার অনেক সামগ্রী ছিল বলে ধারণা করা যায়।
শরণীয়া কাছাড়িদের মধ্যে চ’ত বিহুর অনেক পরম্পরা আছে। গরু বিহুর দিন গরুকে গা ধুইয়ে নতুন পঘা পরায়, প্রথম বহাগ থেকে জ্যেষ্ঠজনের কনিষ্ঠ জনকে আশীর্বাদ এবং আদর জানানো, কনিষ্ঠজনের জ্যেষ্ঠজনকে সেবা জানিয়ে আশীর্বাদ চাওয়া, আপনজনকে বিহুবান উপহার দিয়া, আত্মীয় এবং শুভাকাংশীর ঘরে গিয়ে বিহুর আপ্যায়ন গ্রহণ করা, হুচরি এবং বিহুমরা ইত্যাদি পরম্পরাও শরণীয়া কাছাড়িদের মধ্যে দেখা যায়। অন্য জনগোষ্ঠীর গাভরুর মতো শরণীয়া কাছাড়ি গাভরুরাও বিহুনাচ নাচে। তাঁদের মেখেলা-চাদরের রঙ সবুজ, মেখেলা এবং চাদরের পাড় গুলি লাল, বেগুনি, বগা এবং হলুদ রঙের সংমিশ্রিত ফুলে সজ্জিত। কিছু গাওঁতে কেঁচবছা চাদরও ব্যবহার করতে দেখা যায়। নাচনীর চোলাও সবুজ রঙের। নাচনী হাতে গাম খারু, খোপাতে কপৌফুল, ডিঙিতে ঢোলবিরি, জোনবিরি ইত্যাদি পরিধান করেন। অন্যদিকে নাচনি বা বিহুবাই ছোটদের সবুজ রঙের (কয়েকজন বগা রঙের) চুড়ি বা দীর্ঘ গামোচা পরিধান করেন এবং গায়ে মুগা, বগা বা সবুজ রঙের হাতকাটা বিহুচোলা পরেন। অন্য জনগোষ্ঠীর বিহুবার মতো শরণীয়া কাছাড়ি জনগোষ্ঠীর বিহুবা মাথায় বগা বা সবুজ রঙের বিহুবান পরে বিহু করেন। শরণীয়া কাছাড়িরা বিহুবানকে ‘বিহান’ বলে। তাঁতশালে ফুলবাছার পরম্পরা থাকার জন্য শরণীয়া কাছাড়ি গাভরুরা বাবরিফুলীয়া, ভমকাফুলীয়া ইত্যাদি ফুলবাছা বিহুবানগুলি বয়ে আপনজনকে উপহার দেন।