গরু বিহু

রঙালী বিহুর প্রথম দিন

বিহু আসাম-এর জাতীয় উৎসব। চৈত্রের সংক্রান্তির দিন গো-দেবতার প্রতি বিশেষ সম্মান জানিয়ে অসমীয়া লোকরা গরু বিহু রূপে পালন করে আসছে। গরু বিহুর সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন নিয়ম স্থানভেদে বিভিন্নরূপে পরিলক্ষিত হয়।

গরু বিহুর দিন গরুর গায়ে মারতে চাট সাজছে

গরু বিহুর মূল বৈশিষ্ট্য

সম্পাদনা

গরু বিহুর দিনের মূল বৈশিষ্ট্য হল - ঘরের গোয়ালের গরুগুলির মঙ্গল তথা সু-স্বাস্থ্য কামনা করা এবং তার অর্থে ভগবান-এর কাছে প্রার্থনা জানানো।

গরু বিহুর নিয়ম প্রথা

সম্পাদনা
 
গরুগুলিক গা ধোয়া দৃশ্য

গরু বিহুর দিন ভোরে উঠে গরুগুলিকে নদীর পারে নিয়ে যাওয়া হয় এবং আটি-টিকোরিকৈ গা ধোয়া হয়। গরুর গা ঘষার জন্য খের-এর নুরা ব্যবহার করা হয়। জলে গা ধোয়ার পরে গরুর গায়ে মাষ-হলদির মিহি মিশ্রণ দিয়ে দেয়া হয়। সেইদিন গরুর গায়ে লাউ-বেঙেনা ইত্যাদি ছিটিয়ে ছাট সজা হয়। গরুর স্নান পর্ব শেষ হওয়ার পরে গরুর নিরোগ একটি শরীর কামনা করে গায়ে লাউ, বেঙেনা ইত্যাদি ছেটানো হয়। এইক্ষেত্রে আসামবাসী এমনভাবে গায়-

 
গরুর গা ধোয়াচ্ছে

লাউ খা বেঙেনা খা, বছরে বছরে বাঢ়ি যা।
মার ছোট বাপের ছোট, তই হ'বি বর বর গরু

নদীর পারের এই সমগ্র কর্মরাজিতে গ্রামের ডেকা-গাভরু, শিশু-মহিলা সমস্ত উপস্থিত থাকে এবং পরিবেশটি যথেষ্ট মোহনীয় হয়ে পড়ে। এই মধুর ক্ষণে দীঘলতি এবং মাখিয়তীর গরুর গায়ে কোবোবা প্রথাও গরুবিহুর একটি নিয়ম। এইক্ষেত্রে আসামবাসী এভাবে গায়-

দীঘলতির দীঘল পাত, গরু বলাওঁ জাত জাত
মাখিয়তীর মাখি পাত, মাখি মারোঁ জাত জাত

একটি ছাটে থাকা সমস্ত লাউ-বেঙেনা গরুর গায়ে না ছুড়ে কিছু অংশ ছাটটিতে রাখা হয়। নিজের ঘরের ছাট ঘরে ওভোটাই নানি ওচর-চুবুরীয়ার সঙ্গে ছাট বদল করাটিও গরু বিহুর একটি নিয়ম। গোয়ালের কোনো এক কোণে ছাটটি সযত্নে সংরক্ষণ করা হয়। এই সমস্ত নিয়ম থেকে ফিরে হয়ে গৃহস্থই ঘরে এসে স্নান করে। জনপ্রবাদ অনুসারে পথে বা নদীর পারে গরুর গায়ে মরা হলদিতে সেইদিন গা ধুলে বহু রোগের থেকে মুক্ত হওয়া যায়। সেইদিন বহু অসমীয়া ঘরের গরুগুলির মঙ্গলার্থে ভগবানের কাছে মিনতি নিবেদন করে গোসাঁইঘরে প্রার্থনা জানায়। গ্রামের বুঢ়ামেথা সেইদিন নামঘরে সমবেত হয়ে শরাই শুরু করে। ঘরের সমস্ত সদস্য একসাথে বসে চিড়ে–দৈ দিয়ে একসাজ জলপান করা অসমীয়া সমাজের এক চিরাচরিত নিয়ম।

 
একজন ছোট মেয়ে গরুর গায়ে লাউ বেঙেনা ছুড়ছে
 
সন্ধিয়া গরুকে জাক দিয়েছে

নাহের পাতায় মন্ত্র লিখে ঘরের দুয়ার-খিরকীর কোণে লাগানো গরু বিহুর একটি উল্লেখযোগ্য প্রথা। জনবিশ্বাস অনুসারে এমন করলে ধুমুহা, বা-মারলির থেকে ঘরটি রক্ষা পায়। ভগবান শিবকে প্রার্থনা জানিয়ে নাহের পাতার বিপরীত অংশে এভাবে লেখা হয়,

দেব দেব মহাদেব নীলগ্রীব জটাধর ।
বাত বৃষ্টি হরংদেব মহাদেব নমস্তুতে ।।

 
নাহর পাতায় লেখা মন্ত্ৰ

সন্ধ্যাবেলা পথের থেকে ঘরের গরু ঘুরে আসার পরেই খের, বিহলঙনী ইত্যাদি দিয়ে জুই জ্বালিয়ে গরুর আগে তার ধোঁয়া বিচালি বিছিয়ে দেয়া হয়। আসামবাসীর মধ্যে একে ‘জাগ দেয়া’ বলা হয়। প্রবাদ আছে যে, আসামবাসী গরু বিহুর দিন ঘরের গরুগুলিকে জাগ দেয়ার পরেই বিচালি ব্যবহার করে। আসামের অনেক স্থানে সন্ধ্যাবেলা গরু গোয়ালে প্রবেশ করার আগে আগে মাছের জলে গরুর ভরি ধোয়ার নিয়ম প্রচলিত আছে। জনবিশ্বাস মতে - এমন করলে সারাবছর গরুর খুড়ে কোনোধরনের রোগ আক্রমণ করতে পারবে না। কোনো কোনো স্থানে পিঠাগুড়ি খুড়ে গরুকে খাওয়ানোর জন্য পিঠা তৈরি করার প্রথাও প্রচলিত আছে।

গরুকে নতুন পঘা দেয়া গরু বিহুর এক উল্লেখযোগ্য নিয়ম। বিশেষত এই পঘা মরাপাটে তৈরি করা হয়। মরাপাটের প্রতিটি পাকের মধ্যে মধ্যে ‘তরাগাছ’-এর বাকলি গুঁজে এই পঘা সাজানো হয়। তাতে হলদির মিহি প্রলেপ দিয়ে গরু বিহুর দিনই গরুকে নতুন পঘায় আদর জানানো হয়।[]

 
নাহর পাতায় লেখা মন্ত্ৰ

গরু বিহুত ব্যবহৃত শাক-পাতা

সম্পাদনা

আসামের বহু সমাজের লোক গরু বিহুর দিনই একশ এক রকম শাক-পাতা একসাথে রেধে গ্রহণ করে। অবশ্য আসামের বহু স্থানে সাতবিহুর দিনই এই প্রথা প্রচলিত হওয়া দেখা যায়। এই ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বিভিন্ন শাক-পাতা নিচে উল্লেখ করা হল। আজকাল সমস্ত শাক-পাতা লভ্য নয় যদিও কিছু এখনও পাওয়া যায়। সেইগুলি হচ্ছে-

১) অমিতাফুল

২) অমরা ফুল

৩) অশোক ফুল

৪) আরফুল

৫) আমর মল

৬) আনারসর কোঁহ

৭) আলুগুটির পাতা

৮) আদাপাতা

৯) আগেজলা

১০) ওলকচুপাতা

১১) ওলকবি পাতা

১২) কঁাঠালের মুচি

১৩) কেঁহেরাজ শাক

১৪) কচুশাক

১৫) কুঁহিয়ার পাতার আগা

১৬) কুকুরাঠেঙীয়া

১৭) বলাভাতুরি

১৮) কেঞাবন

১৯)কাচিপকা

২০) কাঁছকল পাতা

২১) কাঠ আলু পাতা

২২) কর্দৈ পাতা

২৩) কলমৌ শাক

২৪) কুহিলা পাতা

২৫) কলপচলা

২৬) কোমোরা পাতা

২৭) কেরেলা পাতা

২৮) খুতরা শাক

২৯) গাখীরতী

৩০) গাজর পাতা

৩১) গরুখিচ

৩২) চুকাশাক

৩৩) চজিনা পাতা

৩৪) চালকুঁবরী আগ

৩৫) চিরতা পাতা

৩৬) চয়াবিন পাতা

৩৭) জিলমিল শাক

৩৮) জেতুলীপকা পাতা

৩৯) জালুকপাতা

৪০) জলকীয়া পাতা

৪১) জবাফুল

৪২) জ্যেষ্ঠমধু পাতা

৪৩) জবেত্রী

৪৪) জাতিলাউ পাতা

৪৫) জিকা পাতা

৪৬) টিকনি বরুয়া

৪৭) টুপুরী লতা

৪৮) টেঙামরা

৪৯) টেঙেচি টেঙা

৫০) তিতাফুল

৫১) তিল পাতা

৫২) তুলসী

৫৩) তিঁয়হ পাতা

৫৪) থেকেরা পাতা

৫৫) থেরেজু পাতা

৫৬) দাংবদি

৫৭) দোরোণশাক

৫৮) সোনাবরীয়াল

৫৯) দুপরটেঙা

৬০) ধুন্দুলি পাতা

৬১) ধতুরা

৬২) ধনিয়া

৬৩) ঢেকীয়াশাক

৬৪) নরসিংহ

৬৫) নহরু পাতা

৬৬) নেফাফু

৬৭) নুনি পাতা

৬৮) নিলাজী বন

৬৯) পিরালি পালেং

৭০) পিঁয়াজপাতা

৭১) পদিন

৭২) পিরালি কুঁবরী

৭৩) পটল পাতা

৭৪) পালেং

৭৫) পুরৈশাক

৭৬) পনৌনৌবা

৭৭) পচতীয়া

৭৮) পিপলি

৭৯) ব্রাহ্মীশাক

৮০) বিলাহী পাতা

৮১) বাঁধাকবি

৮২) বনজালুক

৮৩) বেতগাজ পাতা

৮৪) বেঙেনা পাতা

৮৫) বরথেকেরা পাতা

৮৬) বিহলঙনি

৮৭) বকফুল

৮৮) বরমানিমুনি

৮৯) বরবরীয়াল

৯০) বৃন্দাবন

৯১) বহমথুরি

৯২) বিশল্যকরণি

৯৩) ভেদাইলতা

৯৪) ভাঙর আগা

৯৫) ভৃঙ্গরাজ

৯৬) ভেকুরি তিতা

৯৭) ভেটফুল

৯৮) মাটিকাঁদুরি

৯৯) ছোট মানিমুনি

১০০) মহানিম

১০১) মচন্দরী

১০২) মানধনিয়া

১০২) মরলীয়া পাতা

১০৩) মরিচা

১০৪) মেথিশাক

১০৫) মেটেকা

১০৬) মরাপাট

১০৭) মধুরী আম পাতা

১০৮) মধুসোলেং

১০৯) মূলাশাক

১১০) রঙালাউ আগ

১১১) লফাশাক

১১২) লাইজাবরী

১১৩) লাইশাক

১১৪) শেবালি ফুল

১১৫) সরিয়হ শাক

১১৬) শুকলতি

১১৭) হাতীখুতরা

১১৮) হেলচী শাক ইত্যাদি।

এই শাকগুলির সমস্তগুলি পাওয়া সম্ভব না হলেও বহুলোক এর এমন সাত রকম শাক ব্যঞ্জন করে খায়। সেইজন্যই একে বহুলোক সাতশাকী বলেও ডাকে। কিছুলোকের মতে ব‘হাগ বিহুর সাতদিনের দিনই এই শাকগুলি খাওয়ার জন্য সাতশাকী বলা হয়।

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. জুরি কটকী (১১ এপ্ৰিল, ২০১০ সাল)। "বিহু আরু লোকবিশ্বাস"। দৈনিক জনমভূমির দেওবরীয়া আলোচনী বসুন্ধরা: ১১ পৃ্ষ্ঠা।  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা