মদনমোহন মালব্য

ভারতীয় রাজনীতিবিদ

মদনমোহন মালব্য (১৮৬১—১৯৪৬) ছিলেন একজন ভারতীয় শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ। তিনি ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের এক বিশিষ্ট নেতা ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের চার বারের সভাপতি। তাকে পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য বলা হয়।[] এবং মহামনা সম্মানে ভূষিত করা হয়।[]

মহামনা পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য
মদনমোহন মালব্যের প্রতিকৃতি, ১৯ ডিসেম্বর, ১৯৫৭ তারিখে ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ কর্তৃক উন্মোচিত
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি
কাজের মেয়াদ
১৯০৯–১০; ১৯১৮, ১৯৩২ ও ১৯৩৩
ব্যক্তিগত বিবরণ
জন্ম(১৮৬১-১২-২৫)২৫ ডিসেম্বর ১৮৬১
এলাহাবাদ, যুক্তপ্রদেশ, ব্রিটিশ ভারত (অধুনা উত্তরপ্রদেশ, ভারত)
মৃত্যু১২ নভেম্বর ১৯৪৬(1946-11-12) (বয়স ৮৪)
বারাণসী, যুক্তপ্রদেশ, ব্রিটিশ ভারত (অধুনা উত্তরপ্রদেশ, ভারত)
জাতীয়তাভারতীয়
রাজনৈতিক দলভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস
প্রাক্তন শিক্ষার্থীএলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
জীবিকাশিক্ষাবিদ
সাংবাদিক
আইনজ্ঞ
রাজনীতিবিদ
স্বাধীনতা সংগ্রামী
ধর্মহিন্দুধর্ম
পুরস্কারভারতরত্ন ২০১৪ (মরণোত্তর)

১৯১৬ সালে মদনমোহন মালব্য বারাণসীতে কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় বা বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি (বি.এইচ.ইউ) প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় ১৯১৫ সালের বি.এইচ.ইউ আইন অনুসারে স্থাপিত। এটি এশিয়ার বৃহত্তম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়।[] এখানে কলা, বিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারি, কৃষিবিজ্ঞান, চারুকলা, আইন ও প্রযুক্তি বিভাগে ৩৫,০০০-এরও বেশি ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করেন। মদনমোহন মালব্য ১৯১৯ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন।[][]

মদনমোহন মালব্য চার বার (১৯০৯, ১৯১৩, ১৯১৯ ও ১৯৩২ সাল) ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছিলেন। ১৯৩৪ সালে তিনি জাতীয় কংগ্রেস ত্যাগ করে হিন্দু মহাসভার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য হিসেবে যোগ দেন।

মদনমোহন মালব্য ছিলেন দ্য ভারত স্কাউট অ্যান্ড গাইডসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।[] তিনি বিশেষ প্রভাবশালী ইংরেজি সংবাদপত্র দ্য লিডারের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯০৯ সালে এটি এলাহাবাদে প্রথম প্রকাশিত হয়।[] ১৯২৪ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত তিনি হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকার চেয়ারম্যানও ছিলেন। তারই উদ্যোগে ১৯৩৬ সালে এই পত্রিকার হিন্দি সংস্করণ হিন্দুস্তান দৈনিক প্রকাশিত হয়।

২০১৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর মদনমোহ মালব্যের ১৫৩তম জন্মবার্ষিকীর আগের দিন তাকে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন (মরণোত্তর) দিয়ে সম্মানিত করা হয়।[]

প্রথম জীবন ও শিক্ষা

সম্পাদনা

১৮৬১ সালের ২৫ ডিসেম্বর ব্রিটিশ ভারতের যুক্তপ্রদেশের (অধুনা ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের উত্তরপ্রদেশ রাজ্য) এলাহাবাদ শহরে মদনমোহন মালব্যের জন্ম।[] তিনি এক গৌড় ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতার নাম পণ্ডিত ব্রিজ নাথ ও মাতার নাম মুনা দেবী। তার পূর্বপুরুষরা ছিলেন অধুনা মধ্যপ্রদেশের মালব (উজ্জয়িনী) অঞ্চলের সংস্কৃত পণ্ডিত। সেই থেকে তারা ‘মালব্য’ নামে পরিচিত। তাদের প্রকৃত পদবী ছিল চতুর্বেদী। মদনমোহন মালব্যের পিতা ছিলেন সংস্কৃত সন্ডিত। তিনি ভাগবত পুরাণ পাঠ করতেন।[১০]

মদনমোহন মালব্য প্রথমে সংস্কৃত পাঠশালা ও পরে একটি ইংরেজি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন।[১১] তিনি পড়াশোনা শুরু করেছিলেন হরদেবের ধর্মজ্ঞানোপদেশ পাঠশালায়। এখানে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে পরে বিদ্যাবর্ধিনী সভার একটি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। পরে তিনি ভর্তি হন এলাহাবাদ জেলা স্কুলে। এখানে পড়ার সময় থেকে তিনি ‘মকরন্দ’ ছদ্মনামে কবিতা লেখা শুরু করেন। এই কবিতাগুলি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হত।

১৮৭৯ সালে তিনি মুয়ার সেন্ট্রাল কলেজ (অধুনা এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। হ্যারিসন কলেজের প্রিন্সিপাল তার জন্য একটি মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা করে দেন। কারণ, সেই সময় মদনমোহন মালব্যের পরিবার আর্থিক অনটনে পড়েছিলেন। এরপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন।

সংস্কৃতে স্নাতকোত্তর পাঠক্রমে ভর্তি হতে চাইলেও তার পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভাল না হওয়ায় তার পিতা তাকে পারিবারিক পেশা ভাগবত পাঠের কাজে নিয়োগ করতে চান। ১৮৮৪ সালে মদনমোহন মালব্য এলাহাবাদের গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ যেন।[১১]

রাজনৈতিক কর্মজীবন

সম্পাদনা

১৮৮৬ সালের ডিসেম্বর মাসে মদনমোহন মালব্য কলকাতায় দাদাভাই নৌরজির সভাপতিত্বে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেন। এখানে তিনি কাউন্সিলে ভারতীয়দের প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি নিয়ে বক্তৃতা দেন। তার ভাষণে নৌরজি খুশি হননি। সেই সময় এলাহাবাদের নিকটস্থ কালাকঙ্করের শাসক রাজা রামপাল সিং হিন্দুস্তান নামে একটি হিন্দি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি পত্রিকাটিকে দৈনিক পত্রিকায় রূপান্তরিত করার জন্য একজন যোগ্য সম্পাদক খুঁজছিলেন। মদনমোহন মালব্যের ভাষণে তিনিও খুশি হননি। কিন্তু পত্রিকা সম্পাদনার জন্য তিনি তাকেই প্রস্তাব দেন। তাই ১৮৮৭ সালের জুলাই মাসে মদনমোহন মালব্য শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে সেই জাতীয়তাবাদী দৈনিকটির সম্পাদনার কাজ শুরু করেন। সেখানে তিনি আড়াই বছর কাজ করেছিলেন। এরপর তিনি এলাহাবাদ ফিরে এসে এল.এল.বি পড়া শুরু করেন। সেই সময় এলাহাবাদে তিনি দি ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন নামে একটি ইংরেজি দৈনিকের সহ-সম্পাদনার কাজ শুরু করেন। আইন পড়া শেষ করে তিনি ১৮৯১ সালে এলাহাবাদ জেলা আদালতে ওকালতি শুরু করেন। পরে ১৮৯৩ সালের ডিসেম্বরে তিনি এলাহাবাদ হাইকোর্টে ওকালতি শুরু অরেন।[১২][১৩]

১৯০৯ ও ১৯১৮ সালে মদনমোহন মালব্য ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলে। তিনি ছিলেন একজন নরমপন্থী নেতা। ১৯১৬ সালের লখনউ চুক্তি অনুসারে মুসলমানদের জন্য পৃথক আইনসভার বিরোধিতা করেছিলেন। মহাত্মা গান্ধী তাকে "মহামনা" সম্মানে ভূষিত করেন।

১৯১১ সালে শিক্ষাবিস্তার ও সমাজসেবার জন্য তিনি তার লাভজনক আইনব্যবসা চিরকালের জন্য পরিত্যাগ করেন। সন্ন্যাস জীবন যাপনের জন্য তিনি সমাজসেবার কাজে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। কিন্তু চৌরিচৌরার ঘটনায় ১৭৭ জন স্বাধীনতা সংগ্রামীর ফাঁসির হুকুম হলে তিনি আদালতে তাদের হয়ে সওয়াল করেন এবং তাদের মুক্তির ব্যবস্থা করেন।[১৪]

১৯১২ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতের ইম্পিরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। এই কাউন্সিল ১৯১৯ সালে কেন্দ্রীয় আইনসভায় রূপান্তরিত হলে তিনি ১৯২৬ সাল পর্যন্ত সেখানকার সদস্য থাকেন।[১৫] মদনমোহন মালব্য অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন।[১৬] যদিও তিনি আবেদন-নিবেদনের রাজনীতি ও খিলাফত আন্দোলনে কংগ্রেসের যোগদানের বিরোধিতা করেছিলেন।

১৯২৮ সালে তিনি মতিলাল নেহেরু, জওহরলাল নেহেরু ও অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে সাইমন কমিশনের বিরোধিতা করেন। ১৯৩২ সালের ৩০ মে, বিলাতি দ্রব্য বর্জন করে ভারতীয় দ্রব্য কেনার আবেদন জানিয়ে তিনি একটি ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করেন।[১৭] ১৯৩০ সালে তিনি প্রথম গোলটেবিল বৈঠকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।

যদিও আইন অমান্য আন্দোলনের সময় ১৯৩২ সালের ২৫ মে তিনি দিল্লিতে অন্যান্য ৪৫০ জন কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবকের সঙ্গে গ্রেফতার হন। কিন্তু এই বছরই সরোজিনী নাইডু গ্রেফতার হওয়ার পর তিনি দিল্লিতে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন।[১৮] ১৯৩৩ সালে কলকাতায় মদনমোহন মালব্য আবার কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ভারতের স্বাধীনতার আগে মদনমোহন মালব্যই একমাত্র নেতা যিনি চার বার কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন।

১৯৩২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ড. ভীমরাও রামজী আম্বেদকর (হিন্দুদের অনগ্রসর শ্রেণির প্রতিনিধি) ও মদনমোহন মালব্যের (হিন্দুদের অন্যান্য শ্রেণির প্রতিনিধি) মধ্যে পুনা চুক্তি সাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে স্থির হয় প্রাদেশিক আইনসভাগুলিতে হিন্দুদের অনগ্রসর শ্রেণিগুলির জন্য আসন সংরক্ষিত থাকবে এবং তা হবে আইনসভার মধ্যেই, এর জন্য পৃথক আইনসভা গঠিত হবে না। এর ফলে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রামসে ম্যাকডোনাল্ড যে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার মাধ্যমে অনগ্রসর শ্রেণিগুলিকে ৭১টি আসন দিয়েছিলেন, তার বদলে এই শ্রেণিগুলি আইনসভায় ১৪৮টি আসন পায়। এই চুক্তির পর সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার আইনটি চুক্তি অনুযায়ী সংশোধিত হয়। এই চুক্তিতে ব্যবহৃত "অবদমিত শ্রেণি" কথাটি ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ও ১৯৫০ সালের ভারতীয় সংবিধানে "তফসিলি জাতি ও উপজাতি" শব্দে পরিণত হয়। [১৯]

সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার ব্যবস্থায় সংখ্যালঘুদের জন্য আলাদা আইনসভার বিরোধিতায় মদনমোহন মালব্য মাধব শ্রীহরি আনের সঙ্গে কংগ্রেস ছেড়ে কংগ্রেস ন্যাশানালিস্ট পার্টি গঠন করেন। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে নির্বাচনে এই দল কেন্দ্রীয় আইনসভায় ১২টি আসন পেয়েছিল।[২০]

সাংবাদিকতা

সম্পাদনা

১৮৮৭ সালে হিন্দি দৈনিক হিন্দুস্তান-এ সম্পাদনার মাধ্যমে মদনমোহন মালব্য তার সাংবাদিক কর্মজীবন শুরু করেন। কালাকঙ্করের (অধুনা প্রতাপগড় জেলা, উত্তরপ্রদেশ) রাজা রামপাল সিং ১৮৮৬ সালে কলকাতায় কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশনে তার ভাষণ শুনে ও ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে তাকে এই পদ গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন।[২১][২২]

১৮৮৯ সালে তিনি দি ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন পত্রিকার সম্পাদনার কাজ শুরু করেন। দি ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন লখনউয়ের অ্যাডভোকেট পত্রিকার সঙ্গে মিশে গেলে মদনমোহন মালব্য তার নিজস্ব হিন্দি দৈনিক অভ্যুদয়-এর সম্পাদনা শুরু করেন। ১৯০৭ থেকে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত তিনি এই পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন।[১১]

১৮৮৩-৮৪ সালের মধ্যে ‘মকরন্দ’ ছদ্মনামে লেখা তার শায়েরি বা হিন্দি কবিতাগুলি বিশিষ্ট সাহিত্যিক ভারতেন্দু হরিশ্চন্দ্র কর্তৃক প্রকাশিত হরিশ্চন্দ্র চন্দ্রিকা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। হিন্দি প্রদীপ পত্রিকায় তার ধর্মীয় ও সমসাময়িক বিষয় নিয়ে রচিত প্রবন্ধগুলিও প্রকাশিত হয়।[২১]

১৯০৮ সালে ব্রিটিশ সরকার মুদ্রণ আইন ও সংবাদপত্র আইন পাস করতে চাইলে মদনমোহন মালব্য এলাহাবাদে একটি সর্বভারতীয় সমাবেশ ডেকে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। এরপর তিনি একটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশ করে সেই আন্দোলনকে সারা ভারতে ছড়িয়ে দিতে চান। এরই ফলশ্রুতিতে মতিলাল নেহেরুর সাহায্যে ১৯০৯ সালে তিনি লিডার পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯০৯ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত তিনি এই পত্রিকার সম্পাদক এবং ১৯১১ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত এই পত্রিকার সভাপতি থাকেন।[২১]

১৯১০ সালে মদনমোহন মালব্য হিন্দি পত্রিকা মর্যাদা চালু করেন।[২১]

১৯২৪ সালে মদনমোহন মালব্য বিশিষ্ট নেতা লালা লাজপত রাই ও এম. আর. জয়কার ও শিল্পপতি ঘনশ্যামদাস বিড়লার সাহায্যে হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকা অধিগ্রহণ করে এটিকে অবলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করেন।[২৩] মদনমোহন মালব্য ৫০,০০০ টাকা তুলেছিলেন এই পত্রিকাটিকে বাঁচাতে। এই টাকার বেশিরভাগটাই দিয়েছিলেন ঘনশ্যামদাস বিড়লা। ১৯২৪ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত মদনমোহন মালব্য ছিলেন এই পত্রিকার চেয়ারম্যান। ১৯৩৬ সালে তারই উদ্যোগে এই পত্রিকার হিন্দি সংস্করণটি প্রকাশিত হয়। বর্তমানে বিড়লা পরিবার এই পত্রিকার মালিক।

১৯৩৩ সালে মালব্য কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সনাতন ধর্ম নামে একটি ধর্মীয় পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন।[২১]

ওকালতি

সম্পাদনা

১৮৯১ সালে মদনমোহন মালব্য এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল.এল.বি পাস করে এলাহাবাদ জেলা আদালতে ওকালতি শুরু করেন। ১৮৯৩ সালে তিনি এলাহাবাদ হাইকোর্টে ওলাকতি শুরু করেন। শীঘ্রই তিনি সেখানে এই বিশিষ্ট আইনজ্ঞের সম্মান পান।

তার ওকালতি জীবন সম্পর্কে স্যার তেজবাহাদুর সপ্রু বলেছেন, “...(তিনি ছিলেন) একজন মেধাবী দেওয়ানি উকিল।” স্যার মির্জা ইসমাইল বলেছেন, “আমি শুনেছি, এক বিশিষ্ট আইনজীবী বলেছেন, যদি শ্রীমালব্য চাইতেন, তবে তিনি আইনবিভাগের একজন শিরোমণি হতে পারতেন।” [২৪]

১৯২৪ সালে চৌরিচৌরার ঘটনার পর একবারই মাত্র মদনমোহন মালব্য উকিল হিসেবে আদালতে এসেছিলেন। এই ঘটনায় ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জনতা একটি থানা আক্রমণ করে তাতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। তারপরই মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। এই ঘটনায় অভিযুক্ত ১৭০ জনকে আদালত মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। এলাহাবাদ হাইকোর্টে তাদের হয়ে ওকালতি করে মদনমোহন মালব্য ১৫৫ জনকে মৃত্যুদণ্ডের হাত থেকে রক্ষা করেন। বাকি ১৫ জনের শাস্তিও কমে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। বিচার চলাকালীন মুখ্য বিচারপতি স্যার গ্রিমউড মেয়ারস মদনমোহন মালব্যের মেধাদীপ্ত সওয়ালের জন্য তাকে তিন বার অভিবাদন জানিয়েছিলেন।

কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পাদনা

১৯১১ সালের এপ্রিল মাসে অ্যানি বেসান্ত মদনমোহন মালব্যের সঙ্গে দেখা করেন। তারা স্থির করেন বারাণসীতে একটি সাধারণ হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করবেন। বেসান্তের প্রতিষ্ঠিত সেন্ট্রাল হিন্দু কলেজের সহকারী ফেলোগণ সহ বেসান্ত স্থির করেন যে এই কলেজ নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হবে। সরকারও তাতে রাজি হয়। ১৯১৫ সালের কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় আইন বলে ১৯১৬ সালে কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে এটি ভারতের একটি বিশিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।[][২৫] ১৯৩৯ সালে মদনমোহন মালব্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তার পরে ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ (পরবর্তীকালে যিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন) এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন।[২৬]

সমাজসেবা

সম্পাদনা

ভারত থেকে অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ ও হরিজন আন্দোলনকে পরিচালনার ক্ষেত্রে মদনমোহন মালব্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৩৩ সালে তার সভাপতিত্বে আয়োজিত একটি সম্মেলনে হরিজন সেবক সংঘ স্থাপিত হয়।[১১]

মদনমোহন মালব্য বলেছিলেন, “যদি তুমি মানবাত্মার আন্তরিক পবিত্রতায় বিশ্বাস কর, তবে তুমি বা তোমার ধর্ম কখনই অন্য মানুষের স্পর্শ বা সঙ্গতে অপবিত্র বা কলুষিত হতে পারে না।”[২৭]

অস্পৃশ্যতা দূরীকরণে তিনি একটি হিন্দু পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন। তিনি হিন্দু সমাজে অস্পৃশ্য বলে পরিচিত মানুষদের মন্ত্রদীক্ষা দিতেন। তিনি বলেছিলেন, “মন্ত্র দ্বারা তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি সম্ভব।”[২৭]

তিনি মন্দির ও অন্যান্য সামাজিক ক্ষেত্রে বর্ণের বাধা দূরীকরণে সচেষ্ট হয়েছিলেন। মূলত তারই উদ্যোগে হিন্দু মন্দিরে অস্পৃশ্যরা প্রবেশাধিকার পায়। ১৯৩৬ সালের মার্চ মাসে হিন্দু দলিত (হরিজন) নেতা পি. এন. রাজভোজ ২০০ জন অনুগামী নিয়ে রথযাত্রার দিন কলারাম মন্দিরে প্রবেশাধিকার চান।[২৮] মদনমোহন মালব্য কলারাম মন্দিরের পুরোহিতদের উপস্থিতিদের তাদের দীক্ষা দিয়ে মন্দিরে প্রবেশের ব্যবস্থা করে দেন।[২৮] পরে এঁরা রথযাত্রা উৎসবেও অংশ নেন।[২৮]

১৯০১ সালে মদনমোহন মালব্য এলাহাবাদে হিন্দু হোস্টেল (হিন্দু বোর্ডিং হাউস) নামে একটি ছেলেদের হোস্টেল স্থাপন করেন।[২৯]

স্কাউটিং

সম্পাদনা

১৯০৯ সালে ব্যাঙ্গালোরের বিশপ কটনস বয়েজ স্কুলে ব্রিটিশ সরকার ভারতে প্রথম স্কাউটিং আরম্ভ করলেও, ভারতীয়দের জন্য স্কাউটিং-এর ব্যবস্থা শুরু করেন বিচারপতি ভিভিয়ান বসু, মদনমোহন মালব্য, হৃদয়নাথ কুনজ্রু, গিরিজাশংকর বাজপেয়ী, অ্যানি বেসান্তজর্জ অরুনডেল। মদনমদন মালব্য হয়েছিলেন এর প্রথম চিফ স্কাউট।

১৯১৩ সালে তিনি স্কাউটিং-অনুপ্রাণিত একটি সংগঠন স্থাপন করেন। এর নাম ছিল ‘সারা ভারত সেবা সমিতি’।[৩০]

উত্তরাধিকার

সম্পাদনা
 
কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথে মদনমোহন মালব্যের প্রতিমূর্তি।

১৯১৮ সালে দিল্লিতে আয়োজিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করার সময় মদনমোহন মালব্য মুণ্ডকোপনিষদ্‌ থেকে সত্যমেব জয়তে (অর্থাৎ, সত্যেরই জয় হয়) শব্দটিকে নীতিবাক্য হিসেবে গ্রহণ করেন। এটি স্বাধীন ভারতে জাতীয় নীতিবাক্য হয়।[৩১]

হরিদ্বারের হর কি পৌরিতে গঙ্গা নদীর আরতি মদনমোহন মালব্যই শুরু করেছিলেন। এই অনুষ্ঠান আজও হয়। এই ঘাটের কাছে একটি ছোটো দ্বীপের নামকরণ করা হয়েছে মালব্যদ্বীপ। এই দ্বীপে মদনমোহন মালব্যের একটি আবক্ষ মূর্তি আছে।

১৯৬১ সালে মদনমোহন মালব্যের জনশতবার্ষিকী উপলক্ষে ভারতীয় ডাকবিভাগ তার নামে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে।[৩২] and then in 2011 to celebrate his 150th birth centenary[৩৩]

এলাহাবাদ, লখনউ, দিল্লি, ভোপাল, দুর্গজয়পুরে তার নামে একটি করে অঞ্চলের নাম রাখা হয়েছে ‘মালব্য নগর’। জব্বলপুর শহরের একটি প্রধান চক এলাকার নাম করা হয়েছে ‘মালব্য চক’। জয়পুরে তার নামে স্থাপিত হয়েছে মালব্য ন্যাশানাল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি। উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর শহরে তার নামে স্থাপিত হয়েছে মদনমোহন মালব্য প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়আইআইটি খড়গপুর, আইআইটি রুরকি সাহারানপুর শিক্ষাপ্রাঙ্গনের হোস্টেল এবং বিআইটিএস পিলানি ও হায়দ্রাবাদ শিক্ষাপ্রাঙ্গনের নাম মালব্য ভবন। শ্রীগৌড় বিদ্যামন্দির প্রতিবছর তার জন্মদিনটি মহামনা দিবস রূপে পালন করে।

ভারতীয় সংসদের সেন্ট্রাল হলে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ মদনমোহন মালব্যের একটি পূর্ণাবয়ব প্রতিকৃতি উন্মোচিত করেছিলেন। ১৯৬১ সালে মদনমোহন মালব্যের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশদ্বারের সামনে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ মদনমোহন মালব্যের একটি মূর্তি উন্মোচন করেন।[১৫]

২০০৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর দিল্লিতে মদনমোহন মালব্যের জাতীয় স্মৃতি ভবন ‘মালব্য স্মৃতিভবন’ উদ্বোধন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. এ. পি. জে. আব্দুল কালাম[৩৪]

২০১৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর মদনমোহন মালব্যকে মরণোত্তর ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন দ্বারা ভূষিত করা হয়।[]

  • A criticism of Montagu-Chelmsford proposals of Indian constitutional reform. Printed by C. Y. Chintamani, 1918.
  • Speeches and writings of Pandit Madan Mohan Malaviya. Publisher G.A. Natesan, 1919.

পাদটীকা

সম্পাদনা
  1. "Indian Political Thought" 
  2. "Mahamana's life as exemplary as Mahatma's: BHU V-C"The Times of India। ২৭ ডিসেম্বর ২০০৯। ৪ নভেম্বর ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩১ মার্চ ২০১৫ 
  3. Singh, Binay (১৩ মার্চ ২০০৯)। "BHU set to realise future goals"। VARANASI: The Times of India। ১৪ জুন ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩ জুন ২০১১ 
  4. "History of BHU"। Banaras Hindu University website। ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩১ মার্চ ২০১৫ 
  5. "University at Buffalo, BHU sign exchange programme"Rediff News। ৪ অক্টোবর ২০০৭। 
  6. Our Leaders (Volume 9 of Remembering Our Leaders)Children's Book Trust। ১৯৮৯। পৃষ্ঠা 61। আইএসবিএন 81-7011-842-5 
  7. "C. Y. Chintamani (10 April 1880 – 1 July, 1941)"The Tribune। ৭ মে ২০০০। 
  8. "Press Information Bureau English Releases" 
  9. Bhattacherje, S. B. (মে ১, ২০০৯)। Encyclopaedia of Indian Events & Dates। Sterling Publishers Pvt. Ltd। পৃষ্ঠা 138–139। সংগ্রহের তারিখ মার্চ ২৪, ২০১৪ 
  10. Rao, P. Rajeswar (১৯৯১)। The Great Indian patriots, Volume 1। Mittal Publications। পৃষ্ঠা 10–13। আইএসবিএন 81-7099-280-X 
  11. "MADAN MOHAN MALAVIYA" 
  12. Our Leaders (Volume 9 of Remembering Our Leaders): Madan Mohan MalaviyaChildren's Book Trust। ১৯৮৯। পৃষ্ঠা 53–73। আইএসবিএন 81-7011-842-5 
  13. "MsnSpecials"। ২১ আগস্ট ২০০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩১ মার্চ ২০১৫ 
  14. "RSS Resolution 2: 150th Birth Anniversary of Mhamana Malviya ji"Vishwa Samvada Kendra। ৩১ অক্টোবর ২০১০। ২৬ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩১ মার্চ ২০১৫ 
  15. "Old Secetariat:Important Members of Imperial Legislative Council"Legislative Assembly of Delhi website। ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩১ মার্চ ২০১৫ 
  16. "Gandhi is Urged to Delay Break"New York Times। ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯২২। 
  17. ""Buy Indian" Move Gains"The New York Times। ৩০ মে ১৯৩২। 
  18. "450 Seized at Delhi for Defiance of Ban on Indian Congress"New York Times। ২৫ এপ্রিল ১৯৩২। 
  19. Sharma, Brij Kishore (2007). Introduction to the Constitution of India. PHI Learning Pvt. Ltd. Source: [১] (accessed: Sat Dec 27, 2014)
  20. "-- Schwartzberg Atlas -- Digital South Asia Library" 
  21. "Pandit Madan Mohan Malaviya - Biography"। ২৭ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ এপ্রিল ২০১৫ 
  22. "20 Things We Must Know About Madan Mohan Malaviya"TopYaps। ১৮ মার্চ ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ এপ্রিল ২০১৫ 
  23. TJS George, Lessons in Journalism, 2007, Viva Books, New Delhi.
  24. "BHU Fiunder page" 
  25. "BANARAS HINDU UNIVERSITY" (PDF)Indian Academy of Sciences। ২৬ জুলাই ২০০৫। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৪-১৯ 
  26. Murty, K. Satchidananda; Ashok Vohra (১৯৯০)। Radhakrishnan: his life and ideas। SUNY Press। পৃষ্ঠা 90। আইএসবিএন 0-7914-0343-2 
  27. dimitrios vassiliadis। "CONTRIBUTIONS OF MAHAMANA PT. MADAN MOHAN MALAVIYA TO INDIAN RELIGION AND SOCIETY"। ২৪ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ এপ্রিল ২০১৫ 
  28. Political Mobilization and Identity in Western India, 1934–47 By Shri Krishan
  29. "http://www.bhu.ac.in/mahamana.php"
  30. "Honouring the oath: The beginning"The Hindu। ১৭ আগস্ট ২০০৭। ১৯ আগস্ট ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ এপ্রিল ২০১৫ 
  31. "India's Freedom Struggle: Madan Mohan Malaviya" (PDF)। Kamat's Potpourri। ২২ ডিসেম্বর ২০০৭। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৩-০৯ 
  32. "MADAN MOHAN MALAVIYA" 
  33. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ এপ্রিল ২০১৫ 
  34. "Former President Kalam inaugurates BHU founder's memorial"The Indian Express। ২৬ ডিসেম্বর ২০০৮। 

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা