ভিক্ষুকোপনিষদ্‌

একটি অপ্রধান উপনিষদ্‌

ভিক্ষুকোপনিষদ্‌ (সংস্কৃত: भिक्षुक उपनिषत्) হল সংস্কৃত ভাষায় রচিত একটি অপ্রধান উপনিষদ্‌। এটি হিন্দুধর্মের একটি ধর্মগ্রন্থ

ভিক্ষুকোপনিষদ্‌
যে সকল হিন্দু ভিক্ষুক যোগ সহায়ে আধ্যাত্মিক মুক্তির অনুসন্ধান করেন, তাঁদের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে ভিক্ষুকোপনিষদ্‌ গ্রন্থে।
দেবনাগরীभिक्षुक
IASTBhikṣuka
নামের অর্থতপস্বী বা ভিক্ষোপজীবী
উপনিষদের
ধরন
সন্ন্যাস
সম্পর্কিত বেদশুক্ল যজুর্বেদ
অধ্যায়ের সংখ্যা
শ্লোকসংখ্যা
মূল দর্শনবেদান্ত

ভিক্ষুকোপনিষদ্‌ গ্রন্থে চার ধরনের হিন্দু সন্ন্যাসী এবং তাঁর খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রা প্রণালীর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। চারটি শাখারই আধ্যাত্মিক মুক্তির পন্থাটি হল যোগ। এঁদের মধ্যে ‘পরমহংস’ শাখার সন্ন্যাসীদের কথাই এই গ্রন্থে অধিকতর পরিসরে আলোচিত হয়েছে। বলা হয়েছে যে, তাঁরা একাকী বাস করেন, সকলের সঙ্গে মিষ্ট ব্যবহার করেন, তাঁদের চিন্তায় দ্বৈতবোধ নেই এবং তাঁরা তাঁদের আত্মাব্রহ্মের ধ্যানে মগ্ন থাকেন।

নামকরণ সম্পাদনা

‘ভিক্ষুক’ শব্দের অর্থ ‘ভিক্ষোপজীবী’ বা ‘সন্ন্যাসী’। এই শব্দটি ‘ভিক্ষু’ শব্দ থেকে এসেছে। ‘ভিক্ষু’ শব্দের অর্থ ‘যিনি সম্পূর্ণ ভিক্ষার দ্বারা জীবন নির্বাহ করেন।’[১]

ইতিহাস সম্পাদনা

ভিক্ষুকোপনিষদ্‌ গ্রন্থের রচয়িতার নাম জানা যায় না। এই গ্রন্থের রচনার তারিখও অজ্ঞাত। সম্ভবত মধ্যযুগের শেষ ভাগ বা আধুনিক যুগের প্রথম ভাগে (খ্রিস্টীয় ১৪শ বা ১৫শ শতাব্দী) এই গ্রন্থ রচিত হয়েছিল।[২] এই গ্রন্থের উৎস প্রাচীন। কারণ, এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু আশ্রমোপনিষদ্‌ গ্রন্থের ৪র্থ অধ্যায়ের মূল বিবরণির অনুরূপ।[৩] উল্লেখ্য, আশ্রমোপনিষদ্‌ গ্রন্থটি আনুমানিক খ্রিস্টীয় ৩য় শতাব্দীতে রচিত।[২][৪][৫] উভয় গ্রন্থেই চার প্রকার তপস্বী ও তাঁদের জীবনযাত্রার প্রণালী বর্ণিত হয়েছে।[৩] দুই গ্রন্থের মধ্যে কয়েকটি নগন্য পার্থক্য রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, প্রাচীনতর আশ্রমোপনিষদ্‌ গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, প্রত্যেক শাখা সন্ন্যাসীরা মুক্তির জন্য আত্মজ্ঞান লাভ করতে চান।[৬] অন্যদিকে ভিক্ষুকোপনিষদ্‌ গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, তাঁরা যোগের পথ অনুসরণ করে মুক্তিলাভ করতে চান।[৭]

ভিক্ষুকোপনিষদ্‌ গ্রন্থটি একটি অপ্রধান উপনিষদ্‌। এটি শুক্ল যজুর্বেদের সঙ্গে যুক্ত।[৮] এটি হিন্দুধর্মের ‘সন্ন্যাস উপনিষদ্‌’ বর্গের অন্তর্ভুক্ত।[৮][৭] আধুনিক যুগের সংকলন মুক্তিকোপনিষদ্‌ গ্রন্থে রামহনুমানের কথোপকথনের আকারে যে ১০৮টি উপনিষদের তালিকা দেওয়া রয়েছে, তাতে ভিক্ষুকোপনিষদ্‌ গ্রন্থের ধারাবাহিক সংখ্যাটি হল ৬০।[৩] ভিক্ষুকোপনিষদ্‌ শিরোনামে কয়েকটি পাণ্ডুলিপি এখনও পাওয়া যায়।[৯]

বিষয়বস্তু সম্পাদনা

ভিক্ষুকোপনিষদ্‌ গ্রন্থটি একটি মাত্র অধ্যায়ে পাঁচটি শ্লোকে বিন্যস্ত। প্রথম শ্লোকে বলা হয়েছে যে, চার প্রকার ভিক্ষুক মুক্তিকামী। এঁরা হলেন ‘কুটিচক’, ‘বহূদক’, ‘হংস’ ও ‘পরমহংস’।[১০] এই গ্রন্থে চার প্রকার সন্ন্যাসীর মিতব্যয়ী জীবনযাত্রা প্রণালীর কথা বর্ণিত হয়েছে। সেই সঙ্গে বলা হয়েছে, তাঁরা প্রত্যেকেই যোগের পথে মোক্ষ অর্জনকেই জীবনের লক্ষ্য মনে করেন।[৭] প্রথম তিন প্রকার ভিক্ষুকের বর্ণনা সংক্ষেপে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে চতুর্থ প্রকার ভিক্ষুক বা ‘পরমহংস’ শ্রেণির সন্ন্যাসীদের কথাই এই গ্রন্থে সর্বাধিক পরিসরে আলোচিত হয়েছে।[১১]

কুটিচক, বহূদক ও হংস সন্ন্যাসী সম্পাদনা

ভিক্ষুকোপনিষদ্‌ অনুসারে, কুটিচক সন্ন্যাসীরা দিনে আট গ্রাস খাদ্য গ্রহণ করেন।[১০] যে সকল বিশিষ্ট প্রাচীন ঋষি কুটিচক শ্রেণিভুক্ত, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গৌতম, ভরদ্বাজ, যাজ্ঞবল্ক্যবশিষ্ঠ[১০][১২]

বহূদক সন্ন্যাসীরা একটি কমণ্ডলু ও ‘ত্রিদণ্ড’ নামক লাঠি বহন করেন।[১০] তাঁরা মাথায় জটা রাখেন এবং গৈরিক বস্ত্র পরিধান করেন। তাঁরা যজ্ঞোপবীতও পরিধান করেন।[১০] বহূদক সন্ন্যাসীরা মাংস বা মধু খান না। তাঁরা দিনে আট গ্রাস খাদ্যের জন্য ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করেন।[১০][১২]

হংস সন্ন্যাসীরা হলেন পরিব্রাজক। তাঁরা কোনো গ্রামে এক রাত্রি বা কোনো শহরে পাঁচ রাত্রির বেশি অবস্থান করেন না। তীর্থস্থানে তাঁরা সাত রাত্রির বেশি অবস্থান করেন না।[১০] প্রতিদিন গোমূত্র পান এবং গোময় ভক্ষণ হল হংস সন্ন্যাসীদের কঠোর তপশ্চর্যার অংশ।[১২] তাঁদের খাদ্যের পরিমাণ চন্দ্রকলার হ্রাসবৃদ্ধি অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন হয়। একে বলা হয় ‘চান্দ্রায়ণ’ ব্রত।[১০][১৩] অমাবস্যার পরদিন তাঁরা এক গ্রাস মাত্র খাদ্য গ্রহণ করেন। এরপর চন্দ্রকলার বৃদ্ধি অনুসারে তাঁরাও এক এক গ্রাস করে অধিক পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ করতে থাকেন। এই ভাবে পূর্ণিমার পরদিন তাঁরা পনেরো গ্রাস খাদ্য গ্রহণ করেন।[১৩] এরপর থেকে তাঁরা এক এক গ্রাস করে অল্প পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ করতে থাকেন। এই ভাবে পরবর্তী অমাবস্যার পরদিন তাঁরা এক গ্রাস মাত্র খাদ্য গ্রহণ করেন।[১৩]

পরমহংস সন্ন্যাসী সম্পাদনা

ভিক্ষুকোপনিষদ্‌ গ্রন্থে কয়েকটি নাম সহ পরমহংস (আক্ষরিক অর্থে, ‘শ্রেষ্ঠ পরিযায়ী পাখি’) [১৪] সন্ন্যাসীদের বিবরণ দেওয়া হয়েছে।[১৫] এই তালিকায় সম্বর্তক, আরুণি, শ্বেতকেতু, জড়ভরত, দত্তাত্রেয়, শুক, বামদেব ও হরিতকের নাম পাওয়া যায়।[১১][১৬] তাঁরা দিনে আট গ্রাস খাদ্য গ্রহণ করেন এবং নির্জনে বাস করেন।[১১] তাঁরা বস্ত্র পরিধান করেন অথবা নগ্ন অবস্থায় থাকেন অথবা ছিন্ন বস্ত্রখণ্ড পরিধান করেন।[১৪]

এই উপনিষদের অবশিষ্ট শ্লোকগুলিতে পরমহংস শ্রেণির সন্ন্যাসীদের ধর্মমতের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ:

न तेषां धर्माधर्मौ लाभालाभौ
शुद्धाशुद्धौ द्वैतवर्जिता समलोष्टाश्मकाञ्चनाः
सर्ववर्णेषु भैक्षाचरणं कृत्वा सर्वत्रात्मैवेति पश्यन्ति
अथ जातरूपधरा निर्द्वन्द्वा निष्परिग्रहाः
शुक्लध्यानपरायणा आत्मनिष्टाः प्राणसन्धारणार्थे
[১১]

তাঁদের কাছে ধর্ম বা অধর্ম, লাভ বা ক্ষতি, পবিত্রতা বা অপবিত্রতার দ্বৈতবোধ নেই।
তাঁরা এসবে সমদৃষ্টি পাত করেন। তাঁদের কাছে স্বর্ণ ও মৃত্তিকা সমতুল্য। তাঁরা সবই মানিয়ে চলেন, সকলের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখেন, খাদ্যের সন্ধানে ফেরেন এবং যার থেকে পান তার থেকেই খাদ্য সংগ্রহ করেন।
তাঁরা বর্ণ ও চেহারার ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে পার্থক্য করেন না। তাঁরা নির্লোভ ও অপরিগ্রহী
তাঁরা সকল প্রকার দ্বৈতবোধ থেকে মুক্ত, ধ্যানে নিরত ও আত্মনিষ্ঠ

— ভিক্ষুকোপনিষদ্‌[৭][১৩][১৭]

পরমহংস সন্ন্যাসীরা নির্জনে কোনো পরিত্যক্ত বাড়িতে, মন্দিরে, খড়ের চালবিশিষ্ট কুঁড়েঘরে, বল্মীকের ঢিপিতে, গাছের কোটরে বা মুক্ত প্রাঙ্গনে বাস করেন।[৭] এই উপনিষদের মতে, এই নির্জনবাসী সন্ন্যাসীরা ব্রহ্মের পথে অনেক দূর অগ্রসর হন। তাঁরা শুদ্ধচিত্ত ও ‘পরমহংস’।[১১][১৬][১৫]

প্রভাব সম্পাদনা

ভিক্ষুকোপনিষদ্‌ গ্রন্থে সন্ন্যাসীদের শ্রেণিবিন্যাস, তাঁদের মিতাহার অভ্যাস ও সরল জীবনযাত্রা প্রণালীর কথা মহাভারত গ্রন্থেও (১। ৭। ৮৬-৮৭ ও ১৩। ১২৯) পাওয়া যায়।[১৮][১৯]

প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির নৃতত্ত্ব বিভাগের এমিরিটাস অধ্যাপক বলেছেন যে, ভিক্ষুকোপনিষদ্‌ গ্রন্থে স্বীকৃত ধারণাগুলি জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ ইত্যাদি বৈদিক সাহিত্য থেকে গৃহীত।[২০] নারদপরিব্রাজকোপনিষদ্‌বৃহৎসন্ন্যাসোপনিষদ্‌ প্রভৃতি অন্যান্য উপনিষদেও এই ধারণাগুলি বিবৃত হয়েছে।[৫][২০] এই সকল ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে, সন্ন্যাসী তিনিই যিনি আধ্যাত্মিকতার অনুসন্ধানে রত হয়ে “সামাজিক জগৎ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করবেন এবং সামাজিক প্রথা ও রীতিনীতির প্রতি ঔদাসিন্য বজায় রাখবেন।”[২০]

যেখানে ‘ঠিক ও ভুল’, সমাজে জনপ্রিয় ‘সত্য ও অসত্য’, দৈনন্দিরন নৈতিকতা এবং জগতে যা কিছু ঘটছে তার প্রতি ঔদাসিন্য সন্ন্যাসীর ধর্ম। তিনি “সত্য ও অসত্যকে” বর্জন করার পর “যা দ্বারা এগুলিত বর্জিত হয়েছে তাকেও বর্জন করবেন।” সন্ন্যাসী সম্পূর্ণ আত্মায় নিমগ্ন থাকবেন এবং আত্মাকেও ব্রহ্ম বলে জানবেন।[২০][২১]

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Monier Monier Williams (2011 Reprint), Sanskrit-English Dictionary, Oxford University Press, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-২০৮-৩১০৫-৬, p. 756, see bhikSu Archive
  2. Olivelle 1992, পৃ. 8–10।
  3. Deussen, Bedekar এবং Palsule 1997, পৃ. 557 footnote 6, 763।
  4. Joachim Friedrich Sprockhoff (1976), "Saṃnyāsa: Quellenstudien zur Askese im Hinduismus", Volume 42, Issue 1, Deutsche Morgenländische, আইএসবিএন ৯৭৮-৩-৫১৫-০১৯০৫-৭, pp. 117–132 (in German)
  5. Olivelle 1992, পৃ. 98–100।
  6. Deussen, Bedekar এবং Palsule 1997, পৃ. 765-766।
  7. Olivelle 1992, পৃ. 236–237।
  8. Tinoco 1997, পৃ. 89।
  9. Vedic Literature, Volume 1, গুগল বইয়ে A Descriptive Catalogue of the Sanskrit Manuscripts, পৃ. PA492,, Government of Tamil Nadu, Madras, India, page 492
  10. Olivelle 1992, পৃ. 236।
  11. ॥ भिक्षुकोपनिषत् ॥ Sanskrit text of Bhiksuka Upanishad, SanskritDocuments Archives (2009)
  12. Parmeshwaranand 2000, পৃ. 67।
  13. KN Aiyar, Thirty Minor Upanishads, University of Toronto Archives, ওসিএলসি ২৪৮৭২৩২৪২, p. 132 footnote 3
  14. Deussen, Bedekar এবং Palsule 1997, পৃ. 766।
  15. Olivelle 1992, পৃ. 237।
  16. KN Aiyar, Thirty Minor Upanishads, University of Toronto Archives, ওসিএলসি ২৪৮৭২৩২৪২, pp. 132–133
  17. Deussen, Bedekar এবং Palsule 1997, পৃ. 763, 766।
  18. J. A. B. van Buitenen (1980), The Mahabharata, Volume 1, Book 1, University of Chicago Press, আইএসবিএন ৯৭৮-০-২২৬-৮৪৬৬৩-৭, pp. 195, 204–207
  19. Deussen, Bedekar এবং Palsule 1997, পৃ. 763,
    Sanskrit: चतुर्विधा भिक्षवस ते कुटी चर कृतॊदकः
    हंसः परमहंसश च यॊ यः पश्चात स उत्तमः – Anushasana Parva 13.129.29, Mahabharata।
  20. Gananath Obeyesekere (2005), Karma and Rebirth: A Cross Cultural Study, Motilal Banarsidass, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-২০৮-২৬০৯-০, pp. 99–102
  21. Oliver Freiberger (2009), Der Askesediskurs in der Religionsgeschichte, Otto Harrassowitz Verlag, আইএসবিএন ৯৭৮-৩-৪৪৭-০৫৮৬৯-৮, p. 124 with footnote 136, 101–104 with footnote 6 (in German)

গ্রন্থপঞ্জি সম্পাদনা