বিরাজ

হিন্দুধর্ম মতে পৌরাণিক আদিম সত্তা

বিরাজ (সংস্কৃত: विराज) হল সংস্কৃত শব্দ, যা শ্রেষ্ঠত্ব, সার্বভৌমত্ব, বা জাঁকজমক নির্দেশ করে। বিরাজ হল সৃষ্টির সাথে যুক্ত পৌরাণিক আদিম সত্তা যাকে প্রায়শই গৌণ স্রষ্টা হিসেবে মূর্ত করা হয়।[১]

ইতিহাস সম্পাদনা

পুরুষ থেকে বিরাজের জন্ম হয় এবং পুরুষের জন্ম হয় বিরাজ থেকে। অথর্ববেদে, বিরাজ হল গাভী বা প্রাণের সাথে, জীবন-শ্বাস। মহাভারতে বিরাজ হল আদিম সত্তা, পুরুষের নাম, যাকে বিষ্ণুশিব দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে। মনুস্মৃতি ১.৩২ বলে যে ব্রহ্মা তার দেহকে দুই ভাগে ভাগ করেছিলেন, একটি পুরুষ এবং অন্যটি নারী, নারী থেকে বিরাজের জন্ম হয়েছিল যিনি স্বয়ম্ভুব মনু তৈরি করেছিলেন যিনি দশজন প্রজাপতি সৃষ্টি করেছিলেন। ভবিষ্য পুরাণ অনুসারে – পুরুষ ছিলেন মনু এবং নারী ছিলেন শতরূপা, সৃষ্টির সূচনা হয়েছিল বিরাজ ও শতরূপার মিলনের মাধ্যমে। বেদান্তে, বিরাজকে সর্বোচ্চ বুদ্ধি দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিরাজ একটি ছন্দের নামও।[২]

বেদে বিরাজকে ইন্দ্র, অগ্নি, প্রজাপতি ও পরমেষ্টিন দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে;[৩] এছাড়া দেবতাবিষ্ণুসবিত্ররুদ্র, ব্রহ্মচারীজল ও জগত,[৪] ইন্দ্রের  নিয়ন্ত্রণ কর্তা,[৫] অমর ব্যাপক বিস্তার ক্ষমতাসীন ক্ষমতা,[৬] প্রথম ও সৃজনশীল নীতি,[৭] মহাবিশ্ব,[৮] ব্রহ্মের পিতা,[৯] বাকশক্তি, পৃথিবী, বায়ুমণ্ডল, মৃত্যু,[১০] ব্রহ্মের মুখ,[১১] এবং ধ্রুব[১২] হিসাবেও উল্লেখ করা হয়েছে।[১৩] দেবতারা অগ্নি থেকে বিরাজম (দীপ্তি) প্রাপ্ত করেছিলেন পবিত্রতার মাধ্যমে, বিরাজ হল বারো মাসের সমন্বয়ে গঠিত বছর, স্তূপাকার করা অগ্নি হল বছর, স্তূপ করা ইট হল দিন ও রাত, এবং বিরাজ ছয়টি ঋতু নিয়ে গঠিত এবং এর ত্রিশটি শব্দাংশ রয়েছে।[১৪][১৫] ব্রাহ্মণে, শ্রী ও বিরাজকে খাদ্য দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে[১৬], এবং এটিকে পৃথিবীর সাথে সনাক্ত করা হয়[১৭][১৮][১৯]

তৈত্তিরীয়োপনিষদ-ভাষ্যবর্তিকম্ এর ১৫৮-১৬১ শ্লোকে বিরজের পদ্ধতিগতভাবে বর্ণনা রয়েছে। বৃহদারণ্যক উপনিষদে[২০] "বাম চোখে মানুষের রূপ" এবং ছান্দোগ্য উপনিষদে[২১] "বাক' এবং "খাদ্য ও খাদ্য ভক্ষক হিসাবে" একে উল্লেখ করেছে। শিবপুরাণে[২২] এটিকে দেবতা, প্রথম জন্মের অগ্নি, প্রথম মূর্ত সত্তা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিরাজের উৎপত্তি হয়েছে সূত্রম্ থেকে, যাকে বেদান্তসারে সুত্রাত্মানও বলা হয়, মূলত স্ত্রীলিঙ্গ থেকে, এর পুংলিঙ্গ লিঙ্গটি ব্রহ্ম পুরাণ ১.৫৩-এও পাওয়া যায়, এর উদ্ভব ভ্রান্তির কারণে। বিরাজকে বলা হয় অন্ন, অন্নের সার, পিণ্ডের অনুরূপ, অন্ন এবং অন্ন ভক্ষক, খাদ্য হিসাবে জীবের মধ্যে জ্যেষ্ঠ, সমস্ত দ্রব্যকে তাদের বস্তুগত কারণ হিসাবে পরিব্যাপ্ত করা, প্রজাপতি। বিরাজকে তার নিজের স্বভাবের কারণে মুক্তি দেওয়া হয়, বিরাজ, পুরুষ বা মনু থেকে ব্রাহ্মণের উৎপত্তি। বেদান্তসারে এটি  বৈশ্বানর এবং একদিকে স্থূলশরীরঅন্নময়কোষ  এবং জাগ্রাদ দ্বারা চিহ্নিত চৈতন্যম্ এবং অন্যদিকে  হিরণ্যগর্ভ বা প্রাণ, জ্ঞানময়কোষমনোময়কোষ  এবং প্রাণময়কোষ বা স্বপ্নের সমন্বয়ে সূক্ষ্মশরীরের দ্বারা নির্ধারিত বুদ্ধিমত্তা; এই ধারণাগুলিকে পদ্ধতিগত করার জন্য এটি এইভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সূত্রম্ হল তিনটি আবরণ যেমন, শ্বাস, মনস ও উপলব্ধি; খাদ্য হল এর আবরণ এবং আনন্দ হল কারণের আবরণ যা হিরণ্যগর্ভ, সর্বোচ্চ মহাজাগতিক আত্মা এবং বিরাজের উৎপত্তি।[২৩] ঐতরেয় উপনিষদে বিরাজ হল আত্মা ও জগতের মধ্যস্থতাকারী, আদিম আত্মার দ্বারা জগৎ সৃষ্টি হয়েছিল মধ্যস্থতাকারী বিরাজের মাধ্যমে। এটি মহাজাগতিক স্ব-এর জাগ্রত অবস্থা; মহাজাগতিক স্বয়ং যখন এটি তার চারটি রাজ্য বৈশ্বানর, তৈজস, প্রজ্য ও আত্মনের মধ্য দিয়ে যায়, তার যথাক্রমে বিরাজ, হিরণ্যগর্ভ, ঈস ও ব্রহ্ম নাম হয়।[২৪]

ভগবদ্গীতার বিরাজ বা বিরাট হল সেই মহাজাগতিক দেহ যার মধ্যে জীব ও জড় উভয় প্রাণীর সমন্বয়ে সমগ্র সৃষ্টিকে কেন্দ্রীভূত করা হয় এবং অন্য যা কিছু দেখতে চান এবং যাকে অর্জুন তার সমস্ত বহুবিধ বিভাজন সহ দেখেছিলেন।[২৫] আদি শঙ্কর বৃহদারণ্যক উপনিষদ ১.২.৩ তে তাঁর ভাস্যে ব্যাখ্যা করেছেন, যে বিরাজ জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তিনি নিজেই নিজেকে, তার দেহ ও অঙ্গগুলিকে তিনটি উপায়ে আলাদা করেছেন বা বিভক্ত করেছেন..তাই এই প্রাণ (বিরাজ), যদিও স্বয়ং, যেমনটি ছিল, সমস্ত প্রাণীর, বিশেষভাবে নিজেকে মৃত্যু হিসাবে অগ্নি, বায়ু ও সূর্য এই তিনটি উপায়ে বিভক্ত করা হয়েছে, তবে তার নিজের বিরাজের রূপকে ধ্বংস না করে।[২৬]

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Rig Veda X.90.5
  2. Rashan Dalal (২০১০)। Hinduism:An Alphabetical Guide। Penguin Books। পৃষ্ঠা 457। আইএসবিএন 9780143414216 
  3. Atharva Veda, 4.11.7
  4. Atharva Veda, 8.5.10
  5. Atharva Veda, 11.5.16
  6. Atharva Veda, 7.84.1
  7. Atharva Veda, 8.9.7
  8. Atharva Veda, 8.10.11
  9. Atharva Veda, 8.9.7
  10. Atharva Veda, 9.10.24
  11. Atharva Veda, 10.7.19
  12. Atharva Veda, 12.3.11
  13. J.Gonda (১৯৬৬)। ancient Indian kingship from the religious point of view। Brill Archive। পৃষ্ঠা 115–119। 
  14. Yajur Veda v.6.7
  15. The Yajur Veda Taittiriya Sanhita। Kessinger Publishing। জুন ২০০৪। পৃষ্ঠা 405। আইএসবিএন 9781419188961 
  16. Shatapatha Brahmana 11.4.3.18
  17. Shatapatha Brahmana 12.6.1.40
  18. Mahabharata 12.262.41
  19. Jan Gonda (১৯৬৯)। Aspects of Early Vishnuism। Motilal Banarsidass। পৃষ্ঠা 187। আইএসবিএন 9788120810877 
  20. Brihadaranyaka Upanishad IV.ii.3
  21. Chandogya Upanishad I.xiii.2 and IV.iii.8
  22. Shiva Purana V.i.8.22
  23. Taittiriyopanishad-bhasyavartikam। Brill Archive। ১৯৭১। পৃষ্ঠা 81। 
  24. Ramachandra Dattatrya Ranade (১৯২৬)। The constructive survey of Upanishadic philosophy। Mumbai: Bharatiya Vidya Bhavan। পৃষ্ঠা 18,101। 
  25. Bhagavad Gita XI.7 and XI.13
  26. The Brhadaranyaka Upanishad (Commentary by Sankaracarya)। Advaita Ashrama। পৃষ্ঠা 20।