বন্দে মাতরম্
বন্দে মাতরম্ ("বন্দনা করি মায়"[১][২]) বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক ১৮৮২ সালে রচিত আনন্দমঠ উপন্যাসের অন্তর্ভুক্ত একটি গান। সংস্কৃত-বাংলা মিশ্রভাষায় লিখিত[৩] এই গানটি বন্দনাগীতি এবং বাংলা মা তথা বঙ্গদেশের একটি জাতীয় মূর্তিকল্প। শ্রীঅরবিন্দ বন্দে মাতরম্ গানটিকে "বঙ্গদেশের জাতীয় সংগীত" বলে উল্লেখ করেন।[৪] ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই গানটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।
ভারত-এর জাতীয় স্তোত্র | |
কথা | বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, আনন্দমঠ (১৮৮২) |
---|---|
সঙ্গীত | হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, যদুনাথ ভট্টাচার্য |
গ্রহণকাল | ২৪ জানুয়ারি ১৯৫০ |
১৮৯৬ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গাওয়া হয় বন্দে মাতরম গানটি। উক্ত অধিবেশনে গানটি পরিবেশন করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।[৫] ১৯৫০ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারতের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা লাভ করলে বন্দে মাতরম্ গানটিকে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় স্তোত্রের মর্যাদা দেওয়া হয়।[৫] তবে একাধিক ভারতীয় মুসলিম সংগঠন বন্দে মাতরম্ গাওয়ার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেছেন। তাদের মতে, ভারতমাতার বন্দনাগীতি এই গানটির মূলভাবনা ইসলাম-নিষিদ্ধ পৌত্তলিকতার অনুসরণ করে। [৬]
১৯০৯ সালে শ্রীঅরবিন্দ Mother, I bow to thee! শিরোনামে বন্দে মাতরম্ গানটির ইংরেজি অনুবাদ করেন। ইংরেজি ভাষায় এই অনুবাদটি বহুল প্রচলিত।[৭] একাধিকবার এই গানটিতে সুরারোপ করা হয়। বন্দে মাতরম্ সঙ্গীতের প্রাচীনতম প্রাপ্ত অডিও রেকর্ডিংটি ১৯০৭ সালের। সমগ্র বিংশ শতাব্দীতে গানটি প্রায় একশোটি ভিন্ন সুরে রেকর্ড করা হয়েছিল। ২০০২ সালে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দশটি জনপ্রিয় গান নির্বাচনের একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষা চালায়। এই সমীক্ষায় ৭০০০ গানের মধ্যে থেকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সুরারোপিত বন্দে মাতরম্ গানটি বিশ্বের দ্বিতীয় জনপ্রিয়তম গান নির্বাচিত হয়।[৮]
পাঠ
সম্পাদনাজাতীয় স্তোত্ররূপে গৃহীত অংশ: | সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কর্তৃক বঙ্গানুবাদ[৯]: |
---|---|
বন্দে মাতরম্ |
বন্দনা করি মায়! |
ভারতের সঙ্গীত | |
---|---|
ধারা | |
| |
গণমাধ্যম ও অনুষ্ঠান | |
সঙ্গীত পুরস্কার | |
সঙ্গীত উৎসব | |
সঙ্গীত মাধ্যম | |
জাতীয়তাবাদী ও দেশাত্মবোধক গান | |
জাতীয় সঙ্গীত | জনগণমন |
অন্যান্য | বন্দে মাতরম্ |
অঞ্চলিক সঙ্গীত | |
| |
মূল পাঠ
সম্পাদনাবন্দে মাতরম্
সুজলাং সুফলাং
মলয়জশীতলাং
শস্যশ্যামলাং
মাতরম্৷৷
শুভ্র-জ্যোৎস্না-পুলকিত-যামিনীম্
ফুল্লকুসুমিত-দ্রুমদলশোভিনীম্
সুহাসিনীং সুমধুরভাষিণীম্
সুখদাং বরদাং মাতরম্৷৷
সপ্তকোটিকণ্ঠকলকলনিনাদকরালে,
দ্বিসপ্তকোটীভুজৈর্ধৃতখর-করবালে,
অবলা কেন মা এত বলে৷৷
বহুবলধারিণীং
নমামি তারিণীং
রিপুদলবারিণীং
মাতরম্৷৷
তুমি বিদ্যা তুমি ধর্ম্ম
তুমি হৃদি তুমি মর্ম্ম
ত্বং হি প্রাণাঃ শরীরে৷৷
বাহুতে তুমি মা শক্তি
হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি
তোমারই প্রতিমা গড়ি
মন্দিরে মন্দিরে॥
ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী
কমলা কমল-দলবিহারিণী
বাণী বিদ্যাদায়িনী
নমামি ত্বাং
নমামি কমলাম্
অমলাং অতুলাম্
সুজলাং সুফলাম্
মাতরম্॥
বন্দে মাতরম্
শ্যামলাং সরলাম্
সুস্মিতাং ভূষিতাম্
ধরণীং ভরণীম্
মাতরম্॥
ইতিহাস ও গুরুত্ব
সম্পাদনারচনা
সম্পাদনাসাধারণভাবে অনুমান করা হয়, ১৮৭৬ সাল নাগাদ ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চাকুরিরত অবস্থাতেই বন্দে মাতরম্ রচনার কথা ভেবেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। গানটি ১৮৭৫ সালে (মতান্তরে ১৮৭৬ সালে) ২০ ডিসেম্বর রচিত হয়েছিল।[১১] ১৮৮২ সালে বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ উপন্যাসে প্রথম গানটি প্রকাশিত হয়।[৩] রচনার অব্যবহিত পরে লেখক যদুভট্টকে গানটিতে সুরারোপ করার জন্য অনুরোধ করেন।[৩]
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন
সম্পাদনা"বন্দেমাতরম" ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের জাতীয় ধ্বনিতে পরিণত হয়। প্রথমে কলকাতা মহানগরীতে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক সমাবেশে "বন্দেমাতরম" ধ্বনি দেওয়া শুরু হয়। এই ধ্বনির তীব্র প্রতিক্রিয়ায় ভীত হয়ে একবার ব্রিটিশ সরকার জনসমক্ষে এই ধ্বনি উচ্চারণ নিষিদ্ধ করে দেয়; এই সময় বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী "বন্দেমাতরম" ধ্বনি দেওয়ার অপরাধে গ্রেফতার হয়েছিলেন। ১৮৯৬ সালে বিডন স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে গানটি পরিবেশন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পাঁচ বছর বাদে ১৯০১ সালের কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে গানটি পরিবেশন করেন দক্ষিণাচরণ সেন। ১৯০৫ সালে কংগ্রেসের বারাণসী অধিবেশনে গানটি পরিবেশন করেছিলেন সরলা দেবী চৌধুরাণী। লালা লাজপত রায় লাহোর থেকে বন্দে মাতরম নামক একটি সাময়িকপত্র প্রকাশ করতেন।[৩] ১৯০৫ সালে হীরালাল সেন ভারতের প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছিলেন; এই চলচ্চিত্রের সমাপ্তি হয়েছিল গানটির মাধ্যমে। ব্রিটিশ পুলিশের হাতে নিহত হওয়ার আগে মাতঙ্গিনী হাজরার শেষ উচ্চারিত শব্দ ছিল "বন্দেমাতরম"।[১২]
১৯০৭ সালে মাদাম কামা (১৮৬১–১৯৩৬) ভারতের প্রথম জাতীয় পতাকার যে রূপদান করেছিলেন, তার মাঝের ব্যান্ডে দেবনাগরী হরফে "বন্দে মাতরম্ " ধ্বনিটি খোদিত ছিল।[১৩]
পাদটীকা
সম্পাদনা- ↑ সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কর্তৃক সংস্কৃতাংশের বঙ্গানুবাদ, জাতীয় সংগীত (ভারতবর্ষ), তীর্থ-সলিল, সত্যেন্দ্র কাব্যগুচ্ছ, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, পৃ. ১৬১
- ↑ Sanskrit vandate (1st class, atmanepadam) "to praise, celebrate, laud, extol; to show honour, do homage, salute respectfully or deferentially, venerate, worship , adore" (Monier Williams)
- ↑ ক খ গ ঘ Suresh Chandvankar, Vande Mataram (2003) at Musical Traditions (mustrad.org.uk)
- ↑ Sri Aurobindo commented on his English translation of the poem with "It is difficult to translate the National Anthem of Bengal into verse in another language owing to its unique union of sweetness, simple directness and high poetic force." cited after Bhabatosh Chatterjee (ed.), Bankim Chandra Chatterjee: Essays in Perspective, Sahitya Akademi, Delhi, 1994, p. 601.
- ↑ ক খ "National Symbols of India"। Government of India। ২০০৮-০৩-২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৪-২৯।
- ↑ "Fatwa against Vande Mataram"
- ↑ Sri Aurobindo, Bande Mataram and a lecture on the hidden meaning of that song (1908, 1909).
- ↑ The Worlds Top Ten — BBC World Service
- ↑ তীর্থ-সলিল কাব্যগ্রন্থে সত্যেন্দ্রনাথ প্রথম কয়েকটি পংক্তির অনুবাদ করেন। দ্রঃ সত্যেন্দ্র কাব্যগুচ্ছ, ড. অলোক রায় সম্পাদিত, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, পৃ. ১৬১
- ↑ বঙ্কিম রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, পৃ. ৬৬৩-৬৪-এর পাঠানুসারে
- ↑ "প্রাত্যহিকী অনুষ্ঠান,গীতাঞ্জলি প্রচার তরঙ্গ, আকাশবাণী কলকাতা"। ২০২৩-১২-২০।
- ↑ Chakrabarty, Bidyut (১৯৯৭)। Local Politics and Indian Nationalism: Midnapur (1919-1944)। New Delhi: Manohar। পৃষ্ঠা 167।
- ↑ "p2"। ৬ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ ডিসেম্বর ২০০৯।
- Sabyasachi Bhattacharya, Vande mataram, the biography of a song, Penguin Books, 2003, আইএসবিএন ৯৭৮-০-১৪-৩০৩০৫৫-৩.
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- Vande Matharam Sung by Lata Mangeshkar in Anand Math
- Vande Matharam Sung by Hemant Kumar Mukhopadhaya in Anand Math
- Download the most simple and most elegant version of Vande Mataram from the National Portal of India, Government of India.
- Vande Mataram voted second in The World's Top Ten - BBC
- Vande Mataram against Sikh tenets
- "How Secular is Vande Mataram?" AG Noorani on the controversy
- Boycott threat over Indian song - BBC
- 1937 Congress Resolution on validity of Muslim objection to this song
- "Vande Mataram and Muslims" - Islamic Voice (magazine)
- Vande Matram is back as a handle to beat Muslims with ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে
- Historical perspective from Islamic Voice ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৩ সেপ্টেম্বর ২০০৯ তারিখে