নুরুল আমিন

বাঙালি নেতা, আইনজ্ঞ, জাতীয় রক্ষণশীল, রাজনীতিবিদ

নুরুল আমিন (উর্দু: نورالامین, জাপানি: নূরুল আমীন‎‎, ১৫ জুলাই ১৮৯৩ – ২ অক্টোবর ১৯৭৪) ছিলেন একজন বাঙালি নেতা, আইনবিদ, পাকিস্তান মুসলিম লীগের চেয়ারম্যান।

নূরুল আমীন
نورالامین
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী
কাজের মেয়াদ
৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ – ২০ ডিসেম্বর ১৯৭১
রাষ্ট্রপতিইয়াহিয়া খান
পূর্বসূরীফিরোজ খান নুন
উত্তরসূরীজুলফিকার আলী ভুট্টো
পাকিস্তানের উপরাষ্ট্রপতি
কাজের মেয়াদ
২০ ডিসেম্বর ১৯৭১ – ২১ এপ্রিল ১৯৭২
রাষ্ট্রপতিজুলফিকার আলী ভুট্টো
পূর্বসূরীনতুন অফিস
উত্তরসূরীপদ বিলুপ্ত
বিরোধীদলের নেতা
কাজের মেয়াদ
৯ জুলাই ১৯৬৭ – ৭ ডিসেম্বর ১৯৭০
পূর্বসূরীফাতেমা জিন্নাহ
উত্তরসূরীখান আবদুল ওয়ালি খান
পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী
কাজের মেয়াদ
১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ – ৩ এপ্রিল ১৯৫৪
গভর্নরফিরোজ খান নুন
চৌধুরী খালিকুজ্জামান
পূর্বসূরীখাজা নাজিমুদ্দিন
উত্তরসূরীএ কে ফজলুল হক
ব্যক্তিগত বিবরণ
জন্ম(১৮৯৩-০৭-১৫)১৫ জুলাই ১৮৯৩
শাহবাজপুর, বাংলা প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত
(বর্তমান শাহবাজপুর টাউন, বাংলাদেশ)
মৃত্যু২ অক্টোবর ১৯৭৪(1974-10-02) (বয়স ৮১)
রাওয়ালপিন্ডি, পাঞ্জাব, পাকিস্তান
নাগরিকত্ব ব্রিটিশ ভারত (১৯৪৭ সাল পর্যন্ত)
 পাকিস্তান
রাজনৈতিক দলমুসলিম লীগ
প্রাক্তন শিক্ষার্থীআনন্দ মোহন কলেজ
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

১৯৪৮ সালে নুরুল আমিন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হন। তিনি সরবরাহ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সরাসরি বিরোধীতাকারীদের একজন ছিলেন। ১৯৭০ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার পর তিনি পাকিস্তানের অষ্টম প্রধানমন্ত্রী হন। এছাড়া তিনি পাকিস্তানের একমাত্র উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।[১] তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। সেসময় নূরুল আমিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানীদের সঙ্গে কাজ করেছিলেন।

প্রথম জীবন সম্পাদনা

নুরুল আমিন ১৮৯৩ সালের ১৫ জুলাই তারিখে অবিভক্ত বাংলার ত্রিপুরা জেলার ব্রাহ্মণবাড়ীয়া মহকুমার শাহবাজপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক বাড়ী ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলার বাহাদুরপুরে, যেখানে তিনি বড় হন।[২] তাঁর বাবা ছিলেন একজন জমিদার, এবং দাদা ছিলেন নবাবী আমলের আলা-সদর[৩][৪]

১৯১৫ সালে ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে তিনি কলেজ এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।[৫] ১৯১৭ সালে নুরুল আমিন আনন্দ মোহন কলেজ থেকে কলা বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯১৯ সালে তিনি ইংরেজি সাহিত্যে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন।[২][৫]

স্নাতক সম্পন্ন করার পর নুরুল আমিন কলকাতায় শিক্ষকতা শুরু করেন। পরে তিনি আইনপেশায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।[২][৫] ১৯২০ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯২৪ সালে আইন ও বিচারের উপর এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। একই বছর তিনি বার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।[৫] ময়মনসিংহ জজ আদালতে আইনজীবী হিসেবে তিনি তার আইনপেশা শুরু করেন।[৫]

কর্মজীবন সম্পাদনা

১৯২৯ সালে নুরুল আমিন ময়মনসিংহ লোকাল বোর্ডের সদস্য নিযুক্ত হন এবং ১৯৩০ সালে ময়মনসিংহ জেলা বোর্ডের সদস্য হন।[৫] ১৯৩২ সালে ব্রিটিশ সরকার তাকে ময়মনসিংহ পৌরসভার কমিশনার নিযুক্ত করে। ১৯৩৭ সালে নুরুল আমিন ময়মনসিংহ জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে বহাল ছিলেন।[৫]

এসময়ের মধ্যে তিনি রাজনীতিতে আগ্রহী হন। তিনি মুসলিম লীগের প্রথমদিককার সদস্যদের অন্যতম।[৫] সেসময় মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ দলের নেতা ছিলেন। একসময় ময়মনসিংহ জেলায় তিনি মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট হন। ১৯৪৪ সালে তাকে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের ভাইসপ্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হয়।[৫]

১৯৪৫ সালে নুরুল আমিন নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রথমে বাংলা আইন পরিষদের সদস্য ও পরে স্পিকার জেনারেল নির্বাচিত হন।[৫]

পাকিস্তান সম্পাদনা

পাকিস্তান আন্দোলন সম্পাদনা

নুরুল আমিন পূর্ব বাংলায় মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর বিশ্বস্ত সহকারী হয়ে উঠেন। তিনি ব্রিটিশ ভারতে বাংলার মুসলিমদের অধিকারের পক্ষে লড়াই করেন।[৬] পাকিস্তান আন্দোলনে নুরুল আমিন সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এসময় তিনি বাংলার মুসলিমদের সংগঠিত করেন এবং মুসলিম লীগকে শক্তিশালী করার কাজ চালিয়ে যান।[৬]

১৯৪৬ সালে মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ বাংলায় সফরে আসেন। এসময় নুরুল আমিন তার সাথে ছিলেন। তিনি পূর্ব বাংলায় তিনি মুসলিম ঐক্য জোরদার করার সপক্ষে কাজ করেছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় নুরুল আমিন ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষকতাকারীদের অন্যতম।[৬]

মুখ্যমন্ত্রী সম্পাদনা

জিন্নাহ তাকে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নিয়োগ করেন। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান ও গভর্নর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দিনের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। লিয়াকত আলি খানের হত্যাকান্ডের পর নুরুল আমিনকে সরবরাহ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন।

জিন্নাহর মৃত্যুর পর নুরুল আমিন পরবর্তী গভর্নর জেনেরাল খাজা নাজিমুদ্দিন কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী মনোনীত হন।[৭] তিনি কয়েক সপ্তাহ এই পদে ছিলেন।[৭]

ভাষা আন্দোলন সম্পাদনা

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনের ফলে মুসলিম লীগ পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয়তা হারায়। খাজা নাজিমুদ্দিন ও নুরুল আমিন উভয়েই পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হন। নুরুল আমিন কমিউনিস্ট পার্টিকে এর জন্য দায়ী করেন এবং ভাষা আন্দোলনে উস্কানির জন্য তাদের দোষারোপ করেন। নাজিমুদ্দিন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মুসলিম লীগের ভেতর থেকে সমস্যা সৃষ্টি হয়। তিনি নুরুল আমিনের বিরোধিতা করেন। নুরুল আমিনের মত ছিল যে পাকিস্তানের অস্তিত্ব মুসলিম লীগের শক্তিশালী হওয়ার উপর নির্ভরশীল কিন্তু নাজিমুদ্দিন তা বুঝতে পারছেন না।

পূর্ব পাকিস্তানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়ার পর নুরুল আমিন সামরিক পুলিশকে সহায়তার জন্য ডেকে পাঠান।[৮] এসকল উত্তেজনাকর অবস্থার সময় পূর্ব পাকিস্তানে পুলিশের গুলিতে মিছিলে থাকা কয়েকজন নিহত হলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদরা নুরুল আমিনের পদত্যাগ দাবি করে।

১৯৫৪ নির্বাচন সম্পাদনা

১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে মুসলিম লীগ প্রতিপক্ষ যুক্তফ্রন্টের কাছে পরাজিত হয়। নির্বাচনের পর যুক্তফ্রন্টের নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হন। এ কে ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টি, মাওলানা আতহার আলির নেজামে ইসলাম, হাজি মুহাম্মদ দানেশমাহমুদ আলির গণতন্ত্রী দল এসময় প্রভাবশালী হয়ে উঠে।[৯] নুরুল আমিন আইনসভায় তার আসন হারান। মুসলিম লীগ প্রাদেশিক রাজনীতির দৃশ্যপটে তার প্রভাব হারিয়ে ফেলে।

নুরুল আমিন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু সেনা কর্মকর্তা জেনারেল আইয়ুব খান অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। রাষ্ট্রপতি ইস্কান্দার মির্জাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। দেশে রাজনৈতিক দল ভেঙে দেয়ার পর নুরুল আমিনের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার সমাপ্ত হয়।

বিরোধীদলীয় নেতা সম্পাদনা

ফাতেমা জিন্নাহর মৃত্যুর পর নুরুল আমিন বিরোধীদলীয় নেতা হন। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন। এসময় জেনারেল ইয়াহিয়া খান পুনরায় সামরিক আইন জারি করেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পাদনা

১৯৭০ সালের নির্বাচনে নুরুল আমিন জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ বহির্ভূত নির্বাচিত দুইজন ব্যক্তির মধ্যে তিনি অন্যতম। যুদ্ধের সময় তার বেড়ে উঠা নিজ জেলার পরিস্থিতির অবনতি হয়। ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর তাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। ২০ ডিসেম্বর ইয়াহিয়া খান পদত্যাগ করার পর জুলফিকার আলী ভুট্টো নতুন রাষ্ট্রপতি হন। দুদিন পর নুরুল আমিনকে উপরাষ্ট্রপতি নিয়োগ করা হয়। এই পদে থাকা তিনি একমাত্র ব্যক্তি। ১৯৭২ সালের ২১ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন।

যুদ্ধপরবর্তী সময় সম্পাদনা