তারা (দেবী)
তারা (সংস্কৃত: तारा) হলেন হিন্দু দেবী কালীর একটি বিশিষ্ট রূপ। ইনি দশমহাবিদ্যার দ্বিতীয় মহাবিদ্যা। কালীর মতোই তারা ভীষণা দেবী। তারামায়ের আটটি রূপ হল- তারা(বামাকালী), উগ্ৰতারা, নীলসরস্বতী, একজটা তারা, তারিণীতারা, নিত্যাতারা, বজ্রাতারা, কামেশ্বরীতারা। বৌদ্ধধর্মেও তারাদেবীর পূজা প্রচলিত। তারার মূর্তিকল্পনা কালী অপেক্ষাও প্রাচীনতর।[১] পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার তারাপীঠে অবস্থিত দেবী তারার মন্দির বিখ্যাত। তিনি দেবী পার্বতীর এক উগ্র রূপ। একজন বিখ্যাত তারা-সাধক হলেন বামাক্ষ্যাপা।
তারা | |
---|---|
দেবনাগরী | तारा |
অন্তর্ভুক্তি | মহাশক্তি, মহাবিদ্যা, পার্বতী |
মন্ত্র | স্ত্রীং |
অস্ত্র | খড়্গ, কর্তৃকা, নীলপদ্ম, সমুণ্ড খর্পর |
সঙ্গী | সদ্যোজাত মহাকাল, অক্ষোভ্য ভৈরব |
উপাখ্যান এবং সাধনাপথ
সম্পাদনারুদ্রযামল গ্রন্থের সপ্তদশ(১৭) পটল বা অধ্যায়ে দেবী তারার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। এখানে বর্ণিত হয়েছে যে, সাধক বশিষ্ঠ আগমোক্ত প্রথায় দেবীর সাধনা করে সিদ্ধিলাভে ব্যর্থ হন। (ব্রহ্মযামল মতে, তার প্রথম সাধনস্থান মহাসাগরে বা কামাখ্যায়। পরবর্তীতে, বশিষ্ঠ মহাচীনদেশে গমন করেন এবং সেখানে ভগবান বিষ্ণুর অবতার বুদ্ধ তাকে শাক্ত কৌল তন্ত্রানুসারে দীক্ষা দেন। পরে, বশিষ্ঠ তান্ত্রিক কুলাচার অনুসারে পঞ্চমকার পদ্ধতিতে দেবী তারার কঠোর সাধনা করেন এবং সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেন। দেবী তারাকে অথর্ববেদাক্ষিণী বা অথর্ববেদও বলা হয়ে থাকে।[২] তোড়ল তন্ত্র অনুসারে, দেবী তারার ভৈরব হলেন অক্ষোভ্য কারণ তিনি ভয়ংকর হলাহল বা বিষ কোনো অক্ষোভ বা যন্ত্রণা ছাড়ায় পান করেছিলেন।[৩] স্বতন্ত্র তন্ত্র মতে, দেবী তারা, তার সকল ভক্তকে উগ্র বা ভীষণ বিপদ থেকে রক্ষা করেন, তাই তার আরেক নাম উগ্রতারা।[৪] দেবী সর্বব্যাপী এবং সর্বত্রই তিনি সমভাবে বিরাজিত।[৪] যে সাধক এবং ভক্ত দেবীর সাধনা বা তপস্যায় সিদ্ধ হন তিনি কাব্যশক্তি লাভ করেন, সর্বশাস্ত্র বিশারদ হন এবং মোক্ষ লাভ করেন।[৪]
মূর্তিতত্ত্ব
সম্পাদনাহংসনারায়ণ ভট্টাচার্য তার হিন্দুদের দেবদেবী: উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ বইয়ে বলেছেন, তন্ত্রসারে দেবী তারার যে রূপ বর্ণিত হয়েছে তা নিম্নরূপ:
৺তারা প্রত্যালীঢ়পদা অর্থাৎ শববক্ষে বামপদ স্থাপিতা। ভয়ঙ্করী, মুণ্ডমালাভূষিতা, খর্বা, লম্বোদরী, ভীষণা, কটিতে ব্যাঘ্রচর্মাবৃতা, নবযৌবনা, পঞ্চমুদ্রা শোভিতা, চতুর্ভুজা, লোলজিহ্বা, মহাভীমা, বরদা, খড়্গ কাতরি দক্ষিণহস্তে ধৃতা, বামহস্তদ্বয়ে কপাল ও নীলপদ্ম, পিঙ্গলবর্ণ একজটাধারিণী, ললাটে অক্ষোভ্য প্রভাতসূর্যের মতো গোলাকার তিন নয়নশোভা, প্রজ্জ্বলিত চিতামধ্যে অবস্থিতা, ভীষণদন্তা, করালবদনা, নিজের আবেশে হাস্যমুখী, বিশ্বব্যাপ্ত জলের মধ্যে শ্বেতপদ্মের উপর অবস্থিতা।"[১]
তন্ত্রসারে তারার আরও একটি ধ্যানমন্ত্র বর্ণিত হয়েছে: "শ্যামবর্ণা, ত্রিনয়না, চতুর্ভুজা, বরমুদ্রা ও পদ্মধারিণী, চতুর্দিকে বহুবর্ণা ও বহুরূপা শক্তির দ্বারা বেষ্টিতা, হাস্যমুখী মুক্তাভূষিতা, রত্নপাদুকায় পদদ্বয় শোভিত, (এরূপে) তারাকে ধ্যান করবে।"[১] বৃহদ্ধর্ম পুরাণে তারাকে কেবল শ্যামবর্ণা ও কালরূপিকা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[৫] তন্ত্রসারে তারাকেই মহানীল সরস্বতী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[৬]
ভারতচন্দ্র রায় তাঁর অন্নদামঙ্গল কাব্যে তারার যে রূপবর্ণনা করেছেন, তা নিম্নরূপ:
তারা রূপ ধরি সতী হইলা সম্মুখ।।
নীলবরণা লোলজিহ্বা করালবদনা। সর্পবান্ধা ঊর্দ্ধ এক জটাবিভূষণা।।
অর্দ্ধচন্দ্র পাঁচখানি শোভিত কপাল। ত্রিনয়ন লম্বোদর পরা বাঘছাল।।
নীল পদ্ম খড়্গ কাতি সমুণ্ড খর্পর। চারি হাতে শোভে আরোহণ শিবোপর।।[৭]
তারাপীঠের ব্রহ্মশিলায় খোদিত তারামূর্তিটি চতুর্ভুজা, সর্পযজ্ঞোপবীতে ভূষিতা এবং তাঁর বাম কোলে পুত্ররূপী ও স্তন্যপানরত সদাশিব চিরশায়িত।[৮]
পাদটীকা
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ হিন্দুদের দেবদেবী: উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ, তৃতীয় খণ্ড, হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য, ফার্মা কেএলএম প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, ২০০৭, পৃ. ২৮৭-৯৭ উদ্ধৃতি ত্রুটি:
<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়; আলাদা বিষয়বস্তুর সঙ্গে "hinduderdebdebi" নামটি একাধিক বার সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে - ↑ Avalon, Arthur। "Shakti and Shakta"। Sacred Texts।
- ↑ Bühnemann, Gudrun। "The Goddess Mahācīnakrama-Tārā (Ugra-Tārā) in Buddhist and Hindu Tantrism"। Bulletin of the School of Oriental and African Studies।
- ↑ ক খ গ Pravrajika Vedantaprana, Saptahik Bartaman, Volume 28, Issue 23, Bartaman Private Ltd., 6, JBS Haldane Avenue, 700 105 (ed. 10 October 2015) p.18
- ↑ "যান্তরীক্ষে শ্যামবর্ণা সা তারা কালরূপিকা", বৃহদ্ধর্ম পুরাণ, মধ্য, ৬।১২৮
- ↑ তন্ত্রসার, কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ, বঙ্গবাসী, কলকাতা, পৃ. ৫১৪-১৫
- ↑ অন্নদামঙ্গল কাব্যে দশমহাবিদ্যার বর্ণনা, উইকিসংকলন
- ↑ পশ্চিমবঙ্গের পূজাপার্বণ ও মেলা, অশোক মিত্র সম্পাদিত, চতুর্থ খণ্ড, ভারত সরকার, নতুন দিল্লি, পৃ. ৩২৭
গ্রন্থপঞ্জি
সম্পাদনা- Banerjee, Sumanta (২০০২)। Logic in a Popular Form: Essays on Popular Religion in Bengal। Seagull Books। আইএসবিএন 8170461626।
- Kinsley, David R. (১৯৮৮)। Hindu Goddesses:Visions of the Divine Feminine in the Hindu Reigious Tradition। University of California Press। আইএসবিএন 0520063392।
- Kinsley, David R. (১৯৯৭)। Tantric Visions of the Divine Feminine: The Ten Mahāvidyās। New Delhi: Motilal Banarsidass। আইএসবিএন 978-0520204997।
- MacDaniel, June (২০০৪)। Offering Flowers, Feeding Skulls: Popular Goddess Worship in West Bengal। Oxford University Press। আইএসবিএন 0195167902।
- MacDaniel, June (১৯৮৯)। The Madness of the Saints: Ecstatic Religion in Bengal। University of Chicago Press। আইএসবিএন 0226557235।
- Shankaranarayanan, Sri (১৯৭২)। The Ten Great Cosmic Powers। Dipti Publications। আইএসবিএন 8185208387।
- Svoboda, Robert E (১৯৮৬)। Aghora: at the Left Hand of God। আইএসবিএন 0-914732-21-8।
- Svoboda, Robert E। Aghora II: Kundalini। আইএসবিএন 0-914-73231-5।
- Svoboda, Robert E। Aghora III: The Law of Karma। আইএসবিএন 0-914-73237-4।
- A Short Biography of Vamaksepa