ছবি খাঁ

বাকলার ফৌজদার

সাবিহ খাঁন (ফার্সি: صبيح خان), যিনি ছবি খাঁ নামেই বেশ পরিচিত, ছিলেন একজন মোগল কর্মচারী যিনি বাদশাহ জাহাঙ্গীরের শাসনামলে বাকলার (বরিশাল) ফৌজদারকোতোয়াল হিসাবে বিখ্যাত। বৃহত্তর বরিশালে তিনি অসংখ্য রাস্তা, পুল, দীঘি এবং মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন।[] হেনরী বেভারীজ তাঁকে বরিশালের প্রথম রাস্তা-নির্মাতা হিসাবে কৃতিত্ব দেয়।[] কথিত আছে যে তাঁর পদেই কোটালীপাড়া উপজেলার নামকরণ হয়েছিল।[]

প্রারম্ভিক জীবন এবং নিযুক্তি

সম্পাদনা
 
গৌরনদীতে কসবা মসজিদ নির্মাণের কৃতিত্ব ছবি খাঁর। []

ছবি খাঁ মোগল বাদশাহ জাহাঙ্গীরের শাসনামলে বাংলার সুবাহদারের প্রতিনিধি হিসেবে এই অঞ্চলে এসেছিলেন বলে জানা যায়। কিছু গবেষকরা মনে করেন যে তিনি সুলতান দাউদ খান কররানির সমসাময়িক ছিলেন। []

জাহাঙ্গীর নগর (পুরান ঢাকা) অবস্থিত বাংলার সুবাহদার ষোড়শ শতাব্দীর শুরুতে ছবি খাঁকে বাকলার ফৌজদার নিযুক্ত করেন। তিনি তার সেনাবাহিনী নিয়ে বর্তমান আগৈলঝাড়ার গৈলা-ফুল্লশ্রী এলাকায় বসতি স্থাপন করেন। কথিত আছে যে গোলাবারুদ থেকে গৈলা গ্রামের নাম এসেছে কারণ ছবি খাঁ এবং তার দল এই গ্রামে গোলাবারুদ তৈরি করেছিলেন। ইটের দেয়ালে আবিষ্কৃত ভিত্তির কারণে বর্তমান গৈলা দাস বাড়ীটিকে ছবি খাঁর বাড়ি মনে করা হয়। []

হেনরী বেভারীজ একটি ভিন্ন রূপকথা লিপিবদ্ধ করেছেন, যা ছবি খাঁকে একজন ধনী সওদাগরের ছেলে হিসাবে স্থান দেয়, ছবি খাঁকে অল্প বয়সে অপহরণ করা হয়েছিল এবং বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের বনে তিনি বড় হন। বেভারীজ বর্ণনা করে যে কিছু বছর পর কিছু লোক তাঁর বাবাকে হত্যা করে অবশেষে ছবি খাঁর মা বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের বনে পালিয়ে যায়। এই বিবরণে, অজানা অবস্থায় ছবি খাঁর সাথে বিয়ে হয়, কিন্তু একদিন মা তার পায়ে একটি তিল আবিষ্কার দেখে বুঝে ফেললেন ছবি খাঁর আসল পরিচয়। রূপকথা অনুসারে ছবি খাঁর স্থাপত্যিক জনহিতৈষীর কারণ ছিল তাঁর গুনাহ-মাফের একটি উসিলা। []

ছবি খাঁ বাকলা অঞ্চলের উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রেখেছিলেন এবং এর নিদর্শন এখনও গৌরনদী, উজিরপুর, কোতোয়ালী, মুলাদী এবং কোটালীপাড়ায় পাওয়া যায়। [] ফৌজদার থাকাকালে টরকি বন্দর থেকে কসবা, গৈলা, ধামুরা ও ওটরা হয়ে চন্দ্রদ্বীপের রাজধানী মাধবপাশা পর্যন্ত একটি বড় রাস্তা নির্মাণ করা হয়। তিনি বাকলা থেকে ঝালকাঠি, রহমতপুর, শিকারপুর, গৈলা হয়ে কোটালীপাড়া পর্যন্ত একটি রাস্তাও নির্মাণ করেন। তার নিজের গ্রাম গৈলায় আরও তিনটি রাস্তা ছিল। প্রথমটি রামদাস-হাটখোলা থেকে দক্ষিণ দিকে ধামুরা ও ওটরার দিকে গেছে, দ্বিতীয়টি পশ্চিমে কোটালীপাড়া থেকে মুর্শিদাবাদের দিকে গেছে এবং তৃতীয়টি দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে গিয়ে বর্তমান গৈলা-গৌরনদী সড়কের সাথে মিশেছে। ৫০ ফুটের গৈলা-মশাং সড়কটি আজও ব্যবহার করা হচ্ছে, যদিও এটি এখন ২০ ফুটে নেমে এসেছে। রাস্তার দুই পাশে স্থানীয় ও তার সেনাবাহিনীর জন্য একটি দীঘি তৈরি করেছিলেন। দীঘির কাছে একটি জনবসতি স্থাপিত হয় যা "ছবি খাঁর পাড়" নামে পরিচিত। [] তিনি বরিশাল থেকে ভূরঘাটা পর্যন্ত একটি রাস্তাও নির্মাণ করেন এবং ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কটি তার এটার নির্মিত হয়েছিল। নলচিড়া থেকে ভবিষ্যতের শরিকেল কেল্লা একটি রাস্তাও তার তৈরি ছিল।[]

রাস্তা ছাড়াও ছবি খাঁ গৈলা, রামসিদ্ধি,[] কসবা ও কোটালীপাড়ায় অসংখ্য মসজিদ নির্মাণ করেন।[১০] তার নির্মিত রাস্তায় ইট ও লোহার পুলও পাওয়া যায়। গৌরনদীর একটি পুল গত শতাব্দীতে ধ্বংস হয়ে গেছে, যদিও ছবি খাঁর একটি পুলের ধ্বংসাবশেষ ঘন্টেশ্বর গ্রামে এখনও দেখা যায়। []

গ্রেফতার

সম্পাদনা

কথিত আছে যে বাদশাহ জাহাঙ্গীর তাকে তার জনহিতকর কাজে প্রচুর অর্থ ব্যয় করার অনুমতি দিয়েছিলেন। যাইহোক, তখন গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে ছবি খাঁর কাজগুলো জাহাঙ্গীরের নামে করা হচ্ছে না এবং ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তায় ছবি খাঁ তাকে ছাড়িয়ে গেছেন[] এটি সম্রাটকে ক্ষুব্ধ করে, যিনি তাকে কারারুদ্ধ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এক সময়ে, রাম মিশ্র (গৈলার মিশ্র গোষ্ঠীর পূর্বপুরুষ) ছবি খাঁকে ঘুমন্ত হালতে ধরে বাংলার সুবাহদারের সৈন্যদের কাছে নিয়ে যায়। অভিযোগ মিথ্যা বলে সুবাহদার মুক্তি দেওয়ার পর ছবি খাঁকে পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। []

ব্যক্তিগত জীবন

সম্পাদনা

ছবি খাঁ ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ সুন্নি মুসলিম। তিনি ঝালকাঠির উদচড়া গ্রামের দরবেশ হজরত মীর মশায়েখের মুরীদ ছিলেন। তাছাড়া তিনি নলচিড়ার দরবেশ সৈয়দ কুতুব শাহের অনুসারীও ছিলেন। গৌরনদীর কসবা গ্রামে এক মুসলিমার সঙ্গে তার শাদী হয়। []

ইন্তেকাল

সম্পাদনা

অবসর গ্রহণের পর ছবি খাঁ বাকলা অঞ্চলে থেকে যান এবং ধর্মে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি বাটাজোরের বাঙ্কুরা গ্রামে একটি হুজরাখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেখানে তিনি ইন্তেকাল করেন। তার হুজরাখানা আজও দাঁড়িয়ে আছে।[]

আরও দেখুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Khatun, Habiba (২০০৬)। Iqlim Sonargaon: History, Jurisdiction, Monuments। Academic Press and Publishers Library। পৃষ্ঠা 39, 125। আইএসবিএন 9789840802128 
  2. বাকেরগঞ্জ জেলার ইতিহাস। History of Bakerganj District Project। ১৯৯০। পৃষ্ঠা 520। 
  3. Beveridge (1876).
  4. "Index of Ancient Monuments by classes"। List of Ancient Monuments in the Dacca Division। Bengal secretariat Press। ১৮৯৬। 
  5. সাইফুল আহসান বুলবুল (২০১২)। "সাবিহ খানের হুজরাখানা"। বৃহত্তর বরিশালের ঐতিহাসিক নিদর্শন। গতিধারা। 
  6. সিরাজ উদদীন আহমেদ (২০১০)। "ছবি খা"। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস। ভাস্কর প্রকাশনী। 
  7. Beveridge (1876), p. 48-49.
  8. Abdus Sattar, Mohammad (১৯৯৩)। ফরিদপুরে ইসলামIslamic Foundation Bangladeshআইএসবিএন 9789840600953 
  9. Directorate of Land Records and Surveys (১৯৫৪)। Faridpur Revisional Settlement Final Report। East Bengal Government Press। পৃষ্ঠা 217। 
  10. Jack, James Charles (১৯১৮)। Bakarganj। Bengal Secretariat Book Department। পৃষ্ঠা 148। 

আরও পড়া

সম্পাদনা