কালো তিতির
কালো তিতির বা শেখ ফরিদ বা কালা তিতির (বৈজ্ঞানিক নাম: Francolinus francolinus),ফ্যাজিয়ানিডি (Phasianidae) গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত ফ্র্যাঙ্কোলিনাস গণের এক প্রজাতির বুনো তিতির।[১][২] কালো তিতিরের বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ ছোট মুরগী বা ক্ষুদে মুরগী।[২] প্রায় ৩০ লক্ষ ২০ হাজার বর্গ কিলোমিটারএলাকা জুড়ে এদের আবাস।[৩] আই. ইউ. সি. এন. এই প্রজাতিটিকে আশঙ্কাহীন বলে ঘোষণা করেছে।[৪] বাংলাদেশে এরা মহাবিপন্ন বলে বিবেচিত। বাংলাদেশের ১৯৭৪[২] ও ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।[৫]
কালো তিতির Francolinus francolinus | |
---|---|
কালো তিতির Francolinus francolinus | |
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস | |
জগৎ: | প্রাণীজগৎ |
পর্ব: | কর্ডাটা |
শ্রেণী: | পক্ষী |
বর্গ: | Galliformes |
পরিবার: | Phasianidae |
উপপরিবার: | Perdicinae |
গণ: | Francolinus |
প্রজাতি: | F. francolinus |
দ্বিপদী নাম | |
Francolinus francolinus (Linnaeus, 1766) | |
প্রতিশব্দ | |
Tetrao francolinus (Linnaeus, 1766) |
বিস্তৃতি
সম্পাদনাআফগানিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, ভুটান, সাইপ্রাস, জর্জিয়া, সিরিয়া, ইসরাইল, ফিলিস্তিন, জর্ডান, ইরাক, ইরান, তুরস্ক, তুর্কমেনিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশ কালো তিতিরের প্রধান আবাসস্থল। বাংলাদেশের ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের পাতাঝরা বন ও রাজশাহী বিভাগের উত্তর প্রান্তে গ্রামাঞ্চলে এ পাখিটি দেখা যায়।[১][৬] সিলেট বিভাগেও একসময় এ পাখিটি দেখা যেত।[২] সৌদি আরব থেকে সম্ভবত কালো তিতির বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ইতালি ও স্পেন থেকে পাখিটি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পর্তুগালে কালো তিতির পুনঃঅবমুক্ত করা হয়েছে। লেবাননে পাখিটি অনিয়মিত (Vagrant)।[৪]
উপপ্রজাতি
সম্পাদনাকালো তিতিরের মোট ছয়টি উপপ্রজাতি শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।[৭] এগুলো হল:
- F. f. francolinus (Linnaeus, 1766): সাইপ্রাস, দক্ষিণ তুরস্ক থেকে ইরাক, ইরান, সিরিয়া ও ইসরাইল পর্যন্ত এদের বিস্তৃতি।
- F. f. arabistanicus (Zarudny and Harms, 1913): দক্ষিণ ইরাক ও পশ্চিম ইরান।
- F. f. asiae (Bonaparte, 1856): উত্তর ভারত (কচ্ছ ব্যতীত), বিহার ও উড়িষ্যা এদের প্রধান আবাস।
- F. f. henrici (Bonaparte, 1856): দক্ষিণ পাকিস্তান থেকে পশ্চিম ভারত পর্যন্ত এদের বিস্তার।
- F. f. bogdanovi (Zarudny, 1906): এদের প্রধান বিচরণ দক্ষিণ ইরান থেকে আফগানিস্তান হয়ে পাকিস্তান পর্যন্ত।
- F. f. melanonotus (Hume, 1888): এদের প্রধান বিচরণ পূর্বভারতের আসাম ও সিকিম থেকে মণিপুর পর্যন্ত এবং বাংলাদেশ।
বিবরণ
সম্পাদনাকালো তিতির কালচে বাদামী ভূচর পাখি। এদের দৈর্ঘ্য কমবেশি ৩৪ সেন্টিমিটার, ওজন ৪৩০ গ্রাম, ডানা ১৫ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ২.৪ সেন্টিমিটার, পা ৪.৮ সেন্টিমিটার ও লেজ ১০ সেন্টিমিটার।[২] পুরুষ ও স্ত্রী তিতিরের চেহারা ভিন্ন। পুরুষ তিতিরের পিঠ ঘন কালো, মধ্যে মধ্যে সাদা ও মেটে তিলা, বগলের তিলাগুলো বেশ মোটা। মুখ কালো ও গাল সাদা, গলাবন্ধ লালচে। স্ত্রী তিতিরের পিঠ ফিকে বাদামী ও মেটে বর্ণের। ঘাড়ের নিচের অংশ লালচে, কান ঢাকনি ও ভ্রু-রেখা হালকা পীত রঙের। চক্ষুরেখা কালচে। কাঁধ-ঢাকনি ও পিঠে হালকা পীত বর্ণের লম্বা ছিটা দাগ থাকে। থুতনি ও গলা সাদাটে। দেহতলের বাকি অংশে ও বগলে প্রশস্ত সাদা-কালো ডোরা থাকে এবং লেজের নিচটুকু তামাটে হয়। পুরুষ ও স্ত্রী তিতিরের উভয়ের চোখ বাদামি বা পিঙ্গল-বাদামি। ঠোঁট কালো। লেজের ডগা সূঁচালো। প্রজনন মৌসুমে পা ও পায়ের পাতা গাঢ় লাল বর্ণ ধারণ করে। অপ্রাপ্তবয়স্ক তিতির দেখতে স্ত্রী তিতিরের মত। তবে তার কালো ভ্রুরেখা ও কালো বুকে সাদা তিলা থাকে। উপপ্রজাতিভেদে কালো তিতিরের পালকের রঙে বিভিন্নতা দেখা যায়।[১][২]
স্বভাব
সম্পাদনাকালো তিতির উঁচু ঘাস, ক্ষেত-খামার, চা বাগান ও পানির ধারের ছোট ঝোপে বিচরণ করে। সচরাচর একাকী কিংবা জোড়ায় জোড়ায় ঘুরে বেড়ায়। এরা খোলা মাঠ, বনের পাশে ঘাসবনে বা ছোট ঝোপ মধ্যে খাবার খোঁজে। খাদ্যতালিকায় রয়েছে ঘাসবীজ, আগাছা, শস্যদানা, কচি কাণ্ড, ফল ও পোকামাকড়। সাধারণত ওড়ে না, বিপদের আভাস পেলে লুকিয়ে পড়ে। ঊষা ও গোধূলিতে এরা বেশি কর্মচঞ্চল হয়। এসময় স্বভাবসিদ্ধ তীক্ষ্ণ স্বরে ডাকে: চিক......চিক.....চিক......ক্রেকেক।[২] এই অদ্ভুত শব্দবিশিষ্ট ও ছন্দময় ডাকের জন্য বাংলাদেশের তেঁতুলিয়ার কৃষক আর রাখালেরা এই পাখিটিকে ডাকে পান-বিড়ি-সিগ্রেট বলে।[১]
প্রজনন
সম্পাদনামার্চ থেকে অক্টোবর মাস কালো তিতিরের প্রজনন মৌসুম।[৬] এসময় পুরুষ তিতির গলা টান করে ডাকতে থাকে। লেজ ওঠা নামা করে। লম্বা ঘাসের গোড়ায় বা ঘন ঝোপের নিচে মাটির খোদলে ঘাস দিয়ে বাসা বানায়। বাসা বানানো শেষে ৬-৯টি ডিম পাড়ে। ডিমগুলো হলদে-জলপাই থেকে হালকা জলপাই-বাদামি রঙের হয়। ডিমের মাপ ৩.৮×৩.১ সেন্টিমিটার। শুধু স্ত্রী তিতির ডিমে তা দেয়। ১৮-১৯ দিন পর ডিম ফুটে ছানা বের হয়।[২]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ ঘ রেজা খান, বাংলাদেশের পাখি (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ২০০৮), পৃ. ৩৩০।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ জিয়া উদ্দিন আহমেদ (সম্পা.), বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ: পাখি, খণ্ড: ২৬ (ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০০৯), পৃ. ১-২।
- ↑ Francolinus francolinus ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখে, BirdLife International এ কালো তিতির বিষয়ক পাতা।
- ↑ ক খ Francolinus francolinus[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ], The IUCN Red List of Threatened Species এ কালো তিতির বিষয়ক পাতা।
- ↑ বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত, জুলাই ১০, ২০১২, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, পৃষ্ঠা-১১৮৪৪৪৮
- ↑ ক খ বিলুপ্তপ্রায় পাখি শেখ ফরিদ ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৯ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখে, খসরু চৌধুরী, তারিখ: ৩০-০৩-২০১০, দৈনিক প্রথম আলো।
- ↑ [১] ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৫ মার্চ ২০১৬ তারিখে, The Internet Bird Collection এ কালো তিতির বিষয়ক পাতা।
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- উপসম্পাদকীয়: শেখ ফরিদ, দৈনিক সমকাল।
- কালো তিতির বিষয়ক আরও তথ্য
- Oriental Bird Images ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৫ মার্চ ২০১৬ তারিখে, কালো তিতিরের আলোকচিত্র ও ডাক।