আলি ইবনে আব্বাস আল মাজুসি

আলী ইবনে আব্বাস আল মাজুসি ( আরবি: علی بن عباس المجوسی; মৃত্যু: ৯৮২ থেকে ৯৯৪ সালের মাঝে ) যিনি মাসুদী বা লাতিন হলি আব্বাস নামেও পরিচিত –ছিলেন ইসলামি স্বর্ণযুগের একজন পার্সিক দার্শনিক ও মনোবিজ্ঞানী। তিনি তার বিখ্যাত গ্রন্থ কিতাব আল মালাকি বা কামিল আল সানায়া আল তিব্বিয়া (The Complete Book of the Medical Art ) এর জন্য বিখ্যাত, যা মনোবিজ্ঞানচিকিৎসা বিজ্ঞানে লিখিত একটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ[১]

আলি ইবনে আব্বাস আল মাজুসি
علي ابن عباس المجوسي
Haly Abbas
আল-মাজুসির কামিল আল-সানাআহ আল-তিব্বিয়্যাহের পাণ্ডুলিপি, যা ১১৯৪ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে ইরানে প্রস্তুত করা হয়েছিল।
জন্মঅজ্ঞাত
মৃত্যু৯৯২/৯৯৪ খ্রি.
পেশাচিকিৎসক
উচ্চশিক্ষায়তনিক কর্ম
যুগইসলামি স্বর্ণযুগ
বিষয়মনোবিজ্ঞানী, চিকিৎসক
প্রতিষ্ঠানআল-আদুদী হাসপাতাল, বাগদাদ, ইরাক
উল্লেখযোগ্য কাজকিতাব আল মালাকি বা কিতাবু কামিল আল সানায়াহ আল তিব্বিয়াহ (The Complete Book of the Medical Art )

জীবনী সম্পাদনা

আলি ইবনে আব্বাস পারস্যের দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলীয় আহওয়াজে একটি পার্সিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন  এবং শায়খ আবু মাহের মুসা ইবনে সাইয়ারের অধীনে তিনি পড়াশোনা করেন। সেই সময়ের পূর্ব খিলাফতের তিনজন সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসকের মধ্যে আলিকে একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং বুওয়াইহ রাজবংশের আমির 'আদুদু দ্দৌলা ফানা খুসরো'র চিকিৎসক হয়ে তিনি কর্রমত ছিলেন, যিনি ৯৪৯ সাল থেকে ৯৮৩ সাল পর্যন্ত শাসন করেন। আমির চিকিৎসাশাস্ত্রের একজন মহান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং তিনি পারস্যের শিরাযে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন এবং ৯৮১ সালে তা বাগদাদের আল-আদুদী হাসপাতালে স্থানান্তরিত হয়, যেখানে আল-মাজুসি কাজ করতেন। তার পূর্বপুরুষরা জরাথুস্ট্রীয় ছিল ( যেখান থেকে তার নিসবাহ "আল-মাজুসি) ; কিন্তু তিনি নিজে একজন মুসলিম ছিলেন। তার পিতার নাম ছিল আব্বাস এবং ইরানিকার মতে, আলীর এই নামটি (আল মাজুসি) সাধারণত একজন নবজাতককে দেওয়া নামের মত নয় এবং একটি সত্য, যা ইঙ্গিত করে যে, পরিবারটি তার দাদা-দাদির প্রজন্মে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়; এর আগে নয়। তিনি নিজেও মুসলিম উত্সাহের অভাব বোধ করেন, যেহেতু তিনি নিজের সূচনা বক্তব্যে নবী মোহাম্মদের কোন উল্লেখ করতেন না; যদিও ওষুধের শ্রেষ্ঠত্বের জন্য তার যুক্তি সম্পূর্ণরূপে কুরান বা সুন্নার আশ্রয় ছাড়াই বাস্তববাদী যুক্তির উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। অধিকন্তু, নিজেকে "আলি বিন আব্বাস মাজুসি" বলে পরিচয় দিয়ে লেখক ইচ্ছাকৃতভাবে তার জরথুষ্ট্রীয় পটভূমির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।[২][৩]

রচনা: কিতাব আল মালাকি সম্পাদনা

আল-মাজুসি তার কিতাবু কামিল আল সানায়াহ আল তিব্বিয়া ( كتاب كامل الصناعة الطبية : চিকিৎসা শাস্ত্রের পরিপূর্ণ বই" ) এর জন্য সর্বাধিক পরিচিত, যাকে পরে দ্য কমপ্লিট আর্ট অফ মেডিসিন বলা হয়। এটি মাজুসি প্রায় ৯৮০ সালে সম্পন্ন করেন এবং তার তিনি কাজটি তৎকালীন আমিরকে উৎসর্গ করেন। তাই এটি কিতাব আল-মালাকি (كتاب الملكي : রয়্যাল বুক ) বা লাতিন লিবার রেগালিস অথবা রেগালিস ডিসপোজিও নামে পরিচিতি লাভ করে। বইটি আল রাজির হাউইয়ের চেয়ে আরো নিয়মতান্ত্রিক ও সংক্ষিপ্ত বিশ্বকোষ এবং ইমাম ইবনে সিনার কানুন ফিত্তিবের (দ্য ক্যানন অফ মেডিসিন) চেয়েও বেশি ব্যবহারিক, যার কারণে এটি (পঠনে) বাতিল হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।

কিতাব আল মালিকি ২০টি বক্তৃতায় বিভক্ত, যার মধ্যে প্রথম দশটি তত্ত্বের সাথে এবং দ্বিতীয় দশটি ওষুধের অনুশীলন নিয়ে। বইয়ে আলোচিত বিষয়গুলির মধ্যে কিছু উদাহরণ হলো, ডায়েটিক্স ও মেটেরিয়া মেডিকা, কৈশিক নালীর একটি প্রাথমিক ধারণা, আকর্ষণীয় চিকিৎসামূলক পর্যবেক্ষণ এবং প্রসবের সময় গর্ভের গতির প্রমাণ (উদাহরণস্বরূপ, শিশুটি যদি বের না হয়, তাহলে তাকে বাইরে ঠেলে দেওয়া)।

কনস্টান্টিনাস আফ্রিকানাসের ( ১০৮৭ খ্রি.) ইউরোপে একরি আংশিক লাতিন অনুবাদ "লিবার প্যান্টেগনি" নামে রূপান্তরিত হয়, যা সালেরনাতো স্কোলা মেডিকা সালেরনিটানার একটি প্রতিষ্ঠাতা পাঠে পরিণত হয়। ১১২৭ সালে অ্যান্টিওকের স্টিফেনের একটি সম্পূর্ণ এবং আরো ভালো অনুবাদ প্রকাশিত হয় এবং এটি ১৪৯২ এবং ১৫২৩ সালে ভেনিসে মুদ্রিত হয়। তার এই ওষুধের বইটি জেফ্রি চসারের দ্য ক্যান্টার্বেরি টেলসে উদ্ধৃত করা হয়েছে।

চিকিৎসাবিষয়ক নৈতিকতা ও গবেষণা পদ্ধতি সম্পাদনা

একজন চিকিৎসকের নৈতিকতা এবং রোগীদের সাথে তার আচরণ সম্পর্কে আলি ইবনে আব্বাস বলেছেন, “ডাক্তারকে সর্বদাই হতে হবে বিশুদ্ধ, বুদ্ধিমান, ধার্মিক, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের প্রতি আস্থাবান, কোমল জিহ্বা ও সুন্দর আচরণের অধিকারী, সমস্ত অপবিত্রতা থেকে দূরে অবস্থানকারী সেই সাথে নোংরামি ও অনৈতিকতা অপছন্দাকারী এবং তিনি কোনো রোগীর গোপনীয়তা অন্যের কাছে প্রকাশ করবেন না। কারণ অনেক রোগী এমন অসুস্থতার মুখোমুখি হন, যা তারা পিতামাতা ও পরিবারের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখে ডাক্তারের কাছে প্রকাশ করেন।"

এ কাজটি ডাক্তার ও রোগীদের মধ্যে একটি স্বাস্থ্যকর সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয় এবং এটি চিকিৎসার নৈতিকতার গুরুত্বের উপরও জোর দেয়। এটি একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির বিশদ প্রদান করে, যা আধুনিক জৈবচিকিৎসা প্রযুক্তি গবেষণার অনুরূপ।

স্নায়ুবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান

কিতাব আল মালিকিতে স্নায়ুবিজ্ঞানমনোবিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তিনি মস্তিষ্কের স্বায়ুতন্ত্র, স্নায়ুবিজ্ঞান ও স্বায়ুশারীরবিদ্যা বর্ণনা করেন এবং প্রথমে ঘুমের অসুস্থতা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, বিষণ্নপ্রকৃতি, কোমা, গরম ও ঠান্ডা মেনিনজাইটিস, ভার্টিগো মৃগী, প্রেমের অসুস্থতা ও অর্ধ পক্ষাঘাতসহ বিভিন্ন মানসিক ব্যাধি নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি ওষুধ বা ওষুধের চেয়ে খাদ্য এবং প্রাকৃতিক নিরাময়ের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সংরক্ষণের উপর বেশি জোর দিয়েছিলেন এবং তিনি ওষুধকে শেষ অবলম্বন হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন।

মনোশারীরবিজ্ঞান ও মনোদৈহিক ওষুধ সম্পাদনা

ইবনে আব্বাস মাজুসী ছিলেন মনোশারীরবিজ্ঞান ও মনোদৈহিক ওষুধের একজন পথপ্রদর্শক। তিনি বর্ণনা করেছেন কিভাবে একজন রোগীর শারীরবৃত্তীয় এবং মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলি একে অপরের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে অস্বাস্থ্যকর রোগীদের মধ্যে একটি সম্পর্ক খুঁজে পান এবং তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, "আনন্দ ও তৃপ্তি এমন অনেকের জন্য একটি উন্নত জীবনযাত্রার মর্যাদা আনতে পারে, যারা অন্যথায় অপ্রয়োজনীয় দুঃখ, ভয়ের কারণে অসুস্থ ও দুর্দশাগ্রস্ত হয়।" [৪]

চিকিৎসায় অবদান সম্পাদনা

আলি বিন আব্বাস আল আহওয়াজিকে প্রথম প্রাচীন চিকিৎসকদের একজন বলে মনে করা হয় যিনি বলেন যে, স্পন্দনশীল শিরা (অর্থাৎ ধমনী) ও অস্পন্দনকারী শিরাগুলির মধ্যে একটি কৈশিক নেটওয়ার্ক রয়েছে। এরপর ইংরেজ চিকিৎসক হার্ভে ( ১৫৭৮১৬৫৮ খ্রি.) কৈশিকের রক্ত সঞ্চালনের বর্ণনা দিয়ে এই চিকিৎসার কৃতিত্বের নেন। তিনি জরায়ুকে প্রভাবিত করে টিউমার অপসারণ এবং ঘাড়ের প্রদাহের বর্ণনাও দিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, টন্সিলগুলি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অপসারণ নিশ্চিত করা যায়, যদি সে সব আকারে বড় হয়; দীর্ঘ সময় নেয় এবং ব্যক্তির পক্ষে খাবার গিলতে অসুবিধা হয়; যদি ওষুধ, মলম ও অন্যান্য শক্তিশালী পদার্থ তাদের নিরাময়ে সফল না হয়। অস্ত্রোপচারে তার দক্ষতা ফ্র্যাকচার, স্থানচ্যুতির চিকিত্সা ও স্প্লিন্ট করার ক্ষেত্রেও বহু কাজে লেগেছিল। নিচের চোয়াল ভেঙে গেলে তারও চিকিৎসার নির্দিষ্ট বর্ণনা দিয়েছেন তিনি।[২]

আলী ইবনে আব্বাস আল আহওয়াজি দন্তচিকিৎসায় ব্যাপক আগ্রহ নিয়েছিলেন, যা তাকে তার বইতে এই বিষয়ে একটি ব্যাপক বিস্তৃত অধ্যয়ন উপস্থাপন করতে সাহায্য করে। তিনি মৃগীরোগ নিয়ে গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন এই পর্যায়ে যে, তিনি এমন ফলাফলে পৌঁছেন যে, তা যুগে যুগে একটি রেফারেন্স হিসাবে রয়ে গেছে।আলী ইবনে আব্বাস যক্ষ্মা দ্বারা সংক্রামিত ফুসফুস নিরাময়ের অসুবিধা লক্ষ্য করেছিলেন এবং তিনি এই বিষয়ে বলেছিলেন যে: “যেই কারণে ফুসফুসের যক্ষ্মা নিরাময় হয় না, তা হল ফুসফুস সর্বদা গতিশীল থাকে এবং ঘন ঘন হওয়ার কারণে স্থির হয় না। নড়াচড়া ও কাঁপুনি ও কাশির জ্বালা এতে চলতেই থাকে। কারণ আলসারযুক্ত অঙ্গটি শান্ত হওয়া দরকার। তিনিই প্রথম অগ্রগামী ব্যক্তি যিনি ফুসফুসের খোঁচা পদ্ধতিটি বর্ণনা করেন, যা যক্ষ্মা রোগের চিকিত্সার জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল; বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের আগে।[২]

আলী বিন আব্বাস ক্যাথেটার উদ্ভাবন করেছিলেন, যা তিনি ডিসুরিয়া রোগে আক্রান্ত রোগীর মূত্রাশয় থেকে প্রস্রাব বের করতে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি ছিলেন যক্ষ্মা সার্ভিকাল লিম্ফ্যাডেনাইটিসের চিকিত্সার প্রথম অগ্রগামীদের একজন, যারা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তা অপসারণ করে থাকেন এবং নির্ভুলতা, মনোযোগ ও সতর্কতার তা সাথে পরিষ্কার করেন।[২]

আরও দেখুন সম্পাদনা

গ্রন্থপঞ্জী সম্পাদনা

  • Lutz Richter-Bernburg, "‘Ali b. ‘Abbas Majusi", in Encyclopædia Iranica, ed. Ehsan Yarshater, 6+ vols. (London: Routledge & Kegan Paul and Costa Mesa: Mazda, 1983 to present), vol. 1, pp. 837–8 [১]
  • Manfred Ullmann, Die Medizin im Islam, Handbuch der Orientalistik, Abteilung I, Erg?nzungsband vi, Abschnitt 1 (Leiden: E.J. Brill, 1970), pp. 140–146
  • Fuat Sezgin, Medizin-Pharmazie-Zoologie-Tierheilkunde bis ca 430 H., Geschichte des arabischen Schrifttums, Band 3 (Leiden: E.J. Brill, 1970), pp. 320–322
  • Manfred Ullmann, Islamic Medicine (Edinburgh: Edinburgh University Press, 1978, reprinted 1997), pp. 55–85.
  • Wustenfeld: Geschichte der arabischen Aerzte (59, 1840).
  • Edward G. Browne, Islamic Medicine, 2002, p. 53-54, আইএসবিএন ৮১-৮৭৫৭০-১৯-৯
  • Charles S. F. Burnett, Danielle Jacquart (eds.), Constantine the African and ʻAlī Ibn Al-ʻAbbās Al-Magūsī: The Pantegni and Related Texts. Leiden: Brill, 1995. আইএসবিএন ৯০-০৪-১০০১৪-৮
  • Shoja MM, Tubbs RS. The history of anatomy in Persia. J Anat 2007; 210:359–378.

বাহ্যিক লিংক সম্পাদনা

Hamarneh, Sami (২০০৮) [1970-80]। "Al-Majūsī, Abu'l-Ḥasan 'Alī Ibn 'Abbās"Complete Dictionary of Scientific Biography। Encyclopedia.com। 

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Frye, Richard Nelson, সম্পাদক (১৯৭৫)। The Cambridge history of Iran. 4: The period from the Arab invasion to the Saljuqs / ed. by R. N. Frye (6. print সংস্করণ)। Cambridge: Cambridge Univ. Pr। আইএসবিএন 978-0-521-20093-6 
  2. Foundation, Encyclopaedia Iranica। "Welcome to Encyclopaedia Iranica"iranicaonline.org (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০২-১৯ 
  3. Glick, Thomas F.; Livesey, Steven John; Wallis, Faith (২০১৬)। Medieval science, technology, and medicine: an encyclopedia। Routledge revivals (Facsimile ed. সংস্করণ)। New York: Routledge। আইএসবিএন 978-1-138-05670-1 
  4. Nurdeen Deuraseh and Mansor Abu Talib (2005), "Mental health in Islamic medical tradition", The International Medical Journal 4 (2), p. 76-79.