স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান

বাংলাদেশি সামরিক ব্যক্তিত্ব

স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান (১৯৪০ - ৫ জানুয়ারি ১৯৭২) ছিলেন ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ৩নং আসামি, বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা[১][২][৩][৪] তিনি মূলত তৎকালীন পাকিস্তান নৌবাহিনীতে স্টুয়ার্ড মুজিব হিসেবেই বেশি পরিচিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং সশস্ত্র যুদ্ধে স্টুয়ার্ড  মুজিব একজন বলিষ্ঠ, সাহসী ও উজ্জ্বল স্ফুলিঙ্গের মূর্ত প্রতীক। স্বাধীনতাযুদ্ধে জীবন বিসর্জন ত্যাগ, তিতিক্ষা ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে স্বরনীয় ও বরনীয় মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে জাতীয় স্বীকৃতি পেয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতার ইতিহাসে হয়েছেন চির স্বরনীয় ও চির জাগ্রত, তাদের সারিতে স্টুয়ার্ড মুজিব স্বাধীনতা পিপাসু এক অনন্য ব্যক্তিত্ব, কিন্তু তার অবদান ও ত্যাগের কোন স্বীকৃত জাতীয় পর্যায়ে অদ্যাবধি দৃশ্যমান নয়।

স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান
জন্ম
মুজিবুর রহমান

১৯৪০
অন্তর্ধান০৫ জানুয়ারি ১৯৭২
ঢাকা
অবস্থামৃত মনে করা হয়
নাগরিকত্ব ব্রিটিশ ভারত (১৯৪৭ সালের পূর্বে)
 পাকিস্তান (১৯৭১ সালের পূর্বে)
 বাংলাদেশ (১৯৭১ সালের পর)
মাতৃশিক্ষায়তনচরমুগরিয়া মার্চেন্টস উচ্চ বিদ্যালয়
পেশাস্টুয়ার্ড (নৌবাহিনী), মুক্তিযোদ্ধা
দাম্পত্য সঙ্গীসুলতানা রহমান
সন্তানটিপু সুলতান

১৯৭২ সালের ৫ জানুয়ারি তাকে সচিবালয়ের সামনে থেকে অজ্ঞাত পরিচয় লোক সাদা রঙের গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়।

প্রাথমিক জীবন সম্পাদনা

স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান ১৯৪০ সালে মাদারীপুর শহর সংলগ্ন রাস্তি ইউনিয়নের লক্ষ্মীগঞ্জ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মৌলভী শাহ্ সৈয়দ আবদুল লতিফ ছিলেন কো-অপারেটিভ ব্যাংকের পরিচালক। মায়ের নাম সৈয়দা জহুরুননেছা কাজী। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে স্টুয়ার্ড মুজিব ছিলেন তৃতীয়।[৩] কোন এক সময় গ্রামের সীমানা দিয়ে প্রবাহিত খরস্রোত আড়িয়াল খাঁ নদীর ভাঙ্গনে ঐ গ্রামের ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং স্টুয়ার্ড মুজিব এর বাবা ঐ গ্রাম ছেড়ে ঘটমাঝি  ইউনিয়নের  ঘটমাঝি গ্রামে বসবাস শুরু করেন। এখান থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে চরমুগরিয়া মার্চেন্টস উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন।

কর্মজীবন সম্পাদনা

স্টুয়ার্ড মুজিব চরমুগরিয়া মার্চেন্টস উচ্চ বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেনীতে পড়াশুনা অবস্থায় ১৯৫৪ সালে ঘটমাঝি ইউনিয়নের খাগদি গ্রামের বাসিন্দা পাকিস্তান নৌবাহিনীর অফিসার এম এ খান সাহেবের সাথে যোগাযোগ করেন। লে. কমান্ডার এম এ খান তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানে সেনা ও নৌবাহিনীর রিক্রুটিং অফিসার থাকাকালে ১৯৫৭ সালে এর শেষের দিকে মুজিবকে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে ভর্তি করেন। মুজিবকে পাঠানো হয় পাকিস্তান নেভাল ট্রেনিং সেন্টার করাচী পি. এন. এস. বাহাদুর, ট্রেনিং শেষ করে ১৯৫৮ সাল তিনি পি এন এস মনোরাতে বদলি হন। ১৯৬২ সালে করাচীর মনোরাদ্বীপের হিমালয়াতে লিডিং সিম্যান সুলতান, স্টুয়ার্ড মুজিব ও সিম্যান নূর মুহাম্মদের নেতৃত্বে বাঙালী নাবিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ওয়েলফেয়ার এ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। যা পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তানে বিস্তৃতি লাভ করে। ধীরে ধীরে সংগঠনটির কর্মকাণ্ড সম্প্রসারিত হয়ে বাঙালীদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের দিকে ধাবিত হয়।[৩]

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সম্পাদনা

১৯৬৫ সালে স্টুয়ার্ড মুজিব তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন এবং বিমান, নৌ ও সেনাবাহিনীর বাঙালী সৈনিকদের গোপনে সশস্ত্র বিপ্লবে দীক্ষিত করে তোলেন এবং স্বাধিকার আন্দোলনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তৎপর হয়ে ওঠেন। ১৯৬৬ সালে কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন চট্টগ্রামে বদলি হয়ে আসেন। এতে তৎপরতা আরো জোরদার করার সুযোগ পান তিনি। ১৯৬৭ সালের জুন/জুলাই মাসে মামলার অন্যতম দুই অভিযুক্ত স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান আর আলি রেজা যে বিলোনিয়া দিয়ে ত্রিপুরায় এসে একজন ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা কর্ণেল মেননের [যাঁর আসল নাম কে শঙ্করণ নায়ার বলেই মনে করা হয়, যিনি ভারতের বর্হিদেশীয় গুপ্তচর সংস্থা রিসার্চ এন্ড এনালিসিস উইং এর দ্বিতীয় প্রধান হয়েছিলেন] সঙ্গে শালবাগানে দেখা করে ভারতের সাহায্য চেয়েছিলেন, সেটা অনেকেরই জানা তথ্য।[৫]

সে সময় শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গেও তাদের যোগাযোগ স্থাপিত হয়। কিন্তু এ গোপন পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে গেলে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী ১৯৬৮ সালের ১৮ জুন শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ বাঙালীকে আসামি করে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের এবং তাদের গ্রেফতার করে। মামলাটি ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে পরিচিত ছিল। গণআন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার তাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।[৩] মামলা নিষ্পত্তির চার যুগ পর মামলার আসামী ক্যাপ্টেন এ. শওকত আলী ২০১১ সালে প্রকাশিত একটি স্বরচিত গ্রন্থে এ মামলাকে সত্য মামলা' বলে দাবী করেন।[৬]

স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পাদনা

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম লগ্নে স্টুয়ার্ড মুজিব খুলনায় প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন। ৪ এপ্রিল খুলনার গল্লামারী রেডিও সেন্টার আক্রমণের অন্যতম রূপকার ছিলেন তিনি। বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদে স্থাপিত মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। খুলনার গল্লামারী রেডিও সেন্টার দখল যুদ্ধের পর তিনি মাদারীপুরে চলে আসেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আরেক অন্যতম আসামি ক্যাপ্টেন শওকত আলী আগে থেকেই মাদারীপুরে অবস্থান করছিলেন এবং দুজনে পরামর্শ করে প্রথমত নাজিমউদ্দিন কলেজ মাঠে  মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করেন। ১৭ এপ্রিল শনিবার সকালে মাদারীপুরের প্রাথমিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১৬৫ ছাত্র-যুবককে সঙ্গে নিয়ে স্টুয়ার্ড মুজিব মুক্তিযুদ্ধের উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতের উদ্দেশে রওনা দেন।[৭][৮] এই দলটি ছিল ভারতে গমনকারী প্রথম দল। ভারতগামী মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার যোগাতে তিনি তার স্ত্রীর স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি করে দেন।[৩]

৯ নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত হাসনাবাদ ইউনিটের মূল উদ্যোক্তা পাকিস্তান নৌবাহিনীর দুর্ধর্ষ কমান্ডো লিডিং সিম্যান বেগ, সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের একজন সহযোগী কর্মকর্তা হিসেবে বিভিন্ন সামরিক অপারেশনে অংশ নিতেন। তার সঙ্গে আরো ছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি আলোড়ন সৃষ্টিকারী স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমান, ডুবুরি সোলতান আহমদ ও নূর মোহাম্মদ। এই দুজনও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি ছিলেন। তাদের শেষ অপারেশনে হাসনাবাদের সমুদ্রগামী রণতরী পলাশ ও পদ্মা ইউনিটটিকে মাদারবেইজ হিসেবে ব্যবহার করেছিল।[৯]

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ৯নং সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল ‘অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা’ বইয়ে স্টুয়ার্ড মুজিব সম্পর্কে বলেন,

"দায়িত্বশীল, নিষ্ঠাবান, তেজোদীপ্ত যুবক স্টুয়ার্ড মুজীব আমার ৯নং সেক্টরের অধীনে এবং পরে ৮নং সেক্টরে যুদ্ধ করেছে। তার মত নির্ভেজাল ত্বরিতকর্মা একজন দেশপ্রেমিক যোদ্ধা সত্যিই বিরব। প্রচন্ড সাহস ও বীরত্বের অধিকারী স্টুয়ার্ড মুজিব ছিল শেখ মুজীবের অত্যন্ত প্রিয় অন্ধভক্ত। মাদারীপুর অধিবাসী মুজিবকে দেখেছি বিদ্যুতের মতই এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছুটোছুটি করতে। কি করে মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করা যায়, ভারতের কোন নেতার সাথে যোগাযোগ করলে মুক্তিযুদ্ধের রসদ লাভ করা যায় কেবল সেই চিন্তা এবং কর্মেই অস্থির দেখেছি স্টুয়ার্ড মুজিবকে।"[১০]

ব্যক্তিগত জীবন সম্পাদনা

আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে স্টুয়ার্ড মুজিব ১৯৬৯ সালে বর্তমান শরীয়তপুর জেলার আঙ্গারিয়ার রুদ্রকর গ্রামের জনাব হাসমত আলীর মেয়ে সুলতানা রহমানকে বিয়ে করেন। বিবাহিত জীবনে তিনি এক ছেলে সন্তানের বাবা। তার ছেলে টিপু সুলতান বর্তমানে মাদারীপুরে বসবাস করছেন।[৩]

মৃত্যু সম্পাদনা

বীর মুক্তিযোদ্ধা স্টুয়ার্ড মুজিবের অজানা বহুকথা ইতিহাসের অন্তরালে রয়ে গেছে। কষ্টার্জিত স্বাধীনতার সুবাতাসে তিনি একটি মাসও প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে পারেননি। ১৯৭২ সালের ৫ ই জানুয়ারি এম এ জি ওসমানি সাহেব ও হাইপ্রফাইল ব্যক্তিবর্গের সাথে দেখা করার জন্য সকাল ৯/১০ টার দিকে রিক্সাযোগে লতিফ উকিলকে সাথে নিয়ে রিক্সাযোগে সচিবালয়ের দিকে যাচ্ছিলেন, প্রেসক্লাবের সামনে রিক্সার গতি রোধ করে একটি সাদা প্রাইভেট কার থেকে ২ জন যুবক নেমে স্টুয়ার্ড মুজিব এর সাথে হ্যান্ডশেক করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। তিনি আর ফিরে আসেননি।[৩] এভাবে হারিয়ে যায় বাংলার আর একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র।

স্বীকৃতি সম্পাদনা

স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান এর নামে মাদারীপুরে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে।

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Nobel (২০১৭-০১-০৮)। "সার্জেন্ট জহুরুল হকের বিরুদ্ধে ফর্মাল চার্জশিট"যুদ্ধদলিল (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৭-১৯ 
  2. "অন্তহীন শোকের উচ্চারণ"চ্যানেল আই অনলাইন (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৬-০৮-৩০। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৭-১৯ 
  3. "মুক্তিযুদ্ধের অজানা কাহিনী || টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া"জনকন্ঠ (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৭-১৯ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  4. "স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের আওয়ামী শ্লোগান -জাহাঙ্গীর আলম আনসারী"The Daily Sangram। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৭-১৯ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  5. বাংলা, অমিতাভ ভট্টশালী বিবিসি; কলকাতা। "শেখ মুজিবুর রহমান কবে গিয়েছিলেন আগরতলায়?"BBC News বাংলা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৭-১৯ 
  6. প্রথম আলো
  7. মাহমুদ, লিখন (১০ ডিসেম্বর ২০১২)। মাদারিপুর ইতিবৃত্ত। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র মাদারিপুর। পৃষ্ঠা ১৫। আইএসবিএন 978-984-35-3208-4 
  8. "১৭ এপ্রিল, ১৯৭১ঃ বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ"albd.org (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৭-১৯ 
  9. "স্বাধীনতাযুদ্ধে রণতরী পলাশ ও পদ্মার অবদান | কালের কণ্ঠ"Kalerkantho। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৭-১৯ 
  10. "টুডে ব্লগঃ নিখুজের রহস্য এখনো অজানা কেন ?"A complete online magazine। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৭-১৯ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা