সূরা ক্বদর

কুরআন শরীফের ৯৭তম সূরা

সূরা আল-কদর (বা ক্বদর) (আরবি: سورة القدر) মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ কুরআনের ৯৭ তম সূরা, এর আয়াত সংখ্যা ৫ টি এবং এর রূকুর সংখ্যা ১। আল ক্বদর সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে।[১] কদরের এর অর্থ মাহাত্ম্য ও সম্মান। এর মাহাত্ম্য ও সম্মানের কারণে একে "লায়লাতুল-কদর" তথা মহিম্মান্বিত রাত বলা হয়। আবু বকর ওয়াররাক বলেনঃ এ রাত্রিকে লায়লাতুল-কদর বলার কারণ এই যে, আমল না করার কারণে এর পূর্বে যার কোন সম্মান ও মূল্য মহিমান্বিত থাকে না, সে এ রাত্রিতে তওবা-এস্তেগফার ও এবাদতের মাধ্যমে সম্মানিতও হয়ে যায়।

আল ক্বদর
শ্রেণীমাক্কী সূরা
পরিসংখ্যান
সূরার ক্রম৯৭
আয়াতের সংখ্যা
রুকুর সংখ্যা
← পূর্ববর্তী সূরাসূরা আলাক্ব
পরবর্তী সূরা →সূরা বাইয়্যিনাহ
আরবি পাঠ্য · বাংলা অনুবাদ

ঐতিহাসিক পটভূমি সম্পাদনা

হযরত আবু যর গেফারী বর্ণিত রেওয়ায়েতে রসূলুল্লাহ্‌ (সঃ) বলেনঃ ইবরাহীম-এর সহীফাসমূহ ৩রা রমযানে, তাওরাত ৬ই রমযানে, ইঞ্জিল ১৩ই রমযানে এবং যাবুর ১৮ই রমযানে অবতীর্ণ হয়েছে। কোরআন পাক শেষ দশের বিজোড় যেকোনো এক রমযানুল-মোবারকে নাযিল হয়েছে।[২] হাদীসে আছে, শবে-কদরে জিবরাঈল ফেরেশতাদের বিরাট এক দল নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং যত নারী-পুরুষ নামায অথবা যিকরে মশগুল থাকে, তাদের জন্যে রহমতের দোয়া করেন। ফেরেশতাগণ শবে-কদরে সারা বছরের অবধারিত ঘটনাবলী নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করে। কোন কোন তফসীরবিদ একে "সালাম্মুন" এর সাথে সম্পর্কযুক্ত করে এ অর্থ করেছেন যে, এ রাত্রিটি যাবতীয় অনিষ্ট ও বিপদাপদ থেকে শান্তিস্বরূপ।[৩] শবে-কদরের এই বরকত রাত্রির কোন বিশেষ অংশে সীমিত নয়; বরং ফজরের উদয় পর্যন্ত বিস্তৃত।

নাযিল হওয়ার সময় ও স্থান সম্পাদনা

এর মক্কী বা মাদানী হবার ব্যাপারে দ্বিমত রয়ে গেছে। আবু হাইয়ান বাহরুল মুহীত গ্রন্থে দাবী করেছেন , অধিকাংশ আলেমের মতে এটা মাদানী সূরা । আলী ইবনে আহমাদুল ওয়াহেদী তাঁর তাফসীরে বলেছেন , এটি মদীনায় নাযিলকৃত প্রথম সূরা। অন্যদিকে আল মাওয়ারদী বলেন , অধিকাংশ আলেমের মতে এটি মক্কী সূরা । ইমাম সুয়ূতী ইতকান গ্রন্থে একথাই লিখেছেন। ইবনে মারদুইয়া ইবনে আব্বাস (রা) , ইবনে যুবাইর ( রা) ও হযরত আয়েশা ( রা) থেকে এ উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে , সূরাটি মক্কায় নাযিল হয়েছিল। সূরার বিষয়বস্তু পর্যালোচনা করলেও একথাই প্রতীয়মান হয় যে , এর মক্কায় নাযিল হওয়াটাই যুক্তিযুক্ত।

শানে নুযূল সম্পাদনা

ইমাম তিরমিযী (রহঃ) বলেন, ইউসুফ বিন সাদ কর্তৃক বর্ণিত, ইমাম হাসান (রদিয়াল্লাহু আনহু) মুআবিয়া (রঃ)- এর নিকট বাইআতের সময় জনৈক ব্যক্তি দাড়িয়ে ইমাম হাসান (রাঃ) - কে বলল, 'আপনি মুসলমানদের লজ্জিত করলেন'। তিনি বললেন, আল্লাহ তােমার উপর রহম করুন। আমাকে খারাপ বলাে না। কারণ নবী (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এক রাতে বনূ উমাইয়াকে মিম্বরের উপর দেখে বিহবলিত হয়ে পড়েছিলেন। সে সময়- সুরা কদর এবং সুরা কাউসার অবতীর্ণ হয়। "আমি সম্মনিত রাতে কুরআনকে নাযিল করলাম। আর আপনি কি জানেন সম্মানিত রাত কি ? সম্মানিত রাত মানে হাজার মাসের চেয়েও উত্তম রজনী।" আপনার ইন্তেকালের পর হে হাবীব (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) ! বনূ উমাইয়া হাজার মাসের মালিক হবে !

কাসেম বলেন, আমি হিসাব করেছি আমির মুআবিয়ার বাইআত থেকে হাজার মাস তাদের রাজত্ব ছিল, একটুকুও কম-বেশি হয়নি।

#তারিখুল_খোলাফা

উচ্চারণ ও অর্থ সম্পাদনা

আয়াত [টী ১] উচ্চারণ অর্থ[৪]
○إِنَّآ أَنزَلْنَٰهُ فِى لَيْلَةِ ٱلْقَدْرِ ইন্নাআনঝালনা-হু ফী লাইলাতিল কাদর। নিঃসন্দেহ আমি এটি অবতারণ করেছি মহিমান্বিত রজনীতে।
○وَمَآ أَدْرَىٰكَ مَا لَيْلَةُ ٱلْقَدْرِ ওয়ামাআদরা-কা-মা-লাইলাতুল কাদর। শবে-কদর (মহিমান্বিত রাত) সমন্ধে আপনি কি জানেন?
○لَيْلَةُ ٱلْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ লাইলাতুল কাদরি খাইরুম মিন আলফি শাহর। শবে-কদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
○تَنَزَّلُ ٱلْمَلَٰٓئِكَةُ وَٱلرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمْرٍ তানাঝঝালুল মালাইকাতুওয়াররুহু ফীহা-বিইযনি রাব্বিহিম মিন কুল্লি আমর। এতে প্রত্যেক কাজের জন্যে ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে।
○سَلَٰمٌ هِىَ حَتَّىٰ مَطْلَعِ ٱلْفَجْرِ ছালা-মুন হিয়া হাত্তা-মাতলা‘ইল ফাজর। এটা নিরাপত্তা, যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।

বিষয়বস্তুর বিবরণ সম্পাদনা

(১) এখানে বলা হয়েছে, আমি কদরের রাতে কোরআন নাযিল করেছি আবার সূরা বাকারায় বলা হয়েছে,

এ থেকে জানা যায়, রসূলুল্লাহ্‌ কাছে হেরা গূহায় যে রাতে আল্লাহর ফেরেশতা অহী নিয়ে এসেছিলেন সেটি রমযান মাসের একটি রাত। এই রাতকে এখানে কদরের রাত বলা হয়েছে। সূরা আদ-দোখানে একে মুবারক রাত বলা হয়েছে। বলা হয়েছেঃ

এই রাতে কোরআন নাযিল করার দুটি অর্থ হতে পারে। প্রথম অর্থ হচ্ছে, এই রাতে সমগ্র কোরআন ওহীর ধারক ফেরেশতাদেরকে দিয়ে দেয়া হয়। অতপর অবস্থা ও ঘটনাবলী অনুযায়ী তেইশ বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে জিবরাঈল আল্লাহর হুকুমে তার আয়াত ও সূরাগুলি রসূলুল্লাহ্‌ -এর ওপর নাযিল করতে থাকেন। ইবনে আব্বাস এ অর্থটি বর্ণনা করেছেন। দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, এই রাত থেকেই কোরআন নাযিলের সূচনা হয়। এটি ইমাম শা'বীর উক্তি। এটি একটি অভ্রান্ত সত্য, রসূলুল্লাহ্‌ -এর এবং তঁর ইসলামী দাওয়াতের জন্য কোনো ঘটনা বা ব্যাপারে সঠিক নির্দেশ লাভের প্রয়োজন দেখা দিলে তখনই আল্লাহ কোরআনের সূরা ও আয়াতগুলি রচনা করতেন না। বরং সমগ্র বিশ্ব জাহানের সৃষ্টির পূর্বে অনাদিকালে মহান আল্লাহ পৃথিবতে মানব জাতির সৃষ্টি, তাদের মধ্যে নবী প্রেরণ, নবীদের ওপর কিতাব নাযিল, সব নবীর পরে রসূলুল্লাহ্‌ -কে পাঠানো এবং তার প্রতি কোরআন নাযিল করার সমস্ত পরিকল্পনা তৈরি করে রেখেছিলেন। কদরের রাতে কেবলমাত্র এই পরিকল্পনার শেষ অংশের বাস্তবায়ন শুরু হয়।

কোনো কোনো তাফসীরকার কদরকে তকদীর অর্থে গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ এই রাতে আল্লাহ তকদীরের ফায়সালা জারী করার জন্য তা ফেরেশতাদের হাতে তুলে দেন। সূরা দুখানের এ আয়াতটি এই বক্তব্য সমর্থন করেঃ

অন্যদিকে ইমাম যুহরী বলেন, কদর অর্থ হচ্ছে শ্রেষ্টত্ব ও মর্যাদা। অর্থাৎ এটি অত্যন্ত মর্যাদাশালী রাত। এই অর্থ সমর্থন করে এই সূরার এ আয়াতটি

এ ব্যাপারে ব্যাপক মতবিরোধ দেখা যায়। এ সম্পর্কে প্রায় ৪০টি মতের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে আলেম সমাজের সংখ্যাগুরু অংশের মতে রমযানের শেষ দশ তারিখের কোনো একটি বেজোড় রাত হচ্ছে এই কদরের রাত। আবার তাদের মধ্যেও বেশীরভাগ লোকের মত হচ্ছে সেটি সাতাশ তারিখের রাত। হযরত আবু হুরাইরা বর্ণনা করেছেন, রসূলুল্লাহ্‌ লাইলাতুল কদর সম্পর্কে বলেনঃ সেটি সাতাশের বা উনত্রিশের রাত (আবু দাউদ)। হযরত আয়েশা বর্ণনা করেছেন, রসূলুল্লাহ্‌ বলেনঃ কদরের রাতকে রমযানের শেষ দশ রাতের বেজোড় রাতগুলির মধ্যে তালাশ করো।[৫]

(২) মুফাস্‌সিরগণ সাধারণভাবে এর অর্থ করেছেন, এ রাতের সৎ কাজ হাজার মাসের সৎ কাজের চেয়ে ভালো। রসূলুল্লাহ্‌ এই রাতের আমলের বিপুল ফযীলত বর্ণনা করেছেন। কাজেই বুখারী ও মুসলীমে হযরত আবু হুরাইরা বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, রসূলুল্লাহ্‌ বলেছেনঃ

মুসনাদে আহমদে হযরত উবাদাহ ইবনে সামেত বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, রসূলুল্লাহ্‌ বলেছেনঃ

এই একটি রাতে এত বড় নেকী ও কল্যাণের কাজ হয়েছে যা মানবতার সূদীর্ঘ ইতিহাসে কোনো দীর্ঘতম কালেও হয়নি।

(৩) রুহ বলতে জিবরাঈল -কে বুঝানো হয়েছে। তার শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার কারণে সমস্ত ফেরেশতা থেকে আলাদা করে তার উল্লেখ করা হয়েছে।

(৪) অর্থাৎ তারা নিজেদের তরফ থেকে আসে না। বরং তাদের রবের অনুমতিক্রমে আসে। আর প্রত্যেকটি হুকুম বলতে সূরা দুখানের ৫ আয়াত "আমরে হাকীম" (বিজ্ঞতাপূর্ণ কাজ) বলতে যা বুঝানো হয়েছে এখানে তার কথাই বলা হয়েছে।

(৫) অর্থাৎ সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত সারাটা রাত শুধু কল্যাণে পরিপূর্ণ। সেখানে ফিতনা, দুস্কৃতি ও অনিষ্টকারিতার ছিঁটেফোটাও নেই।

সারসংক্ষেপ সম্পাদনা

  • সুরাটির ১ নং আয়াতে তথ্য অনুযায়ী জানা যায় আল কদরের রাতে ইসলামের নবি মুহাম্মদ (দঃ) - এর প্রতি তার ধর্মীয় ঐশী গ্রন্থ কুরআন অবতীর্ণ হয় ।
  • ২ থেকে ৫ নং আয়াত (শেষ পর্যন্ত) আল কদরের রাত্রির মর্যাদা-মহিমা বর্ণিত ও প্রশংসিত হয়েছে ।[৬]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Quran Verses in Chronological Order
  2. তাফসিরে মাযহারী, কাজী সানাউল্লাহ পানিপতি
  3. ইবনে-কাসীর, মাযহারী
  4. "আয়াত সূমহের অর্থ 'ক্বুরআন' এ্যাপ থেকে নেওয়া হয়েছে"। ১৭ মে ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ জুন ২০২০ 
  5. বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, আহমদ এবং তিরমিযী
  6. Wherry, Elwood Morris (১৮৯৬)। A Complete Index to Sale's Text, Preliminary Discourse, and Notes। London: Kegan Paul, Trench, Trubner, and Co।    এই উৎস থেকে এই নিবন্ধে লেখা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা পাবলিক ডোমেইনে রয়েছে।

পাদটীকা সম্পাদনা

  1. আয়াত সূমহ আরবি Uthmanic 2 (Madina) ফ্রন্টে লেখা হয়েছে, যেখানে আরবির সাকিন চিহ্ন কিছুটা গোলাকৃতির।

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা