ময়মনসিংহীয় উপভাষা
ময়মনসিংহীয় উপভাষা বা ময়মনসিংহীয় বাংলা হলো বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল-এর একটি প্রধান বাংলা উপভাষা। এটি বাংলা ভাষার উপভাষাসমূহের মধ্যে অন্যতম। এই উপভাষায় প্রধানত বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের বাঙালিরা কথা বলে।[১] ময়মনসিংহীয় বাংলা মূলত বাংলা ভাষার বঙ্গালী উপভাষার অন্তর্গত একটি কথ্য উপভাষা।[২]
ময়মনসিংহীয় উপভাষা | |
---|---|
মোমেনসিঙ্গা বাংলা মমিসিঙ্গা বাংলা | |
দেশোদ্ভব | বাংলাদেশ, ভারত |
অঞ্চল | ময়মনসিংহ বিভাগ, ঢাকা বিভাগ, সিলেট বিভাগ, মেঘালয় ও অসম |
জাতি | বাঙালি জাতি |
মাতৃভাষী | |
ইন্দো-ইউরোপীয়
| |
বাংলা লিপি | |
ভাষা কোডসমূহ | |
আইএসও ৬৩৯-৩ | – |
বিস্তার
সম্পাদনাবাংলাদেশের ময়মনসিংহ বিভাগ এর প্রায় সকল জেলাতেই এই উপভাষাটি প্রচলিত। ময়মনসিংহ বিভাগের বাইরে ঢাকা বিভাগের কিশোরগঞ্জ ও টাংগাইল জেলার স্থানীয় অনেক অধিবাসীদের প্রধান কথ্য উপভাষা এটি। এছাড়াও পার্শ্ববর্তী গাজীপুর ও সুনামগঞ্জ কিছু অঞ্চলের মানুষও এ উপভাষায় কথা বলে।
বৈশিষ্ট্য
সম্পাদনা- শব্দতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য:-
- অন্যসকল বঙ্গালী উপভাষার মতই “চ” ও “ছ” ধ্বনির উচ্চারণ ইংরেজি "S" (আ-ধ্ব-ব:/s/), ”জ”, “ঝ” ও “য” ধ্বনির উচ্চারণ ইংরেজি "Z" (আ-ধ্ব-ব:/z/) এবং “প”, “ফ” ধ্বনির উচ্চারণ ইংরেজি "F" (আ-ধ্ব-ব:/f/) এ পরিবর্তিত হয়ে যায়।
- “ই”, “উ” স্বরধ্বনির অপিনিহিত ব্যবহার লক্ষ্যণীয়; যথা- "রাইক্যা" (রেখে), কইরা (করে), "আজকা" (আজকে)।
- “এ” এর উচ্চারণ একই হয়; যথা- ”খেলা” (খেলা), “দেশ” (দেশ)।
- “ও” ধ্বনির উচ্চারণ “উ” ধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়; যথা- “দুয়া” (দোয়া), “লুক” (লোক)।
- কখনো কখনো অনুনাসিক স্বরধ্বনিতে অর্ধ-অনুনাসিকের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়; যথা- "চান্দ্" (চাঁদ), "আন্ধাইর" (আঁধার)।
- মহাপ্রাণ ঘোষ ধ্বনি অল্পপ্রাণ ঘোষ ধ্বনিতে পরিবর্তন হয়; যথা- “দুদ” (দুধ), “বাত” (ভাত), “মেগ” (মেঘ)।
- পদের আদ্যক্ষর “শ”, “ষ” ও “স” ধ্বনি “হ” ধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়ে যায়; যথা- “হাপ” (সাপ), “হামুক” (শামুক), “হালা” (শালা), “হালিক” (শালিক)।
- পদের শেষে "ট" ধ্বনির উচ্চারণ "ড" তে পরিবর্তিত হয়; যথা- “এইডা” (এটা), ”বেডা” (বেটা)।
- রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য-
- কর্মসম্পাদনের একবচনে “রে” বিভক্তি বসে; যথা- “হেরে কও” (তাকে বল)।
- ভবিষ্যৎ কালে উত্তম পুরুষের ক্রিয়াপদে “রাম” বিভক্তি বসে; যথা- করাম, খায়াম, যায়াম, মারাম, ইত্যাদি।
প্রমিত বাংলার সাথে পার্থক্য
সম্পাদনানিম্নে প্রমিত বাংলা ও ময়মনসিংহীয় বাংলার মধ্যে কিছু রূপতাত্ত্বিক পার্থক্য উপস্থাপন করা হলো:-
প্রমিত বাংলা | ময়মনসিংহীয় বাংলা | আধ্বব |
---|---|---|
খাবো | খায়াম | /'khayam/ |
সাথে, সঙ্গে | লগে | /lɔge/ |
সে | হে | /ɦɛ/ |
টাকা | টেহা | /'ʈɛɦa/ |
ঢাকা | ডাহা | /'ɖaɦa/ |
ভালো | বালা | /'bala/ |
ব্যাথা/বেদনা | ব্যাদনা | /'bæd̪na/ |
ঔষধ/ওষুধ | ওষুদ | /oʃud̪/ |
লোক | বেডা, লুক | /'bɛɖa/,/lʊk/ |
ছেলে/পুত্র | পুত | /fu̞t̪/ |
ঝাড়ু/ঝাটা | হাসুন, ঝাডা | /'ɦasun/, /jada/ |
প্রমিত বাংলা উচ্চারণের বাংলা বারো মাসের নাম ময়মনসিংহীয় বাংলাতে-
প্রমিত বাংলা | ময়মনসিংহীয় বাংলা |
---|---|
বৈশাখ | বৈশাগ, বৈশাক |
জৈষ্ঠ্য | জেড, জৈষ্ট |
আষাঢ় | আষার |
শ্রাবণ | শাওন |
ভাদ্র | ভাদর, ভাদ্দর |
আশ্বিন | আশিন |
কার্তিক | কাত্তিক, কাতি |
অগ্রহায়ণ | আগুণ |
পৌষ | পুষ |
মাঘ | মাগ |
ফাল্গুন | ফালগুণ |
চৈত্র | সৈত |
অনুচ্ছেদ রূপান্তর
সম্পাদনানিম্নে একটি অনুচ্ছেদকে প্রমিত বাংলা ও ময়মনসিংহীয় বাংলায় উল্লেখ করা হলোঃ
- প্রমিত বাংলা: বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি রাষ্ট্র। দেশটির উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম সীমানায় ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব সীমানায় মিয়ানমার; দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। সাবেক “বঙ্গ” বা “বাংলা” নামক ভূখণ্ডের পূর্ব অংশ যেটা পূর্ব বাংলা নামে পরিচিত ছিল সেটা বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্র। সুপ্রাচীন কালে বাংলাদেশে প্রথম মানব বসতি গড়ে উঠে। পর্যায়ক্রমে হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিম শাসনের পর বাংলা ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত হয়।
- ময়মনসিংহীয় বাংলা: বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটা রাষ্ট। দেশটার উত্তর, পুব আর পচ্চিম সীমানাদে ভারত আর দক্ষিণ-ফুব সীমানাদে মিয়ানমার; দক্ষিণো বঙ্গোপসাগর। আগের “বঙ্গ” বা “বাংলা” নামের দেশের পুবহানি যেইডা পুব বাংলা নামে মাইনষে জানতো এইডা অহন বাংলাদেশ রাষ্ট। অনেক আগিলা আমলো বাংলাদেশো পতম মাইনষের বসতি অসিন। লাগালাগাই হিন্দু, বৌদ্ধ আর মুসলিম শাসনের পরেরে বাংলা ব্রিটিশ উপনিবেশ অইয়া গেসিন।
- প্রমিত বাংলা: আমার বড় ভাইয়ের বিয়ের জন্যে মেয়ে দেখতে গেছে।
- ময়মনসিংহীয় বাংলা: আমার বড় বাইয়ের বিয়ার লেইগ্যা ছেরি দেখবার গেছে।
আরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "ভাষা আন্দোলন ও ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষা"। ত্রিশাল প্রতিদিন। ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০। সংগ্রহের তারিখ ২৫ অক্টোবর ২০২৪।
- ↑ বাংলা ভাষা ও উপভাষা, সুকুমার সেন, আনন্দ পাবলিশার্স [Bangla language and dialect, Sukumar Sen, Anand Publishers]।