মনোরমা বসু, মাসিমা (বিবাহের পূর্বে মনোরমা রায়) (১৮ নভেম্বর, ১৮৯৭ - ১৬ অক্টোবর,১৯৮৬) ছিলেন অবিভক্ত বাংলার একজন দেশপ্রেমী সমাজসেবক ও স্বদেশী আন্দোলন ও সাম্যবাদী আন্দোলনের লড়াকু নেত্রী। বরিশাল জেলার বিভিন্ন নারীমুক্তি আন্দোলনে, সমাজসেবায় ও মানুষের প্রতি ভালোবাসার কারণে দলমত নির্বিশেষে কমরেড মনোরমা বসু মাসিমা নামে পরিচিত ছিলেন।[১]

মনোরমা বসু
জন্ম
মনোরমা রায়

(১৮৯৭-১১-১৮)১৮ নভেম্বর ১৮৯৭
মৃত্যু১৬ অক্টোবর ১৯৮৬(1986-10-16) (বয়স ৮৮)
দাম্পত্য সঙ্গীচিন্তাহরণ বসু (বি.১৯১১,মৃ.১৯৫৪)
সন্তান৪ কন্যা, ১ পুত্র
পিতা-মাতানীলকণ্ঠ রায় (পিতা)
প্রমোদ সুন্দরী রায় (মাতা)

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন সম্পাদনা

মনোরমা রায়ের জন্ম ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১৮ নভেম্বর (১৩০৪ বঙ্গাব্দের ১ অগ্রহায়ণ) বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অবিভক্ত বাংলার অধুনা বরিশাল জেলার বানারীপাড়া উপজেলার নরোত্তমপুর গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সমর্থক নীলকণ্ঠ রায় ও প্রমোদ সুন্দরী রায়ের পঞ্চম সন্তান ছিলেন তিনি।[২] আশৈশব দারিদ্র্যের মধ্যে কাটানোয় এবং বাল্য বয়সে পিতার মৃত্যুর জন্য তিনি জীবনে লেখাপড়ার সুযোগ পান নি। কিন্তু তার জন্মস্থানের পরিবেশ তাকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে।[৩] তার আট বৎসর বয়ক্রমে স্বদেশীদের 'বঙ্গভঙ্গ' রদের আন্দোলনে হাতে হলুদ রাখি বেঁধে স্বদেশী আন্দোলনে দীক্ষা নেন।[২] এগারো বৎসর বয়সে স্বদেশপ্রেমের মূর্তপ্রতীক ক্ষুদিরাম বসুর আত্মবলিদানে অনুপ্রাণিত হয়ে রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে চোদ্দ বৎসর বয়সে তার বিবাহ হয় বরিশালের বাঁকাই গ্রামের বিপত্নীক জমিদার চিন্তাহরণ বসুর সঙ্গে।[২]

রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্রিয়াকলাপ সম্পাদনা

প্রগতিবাদী স্বামীর সমর্থনে জমিদার বাড়ির বাধানিষেধ ও রক্ষণশীলতা মনোরমার রাজনৈতিক ও স্বদেশী আন্দোলনের ক্রিয়াকলাপে অন্তরায় হয়নি। ছেলেমেয়েদের উপযুক্ত শিক্ষা ও সুষ্ঠু মানসিক বিকাশের জন্য তিনি বরিশালে নিজের জন্য স্থায়ী আবাস গড়ে তোলেন। নিজের কাউনিয়ার বাড়িতে অনাথ দুস্থ মহিলা, বিশেষ করে বিধবা বা অবিবাহিত মায়েদের আশ্রয় দিতে মাতৃমন্দির নামে একটি আশ্রম স্থাপন করেন এবং[১] আজীবন আশ্রমটি তিনিই পরিচালনা করেন। ১৯২১-২২ খ্রিস্টাব্দে "চরকা ধরো, খদ্দর পরো" আন্দোলনে তিনি গ্রামে গ্রামে নারীদের চরকা কাটার কাজ শেখাতেন,[৩] তিনি নিজে সারাজীবন খদ্দরের তৈরি পোষাক পরেছেন।[১]

১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে মহাত্মা গান্ধী রাজনৈতিক প্রচার ও তহবিল সংগ্রহে বরিশালে এলে মনোরমা বসু স্বদেশী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং নিজের গহনা পর্যন্ত দান করে দেন।[২] ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দেই সরোজ নলিনী দত্তের মৃত্যুর পর গুরুসদয় দত্ত স্ত্রীর নামে সরোজ নলিনী মহিলা সমিতি গঠন করলে, মনোরমা বসুই বরিশালে নারী অধিকার রক্ষায় প্রথম শাখা প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই সমিতির মাধ্যমের নারী সমাজকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সংঘবদ্ধ করেন। তিরিশের দশকের প্রথমেই তিনি কংগ্রেসের মহিলা কর্মী হন। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে আইন অমান্য আন্দোলনে যে প্রথম তিনজন মহিলা আইন অমান্য করে কারাবরণ করেছিলেন, মনোরমা বসু ছিলেন তাদেরই একজন। বহরমপুর জেলেই তিনি চিত্তরঞ্জন দাশের ভগিনী ঊর্মিলা দেবীজ্যোতির্ময়ী দেবীর সান্নিধ্য লাভ করেন।[২] ব্রিটিশদের শৃঙ্খল থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করার বিভিন্ন সংগ্রামে অংশগ্রহণ করার সঙ্গে সমাজসেবা, মহিলাদের সংগঠিত করে তাদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার কাজে, তাদের অধিকার রক্ষায়, দুস্থ মানুষের অন্ন, বস্ত্র ও চিকিৎসা বন্দোবস্ত করা ইত্যাদিতে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। মহিলাদের অধিকার রক্ষায় বরিশালে গড়েন মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি, শিক্ষার জন্য আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়, পল্লিকল্যাণ অমৃত পাঠাগার, শিশুদের জন্য মুকুল মিলন খেলাঘর। এমনকি বিভিন্ন সময়ে কারাগারে বন্দি অবস্থাতেও সংগঠন গড়েছেন, বন্দিদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। চল্লিশের দশকের প্রথমেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যা হন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে তার 'মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি'র সূচনা পর্ব থেকে তিনি বরিশাল জেলা সমিতির অন্যতম নেত্রী হন। ১৯৪৩-৪৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় দুর্ভিক্ষের সময় তিনি ত্রাণের কাজে লঙ্গরখানা, চিকিৎসালয়, উদ্ধার আশ্রম প্রভৃতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতার পর কলকাতায় কমিউনিস্ট পার্টির মিটিং-এ আঞ্চলিক কমিটি গড়ে স্থানীয় কমরেডদের সেখানে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে, তিনি পার্টির কাজে পূর্ব পাকিস্তান বেছে নেন এবং বরিশালেই থেকে যান। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে বিভিন্ন সময়ের পুত্রকন্যাসহ তিনি ব্রিটিশ ও পাকিস্তান সরকারের শাসনে কারারুদ্ধ হয়ছেন।[৪] পাকিস্তানের শাসকদের শাসন ও শোষণে জনজীবন বিপর্যস্ত হলে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে সারা পাকিস্তানের দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতির প্রতিকারে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসে খাদ্য আন্দোলনের মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে তাকে একবছরের সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। মুক্তির দিনই আবার জননিরাপত্তা আইনে বন্দি হয়ে আরও তিন বছর কারাভোগের পর ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২৫ এপ্রিল মুক্তি পান। তবে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ মে স্বামীর মৃত্যুর পর কিছুদিন বিরত থেকে তিনি পুনরায় নিজের কর্মকাণ্ড শুরু করেন। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে রাজনৈতিক অস্থিরতার সয়ম কিছুদিন আত্মগোগনে থাকেন। পরে মাতৃমন্দিরের কাজে ব্যস্ত থাকেন। সাম্যবাদে দীক্ষিত মনোরমা বসু সামাজিক ও রাজনৈতিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। ১৯৬২ ও ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে গণ আন্দোলন বা ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের গণঅভ্যুত্থানে তিনি মহিলাদের সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সহ-সভানেত্রী ছিলেন।[১]

পুরস্কার সম্পাদনা

বাংলাদেশে নারীর অধিকার রক্ষায় অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য নানা মরণোত্তর সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন তিনি। লাভ করেছেন 'শের-ই বাংলা পদক' ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে এবং বাংলাদেশ সরকারের বেগম রোকেয়া পদকে ভূষিত হয়েছেন ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে। এছাড়াও বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশের মহিলা পরিষদও মরণোত্তর সম্মাননা প্রদান করে।[২]

জীবনাবসান সম্পাদনা

বাংলার নারী জাগরণের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব মনোরমা বসু ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দ থেকেই নানা অসুস্থতায় পীড়িত ছিলেন। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ অক্টোবর বরিশালের কাউনিয়ায় তার প্রতিষ্ঠিত মাতৃমন্দিরে প্রয়াত হন। তিনি চার কন্যা ও এক পুত্রের জননী ছিলেন। মৃত্যুর পর তার যাবতীয় সম্পত্তি নিয়ে ২০০১ খ্রিস্টাব্দে "মনোরমা বসু মাসিমা স্মৃতি ট্রাস্ট" গঠন করা হয়েছে।[২]

তার মৃত্যুর পর বরিশালের মাতৃমন্দির সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। মনোরমা বসুর জীবদ্দশাতেই ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে প্রখ্যাত সাহিত্যিক সাংবাদিক সত্যেন সেন রচনা করেন মনোরমা মাসিমা গ্রন্থটি।[৩]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, দ্বিতীয় খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৯ পৃষ্ঠা ৩০১, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-২৯২-৬
  2. "প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি মনোরমা বসু 'মাসীমা'"। ২০২২-১০-১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১০-১৮ 
  3. "মনোরমা বসু লাল সেলাম"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১০-১৮ 
  4. "28th death anniversary of Manorama Basu Masima"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১০-১৯