ক্ষুদিরাম বসু

ব্রিটিশ ভারতীয় বাঙালি বিপ্লবী

ক্ষুদিরাম বসু (৩ ডিসেম্বর ১৮৮৯ — ১১ আগস্ট ১৯০৮) ছিলেন একজন ভারতীয়-বাঙালি বিপ্লবী যিনি ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করেছিলেন।

ক্ষুদিরাম বসু
ক্ষুদিরাম বসু
জন্ম(১৮৮৯-১২-০৩)৩ ডিসেম্বর ১৮৮৯
মৃত্যু১১ আগস্ট ১৯০৮(1908-08-11) (বয়স ১৮)
মৃত্যুর কারণফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর
জাতীয়তাভারতীয়
নাগরিকত্ব ব্রিটিশ ভারত (১৯৪৭ সাল পর্যন্ত)
পেশারাজনীতিবিদ
পরিচিতির কারণব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী
রাজনৈতিক দলঅনুশীলন সমিতি
আন্দোলনব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন,
পিতা-মাতা
  • ত্রৈলোক্যনাথ বসু (পিতা)
  • লক্ষ্মীপ্রিয় দেবী (মাতা)

ক্ষুদিরাম প্রফুল্ল চাকির সঙ্গে মিলে গাড়িতে ব্রিটিশ বিচারক, ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড আছেন ভেবে তাকে গুপ্তহত্যা করার জন্যে বোমা ছুঁড়েছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড অন্য একটা গাড়িতে বসেছিলেন, যে ঘটনার ফলে দুজন ব্রিটিশ মহিলার মৃত্যু হয়, যারা ছিলেন মিসেস কেনেডি ও তার কন্যা। প্রফুল্ল চাকি গ্রেপ্তারের আগেই আত্মহত্যা করেন। ক্ষুদিরাম গ্রেপ্তার হন। দুজন মহিলাকে হত্যা করার জন্যে তার বিচার হয় এবং চূড়ান্তভাবে তার ফাঁসির আদেশ হয়।[১]

ফাঁসি হওয়ার সময় ক্ষুদিরামের বয়স ছিল ১৮ বছর, ৭ মাস এবং ১১ দিন, যেটা তাকে ভারতের কনিষ্ঠতম ভারতের বিপ্লবী অভিধায় অভিষিক্ত করেছিল।[২] বাল গঙ্গাধর তিলক, তার সংবাদপত্র কেশরীতে দুজন নবীন যুবককে সমর্থন করে আওয়াজ তোলেন অবিলম্বে স্বরাজ চাই। যার ফল হয় অবিলম্বে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার দেশদ্রোহিতার অপরাধে তিলককে গ্রেপ্তার করে।[৩]

প্রারম্ভিক জীবন সম্পাদনা

ক্ষুদিরাম বসু ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত মেদিনীপুর শহরের কাছাকাছি (বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা) কেশপুর থানার অন্তর্গত মৌবনী (হাবিবপুর) গ্রামের একটি বাঙালি কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।[৪] তার পিতা ত্রৈলোক্যনাথ বসু ছিলেন নাড়াজোলের তহসিলদার।[৫][৬] তার মার নাম লক্ষ্মীপ্রিয় দেবী। তিন কন্যার পর তিনি তার মায়ের চতুর্থ সন্তান। তার দুই পুত্র অকালে মৃত্যুবরণ করেন। অপর পুত্রের মৃত্যুর আশঙ্কায় তিনি তখনকার সমাজের নিয়ম অনুযায়ী তার পুত্রকে তার বড়ো দিদির কাছে তিন মুঠো খুদের (চালের খুদ) বিনিময়ে বিক্রি করে দেন। খুদের বিনিময়ে কেনা হয়েছিল বলে শিশুটির নাম পরবর্তীকালে ক্ষুদিরাম রাখা হয়।[৭] ক্ষুদিরামের বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর তখন তিনি তার মাকে হারান। এক বছর পর তার পিতার মৃত্যু হয়। তখন তার বড়ো দিদি অপরূপা তাকে দাসপুর থানার এক গ্রামে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। অপরূপার স্বামী অমৃতলাল রায় ক্ষুদিরামকে তমলুকের হ্যামিল্টন হাই স্কুলএ ভর্তি করে দেন।[৬]

১৯০২ এবং ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে শ্রী অরবিন্দ এবং ভগিনী নিবেদিতা মেদিনীপুর ভ্রমণ করেন। তারা স্বাধীনতার জন্যে জনসমক্ষে ধারাবাহিক বক্তব্য রাখেন এবং বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে গোপন অধিবেশন করেন, তখন কিশোর ছাত্র ক্ষুদিরাম এই সমস্ত বিপ্লবী আলোচনায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। স্পষ্টভাবেই তিনি অনুশীলন সমিতিতে যোগদান করেন এবং কলকাতায় বারীন্দ্র কুমার ঘোষের কর্মতৎপরতার সংস্পর্শে আসেন। তিনি ১৫ বছর বয়সেই অনুশীলন সমিতির একজন স্বেচ্ছাসেবী হয়ে ওঠেন এবং ভারতে ব্রিটিশ শাসন বিরোধী পুস্তিকা বিতরণের অপরাধে গ্রেপ্তার হন।[৮] ১৬ বছর বয়সে ক্ষুদিরাম থানার কাছে বোমা মজুত করতে থাকেন এবং সরকারি আধিকারিকদেরকে আক্রমণের লক্ষ্য স্থির করেন। [৯]

১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে ক্ষুদিরাম তার বোন অপরূপার স্বামী অমৃতলাল রায়ের সঙ্গে তমলুক শহর থেকে মেদিনীপুরে চলে আসেন।

শিক্ষাজীবন সম্পাদনা

ক্ষুদিরাম বসু তমলুকের হ্যামিল্টন স্কুল এবং মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে শিক্ষালাভ করেন।[১০] বাল্যকালে তার শিক্ষা জীবন শুরুহয় আনন্দপুরের একটি মিডল স্কুলে । সেখানে তিনি চতুর্থ শ্রেণীপর্যন্ত পড়েছিলেন ।

বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড সম্পাদনা

মেদিনীপুরে তার বিপ্লবী জীবনের অভিষেক। তিনি বিপ্লবীদের একটি নবগঠিত আখড়ায় যোগ দেন। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু এবং রাজনারায়ণ বসুর প্রভাবে মেদিনীপুরে একটি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠন গড়ে উঠেছিল। সেই সংগঠনের নেতা ছিলেন হেমচন্দ্র দাস কানুনগো এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন হেমচন্দ্র দাসের সহকারী। এটি রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ব্রিটিশবিরোধীদের দ্বারা পরিচালিত হতো। অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই ক্ষুদিরাম তার গুণাবলীর জন্য সবার চোখে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেন। ক্ষুদিরাম সত্যেন্দ্রনাথের সাহায্যে বিপ্লবী দলভুক্ত হয়ে এখানে আশ্রয় পান। ক্ষুদিরাম তারই নির্দেশে 'সোনার বাংলা' শীর্ষক বিপ্লবাত্মক ইশতেহার বিলি করে গ্রেপ্তার হন। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে কাঁসাই নদীর বন্যার সময়ে রণপার সাহায্যে ত্রাণকাজ চালান।[১০] ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে বারীন্দ্র কুমার ঘোষ তার সহযোগী হেমচন্দ্র কানুনগোকে প্যারিসে নির্বাসনে থাকা একজন রাশিয়ান নিকোলাস সাফ্রানস্কি-এর কাছ থেকে বোমা তৈরির কায়দা শেখার জন্যে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।[১১]বঙ্গ প্রদেশ ফেরার পর হেমচন্দ্র এবং বারীন্দ্র কুমার আবার দুজনের সহযোগিতায় ডগলাস কিংসফোর্ডকে তাদের পরবর্তী লক্ষ্য হিসেবে স্থির করেন। কিংসফোর্ড আলিপুর প্রেসিডেন্সি বিচারালয়ের মুখ্য হাকিম ছিলেন, যার হাতে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত এবং যুগান্তরএর অন্যান্য সম্পাদকদের মামলা চলছিল। যাঁদের তিনি কঠোর সাজা শুনিয়েছিলেন।[১২] যুগান্তর দ্বন্দ্বমূলক সম্পাদকীয় লিখে তার প্রতিক্রয়া জানায়, ফলে এব্যাপারে আরো পাঁচজন অভিযুক্ত হলে এই সংবাদপত্র ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে বিরাট আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।[১২] এসমস্ত অভিযোগে সংবাদপত্রের প্রচার বৃদ্ধি পায় এবং এতে অনুশীলন সমিতির জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী আদর্শ প্রচারের সহায়ক হয়। শুক্লা সান্যালের মতে, বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদ একটা আদর্শ হিসেবে প্রত্যক্ষ না-হলেও অঘোষিতভাবে বঙ্গ প্রদেশের জনতার সমর্থন আদায় করেছিল।[১৩]যুগান্তর মামলার বিরুদ্ধে প্রচারে অংশ নেওয়ায় একজন বাঙালি ছেলে সুশীল সেনকে চাবুক মারার সাজা দেওয়ায় কিংসফোর্ড সাহেবের জাতীয়তাবাদীদের কাছে কুখ্যাতি ছিল। যেমন আলিপুর প্রেসিডেন্সি আদালতে মুখ্য হাকিম হিসেবে কাজে যোগ দেওয়ার সময় থেকেই নবীন রাজনৈতিক কর্মীদের কঠোর ও নিষ্ঠুর বাক্য প্রয়োগ করতেন। তিনি ওইসব কর্মীদের শারীরিক নির্যাতনের সাজা দিতেন।[৬]

কিংসফোর্ডকে গুপ্তহত্যার প্রচেষ্টা সম্পাদনা

প্রথম প্রচেষ্টা

হেমচন্দ্রের তৈরি করা বই বোমা দিয়ে কিংসফোর্ডকে হত্যার প্রথম প্রচেষ্টা করা হয়। একটা ক্যাডবেরি কোকোর খালি টিনে এক পাউন্ড পিকরিক অ্যাসিড এবং তিনটে ডেটোনেটর। এবার এটা হার্বার্ট ব্রুমএর কমেন্টারিজ অন দ্য কমন ল বইয়ের ফাঁপা অংশে প্যাক করা হয়েছিল এবং বাদামি কাগজ দিয়ে মুড়ে নবীন বিপ্লবী পরেশ মল্লিক কিংসফোর্ডের বাড়িতে দিয়ে আসেন। কিংসফোর্ড প্যাকেটটা না-খুলে পরে দেখবেন বলে তার সেলফে রেখে দেন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চে বিচারকের নিরাপত্তার ভয়ে, কিংসফোর্ডের পদোন্নতি করে সরকার তাকে বিহারের মুজাফফরপুর জেলার বিচারপতি হিসেবে বদলি করেন। তার সঙ্গে যায় আসবাবপত্র, লাইব্রেরি এবং বই বোমা।

মুজাফফরপুরে পরিদর্শন-পরিক্রমা

অনুশীলন সমিতি কিংসফোর্ডকে হত্যা করার প্রচেষ্টা জারি রেখেছিল। এপ্রিলে দুই সদস্যের একটা পরিদর্শক দল মুজাফফরপুর সফর করে, যাতে যুক্ত ছিলেন প্রফুল্ল চাকী[১৪] তাদের ফিরে আসায় বোমা দিয়েছিলেন হেমচন্দ্র, যেগুলো বানানো হয়ছিল ৬ আউন্স ডিনামাইট, একটা বিস্ফোরক এবং কালো পাউডার ফিউজ। প্রফুল্ল চাকি মুজাফফরপুরে ফিরেছিলেন একটা নতুন ছেলেকে নিয়ে, যার নাম ক্ষুদিরাম বসু।

পুলিশের সন্দেহ

অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্র ঘোষ এবং তাদের সহযোগীদের কাজকর্মে পুলিশের সন্দেহ হতে থাকে।[১৫] কলকাতা পুলিশ কিংসফোর্ডের জীবন বাঁচানোর জন্যে সচেতন হয়ে ওঠে। কমিশনার এফ এল হলিডে মুজাফফরপুর পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্টের উপেক্ষার বদলে সতর্ক হয়েছিলেন। যাইহোক, চারজন লোককে ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্যে ব্যবস্থা করা হয়।[১৪] ইতিমধ্যে ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকি নতুন নাম ধারণ করে যথাক্রমে হরেণ সরকার ও দীনেশ চন্দ্র রায় হয়েছেন, এবং কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত এক দাতব্য সরাইখানায় (ধর্মশালা) তারা বাসা নেন। তাদের অজ্ঞাতবাসের দিনগুলোতে ওই বিপ্লবীদ্বয় তাদের লক্ষ্যের কার্যকলাপ এবং দৈনন্দিন রুটিনের ওপর নজরদারি করতেন। দুই বিপ্লবী সফলভাবে তিন সপ্তাহের ওপর তাদের পরিচয় গোপন রাখতে পেরেছিল। মুজাফফরপুরের সুপারিন্টেন্ডেন্ট আর্মস্ট্রঙের কাছ থেকে একটা চিঠি নিয়ে সিআইডি অফিসার কলকাতায় ফিরে এসেছিল, যাতে বলা হয়েছিল যে, বিপ্লবীদ্বয় ওখানে পৌঁছায়নি।[১৫] ২৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় ক্ষুদিরাম এবং প্রফুল্ল তাদের পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্যে জায়গামতো হাজির হয়েছিল। স্কুল ছাত্রের ভান করে মুজাফফরপুর পার্কে তারা সমীক্ষা করেছিলেন যে, এটা ব্রিটিশ ক্লাবের উলটো দিকে, যেখানে কিংসফোর্ড ঘনঘন আসেন। একজন কনস্টেবল তাদের দেখেছিল।

মুজাফফরপুরে কিংসফোর্ডকে গুপ্তহত্যার প্রচেষ্টা

ভাগ্য ভালোর দিনে, প্রিঙ্গল কেনেডি নামে একজন ব্রিটিশ ব্যারিস্টারের মেয়ে এবং স্ত্রীর সঙ্গে কিংসফোর্ড এবং তার স্ত্রী ব্রিজ খেলছিলেন। তারা রাত ৮.৩০ নাগাদ বাড়ি ফিরতে মনস্থ করেন। কিংসফোর্ড এবং তার স্ত্রী একটা গাড়িতে ছিলেন যেটা কেনেডি এবং তার পরিবারের গাড়ির মতোই দেখতে ছিল।[১৬] কেনেডি মহিলাগণ কিংসফোর্ডের বাড়ির চত্বর থেকেই যাচ্ছিলেন। যখন তাদের গাড়ি ওই চত্বরের পূর্ব ফটকে পৌঁছায়, ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল গাড়িটার দিকে দৌড়ে যান এবং গাড়িতে বোমাগুলো ছোড়েন। একট প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে এবং গাড়িটা সঙ্গে সঙ্গে কিংসফোর্ডের বাড়িতে আনা হয়। গাড়িটা ভেঙে গিয়েছিল এবং কেনেডি মহিলাগণ ভীষণভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। মিস কেনেডি এক ঘণ্টার মধ্যেই মারা যান এবং মিসেস কেনেডি গুরুতর আঘাতের ফলে ২ মে তারিখে প্রয়াত হন।[১৭]

পলায়ন

ক্ষুদিরাম এবং প্রফুল্ল নিজেদের রাস্তায় পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছিলেন। মধ্যরাতের মধ্যে সারা শহর ঘটনাটা জেনে গিয়েছিল, এবং খুব সকাল থেকেই সমস্ত রেলস্টেশনে সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল যাতে প্রত্যেক যাত্রীর ওপর নজর রাখা যায়। সকাল পর্যন্ত ক্ষুদিরাম ২৫ মাইল পায়ে হেঁটে ওয়াইনি নামে এক স্টেশনে পৌঁছান। যখন একটা চায়ের দোকানে তিনি এক গ্লাস জল চেয়েছিলেন, তখন তিনি ফতে সিং এবং শিউ প্রসাদ সিং নামে দুজন কনস্টেবলের মুখোমুখি হন, যারা তার ময়লা পা এবং বিধ্বস্ত ও ঘর্মাক্ত চেহারা দেখে কিছু সন্দেহ করেছিল। কয়েকটা প্রশ্ন করার পর তাদের সন্দেহ বেড়ে যায় এবং তারা ক্ষুদিরামকে আটক করার সিদ্ধান্ত নেয়। ক্ষুদিরাম তাদের দুজনের সঙ্গে সংগ্রাম শুরু করে এবং তৎক্ষণাৎ দুটো রিভলভারের একটা পড়ে যায়। অন্য রিভলভারটা দিয়ে কনস্টেবলদেরকে গুলি করতে উদ্যত হওয়ার আগেই কনস্টেবলদের একজন ক্ষুদিরামকে পিছন দিক থেকে মজবুত আলিঙ্গনাবদ্ধ করে ধরে ফেলে। নবীনতর এবং হালকা চেহারার ক্ষুদিরামের পক্ষে নিজের প্রতিরক্ষা অথবা অব্যাহতি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিলনা। তার কাছে ৩৭ রাউন্ড গোলাগুলি, ৩০ টাকা নগদ, একটা রেলপথের মানচিত্র এবং একপাতা রেলের সময়সারণি ছিল। ক্ষুদিরাম চিরকালের জন্যে ধরা পড়ে গেলেন![১৭] ওয়াইনি রেল স্টেশনটা বর্তমানে নাম বদল করে হয়েছে ক্ষুদিরাম বসু পুসা স্টেশন

অন্যদিকে প্রফুল্ল কয়েক ঘণ্টা কষ্ট করে অনেকটা হেঁটেছিলেন। দিনের মাঝামাঝি ত্রিগুণাচরণ ঘোষ নামে এক নাগরিক লক্ষ করলেন যে, একজন যুবক তার দিকেই আসছেন। তিনি বোমা বিস্ফোরণে ভীত হয়েছেন এবং অনুভব করেছেন যে, প্রফুল্ল চাকি হলেন সেই অন্য বিপ্লবী। ত্রিগুণাচরণ ঘোষ তার জীবন রক্ষা করে তাকে তার বাড়িতে বিশ্রাম নিয়ে বাঁচাতে চাইছেন। তিনি সেই রাতেই প্রফুল্লর কলকাতায় ফেরার ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি সমস্তিপুর থেকে মোকামাঘাট যাওয়ার এবং পরবর্তী যাত্রায় হাওড়া যাওয়ার ট্রেনের টিকিটের ব্যবস্থা করেন। ট্রেনের একই বগিতে ব্রিটিশ পুলিশের একজন সব-ইন্সপেক্টর নন্দলাল ব্যানার্জি সফর করছিলেন। একটা কথোপকথনে তিনি ধরে ফেলেন যে, প্রফুল্লই হচ্ছেন সেই অন্য বিপ্লবী। শিমুরিঘাট রেল স্টেশনে প্রফুল্ল যখন জল খাওয়ার জন্যে ট্রেন থেকে নামেন, তখন মিস্টার ব্যানার্জি মুজফফরপুর থানায় একটা টেলিগ্রাম পাঠান। মোকামাঘাট রেল স্টেশনে প্রফুল্লকে পাকড়াও করার চেষ্টা করেন মিস্টার ব্যানার্জি। প্রফুল্ল তার কাছে থাকা রিভলভার দিয়ে নিজের মতো লড়াই করার চেষ্টা করেন, কিন্তু শেষে যখন দেখেন যে, রিভলভারে একটামাত্র গুলি আছে, তখন তিনি নিজের মুখের মধ্যে গুলি করেন।[১৬]

হাতে হাতকড়ি লাগানো ক্ষুদিরামকে পয়লা মে মুজফফরপুর থেকে আনা হয়। পুরো শহর থানায় ভিড় করেছিল একদল সশস্ত্র পুলিশকর্মীর ঘিরে থাকা একটা কিশোর ছেলেকে শুধু একপলক দেখার জন্যে। জেলাশাসক মিস্টার উডম্যানের বাড়িতে ক্ষুদিরামকে আনা হয়েছিল। পরের দিন, অর্থাৎ ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ২ মে, ইংরেজি দৈনিক দ্য স্টেটসম্যান লিখেছিল:[১৮]

একটা ছেলেকে দেখার জন্যে রেল স্টেশনে ভিড় জমে যায়। ১৮ অথবা ১৯ বছরের এক কিশোর হলেও তাঁকে রীতিমতো দৃঢ় দেখাচ্ছিল। বাইরে তার জন্যেই রাখা এক চারচাকার খোলা গাড়িতে উঠতে প্রথম শ্রেণীর এক রেল কামরা থেকে বেরিয়ে সে হেঁটে আসছিল, এক উৎফুল্ল কিশোরের মতো, যে কোনো উদ্বেগ জানেনা....গাড়িতে নির্দিষ্ট আসনে বসার সময় ছেলেটা চিৎকার করে বলে উঠল 'বন্দেমাতরম্'।"

বিচার ও ফাঁসি সম্পাদনা

ক্ষুদিরাম বসু তার শিক্ষক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কাছ থেকে এবং শ্রীমদ্ভগবদগীতা পড়ে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে বিপ্লব করতে অনুপ্রাণিত হন। তিনি বিপ্লবী রাজনৈতিক দল যুগান্তরে যোগ দেন। একের পর এক বোমা হামলার দায়ে ৩ বছর পর তাকে আটক করা হয়। ৩০ এপ্রিল ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে মুজাফফরপুর, বিহারে রাতে সাড়ে আটটায় ইউরোপিয়ান ক্লাবের সামনে বোমা ছুড়ে তিনজনকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ক্ষুদিরামের বিচার শুরু হয় ২১ মে ১৯০৮ তারিখে যা আলিপুর বোমা মামলা নামে পরিচিত হয়। বিচারক ছিলেন জনৈক ব্রিটিশ মি. কর্নডফ এবং দুজন ভারতীয়, লাথুনিপ্রসাদ ও জানকীপ্রসাদ। রায় শোনার পরে ক্ষুদিরামের মুখে হাসি দেখা যায়। তার বয়স খুব কম ছিল। বিচারক কর্নডফ তাকে প্রশ্ন করেন, তাকে যে ফাঁসিতে মরতে হবে সেটা সে বুঝেছে কিনা? ক্ষুদিরাম আবার মুচকে হাসলে বিচারক আবার প্রশ্নটি করেন। ক্ষুদিরাম তখন ওপরে উদ্ধৃত কথাটি বলেন। তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ভোর ছ-টায়। ফাসির মঞ্চ ওঠার সময়ে তিনি হাসিখুশি ছিলেন। ক্ষুদিরামকে নিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা লিখেছিলেন এবং অনেক গানও তখন রচিত হয়েছিল। যেমন, 'একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি'। তার মৃত্যুর পর ব্রিটিশদের খুন করার জন্য তরুণরা উদ্বুদ্ধ হয়েছিল।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পাদনা

ক্ষুদিরাম বসু সম্পর্কে হেমচন্দ্র কানুনগো লিখেছেন যে, ক্ষুদিরামের সহজ প্রবৃত্তি ছিল প্রাণনাশের সম্ভাবনাকে তুচ্ছ করে দুঃসাধ্য কাজ করবার। তার স্বভাবে নেশার মতো অত্যন্ত প্রবল ছিল সৎসাহস। আর তার ছিল অন্যায় অত্যাচারের তীব্র অনুভূতি। সেই অনুভূতির পরিণতি বক্তৃতায় ছিলনা, বৃথা আস্ফালনও ছিলনা; অসহ্য দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-আপদ, এমনকি মৃত্যুকে বরণ করে, প্রতিকার অসম্ভব জেনেও শুধু সেই অনুভূতির জ্বালা নিবারণের জন্য, নিজ হাতে অন্যায়ের প্রতিবিধানের উদ্দেশ্যে প্রতিবিধানের চেষ্টা করবার ঐকান্তিক প্রবৃত্তি ও সৎসাহস ক্ষুদিরাম চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য।[১৯]

চিত্রশালা সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Calcutta High Court Khudiram Bose vs Emperor on 13 July, 1908"। Indian Kanoon। সংগ্রহের তারিখ ৫ জুন ২০১৮ 
  2. Guha 1971
  3. "The story of our independence: Six years of jail for Tilak"Hindustan Times (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৫-০৮-০৮। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৮-১১ 
  4. রায়, প্রকাশ। "বিস্মৃত বিপ্লবী"। বিপ্লবীদের জীবনী 
  5. "Khudiram Bose"midnapore.in। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৮-২৫ 
  6. "Khudiram Bose"midnapore.in। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৮-২৫ 
  7. "Khudiram Bose"iloveindia.com। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৮-২৫ 
  8. Samaddar 2005
  9. "Khudiram Bose"midnapore.in। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৮-২৫ 
  10. সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, দ্বিতীয় মুদ্রণঃ নভেম্বর ২০১৩, পৃষ্ঠা ১৭১, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
  11. Popplewell 1995, পৃ. 104
  12. Sanyal 2014, পৃ. 91–92 "Bhupendranath Dutt, the editor and proprietor of the Jugantar was arrested in July 1907 and charged under section 124 A; .. Bhupendranath was sentenced to a year's rigorous imprisonment; .. The Jugantar's stance was typically defiant … The paper did nothing to tone down the rhetoric in its future editions."
  13. Sanyal 2014, পৃ. 93. "This attitude cost the paper dearly. It suffered five more prosecutions that, by July 1908, brought about its financial ruin … The trials brought the paper a great deal of publicity and helped greatly in the dissemination of the revolutionary ideology … testimony to the fanatical loyalty that the paper inspired in its readers and the deep impression that the Jugantar writings made on them … revolutionary terrorism as an ideology began to win if not overt, then at least the tacit, support of Bengalis."
  14. Heehs 2008, পৃ. 156
  15. Patel 2008
  16. Heehs 2008, পৃ. 157
  17. Ryves 1908
  18. Chaturvedi 2007
  19. হেমচন্দ্র কানুনগো, বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা; চিরায়ত প্রকাশন প্রা. লি. কলকাতা; আগস্ট, ১৯৯৭; পৃষ্ঠা-৭৫।