বেশান্তর

ক্রসড্রেসিং বা বিপরীত লিঙ্গের পোশাক পরিধান

বেশান্তর (ইংরেজি: Cross-dressing; ক্রসড্রেসিং) হল কোনো ব্যক্তির বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে জড়িত নির্দিষ্ট সমাজ-নির্ধারিত পোশাক অথবা অন্যান্য সামগ্রী ওই ব্যক্তির দ্বারা পরিধান করার ক্রিয়া। আধুনিক যুগে এবং অতীতে ছদ্মবেশ, স্বাচ্ছন্দ্য এবং আত্ম-সন্ধানের উদ্দেশ্যে বেশান্তর ব্যবহৃত হয়েছে।

সুদূর অতীত থেকেই প্রায় প্রতিটি মানব সমাজ প্রত্যেকটি লিঙ্গের জন্য কাঙ্ক্ষিত ভঙ্গিমা, রঙ এবং তাদের পরিধেয় পোশাকের ধরন সম্পর্কিত নির্দিষ্ট নিয়ম তৈরি করেছে। অনুরূপে, কোনো লিঙ্গের জন্য যথাযথ পোশাক কী, তার সংজ্ঞা নির্ধারণহেতু অধিকাংশ সমাজেরই গুচ্ছের বিধিনির্দেশ, দৃষ্টিভঙ্গি, এমনকি আইনও রয়েছে।

বেশান্তর বা ক্রসড্রেসিং পরিভাষাটি এমনই একটি ঘটনা অথবা আচরণকে নির্দেশ করে, যেই আচরণ প্রকাশের নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। অনেক ক্ষেত্রেই ভাবা হয়, এই ঘটনাটি রূপান্তরকামী পরিচয় নয়তো যৌনতা, কামুকতা, আর সমকামিতার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। কিন্তু এই পরিভাষাটি বাস্তবে নিজেই এরূপ কোনো উদ্দেশ্যকে সমর্থন করে না, এবং পরিভাষাটি কোনোভাবেই ব্যক্তিবিশেষের লিঙ্গ-পরিচয়ের সাথে সমার্থক নয়।

ইতিহাস

সম্পাদনা

ইতিহাসের পাতা জুড়ে অনেক সভ্যতাতেই বেশান্তর এর চর্চা হয়েছে। হিন্দু, গ্রিক, নর্স পুরাণে এর অনেক উদাহরণ আছে। বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন স্তরের অনেক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বকেও বেশান্তর করতে দেখা গেছে। লোককথা, সাহিত্য, থিয়েটার ও সংগীতে বেশান্তরের উজ্জ্বল ইতিহাস আছে। কাবুকি, কোরীয় শমন, চিনে অপেরা যার উদাহরণ।

হিন্দু পুরাণে বেশান্তর একটি পরিচিত ঘটনা। রামায়ণে উত্তরকাণ্ডে রাজা ইলার কাহিনিতে ভগবান শিবকে নারীবেশে পার্বতীর সাথে জলকেলি করতে দেখা যায়। সমুদ্র মন্থনে বিষ্ণু অসুরদের লক্ষ্যচ্যুত করতে "মোহিনী" নামে নারীর রূপ ধারণ করেন। সেটাকেও বেশান্তরের রূপভেদ বলা যেতে পারে। মহাভারতে অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বেশান্তর-সম্বন্ধীয়। বিরাটপর্বে অজ্ঞাতবাসে থাকাকালীন অর্জুন প্রায় এক বছর "বৃহন্নলা" নামে নর্তকী নারীর ছদ্মবেশ ধরে মৎস্যরাজ্যে যাপন করেছিলেন (বর্তমানে বৃহন্নলা শব্দটি রূপান্তরকামী অর্থে ব্যবহৃত হয়)। রাজা দ্রুপদের কন্যা শিখণ্ডী পুরুষ সেজে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন। আবার মৌষলপর্বে যাদবরা কৃষ্ণপুত্র শাম্বকে জোরপূর্বক গর্ভবতী নারী সাজিয়ে বিদ্রূপ করেছিল।

গ্রিক পুরাণে ওম্ফ্যালি হেরাক্লিসকে স্ত্রীবেশে দাসী হিসেবে জীবন অতিবাহিত করার শাস্তি দিয়েছিলেন। ট্রোজান যুদ্ধ থেকে বাঁচতে অ্যাকিলিস নারীর ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ইউরোপে মহিলারা ছেলেদের পোশাক পরার অনুমতি পেতেন না। তবে ইতিহাসে প্রতাপশালী নারীযোদ্ধাদের বেশান্তর করতে দেখা যায়। যেমন, ফ্রান্সের 'জোয়ান অফ আর্ক', ভারতের ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ

ভারতীয় থিয়েটার ও চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বেশান্তরের অনেক উদাহরণ আছে। তৎকালীন সমাজে মেয়েদের অভিনয় করা প্রথা-বিরুদ্ধ ছিল বলে, নারীচরিত্রে পুরুষদেরই অভিনয় করতে হত। ১৯১৩ সালে নির্মিত প্রথম ভারতীয় ছবি "রাজা হরিশ্চন্দ্র"-তে হরিশ্চন্দ্রের স্ত্রী তারাদেবীর ভূমিকায় অভিনয় করেন আন্না সালুঙ্কে নামে এক মরাঠি যুবক। বাংলা থিয়েটারেও অনুরূপ দৃষ্টান্তের অভাব নেই। শোনা যায়, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর মেয়ে সেজে নারী-চরিত্রাভিনয়ে পারদর্শী ছিলেন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের কৃষ্ণকুমারী নাটকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ অহল্যাদেবী নামে এক সাহসী রানির ভূমিকায় অভিনয় করেন।

প্রকারভেদ

সম্পাদনা

বেশান্তর অনেক ধরনের হতে পারে এবং কোনো ব্যক্তির এই আচরণে জড়িত হয়ে বেশান্তরকারী (Cross-dresser) হয়ে ওঠারও অনেক কারণ থাকতে পারে। কিছু মানুষ তার বিপরীত লিঙ্গের পোশাক পরেন নিজের স্বাচ্ছন্দ্য অথবা শখের জন্য। এক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তির পোশাক অন্য মানুষের কাছে বেশান্তর বলে বিবেচিত হয় না অথবা হওয়া উচিত নয়। আবার কিছু মানুষ অন্যদের চমকে দিতে বা সামাজিক বিধিনিষেধকে বুড়ো আঙুল দেখাতে বেশান্তর করেন।

লিঙ্গ-পরিচয় গোপন করতে, অর্থাৎ মেয়েরা সমাজে পুরুষ হিসেবে বাঁচতে এবং ছেলেরা নারী হিসেবে কাটাতে বেশান্তর করে। গল্পকাহিনীতে লিঙ্গ-ছদ্মবেশ বারবার ব্যবহৃত হয়েছে আর সাহিত্য, থিয়েটার ও চলচ্চিত্রে এটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা। সেনাবাহিনীর মতো পুরুষপ্রধান পেশায় অংশ নিতে কিছু মহিলা ইতিহাসে বেশান্তর করেছেন। উল্টোদিকে, সেনাবাহিনী থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য, নয়তো রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রতিবাদে ভূমিকা নিতে কিছু পুরুষ বেশান্তর করেছেন।

নোরা ভিনসেন্ট-এর প্রকল্প সেল্ফ-মেড ম্যান অনুসারে, গুপ্ত-সাংবাদিকতায় বেশান্তর করতে হতে পারে।

যে সব মঞ্চনাটক একটি লিঙ্গের মানুষ দ্বারা পরিচালিত হয়, সেখানে কিছু অভিনেতা বিপরীত লিঙ্গের কোনো চরিত্রে অভিনয় করতে বেশান্তর করেন। এক্ষেত্রে মূলত পুরুষরাই মহিলাদের পোশাক পরেন, এবং এটি অনেক সময় কৌতুকের পরিবেশ তৈরি করে ও হাসির উদ্রেক করে।

 
প্রদর্শন-কলায় বেশান্তর করেন ড্র্যাগ কুইনরা।

বেশান্তর ব্যবহার করে একটি বিশেষ প্রদর্শন-কলাকে ইংরেজিতে ড্র্যাগ বলে। এই কলায় পুরুষেরা অতিরঞ্জিত উগ্র নারীচরিত্রে অভিনয় করে, এদেরকে ইংরজিতে ড্র্যাগ কুইন বলা হয়। এরা অত্যন্ত উত্তেজক ধরনের খোলামেলা পোশাক, হাই-হিল জুতো, কড়া মেকআপ আর পরচুলো ব্যবহার করে। ড্র্যাগ কুইনরা সাধারণত জনপ্রিয় চলচ্চিত্র কিংবা পপ-সঙ্গীত তারকাকে অনুকরণ করে অভিনয় করে। এই একই কৌশল যদি কোনো মহিলাই ব্যবহার করে, তবে তাকে ফক্স কুইন বলা হয়।

ড্র্যাগ কুইনের বিপরীত ঘটনা, অর্থাৎ কোনো পুরুষ চিত্রতারকা বা সংগীত তারকাকে অনুকরণ করে কোনো মহিলা পুরুষ-চরিত্রে অভিনয় করলে, তাকে ইংরেজিতে ড্র্যাগ কিং বলে। কিছু মহিলা আবার লিঙ্গান্তর ঘটিয়েও নিজেকে ড্র্যাগ কিং প্রতিপন্ন করে; যদিও সংজ্ঞা অনুসারে এদের ড্র্যাগ কিং বলা চলে না।

যেসব ব্যক্তি বেশান্তরের কাজটিতে উত্তেজক যৌনতার অনুভূতি পান, তাদের বেশান্তরকামী (Transvestic fetishist) বলে। এরা অবশ্য যৌন পরিচয়ে প্রধানত বিষমকামী পুরুষ, কিন্তু মেয়েদের পোশাক পরা তথা 'মেয়ে সাজা'র প্রতি অদম্য চোরা যৌন আকর্ষণ থাকে এই ছেলেদের।

পুরুষ বেশান্তরকারীরা তাদের পুরুষ পোশাকের নিচে মহিলাদের অন্তর্বাস পরা-কে অন্তর্বসন (Underdressing) বলেন। বিখ্যাত চিত্রপরিচালক এডওয়ার্ড ডি. উড স্বীকার করেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর পোশাকের নিচে তিনি প্রায়ই মেয়েদের অন্তর্বাস পরতেন।

কিছু মানুষ বেশান্তর করার সাথে সাথে নিজের চালচলন, কথা বলার ভঙ্গি, এমনকি যৌন চরিত্র বদলে নিজেকে বিপরীত লিঙ্গের একজন হিসেবে পরিপূর্ণভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। অর্থাৎ তিনি নিজেকে বেশান্তরকারী হিসেবে পরিচয় দেন না, বরং বিপরীত লিঙ্গের মানুষ হিসেবে বাঁচার বা “সময় কাটানো”র চেষ্টা করেন। এই প্রক্রিয়ায় ওই বেশান্তরকারীকে জনসমক্ষে আসতে হয়, তাই তিনি অন্য ব্যক্তির হাতে ধরাও পরতে পারেন। ছেলেরা কীভাবে আরো মেয়েলি চেহারা পেতে পারে— তা নিয়ে প্রচুর ভিডিও, বই আর ম্যাগাজ়িন রয়েছে।

কখনো কখনো বিষমকামী দম্পতিরা একে অপরকে উত্তেজিত করতে বেশান্তর করেন। যেমন, ছেলেটি স্কার্ট কিংবা মহিলাদের অন্তর্বাস পরতে পারে, আবার মেয়েটি প্যান্ট বা অন্য পুরুষদের পোশাক পরতে পারে। ট্রান্সভেস্টিক ফেটিশিস্ট-দের মতোই কিছু পুরুষ অন্য কারোর হাতে মেয়ে সাজতে বাধ্য হওয়া আর নিজেকে অপদস্থ করার মধ্য দিয়ে অত্যন্ত কামোত্তেজনা পান। একে বলপূর্বক স্ত্রীরূপান্তরণ (Forced Feminisation) বলে।

কেউ কেউ আবার নিজের পোশাক-আশাকে কিছু পুরুষ বৈশিষ্ট্য আর কিছু নারী বৈশিষ্ট্য — দুটোই মিশিয়ে ফেলেন। যেমন, কোনো পুরুষ একইসাথে শাড়িও পরতে পারে আবার দাড়িও রাখতে পারে। ইংরেজিতে এদের অনেকসময় জেন্ডারফাক বলে।

আসলে কোন্‌টা বেশান্তর, আর কোন্‌টা নয় — তার সংজ্ঞা তৈরি করেছে আমাদের সমাজই। যেমন, পাশ্চাত্য সমাজে মহিলারা বহুকাল থেকে পোশাক হিসেবে ট্রাউজার পরে আসছে, তাই এটিকে কখনোই বেশান্তর বলা হয় না। আবার কিছু সংস্কৃতিতে পুরুষেরা লুঙ্গি ও কিল্টের মতো ঘাঘরা বা স্কার্ট-জাতীয় বস্ত্র পরে, এগুলিকে মেয়েদের পোশাক হিসেবে গণ্য হয় না, এবং এগুলি পরিধান করলেও কাউকে বেশান্তরকারী পুরুষ বলা চলে না। সামাজিক ব্যবস্থায় বিশ্বায়নের প্রভাব যত বাড়ছে, নারী-পুরুষ উভয়েই পোশাকের ক্ষেত্রে সংস্কৃতির আদান-প্রদান করছে। স্কার্টকে পুরুষদের দৈনন্দিন ব্যবহার্য পোশাক হিসেবে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য ফ্যাশন ডিজাইনাররা বিক্ষিপ্ত কিছু প্রচেষ্টা করেছেন।

কস্‌প্লে (Cosplay বা চরিত্রান্তর) হল বেশান্তর করে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করা, যেখানে মেয়েরা পুরুষ সাজেন, অথবা উল্টোটাও হতে পারে। পুরুষ চরিত্রে অভিনয় করার জন্য মহিলাদের ‘স্তন বাইন্ডিং’ করাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। দেহগঠনে বেশি করে নারীত্ব আনতে পুরুষ বেশান্তরকারীরা পোশাকের নিচে বিভিন্ন সিলিকন ব্রেস্ট ফর্ম বা কৃত্রিম স্তন ব্যবহার করেন, যা সাধারণত শারীরিক ত্রুটির কারণে নারীরাই ব্যবহার করেন।

পোশাক-নির্বাচনে নারী বেশান্তরকারীরা অনেকটাই উন্মুক্ত, যে-কোনো পুরুষের পোশাক পরতে পারেন। ছেলেদের জন্য বেশান্তর অনেক বৈচিত্র্যময়। বেশিরভাগ শখের পুরুষ বেশান্তরকারী যদিও আধুনিক হালকা নারীপোশাক পছন্দ করেন, কিন্তু বেশান্তরকামী বা ফেটিশিস্ট পুরুষেরা যতটা সম্ভব আকর্ষণীয় ও খোলামেলা পোশাক পরতে ভালোবাসেন। তাদের কথায়, তারা এই মেয়েলি পোশাক গায়ে দিয়ে প্রচণ্ড উত্তেজিত হন ও মজা পান। তাই তারা ব্রাইডাল গাউন, ব্রা, সুইমওয়্যার, হিল জুতো, স্টকিং পরে নিজেদের আবিষ্কার করতে থাকেন। ফিতে ও জড়ির কাজ-করা সাবেকি বস্ত্র আর ছোট মেয়েদের ফ্রক এদের অত্যন্ত প্রিয়। ভারতীয় উপমহাদেশে পুরুষ বেশান্তরকারীরা বিলিতি পোশাকের চেয়ে শাড়ি, ব্লাউজ়, চুড়িদারের মতো দেশীয় পোশাকেই বেশি স্বচ্ছন্দ। এরা নিজেদের বধূবেশে দেখতে পছন্দ করেন, তাই, বেশান্তরের সময় সিঁদুর, চুড়ি, গয়নাতেও নিজেদের সাজান।

সামাজিক প্রভাব ও সমস্যা

সম্পাদনা
 
আর্ভিং বার্লিনের "দিস ইজ় দ্য আর্মি, মিস্টার জোন্‌স", বেশান্তরকারীদের দ্বারা অভিনীত (১৯৪২)

কোনো ব্যক্তির জীবনে বেশান্তর শুরু হতে পারে শৈশবেই; তার বিপরীত লিঙ্গের ভাই-বোন, অভিভাবক বা বন্ধুর পোশাক পরে। কিছু অভিভাবক জানিয়েছেন, তারা তাদের সন্তানকে ছোটোবেলায় বেশান্তর করতে দিয়েছেন, অনেক ক্ষেত্রেই, সে বড়ো হলে আপনিই ছেড়ে দিয়েছে। কেউ আবার প্রাপ্তবয়স্ক হয়েও বেশান্তর করেছেন, তাকে অভ্যাসটি ছাড়তে হয়েছে বিয়ের পর। বিবাহিত বেশান্তরকারীরা অনেক সময় অপরাধবোধ ও অবসাদের শিকার হন, কারণ তার সঙ্গী (বা সঙ্গিনী) তার এই আচরণটি পছন্দ না-ও করতে পারে। অনেক বেশান্তরকারী তার সমস্ত পোশাক সাময়িকভাবে ফেলে দিয়েছেন, নতুন করে বেশান্তর শুরু করার জন্য।

সমাজ সর্বদাই বেশান্তর সম্পর্কে মিশ্র ধারণা পোষণ করে। ইতিহাসে বারবার পৌরুষের সাথে বীরত্ব এবং নারীত্বের সাথে কোমলতাকে জুড়ে দেওয়ায়, আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে পুরুষের পোশাকে নারী এবং নারীর পোশাকে পুরুষের অবস্থান — দুটো ঘটনা সমাজে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। আজ মহিলারা পুরুষদের পোশাক পরলে তা অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হয়। মেয়েদের ক্ষেত্রে বেশান্তর ও স্বাভাবিক পোশাকের বিভাজনরেখা অতি ক্ষীণ, তাই নারীদের সেই অর্থে বেশান্তরকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় না।

কোনো মহিলা তার স্বামীর শার্ট পরলে তাকে আকর্ষণীয়া ও উত্তেজক বলা হয়, কিন্তু কোনো পুরুষ তার স্ত্রীর শাড়ি পরলে তাকে রূপান্তরকামী ও হাস্যকর বলা হয়। এখনও বিশ্বের অধিকাংশ প্রান্তেই কোনো পুরুষ প্রথাগত মেয়েদের পোশাক পরতে চাইলে তাকে সমাজে মেনে নেওয়া হয় না। সমাজের কাছে বেশান্তরকারীদের একটা বড়ো অভিযোগ হল, মেয়েদেরকে ছেলেদের ব্যবহারের পোশাক সহজেই পরতে দেয়া হয়; কিন্তু ছেলেদেরকে শুধু পোশাকই নয়, মেয়েদের ব্যবহার্য যে-কোনো জিনিস থেকে দূরেই থাকতে হয়।

দৈনন্দিন জীবনে কোনো ছেলে মেয়ের সাজে প্রকাশ্যে আসলে তাকে সমাজ সম্পূর্ণ কোণঠাসা করে, সে হয়ে ওঠে সবার ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের পাত্র, এমনকি প্রশ্ন ওঠে তার যৌন-পরিচয় নিয়ে। মেয়েদের পোশাক পরা ছেলেদের জন্য চরম লজ্জার, হাস্যকর, এতে ‘পৌরুষহানি’ হয় — এমন চিন্তাধারাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। ভারতীয় উপমহাদেশে (অর্থাৎ বাংলাতেও) এই সমস্যাটি ভীষণভাবে প্রকট। দৈনন্দিন ব্যবহারিক ক্ষেত্রে পুরুষদের বেশান্তর এখানে প্রায় নিষিদ্ধ ও বিরলতম ঘটনা। এসবের কারণ সম্ভবত পুরুষদের বেঁধে-দেয়া জন্য লিঙ্গ-প্রকটতা; তাই সে তার প্রথাগত 'পৌরুষ’ থেকে সরে আসতে চাইলে সামাজিক বাধার (বিশেষত অবিরাম অপদস্থ হওয়া) সম্মুখীন হয়। কোনো পুরুষ নারীবস্ত্র গ্রহণ করলে ধরা হয়, তার লিঙ্গ-পরিচয়ের অবনতি ঘটল, কিন্তু কোনো নারী পুরুষ-বস্ত্র গ্রহণ করলে তার লিঙ্গ-পরিচয়ে বিশেষ কোনো পরিবর্তন মনে হয় না। কারণ, নারীকে সমাজে সর্বদাই পুরুষের অধীন এবং নিম্নস্থানে রাখার চেষ্টা হয়েছে। তাই কোনো পুরুষ বেশান্তরিত অবস্থায় আপাত-নারীতে পরিণত হয়, এবং লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে এক প্রতিমূর্তি হয়ে পড়ে।

যদিও বর্তমানে সামাজিক উন্নয়ন মানুষকে পুরুষ ও নারীর লিঙ্গবৈষম্য ও নিষেধাজ্ঞা থেকে অনেকটাই নিষ্কৃতি দিয়েছে, যদিও অন্ধবিশ্বাসের কারণে তা এখনো সম্পূর্ণ মুছে যায়নি। রূপান্তরকামীদের স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে গ্রহণ করার প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, একইভাবে বেশান্তর ও সমকামিতার সম্পর্কে অন্ধধারণারও দ্রুত অবসান ঘটছে কিছুকাল থেকে। রূপান্তরকামী ও সমকামীরা নিজেদের যৌন পরিচয় স্পষ্টভাবে প্রকাশ করছেন বেশান্তরের মাধ্যমেই। আবার, লিঙ্গ-পরিবর্তনের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার একটি পর্যায়ে বেশান্তর করতে হয়।

তবে বেশান্তরের সাংস্কৃতিক গুরুত্ব রয়েছে। অনেক সংস্কৃতিতেই বেশান্তর (প্রধানত পুরুষদের) সামাজিক রীতিনীতির অঙ্গ। ভারতেও পুরুষরা দৈনন্দিন জীবনে বেশান্তরের স্বীকৃতি না পেলেও, লোকসংস্কৃতিতে বেশান্তর স্বাভাবিক ব্যাপার। পশ্চিমবঙ্গবাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে যাত্রা নামক লোকনাটকে নারীচরিত্রে এখনও ছেলেরাই অভিনয় করে। চৈত্র মাসে চড়ক পুজোর আগে বহু প্রান্তিক মানুষ দুর্গা, কালীর মতো দেবীর বেশ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। বৃন্দাবনে কিছু পুরুষ কৃষ্ণভক্ত দেবতার প্রেম পাওয়ার বিশ্বাসে রাধা সেজে পূজার্চনা করেন। ভারতের বিহারে লন্ডা নাচ নামে গ্রাম্য অনুষ্ঠানে নর্তকী সেজে মনোরঞ্জন করে ছেলেরাই। কর্নাটকের প্রাচীন নৃত্যকলা 'যক্ষগান'-ও এমনই এক দৃষ্টান্ত। কেরলের কোট্টঙ্কুলংকার দেবী মন্দিরে চাময়াবিলক্কু নামক বার্ষিক ধর্মীয় উৎসবে পুরুষ ও বালকরা মেয়েদের কাপড় পরে দেবীর আরাধনা করতে যান। বর্তমানে চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনে হাস্যরস তৈরির জন্য হলেও অভিনেতাদের বেশান্তর জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

আরও দেখুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা

পাদটীকা

গ্রন্থপঞ্জি

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা