বড় লোকের বিটি লো

রতন কাহার রচিত বাংলা পল্লী গীতি

বড় লোকের বিটি লো, লম্বা লম্বা চুল অথবা বড়লোকের বেটি লো, লম্বা লম্বা চুল[১] একটি জনপ্রিয় বাংলা পল্লীগীতি। ১৯৭২ সালে রতন কাহার কর্তৃক রচিত ও ঝুমুর তালে সুরারোপিত এই গীতি বা গানটি প্রাথমিকভাবে রতন কাহারের কন্ঠে আকাশবাণীতে প্রচারিত হয়। পরবর্তীতে স্বপ্না চক্রবর্তীর কন্ঠে ১৯৭৬ সালে নতুন করে প্রকাশিত হয় এবং লোকসঙ্গীত হিসেবে জনপ্রিয় হয়।[২][৩] গানটি কালোত্তীর্ণ ও আলোচিত। মূল সুর ঠিক রেখে চলচ্চিত্রসহ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে গানটির পুনরুৎপাদন করা হয়েছে।[৪]

"বড় লোকের বিটি লো"
বড়লোকের বিটি লো অ্যালবাম থেকে
রতন কাহার ও স্বপ্না চক্রবর্তী কর্তৃক পল্লী গীতি
ভাষাবাংলা
রচিত১৯৭২
মুক্তিপ্রাপ্ত১৯৭৬
বিন্যাসআর পি এম ডিস্ক
রেকর্ডকৃত১৯৭৬
ধারালোকসঙ্গীত
দৈর্ঘ্য০৩:০৩
লেবেলঅশোকা রেকর্ড কোম্পানি
গান লেখকরতন কাহার
সুরকাররতন কাহার
প্রযোজকরতন কাহার

পটভূমি সম্পাদনা

১৯৭২ সালে সিউড়ি শহরের চার নম্বর ওয়ার্ডের তৎকালীন নগরী গ্রামের একজন অন্ত্যজ কুমারী ‘পতিতা’ মা ও তার কন্যা শিশুর করুণ জীবন কাহিনি হতে অনুপ্রাণিত হয়ে রতন কাহার এই গীত রচনা করেছিলেন। প্রতিবেশীদের পাশাপাশি ছোট ছোট মাটির ঘরের মাঝে, দোচালা মাটির ঘরের সামনের লম্বা উঠানে ওই কুমারী মা তার ছোট মেয়ের চুলে লাল ফিতে দিয়ে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে নিজের করুণ জীবনকাহিনী রতন কাহারকে শুনিয়েছিলেন[৫][৩]। বর্ণনায় কন্যা শিশুটির তার বাবার রূপ পাওয়া এবং মেয়েটির বাবা বিত্তশালী হওয়ার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছিল। পিতৃপরিচয়হীন নিজের মেয়ের সম্পর্কে কুমারী মা কথায় কথায় বলেছিলেন— ‘এই যে এত্ত চাঁদ রূপ মেয়ের। হবে না কেনে? ই বড়লোকের বিটি আছে বটেক[৩][৬]। কুমারী মায়ের আশ্রয়দাত্রী হরিদাসী নাম্নী এক প্রৌঢ়া, যার ঝুমুরের দল ছিলো, তার কাছে সুর নিতে গিয়ে কুমারী তরুণী মায়ের সাথে রতন কাহারের আলাপ হয়।[৩] এই গল্প থেকেই গানটির সৃষ্টি। কুমারী মা তার পিতৃপরিচয়হীন কন্যাকে 'বড়লোকের বিটি' সম্বোধন করে তার জীবনের যে কাহিনী বলেন তাই রতন কাহারের গীতে রূপ পেয়েছে।

সঙ্গীত ধারণ ও জনপ্রিয়তা সম্পাদনা

রতন কাহার বাংলার রাঢ় অঞ্চলে প্রচলিত ঝুমুর তালে গানটিতে সুরারোপ করেন। ১৯৭২ সালে রচনার পর গানটি রতন কাহারের কন্ঠে আকাশবাণীতে প্রথম পরিবেশিত হয়েছিল, সেসময় গানটি জনপ্রিয়তা পায়নি। ১৯৭৬ সালে স্বপ্না চক্রবর্তী রতন কাহারের কাছ থেকে আরো দুইটি গানের সাথে এই গানটি সংগ্রহ করেন[২] এবং অশোকা রেকর্ড কোম্পানি হতে ''বড়লোকের বিটি লো' এ্যালবামের মাধ্যমে নিজ কন্ঠে ধারণ ও প্রকাশ করেন। নতুন করে প্রকাশের পর গানটি জনপ্রিয় হয়।[৭][৫] জনপ্রিয়তার কারণে এ্যালবামটি 'গোল্ডেন ডিস্ক' পুরস্কার পায়।[৫]

২০২০ সালের ২৫ মার্চ সনি মিউজিক ইন্ডিয়ার ব্যানারে ভারতীয় গায়ক বাদশাহ তার 'গেন্দাফুল' শিরোনামের একক হিন্দি সঙ্গীতে পায়েল দেবের কন্ঠে এই গানের প্রথম দুই পঙ্‌ক্তি ব্যবহার করায় গানটি ভারতের অন্যান্য ভাষার সঙ্গীত শ্রোতাদের মাঝে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।[৭][৮][৯]

গীতিকারের স্বীকৃতি সম্পাদনা

বেশ কয়েকবার এই গানের গীতিকার হিসেবে রতন কাহারের নাম অস্বীকার করার ঘটনা ঘটেছে। ১৯৭৬ সালে অশোকা রেকর্ডের ব্যানারে গানটি প্রকাশের সময় গীতিকার হিসেবে রতন কাহারের নাম উল্লেখ না করে 'প্রচলিত গান' বলে প্রচার করা হয়।[২] ২০২০ সালের ২৫ মার্চ প্রকাশিত বাদশাহ'র 'গেন্দাফুল' শিরোনামের একক হিন্দি সঙ্গীতে পায়েল দেবের কন্ঠে এই গানের প্রথম দুই পঙ্‌ক্তি রতন কাহারের অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করার জন্য বাদশাহ সমালোচিত হন।[৭][৮][৯] গীতিকার ও সুরকার হিসেবে বাদশাহ নিজের নামের সাথে রতন কাহারের নাম উল্লেখ করেননি।[১০] রতন কাহারের অনুমতি গ্রহণ ও তাকে কোন ধরনের পারিশ্রমিক প্রদান ছাড়া তার গান ব্যবহারের জন্য ভারতীয় গণমাধ্যম ও সামাজিকমাধ্যম বাদশাহর সমালোনা করে।[৭][১১][১২] প্রতিবাদের মুখে রতন কাহার এই গানের গীতিকার হিসেবে স্বীকৃত হন।[১৩]

পুনরুৎপাদন সম্পাদনা

"বড় লোকের বেটি"
জে কে মজলিশ ও বিন্দু কণা কর্তৃক একক
মুক্তিপ্রাপ্ত৩ আগস্ট, ২০২০
বিন্যাসভিডিও স্ট্রিমিং
রেকর্ডকৃতজুন, ২০২০
দৈর্ঘ্য০২:৫৬
লেবেলআরটিভি মিউজিক
সুরকারজে কে মজলিশ
"গাঁদা ফুল"
রতন কাহার ও ইমন চক্রবর্তী কর্তৃক একক
মুক্তিপ্রাপ্ত১০ অক্টোবর, ২০২০
বিন্যাসভিডিও স্ট্রিমিং
দৈর্ঘ্য০৩:২২
লেবেলসনি মিউজিক
গান লেখকরতন কাহার, বাদশা, সুগত গুহ
সুরকারবিক্রম ঘোষ

জনপ্রিয়তার নিরিখে বড় লোকের বিটি লো গানটি বিভিন্ন সময়ে চলচ্চিত্রে ও একক সঙ্গীত হিসেবে পুনরুৎপাদিত হয়েছে।[৪]

জে কে মজলিশ সংস্করণ সম্পাদনা

২০২০ সালের জুনে বাংলাদেশে গানটির একটি নতুন সংস্করণ তৈরী করা হয়। রতন কাহারের অনুমতি সাপেক্ষে মূল গীতি ঠিক রেখে বাংলাদেশি সুরকার জে কে মজলিশ এই গানটির নতুন সঙ্গীতায়োজন করেন।[৪] বাংলাদেশী সংস্করণে 'বিটি' শব্দের পরিবর্তে 'বেটি' ব্যবহার করা হয়েছে। এই সংস্করণটি জে কে মজলিশ ও সঙ্গীত শিল্পী বিন্দু কণার দ্বৈতকন্ঠে ধারণকৃত।[১৪]

আরটিভি মিউজিকের ব্যানারে ২০২০-এর ইদুল আযহা উপলক্ষে গানটি মুক্তির জন্য প্রস্তুত করা হয়। পুনরুৎপাদিত সংস্করণটি ৩ আগস্ট ২০২০ আরটিভি মিউজিক তাদের আনুষ্ঠানিক ইউটিউবে চ্যানেলে সঙ্গীত ভিডিও প্রকাশের মাধ্যমে উম্মুক্ত করে।[১৫][১৬]

বিক্রম ঘোষ সংস্করণ সম্পাদনা

এটি তবলা বাদক বিক্রম ঘোষের সঙ্গীতায়জনে পুনরুৎপাদিত। সংস্করণটির সঙ্গীতায়জন তবলা প্রধান। এই গানটিতে মূল গীতির মুখরা ঠিক রেখে সুগত গুহ রচিত নতুন অন্তরা যুক্ত করা হয়েছে, পাশাপাশি বাদশাহ'র গেন্দাফুল গানের হিন্দি র‍্যাপ অন্তর্ভুক্ত আছে।[১৭] গানটির স্রষ্ঠা রতন কাহারের সাথে গায়িকা ইমন চক্রবর্তী এই সংস্করণে কন্ঠ দিয়েছেন। রতন কাহার এই গানের চলচ্চিত্রায়নে অংশও নেন।[১৮]

গানটিকে সারদীয় সপ্তাহ উপলক্ষ্যে বাজারজাত করা হয়। এই গানটি বাদশা'র 'গেন্দাফুল' গানের 'বাংলা রূপান্তর' হিসেবে গণমাধ্যমে প্রচারণা পায়।[১৯][২০] ২০২০ সালের ১০ অক্টোবর, সনি মিউজিক তাদের আনুষ্ঠানিক ইউটিউব চ্যানেলে এই সংস্করণটির ভিডিও 'গাঁদা ফুল' শিরোনামে প্রকাশ করে।[১৯]

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "লকডাউন না থাকলে আজই রতন কাহারের বাড়ি যেতাম: বাদশা"আনন্দবাজার পত্রিকা। ২০২০-০৪-০১। ২০২০-০৪-০৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৪-০৪ 
  2. "বাদশাকে আমি চিনতামই না: রতন কাহার"প্রথম আলো। ২০২০-০৪-০১। ২০২০-১০-২৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৪-০৪ 
  3. "নাম কিনেছে অন্যে, বড়লোকের বিটির স্রষ্টা এখন বিস্মৃতই"এই সময়। ২০১৮-০২-১২। ২০২০-০৬-২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৪-০৪ 
  4. "এবার ঢাকায় 'বড়লোকের বেটি'"প্রথম আলো। ২০২০-০৬-৩০। ২০২০-০৬-৩০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৬-৩০ 
  5. "দিনান্তের ভাঙনে নগরীতে বসে আজও গান বাঁধেন রতন কাহার"চ্যানেল আই অনলাইন। ২০২০-০৪-০২। ২০২০-০৬-২৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৪-০৪ 
  6. "'বড় লোকের বিটি লো' গানের মূল স্রষ্টা রতন কাহার, নেপথ্যের গল্প"দেশ রুপান্তর। ২০২০-০৩-২৮। ২০২০-১০-২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  7. "বিতর্কে বাদশার 'গেঁন্দাফুল'"এই সময়। ২০২০-০৩-৩০। ২০২০-০৪-০৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৪-০৪ 
  8. "'বড়লোকের বিটি লো'র স্রষ্টাকে ভুলে গেলেন বাদশা"বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম। ২০২০-০৩-২৯। ২০২০-০৪-০৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৪-০৪ 
  9. "জেনেশুনে আমি এই ভুলটি করিনি:বাদশা"দৈনিক ইত্তেফাক। ২০২০-০৪-০২। ২০২০-০৬-১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৪-০৫ 
  10. "বড়লোক হলেন বাদশা, নেপথ্যেই থেকে গেলেন বিটি লো-র আসল স্রষ্টা"হিন্দুস্তান টাইমস। ২০২০-০৩-২৮। ২০২০-০৭-১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৫-০৯ 
  11. "Badshah's all-glamarous 'Genda Phool' song featuring Jacqueline Fernandez catches plagiarism allegation."Indiablooms.com। ২০২০-০৩-৩০। ২০২০-০৪-০২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৪-০৫ 
  12. "Badshah's New Song 'Genda Phool' Faces Plagiarism Charges; Netizens Ask Why Real Composer Not Credited"News Nation (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২০-০৪-০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৪-০৫ 
  13. "Badshah Issues A Statement On 'Genda Phool' Plagiarism Allegations"The Live Mirror (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২০-০৪-০১। ২০২০-০৪-০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৪-০৫ 
  14. "মজলিশ-বিন্দুর 'বড়লোকের বেটি লো'"এনটিভি অনলাইন। ২০২০-০৮-০৫। ২০২০-০৮-০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৮-১২ 
  15. "জেকে-বিন্দুর 'বড় লোকের বেটি লো'"দৈনিক জনকন্ঠ। ২০২০-০৭-০৪। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৮-১৩ 
  16. "এবার বাংলাদেশে 'বড় লোকের বেটি'"দৈনিক সমকাল। ২০২০-০৮-০৫। ২০২০-০৯-২৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৮-১৩ 
  17. "আলোচনায় রতন কাহারের নতুন 'গেন্দা ফুল'"বাংলা ট্রিবিউন। ২০২০-১০-১১। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১০-১১ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  18. "'গেন্দা ফুল', তবলা-ফোক-এর মিশেলে মুক্তি পেল 'গাঁদা ফুল', কেন্দ্রবিন্দুতে রতন কাহার, অরিন্দম শীল ও বিক্রম ঘোষের যৌথ প্রচেষ্টায়"সংবাদ ওয়ার্ল্ড। ২০২০-১০-১০। ২০২২-০১-০৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১০-১১ 
  19. "'গেন্দা ফুল' নয়, তবলা-ফোক-এর মিশেলে মুক্তি পেল 'গাঁদা ফুল', কেন্দ্রবিন্দুতে রতন কাহার"জি ২৪ ঘণ্টা। ২০২০-১০-১০। ২০২২-০১-০৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১০-১১ 
  20. "'বাঙালি' হল গেন্দা ফুল, নতুন রূপে-নতুন চমক!"এই সময়। ২০২০-১০-১০। ২০২০-১০-১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১০-১১ 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা