পুরুষসূক্ত
পুরুষসূক্ত (সংস্কৃত: पुरुषसूक्तम्, আইএএসটি: Puruṣasūktam) হল ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের অন্তর্গত একটি সূক্ত (৯০ সংখ্যক সূক্ত)। এটি পরব্রহ্ম বা পুরুষের উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত।[১] এটি শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতার ৩১ অধ্যায়ের ১ থেকে ১৬তম মন্ত্রে এবং অথর্ববেদ সংহিতা ১৯ কাণ্ডের ৬ সূক্তেও রয়েছে। কিছুটা ভিন্নতায় সামবেদেও এটি রয়েছে।[২][৩][৪] এই সূক্তের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি হলেন নারায়ণ। তবে ভাগবত পুরাণ ও মহাভারত মতে বিষ্ণুকে পুরুষ সূক্ত প্রার্থনায় বর্ণিত পরম পুরুষ বা পরম সত্তা হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।[৫]

হিন্দুধর্মের বিশ্বাস অনুসারে, এই সূক্ত ঈশ্বর অনুভূতি ব্যক্ত করে।[৬] এই সূক্তের একটি সংস্করণ তথা ঋগ্বেদে ১৬টি মন্ত্র পাওয়া যায়, যার মধ্যে প্রথম ১৫টি অনুষ্টুপ ছন্দে ও শেষ মন্ত্রটি ত্রিষ্টুপ ছন্দে রচিত। এই সূক্তের অপর একটি সংস্করণ তথা যজুর্বেদে ২৪টি মন্ত্র পাওয়া যায়, প্রথম ১৮টি মন্ত্র পূর্ব-নারায়ণ এবং বাকি ৬টি মন্ত্র উত্তরনারায়ণ নামে অভিহিত। [৭][৮][৯]
বিষয়বস্তু সম্পাদনা
পুরুষসূক্তে ব্রহ্মাণ্ডের আধ্যাত্মিক একত্ব বা অদ্বৈত সত্তা বর্ণিত হয়েছে। এই সূক্তে পুরুষ বা পরব্রহ্মের স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাকে একাধারে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা এবং এর মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[১০] পুরুষসূক্ত অনুযায়ী, এই পুরুষ থেকেই মূল ক্রিয়ামূলক ইচ্ছাশক্তি, (যাকে বিশ্বকর্মা, হিরণ্যগর্ভ বা প্রজাপতি মনে করা হয়) উদ্ভব হয়। এই ইচ্ছাশক্তিই প্রকৃতি ও মহাকালের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করে।[১১] পুরুষসূক্তের সপ্তম মন্ত্রটি মানবসমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে একটি আন্তসম্পর্ক বর্ণনা করে।
পুরুষ সম্পাদনা
সূক্তের দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম শ্লোকে পুরুষের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তাকে জগতের সকল চৈতন্যময় জীব ও জড় বস্তুর মধ্যে অন্তর্নিহিত এক সত্ত্বা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কাব্যিক ভাষায় তার হাজার হাজার মাথা, হাজার হাজার হাত ও হাজার হাজার পায়ের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে এই বিশ্বাস স্বরূপ নিয়েও তিনি মাত্র দশ আঙুল পরিমিত স্থানে জগতকে আবদ্ধ করে আছেন এবং দশদিকেই তিনি জগতে পরিব্যাপ্ত করে আছেন। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল আবির্ভূত সত্ত্বাই পুরুষ স্বয়ং।[১০] আরও বলা হয়েছে যে, তিনি তার সৃষ্টিরও বাইরে যেতে পারেন। সাকার রূপে পুরুষের বিশালত্ব এবং মনের অধিগম্য ক্ষেত্রের বাইরে তার অবস্থানকে সর্বেশ্বরবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়। সবশেষে এই মহানপুরুষের মহিমা বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, তার মহিমা এই সূক্তে উল্লিখিত গৌরবের চেয়ে অনেক বেশি এবং এখানে তার মহিমার ন্যূনতম ধারণা দেওয়া হয়েছে।
সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পাদনা
পুরুষসূক্তের পঞ্চম থেকে পঞ্চদশ শ্লোকে ঋগ্বেদের সৃষ্টিতত্ত্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সূক্ত অনুসারে, পুরুষের বিরাট নামক বিশ্বরূপ হল সৃষ্টির উৎস। বিরাটের মধ্যে সর্বব্যাপী জ্ঞানের আবির্ভাব ঘটে এবং বিরাট থেকে বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয়। শেষের দিকের শ্লোকগুলিতে বলা হয়েছে, পুরুষ নিজেকে আহুতি দিয়ে পক্ষী, বন্য ও গবাদি পশু, তিন বেদ, মন্ত্রের ছন্দ সৃষ্টি করেন। তার মুখ, বাহু, জঙ্ঘা ও পা থেকে চার বর্ণের জন্ম হয়। পুরুষের মন থেকে চন্দ্র[১২] ও চোখ থেকে সূর্যের জন্ম হয়। তার মুখ ও নিঃশ্বাস থেকে ইন্দ্র ও অগ্নির জন্ম হয়। তার নাভি থেকে আকাশ, মাথা থেকে স্বর্গ, পা থেকে পৃথিবী ও কান থেকে অন্তরীক্ষের জন্ম হয়।[১০] এই সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে মানুষ, জাগতিক ও মহাজাগতিক সকল সত্ত্বার মধ্যে একত্ব স্থাপিত হয়। কারণ, সবই সেই একক সত্ত্বা পুরুষের অংশসম্ভূত।[১৩]
যজ্ঞ সম্পাদনা
পুরুষসূক্তে বলা হয়েছে, পুরুষের কৃত যজ্ঞের মাধ্যমে এবং যজ্ঞ থেকে জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। এই আদি যজ্ঞ থেকেই যাবতীয় সৃষ্টি রূপ ধারণ করেছে। সপ্তদশ শ্লোকে বলা হয়েছে যে, এই আদি যজ্ঞ থেকেই যজ্ঞের ধারণার উৎপত্তি হয়েছে। শেষ শ্লোকগুলিতে সকল সৃষ্টির আদিশক্তি রূপে যজ্ঞের গৌরব ঘোষিত হয়েছে।[১৪]
ব্যাখ্যা সম্পাদনা
বৈদান্তিকেরা পুরুষসূক্তকে উপাসনা, জ্ঞান, ভক্তি, ধর্ম ও কর্মের রূপক হিসেবে গ্রহণ করেন। আবার বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ধারণাটির জন্য এটি বৈষ্ণব ভেদাভেদ দর্শনের মূল ভিত্তি হিসেবে দৃষ্ট হয়।[১৫] পুরুষের ধারণাটি সাংখ্য দর্শনেও পাওয়া যায়।
পুরুষসূক্তের উল্লেখ পাওয়া যায় অথর্ববেদ (১৯।৬), সামবেদ (৬।৪), যজুর্বেদ (বাজসনেয়ী ৩১।১-৬) ও তৈত্তিরীয় আরণ্যকের (৩।১২,১৩) মতো বৈদিক গ্রন্থে। শতপথ ব্রাহ্মণ, তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ, শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদ ও মুদ্গল উপনিষদে এর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। আধুনিক হিন্দুধর্মে গায়ত্রী মন্ত্রের মতো যে অল্প কয়েকটি ঋগ্বৈদিক স্তোত্র প্রচলিত আছে, তার মধ্যে এটি একটি। বাজসনেয়ী সংহিতা (৩১। ১-৬), সামবেদ সংহিতা (৬।৪) ও অথর্ববেদ সংহিতায় (১৯।৬) এই সূক্তের অর্থব্যাখ্যা সহ উল্লেখ পাওয়া যায়। পৌরাণিক সাহিত্যের মধ্যে ভাগবত পুরাণ (২।৫।৩৫ থেকে ২।৬।১-২৯) ও মহাভারতে (মক্ষধর্মপর্ব ৩৫১ ও ৩৫২) এই শ্লোকের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
আরও দেখুন সম্পাদনা
উৎস সম্পাদনা
- Coomaraswamy, Ananda, Rigveda 10.90.1: aty atiṣṭhad daśāṅgulám, Journal of the American Oriental Society, vol. 66, no. 2 (1946), 145-161.
- Deo, Shankarrao (Member of India's Constituent Assembly and co-author of the Constitution of India), Upanishadateel daha goshti OR Ten stories from the Upanishads, Continental Publication, Pune, India, (1988), 41-46.
- Koller, John M. The Indian Way: An Introduction to the Philosophies & Religions of India (2nd Edition). Pearson Education, 2006. আইএসবিএন ০১৩১৪৫৫৭৮৮.
- Swami Amritananda's translation of Sri Rudram and Purushasuktam,, Ramakrishna Mission, Chennai.
- Krishnananda, Swami. A Short History of Religious and Philosophic Thought in India. Divine Life Society.
- Patrice Lajoye, "Puruṣa", Nouvelle Mythologie Comparée / New Comparative Mythologie, 1, 2013: http://nouvellemythologiecomparee.hautetfort.com/archive/2013/02/03/patrice-lajoye-purusha.html
তথ্যসূত্র সম্পাদনা
- ↑ Rao, SK Ramachandra। Purusha Sukta - Its meaning, translation, transliteration and commentary।
- ↑ Griffith, R.T.H. (1899) The Texts of the White Yajurveda. Benares: E.J. Lazarus & Co., pp 260-262
- ↑ Griffith, R.T.H. (1917) The Hymns of the Atharva-Veda, Vol. II (2nd edn). Benares: E.J. Lazarus & Co., pp 262-265
- ↑ Purusha Sukta (in Sanskrit)। Melkote: Sanskrit Sanshodhan Sansad। ২ অক্টোবর ২০১১।
- ↑ Rosen 2006, পৃ. 57।
- ↑ The Significance of the Purusha sukta in Daily Invocations ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৩ অক্টোবর ২০০৯ তারিখে by Swami Krishnananda.
- ↑ David Keane (২০১৬)। Caste-based Discrimination in International Human Rights Law। Routledge। পৃষ্ঠা 26। আইএসবিএন 9781317169512।
- ↑ Raghwan (2009), Discovering the Rigveda A Bracing text for our Times, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১৭৮৩৫৭৭৮২, pp 77-88
- ↑ "Rgveda"। gretil.sub.uni-goettingen.de। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-১০-২৯।
- ↑ ক খ গ The Purusha sukta in Daily Invocations by Swami Krishnananda
- ↑ Krishnananda. p. 19
- ↑ Madhavananda, Swami. Brihadaranyaka Upanishad. Advaita Ashram, Verse 1.5.14.
- ↑ Koller, p. 44.
- ↑ Koller, p. 45-47.
- ↑ Haberman, David L. River of Love in an Age of Pollution: The Yamuna River of Northern India. University of California Press; 1 edition (September 10, 2006). P. 34. আইএসবিএন ০৫২০২৪৭৯০৬.