নল (রামায়ণ)

বানর, যাকে লংকা গমণের রাম সেতু গমণের প্রকৌশলী হিসেবে কৃতিত্ব দেয়া হয়

হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণ অনুসারে নল (সংস্কৃত: नल), ছিলেন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার পুত্র, যার নামের আক্ষরিক অর্থ শ্বেতপদ্ম। বিশ্বকর্মার পুত্র হয়েও তিনি ছিলেন বানররূপী। রামায়ণের মুখ্য চরিত্র রামের লঙ্কা গমনের সুবিধার জন্য সমুদ্রের ওপর নির্মিত ভারতের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রামেশ্বরম থেকে লঙ্কার (যা বর্তমানে শ্রীলঙ্কা রাষ্ট্র) মান্নার অবধি বিস্তৃত বিশাল একটি সেতু নির্মানের অন্যতম পরিকল্পক ছিলেন বানর নল।[১][২] সেতুটি লঙ্কা দ্বীপ ও ভারতীয় মুল ভূখণ্ডকে যুক্ত করে। এটি রাম সেতু বা কিছুক্ষেত্রে পরিকল্পক নলের নামে নল সেতু নামেও পরিচিত।[৩] একাধিক সংস্করণভেদে এই রামসেতু নির্মাণে রামের বানর সেনার অপর এক প্রযৌক্তিক বানর ও নলের ভ্রাতা নীলের নামও পাওয়া যায়। নলকে বানরদের স্থপতি বা স্থাপত্যশিল্পী হিসাবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। রামায়ণের লঙ্কাকাণ্ডে নল ও নীল উভয়কেই রামের পক্ষে লঙ্কার রাজা রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দেখা যায়।

শ্বেত গাত্র বর্ণযুক্ত বানর তথা নল এবং নীলাভ বানর নীলের রামের সাথে কথোপকথনের চিত্র। চিত্রের বামে নল ও নীলের নির্দেশানুসারে সমুদ্রের ওপর বানর দলের সেতু নির্মাণ।

সেতুর নির্মাতা সম্পাদনা

মহাকাব্য রামায়ণে স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় যে বিষ্ণুর অবতার, অযোধ্যার রাজা দশরথের জ্যেষ্ঠ পুত্র রাম পিতৃসত্য পালনার্থে বনবাসে গমন করলে তার স্ত্রী সীতাকে লঙ্কাদ্বীপের রাক্ষস রাজা রাবণ অপহরণ করেন। সীতাকে অনুসন্ধান করতে করতে বানররাজ সুগ্রীবের সাথে তার মিত্রতা হয়। তিনি বানরদের সেনা তৈরী করেন ও ভুখণ্ডের শেষ বিন্দুতে পৌঁছান। সমুদ্র টপকে নিকটস্থ দশযোজন দূরবর্তী লঙ্কা দ্বীপে যাওয়ার জন্য তিনি সমুদ্রে দেবতা বরুণ দেবকে আমন্ত্রণ জানান এবং সমুদ্রের মধ্য দিয়েই পথ নির্মাণ করার অনুরোধ করেন। কিন্তু বরুণদেব তার সম্মুখে উপস্থিত হন না, ফলে রাম ক্রুদ্ধ হন এবং তূনীর থেকে এলোপাথারি বাণ নিক্ষেপ করা শুরু করলে সমুদ্রের জল আস্তে আস্তে শুকিয়ে যেতে শুরু করে। ভীতসন্ত্রস্ত বরুণদেব রামের নিকট এরূপ আচরণে অব্যহতির আবেদন করেন। কিন্তু সমুদ্রের মধ্য দিয়ে পথ নির্মাণে বিমুখতা দেখালেও তিনিই একটি সমাধানের পথও বলে দেন। তিনি রামকে বলেন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার পুত্র ও দেবস্থপতি নল রয়েছেন তার বানর সেনায়। নল তার পিতার কাছ থেকে আশীর্বাদস্বরূপ স্থাপত্যশিল্প ও প্রযুক্তির অত্যাবশ্যকীয় শিক্ষা পান এবং একাধিক অভিজ্ঞতার মুখোমুখিও হন। বরুণ পরামর্শ দেন রাম যেন নলের পরিদর্শনে ও দক্ষতায় সেইস্থান থেকে লঙ্কা অবধি একটি সেতু নির্মাণ করেন। এই সময়ে নল স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন ও মন্তব্য করেন যে স্নেহের আহ্বান না শুনলে রাম স্বগুণে জলদেবতার আত্মদম্ভ চূর্ণ করেছেন এবং রাম নাম সমুদ্রের জন্য অতিশুভ ও মান্য। বানরদল বিরাট আকারের ভারী ভারু গাছের গুড়ি, ছোটো টুকরো ডালপালা, ছোটো বড়ো পাথর এনে জড়ো করা শুরু করে এবং আকার অনুসারে তা সমুদ্রের ওপর সাজানো শুরু করে। বানর দলের সহায়তায় নল মাত্র পাঁচ দিনে দশ যোজন (৮০ মাইল বা ১৩০ কিলোমিটার) দীর্ঘ সেতুটি নির্মাণ করা সম্পন্ন করেন। রাম ও তার সৈন্যদল এর ওপর দিয়ে হেঁটে লঙ্কায় পৌঁছান এবং সেখানে তারা রাবণের সাথে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন।[২][৪]

রামায়ণ বিষয়ে আলোচনা করলে এই বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে আসে। বলা হয় নলের বানর মায়ের রূপে মোহিত হয়ে তাকে আলিঙ্গন করার সময়ে বিশ্বকর্মার উদ্দীপনায় ও ঔরসে বানর মায়ের গর্ভে জন্ম হয় নলের।[৫] বিভিন্ন আলোচনার মাধ্যমে এরকম তথ্য পাওয়া যায় যে, বানর সেনার অন্যান্যরা সেতু নির্মাণ করার মূল উপাদানগুলো একত্র করেন এবং নল একাই ঐ সেতুটি নির্মাণ করেন আবার অপর পণ্ডিতদের মতে বানর সেনা নলের পরিদর্শনে ও তার বুদ্ধিতে পাঁচদিনে এই সেতুটি নির্মাণ করেন।[৬] দক্ষিণ ভারতের রামায়ণের একটি স্থানীয় প্রকার কম্ব রামায়ণে কেবল নলকেই সেতুর স্থপতি ও নির্মাতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[৭] আবার তুলসীদাস গোস্বামী রচিত অবধি ভাষার রামায়ণ রামচরিতমানসে নলের সাথে তার ভ্রাতা নীলেরও উল্লেখ পাওয়া যায় এই সেতু নির্মাণের কাজে।[৮]

 
নাসা সংস্থার তোলা রামসেতুর চিত্র

রামায়ণের কিছু সংস্করণে উল্লেখ রয়েছে যে, নল পাথরকে জলে ভাসিয়ে রাখার ক্ষমতা ও দক্ষতা ছিলো, যার ব্যবহারে নল এই সেতুটি নির্মাণ করতে সফল হন।[৩] আরো কিছু সংস্করণে নলের সাথে সাথে অপর এক বানর তথা তার ভ্রাতা নীলের ঐ অনুরূপ দক্ষতা ছিলো, ফলে নল ও নীল একত্রে ঐ বিদ্যার ব্যবহার করে সেতু নির্মাণ করেন। এই ঘটনার ন্যায্যতার প্রতিপাদন করতে গিয়ে যে ঘটনাটি পাওয়া যায় তা হল, বানরদ্বয় তাদের কৈশোরকালে খুব দুষ্টু প্রকৃতির ছিলো এবং মুনি ঋষিদের আরাধ্য দেব-দেবীর দিব্য মূর্তি ছুঁড়ে জলে ফেলে দিতো। এর প্রতিবিধানস্বরূপ মুনি ঋষিগণ ভাগ্যবিধান দেন যে, নল ও নীলের দ্বারা জলে ছোঁড়া কোনো প্রস্তরমূর্তি বা প্রস্তর খণ্ডই জলে ডুববে না। আরেকটি জনশ্রুতি অনুসারে বরুণদেব রামদের আশ্বস্ত করে বলেন যে দেবস্থপতি নল ও নীলের দ্বারা জলে ফেলা পাথর জলে ডুববে না। কিন্তু সমুদ্রের স্রোতের ফলে তারা কেউই জলে স্থায়ীভাবে পাথরগুলো স্থাপন করতে অসফল হয়। এইসময়ে শ্রীরামভক্ত এবং বানরদের দলপতি হনুমান এই সমস্যার অদ্ভুত এক সমাধান করেন। তিনি পাথরে রাম নাম খোদিত করেন যেন তারা একে অপরের সাথে জুড়ে থাকে। এই সমাধানকল্পটি পরবর্তীতে কাজেও আসে।[৯]

তেলুগু এবং বাংলাতে যে আঞ্চলিক রামায়ণের সংস্করণগুলো রয়েছে, শুধু তাই নয় জাভার ছায়ানাটিকাগুলোর ক্ষেত্রেও সেতু নির্মাণে মূখ্য হিসাবে নল-নীল ও হনুমানের অবদানের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। নল তার অশুচি বাম হাত দিয়ে হনুমানকে পাথরগুলো হস্তান্তর করাতে তিনি বিশেষ দুঃখিত হন এবং নিজে নিজের শুচি ডানহাত দিয়ে সেগুলো সমুদ্রে প্রতিস্থাপিত করেন। এমতাবস্থায়, রাম হনুমানকে সান্ত্বনা দেন এবং বলেন যে কারিগরির ক্ষেত্রে এটাই নিয়ম যে নির্মাতারা বাম হাত দিয়ে জিনিস নেবে এবং ডান হাত দিয়ে তার সঠিক স্থানে রাখবে বা পরবর্তীজনকে দেবে।[১০]

পঞ্চদশ শতাব্দীতে লেখা আনন্দ রামায়ণ নামক রামায়ণের অপর একটি সংস্করণে উল্লেখ রয়েছে সেতু নির্মাণের আগে রাম নলের আনা নয়টি জ্যোতির্ময় পাথরকে নবগ্রহরূপে পূজা করেন।[১১]

যুদ্ধক্ষেত্র সম্পাদনা

 
কোম্পানি ধরনের পটে নলের চিত্র

দক্ষিণ ভারতীয় কম্ব রামায়ণ অনুসারে লঙ্কায় পৌঁছানোর পর নল নিজ তদারকিতে বানর সেনার থাকার জন্য একটি আবাসস্থল নির্মাণ করেছিলেন। তিনি সোনার মোড়কের ওপর রত্নখচিত তাবু দিয়ে ছোট্ট একটি শহর নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু নিজের থাকার জন্য অতিসামান্য বাঁশ, কাঠ ও ঘাস-পাতা দিয়ে একটি সাধারণ কুটির নির্মাণ করেছিলেন।[১২]

রাম-রাবণের যুদ্ধে নল রামের পক্ষে রাবণ ও তার রাক্ষস সৈন্যদলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। কাহিনী অনুসারে রাবণপুত্র ইন্দ্রজিতের বাণে নল গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলেন।[১৩] নল তপন নামে অপর এক রাক্ষসকে যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত করেন।[১৪] আবার মহাভারতের বিবরণে নল তুণ্ডক নামে এক দানবকে হত্যা করেছিলেন।[২]

জৈন সংস্করণ সম্পাদনা

জৈন গ্রন্থ অনুসারে নল জৈনদীক্ষা গ্রহণ করেন এবং বর্তমান মহারাষ্ট্রে অবস্থিত মাঙ্গী-তুঙ্গীর নিকট মোক্ষ লাভ করেন।[১৫]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Swamy p. 43
  2. Mani, Vettam (১৯৭৫)। Puranic Encyclopaedia: A Comprehensive Dictionary With Special Reference to the Epic and Puranic Literature। Delhi: Motilal Banarsidass। পৃষ্ঠা 519আইএসবিএন 0-8426-0822-2 
  3. Nanditha Krishna (১ মে ২০১৪)। Sacred Animals of India। Penguin Books Limited। পৃষ্ঠা 246। আইএসবিএন 978-81-8475-182-6 
  4. Venkatesananda p. 280
  5. Goldman p. 617
  6. Goldman p. 619
  7. Kamba Ramayana p. 287
  8. Tulasīdāsa (১৯৯৯)। Sri Ramacaritamanasa। Motilal Banarsidass। পৃষ্ঠা 582আইএসবিএন 978-81-208-0762-4 
  9. Lutgendorf p. 143
  10. Lutgendorf p. 204
  11. Swamy p. 53
  12. Kamba Ramayana pp. 287-8
  13. Venkatesananda p. 315
  14. Goldman p. 764
  15. "Mangi Tungi Temple"। ২০১৩-১০-০১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।