নবগ্রহ

৯টি জ্যোতির্বিজ্ঞানসংক্রান্ত দেবতাদের দল

গ্রহ (সংস্কৃত: ग्रह "seizing, laying hold of, holding",[]) বা নবগ্রহ (সংস্কৃত: नवग्रह, lit. nine planets) হল হিন্দু জ্যোতিষশাস্ত্রের কিছু পরিচিত প্রতীক ৷ এই নয়টি প্রতীক যা , সৌরজগতের গ্রহসমূহের সাথে তুলনীয় ৷ যেমন :সূর্যদেব(সূর্য), চন্দ্রদেব(চন্দ্র), মঙ্গলদেব(মঙ্গল), বুধদেব(বুধ), বৃহস্পতি(বৃহস্পতি গ্রহ), শুক্র(শুক্র গ্রহ), এবং শনিদেব(শনি), রাহুকেতু

নবগ্রহ, রাজা রবি ভার্মার আঁকা চিত্র
নবগ্রহের কারকত্ব:
সম্পাদনা

১। রবি - আত্মা, অহঙ্কার, আত্মসম্মান, উত্সাহ, প্রতিষ্ঠান, পিতা, জীবনীশক্তি, হৃদয় (heart), অস্থি (bones), উচ্চপদস্থ কর্মচারী, রাজনীতি, জ্বর, রক্তচাপ, মস্তক, চক্ষু (বিশেষতঃ ডান চক্ষু), রক্তবর্ণ, ঝাল ইত্যাদি। অপর নাম - ভানু, অর্ক, সবিতা, আদিত্য প্রভৃতি।

২। চন্দ্র - মন, শারীরিক পুষ্টি ও লাবণ্য, মাতা, শ্বেতবস্ত্র, আদর্শবাদিতা, শ্লেষ্মা, রক্ত (শ্বেতকণিকা), গলগণ্ড, জন সাধারণ, ফুসফুস, দেহের জলীয় অংশ, চক্ষু (বিশেষতঃ বাম চক্ষু), শ্বেতবর্ণ, লবণরস ইত্যাদি। অপর নাম - সোম, ইন্দু, শশাঙ্ক, উড়ুপ প্রভৃতি।

৩। মঙ্গল - সাহস, শক্তি, ক্ষিপ্রতা, ক্রোধ, অগ্নি, উগ্র মানসিকতা, কুমারত্ব, কর্মক্ষমতা, তর্ক, ভ্রাতা, রক্ত (লোহিতকণিকা), গুহ্যদেশ, রক্তচাপ, অর্শ, রক্তপাত, দুর্ঘটনা, জমি, ভূমি, আগুন, ক্ষত, কাটাছেঁড়া, গাঢ় রক্তবর্ণ, তিক্তরস ইত্যাদি। অপর নাম - কুজ, ভৌম, বক্র, ত্রুর, মহীজ প্রভৃতি।

৪। বুধ - পরিহাস, বালকসুলভ কথাবার্তা, বাকশক্তি, বুদ্ধি, স্মৃতিশক্তি, অস্থিরচিত্ততা, বিচার বিশ্লেষণ, ভাল মন্দ বিচার করার ক্ষমতা, মুদ্রিত রচনা, খবর, তথ্য, তথ্য আদান-প্রদান, সংবাদ, হিসাব, লেখন, জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিষ, গণিতশাস্ত্র,ব্যাবসা বাণিজ্য, অম্লরস, ত্বক, স্নায়ু, নাক, গলগ্রন্থি (thyroid gland), নিঃশ্বাস, সর্দি, জিহবারোগ, ইত্যাদি। অপর নাম - সৌম্য, হেম, সোমসুত, চন্দ্রসুত, চন্দ্রজ, প্রভৃতি।

৫। বৃহস্পতি - পূজাআর্চা,ধন, শাস্ত্রপাঠ, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বাগ্মিতা, জানুদেশ, যকৃত্, প্লীহা, বাকশক্তি, স্থূলতা, মধুমেহ (blood sugar or diabetes), শ্লেষ্মা, যকৃৎ ও মূত্রাশয়, ধর্ম, গুরু, আধ্যাত্মিকতা, মূল্যবোধ, আদর্শবাদিতা, পুরোহিত, শিক্ষক, শাস্ত্রপাঠ, আইনবিদ্যা, আইনজ্ঞ, বিদ্যা, মধুর রস ইত্যাদি। অপর নাম - গুরু, জীব, আর্য, সূরি প্রভৃতি।

৬। শুক্র - কাম-সম্বন্ধীয় কার্য, জাগতিক সুখ, বিভিন্ন শাস্ত্র, আমোদ-প্রমোদ, শৌখিন ও বিলাস দ্রব্য, সৌন্দর্য, মাধুর্য, মুখমণ্ডল, মোহ, শিল্প, সঙ্গীত, শয়নসুখ, দৃষ্টিশক্তি, যৌন আকর্ষণ, যৌনরোগ, অম্ল রস ইত্যাদি। অপর নাম - কবি, সিত, ভার্গব, উশনা, ভৃগু, দৈত্যগুরু প্রভৃতি।

৭। শনি - বৃদ্ধ, বয়স্ক লোক, বিলম্ব, শৃÍলা, দুরারোগ্য ব্যাধি, নিঃসঙ্গতা, ক্লেশ, দুঃখ, দুঃশ্চিন্তা, ভীতি, মৃত্যু, অস্থিপীড়া, পক্ষাঘাত, মৃত্যুভয়, বধিরতা, শরীর কম্পন, শ্বাসরোগ, যক্ষ্মা, আয়ু, সংযমী, স্বল্পতা, বিচ্ছেদ, সন্ন্যাসী, ত্যাগ, শ্রম,নীল, ধৈর্য, শ্রমিক, আধ্যাত্মিকতা, নিম্নবর্গের লোক, দাস দাসী, অস্থি, দাঁত, পর্বত ভ্রমণ, কেশ, কষায় রস ইত্যাদি। অপর নাম - যম, মন্দ, রবিসুত, শনৈশ্চর, অর্কপুত্র প্রভৃতি।

৮। রাহু - ভোগ, কপটাচার, বিভ্রান্তি, অতৃপ্তি, আকাশ পথ, বিদেশ যাত্রা, উচ্চস্থান, শ্বাসপ্রশ্বাস, অপবাদ, তমোগুণ, যথেচ্ছাচার, সর্প, ইন্দ্রজাল, অনির্ণিত রোগ ইত্যাদি। অপর নাম - তম, অহি, অসুর, ভুজঙ্গ প্রভৃতি।

৯। কেতু - গোপনিয়তা, ব্রণ, আচম্বিতে ঘটা ঘটনা, আঘাত, ক্ষত, মোক্ষ, কৈবল্য ইত্যাদি। অপর নাম - শিখী, ধবজ, রাহুপুচ্ছ, ধুমবর্ণ প্রভৃতি।

জ্যোতিষশাস্ত্রে একটা খুব প্রচলিত কথা আছে। ‘শনিবত্ রাহু’ ও ‘কুজবৎ কেতু’। রাহু ও কেতু অনেক বিষয়েই যথাক্রমে শনি ও মঙ্গলের মত বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে ও তদনুরূপ ফল প্রদান করে।

 
সূর্য তার সাত অশ্বের রথে

সূর্য (সংস্কৃত: सूर्य, Sūrya, "সর্বোচ্চ আলোক"[]) নবগ্রহের মধ্যে প্রধান। তিনি ঋষি কশ্যপের পুত্র ৷ তার কেশ এবং বাহু স্বর্ণের ৷ তার রথ সাতটি ঘোড়া দ্বারা চালিত হয়। তার রথের সারথি হলো অরুণদেব। তার সম্মানার্থে সপ্তাহের একটি দিন হল রবিবার ৷ তার স্ত্রীর নাম সংঙ্গা ও ছায়া। তার অস্ত্র ভগবান বিষ্ণুর অস্ত্রের মতোই।যথাঃ শঙ্খ,চক্র,গদা ও পদ্ম। তার কয়েকটি নাম হলোঃ সূর্য নারায়ণ,আদিত্য,রবি ইত্যাদি। এনার সন্তানরা হলেনঃ— কর্ণ,যম,যমুনা,শনি,ভদ্রা,তপতী,অশ্বিনী-কুমারদ্বয় প্রমুখ।

চন্দ্র

সম্পাদনা
 
চন্দ্র তার রথের উপর উপবিষ্ট (১৯শতকের আঁকা চিত্র)

চন্দ্র (Telugu: Soma, Tamil: Tiṅkaḷ) একজন দেবতা ৷ তিনি সুদর্শন, সুপুরূষ, দ্বি-বাহুযুক্ত ও তার এক হাতে অস্ত্র ও অন্য হাতে পদ্ম ৷ তিনি তার সাতটি হরিণের শ্বেত রথে চড়ে রাত্রে আকাশে উদিত হন ৷ [] তার সম্মানার্থে সপ্তাহের একটি দিন হল সোমবার ৷ তার গায়ের রং শ্বেতবর্ণ। তিনি মহাদেবের জটায় অর্ধচন্দ্র রুপে বিরাজমান। তিনি প্রজাপতি দক্ষের ২৭টি কন্যার জামাতা।

 
মঙ্গল তার বাহনের পিঠে উপবিষ্ট

"মঙ্গল" (সংস্কৃত: मंगल, কন্নড়: ಮಂಗಳ, তেলুগু : మంగళ,(Angaraka), তামিল: செவ்வாய், cevvāi) হলেন ভূমির পুত্র ৷ [] তিনি যুদ্ধের দেবতা এবং অবিবাহিত ৷ তাকে পৃথিবী/ভূমি দেবীর পুত্র বলা হয়। তার দেহে বিজয় এবং গর্বের চিহ্ন বর্তমান, তার চতুর্বাহু ৷ তার সম্মানার্থে সপ্তাহের একটি দিন হল মঙ্গলবার। তার গায়ের রং লাল। তার বাহন মেষ।


বুধ (সংস্কৃত: बुध) হল একটি সংস্কৃত শব্দ যে শব্দের অর্থ হল গ্রহ। বুধগ্রহ.[১] বুধ, হলেন একজন পৌরাণিক চরিত্র,এছাড়াও তিনি একজন দেবতাও।[২] এছাড়াও তিনি আরও অনেক নামে পরিচিত যেমন সৌম্য (সংস্কৃত: सौम्य, অর্থ: চন্দ্রের পুত্র), রোহিনেয়(রোহিণীর পুত্র) এবং Tunga।[২] তার নামানুসারে সপ্তাহের একটি দিনের নাম বুধবার।বুধ'কে ভারতীয় গ্রন্থে একজন দেবতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রায়শই তাকে চন্দ্র এবং তারার(বৃহস্পতির পত্নী) পুত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এবং তিনি বিকল্পভাবে দেবী রোহিণী এবং চন্দ্রদেবের পুত্র হিসেবে বর্ণিত হন। তার চার হাত। তার পত্নী ইলা। শ্রীবুধের বাহন সিংহ।

বৃহস্পতি/দেবগুরু

সম্পাদনা

বৃহস্পতি (সংস্কৃত: बृहस्पति ): বৃহস্পতি দেবতাদের গুরু। তিনি অঙ্গীরা ঋষির পুত্র। তিনি মহাদেবের তপস্যা করেন। মহাদেব তার তপস্যায় তুষ্ট হয়ে তাকে দেবতাদের গুরু বা আচার্য পদে নিযুক্ত করেন। বৃহস্পতি চার হাত বিশিষ্ট। তার হাতে থাকত দন্ড, পদ্ম ও জপমালা। তিনি হলুদ বর্ণের বস্ত্র পরিধান করেন। তার বাহন হস্তি। তার পত্নী তারা দেবী। তার সম্মানার্থে সপ্তাহের একটি দিন হল বৃহস্পতিবার।

শনি (সংস্কৃত: शनि, কন্নড়: ಶನಿ , তামিল: சனி, Caṉi, তেলুগু: శని) নবগ্রহের একটি অন্যতম গ্রহ, শনি গ্রহকে গ্রহরাজ-ও মহাগ্রহ বলা হয়ে থাকে। শনিদেব হিন্দুধর্ম মতে একজন দেবতা। জ্যোতিষীদের মতে শনির কুদৃষ্টি অশুভ ফল নিয়ে আসে। তিনি খারাপের জন্য খারাপ ও ভালোর জন্য ভালো ফল বয়ে আনেন। সৌরজগতের শনি গ্রহ ও সপ্তাহের শনিবার দিনটি শনিদেবের নামে নামকরণ করা হয়। শনিদেব কে শনিশ্চর বা শনৈশ্চর নামেও ডাকা হয়। তার পত্নী ধামিনী। তার সন্তান মান্দী ও কূলিগ্না। তিনি সূর্যদেব ও ছায়ার পুত্র। তার চার হাত। তার হাতে ধনুক,বাণ,ত্রিশুল ও গদা থাকে। তার গায়ের রং কালো। তিনি ধীর গতির তাই তিনি আস্তে চলেন। তার বাহন কাক বা শকুন।

শুক্র/দৈত্যগুরু

সম্পাদনা

শুক্র (সংস্কৃত: शुक्र, উচ্চারণ: Śukra) যে শব্দের অর্থ "নির্মল, স্বচ্ছ, উজ্জ্বল, একজন প্রাচীন ঋষিদেবতা যিনি বৈদিক পুরাণ অনুসারে অসুরদৈত্যদের গুরু। তার সম্মানার্থে সপ্তাহের একটি দিন হল শুক্রবার। তিনি মহাদেবের তপস্যা করে মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা প্রাপ্ত হন। এঁর বাহন হল সাদা ঘোড়া।

রাহু( ), হিন্দু জ্যোতিষ অনুসারে,স্বরভানু নামে এক অসুরের কর্তিত মুন্ড, যে গ্রহণের সময় সূর্য বা চন্দ্রকে গ্রাস করে। জ্যোতিষশাস্ত্রে, একে নবগ্রহের মধ্যে একটি স্থান দেওয়া হয়েছে। দিবাভাগে রাহুকাল নামক মুহূর্তকে (২৪ মিনিট) অশুভ বলে গণ্য করা হয়।[] এর আবাস পাতাললোকে। এর বাহন নীল বা কালো ঘোড়া। স্বরভানুর মুন্ডকে রাহু ও দেহকে কেতু নাম দেওয়া হয়েছে। ব্রহ্মাদেব রাহু ও কেতুকে গ্রহের স্থান দিয়েছে।

কেতু( ), পুরাণ অনুসারে, ইহা স্বরভানু নামক এক অসুরের মস্তকহীন দেহ যা সমুদ্র মন্থনের সময় ভগবান বিষ্ণু আপন সুদর্শন চক্রের মাধ্যমে এর মুন্ড ছিন্ন করে দেন। বৈদিক জ্যোতিষশাস্ত্রে, একে নবগ্রহের মধ্যে একটি স্থান দেওয়া হয়েছে। [] কেতুর আবাস অসুরলোকে। কেতুর বাহন চিল।

মন্দির

সম্পাদনা
 
Navagraha sculpture from Bihar, India, 10th century, now at the San Diego Museum of Art
 
Navagraha statues from Konark, Odisha at British Museum

তথ্যসূত্রঃ

সম্পাদনা
  1. Sanskrit-English Dictionary by Monier-Williams, (c) 1899
  2. Wilhelm, Ernst. Graha Sutras, Kala Occult Publishers, p.49. আইএসবিএন ০-৯৭০৯৬৩৬-৪-৫
  3. Mythology of the Hindus By Charles Coleman p.132
  4. Gopal, Madan (১৯৯০)। K.S. Gautam, সম্পাদক। India through the ages। Publication Division, Ministry of Information and Broadcasting, Government of India। পৃষ্ঠা 75 
  5. Gopal, Madan (১৯৯০)। K.S. Gautam, সম্পাদক। India through the ages। Publication Division, Ministry of Information and Broadcasting, Government of India। পৃষ্ঠা 77 
  6. [১]

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা