দারাদাস
দারাদাস -রা ছিল এক প্রাচীন জনসম্প্রদায় যারা ভারতের কাশ্মীর উপত্যকার উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে বসবাস করত। এই অঞ্চলটিকে বর্তমানে গিলগিত অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। গিলগিত-বালতিস্তান অঞ্চল প্রাচীন বালোরিস্তানের অংশ[১] এবং এটি সিন্ধু নদীর উপকূল অঞ্চল বরাবর বিস্তৃত। দারাদাসদের প্রায়শই স্থানীয় আরেক জাতি কম্বোজদের সাথে তুলনা করা হয়। কম্বোজদের সাথে দারাদাসদের একত্রে উল্লেখ করা হত। মহাভারত অনুসারে পাণ্ডব বীর অর্জুন যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের জন্য কর আদায় করতে উত্তর অভিমুখে সামরিক অভিযানে গিয়েছিলেন। তখন তিনি যাত্রাপথে দারাদাসের দেশে উপস্থিত হয়েছিলেন।
দারাসরা সম্ভবত একটি পাহাড়ী উপজাতি ছিল কারণ দরদ শব্দের সবচেয়ে সাধারণ অর্থ হল পর্বত, যেখান থেকে তারা তাদের নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে হয়।[২] দারদাসদের ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন নামে অভিহিত করেন। তারা দারদাই, দেরদাই, দারদানোই ইত্যাদি নামে পরিচিত।[২]
দারাদাসদের বাসস্থান
সম্পাদনাবায়ুপুরাণ, ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ এবং বামনপুরাণে কম্বোজ, চিনা, তুষার এবং বাহলিকা ইত্যাদি জাতির সাথে দারাদাসদেরও উল্লেখ করা হয়েছে। পুরাণের ভুবনকোষ অনুযায়ী প্রাচীন ভারতের উত্তরাপথ অঞ্চল দারাদাস, কম্বোজ, বারবার, বাহলিকা, লম্পক ইত্যাদি জাতির বাসস্থান ছিল।[৩]
বিষ্ণু পুরাণ অনুযায়ী দারাদাসরা অভিরা এবং কাশ্মীরীদের সাথে সম্পর্কিত কিন্তু মতস্য পুরান অনুযায়ী দারদা বা দারাদাসরা সিন্ধু নদীর অববাহিকা অঞ্চলে স্থিত গান্ধার, শিবপুর, উর্জা, আওরাসা এবং অন্যান্য জেলায় বসবাস করতেন।[২]
পুরাণে উল্লেখ করা আছে যে দারাদাস, গান্ধার এবং আউরসাস (উরসাস) জনজাতিদের বাসভুমি সিন্ধু নদীর জলে পরিপুষ্ট ছিল। বৃহৎসংহিতা গ্রন্থে বরাহমিহির দারাদাস, অভিসার এবং টাঙ্গনাদের একই শ্রেনীর অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
মহাভারতে কম্বোজ ও বাহলিকাদের প্রতিবেশী হিসেবে দারাদাসদের উল্লেখ করা হয়েছে।[৪] মহাভারতে হিমবত-প্রদেশ-কে দারাদাসের দেশ হিসাবে সনাক্ত করা হয়েছে।
মহাকাব্য ও পুরাণের তথ্য অনুসারে দারাদাসদের বাসভূমি হিসাবে যে অঞ্চলটি চিহ্নিত করা হয় সেটি কাশ্মীরের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল বরাবর বিস্তৃত এবং পাঞ্জাবের উচ্চভূমি অঞ্চলে অবস্থিত 'খস' জনজাতিদের বসতি অঞ্চলের নিকটবর্তী স্থান।[২]
টলেমি দারাদাসদের সিন্ধু নদীর উৎসভূমির নিম্ন অঞ্চলের অধিবাসী হিসাবে উল্লেখ করেছেন।হিরোডোটাস দারাদাসদের ড্যাডিকাই হিসাবে উল্লেখ করেছেন এবং তাদের গান্ধার এবং অ্যাপারিটাইয়ের সাথে একই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। হেরোডোটাস এবং স্ট্রাবো তিব্বতের পশ্চিমে স্থিত সোনার খনি সমৃদ্ধ এলাকা দারাদাসদের বাসস্থান হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। কিছু তথ্যপ্রমাণ অনুসারে বলা হয় যে প্রাচীনকালে বালতিস্তান এবং লেহতেও দারাদাসদের উপনিবেশ ছিল।
সমস্ত বিশ্বস্ত ঐতিহাসিক উল্লেখগুলি দারাদাসদের উত্তরাপথের অধিবাসী কাশ্মীরের- নুরিস্তান ও কম্বোজদের প্রতিবেশী হিসাবে চিহ্নিত করেছে।
অর্জুনের সাথে যুদ্ধ
সম্পাদনামহাভারতের সভা পর্ব অনুযায়ী অর্জুন কাশ্মীর, উরসা, অভিসার, সিংহপুর, সুম্ভাস, দারাদাস, কম্বোজ, বাহলিকা, লোহা, ঋষিক, পরমা, কম্বোজ ইত্যাদি জাতির বিরুদ্ধে দিগ্বিজয় অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। [৫]
কৃষ্ণের সাথে যুদ্ধ
সম্পাদনামহাভারতের দ্রোণ পর্ব অনুসারে কৃষ্ণ অঙ্গ, বঙ্গ, মগধ, কাশী, কোশল, বৎস, গর্গ, কারুশ, পুন্ড্র, অবন্তী, দাসেরকা, কাশ্মীর, উরসা, মদুগলস, কম্বোজ, পিসাচস, মালাবস, মালাভস ইত্যাদি জনজাতির লোকেদের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। কথিত আছে তিনি দারাদাসদেরও পরাজিত করেছিলেন।[২][৬]
যুধিষ্ঠরের রাজসূয় যজ্ঞে
সম্পাদনামহাভারতে উল্লেখ আছে যে দারাদাস সহ উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে আগত বাহলিকা, কিরাত, পাহলাব, পরাদ, কম্বোজ, শক, যবন, ত্রিগর্ত, ক্ষুদ্রক, মালাব, অঙ্গস, বঙ্গ প্রভৃতি অসংখ্য উপজাতিরা সম্রাট যুধিষ্ঠর -এর রাজসূয় অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন এবং তার জন্য নিজ রাজ্য থেকে অসংখ্য উপহার এনেছিলেন। [৭]
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে দারাদাস
সম্পাদনামহাভারত অনুসারে কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে সংঘটিত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধেও দারাদাসরা অংশগ্রহণ করেছিলেন। তারা উত্তর পশ্চিম থেকে আগত সৌভিরা, বাহলিকা, শক, যবন, পল্লব, পরাদ, কেকায়, কম্বোজ, মাদ্রাজ, ম্লেচা ইত্যাদি বিভিন্ন উপজাতির সাথে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন।[২][৮] তারা কৌরবদের পক্ষ থেকে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন।[২]
দারাদাসদের ঘোড়া
সম্পাদনাব্রহ্মাণ্ড পুরাণে দারাদাসদের দেশের ঘোড়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। [৯]
বরাহমিহির বৃহৎসংহিতায় দারাদাস
সম্পাদনাবরাহমিহির কর্তৃক ৬ষ্ঠ শতকে রচিত বৃহতসংহিতায় শক, যবন, পরদ এবং কম্বোজদের সাথে দারাদাসদের উল্লেখ আছে। [১০] কাশ্মীরের সীমান্তে বসবাসকারী অভিবাসীদের মধ্যে তাদের নাম উল্লেখ করা আছে।[১১]
তিব্বতি ইতিহাসে দারাদাস
সম্পাদনাতিব্বতীয় ইতিহাসগ্রন্থ কল্পবৃক্ষ -তে, যবন, কম্বোজ, তুখারা, হুনা, খাস ইত্যাদির সাথে দারাদাসদের উল্লেখ আছে [১২]
রাজতরঙ্গিনীতে দারাদাসের উল্লেখ
সম্পাদনাদারদারা কাশ্মীরের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল এবং প্রায়শই রাজতরঙ্গিনীতে তাদের উল্লেখ করা হয়।[২] কল্হনের রচিত প্রাচীন কাশ্মীরের ইতিহাস গ্রন্থ রাজতরঙ্গিনী অনুসারে, কাশ্মীরের রাজা ললিতাদিত্য প্রাচীন কাশ্মীরের উত্তরের অঞ্চলে যুদ্ধ অভিযান পরিচালনা করেন এবং প্রথমে তিনি কম্বোজদের সাথে যুদ্ধ করেন।[১৩] কম্বোজদের পর তিনি তুখরাদের রাজ্য দখলের উদ্দেশে যান। তুখাররা তার সাথে যুদ্ধ না করে পলায়ন করেন। [১৪] তারপর ললিতাদিত্য কাশ্মীরের উত্তরে পশ্চিম তিব্বতের বাল্টিস্তানে ভাট্টা,[১৫] কারাকোরাম হিমালয়ের দারাদাস,[১৬] ভালুকামবুধি [১৭] ইত্যাদি রাজ্য আক্রমন করেন। তারপর তিনি স্ত্রীরাজ্য,[১৮] উত্তরাকুরুস [১৯] এবং প্রাগজ্যোতিষ -দের রাজ্য পরপর আক্রমন করেন।
কলহন তার রচনায় বেশ কয়েকজন দারাদাস শাসকের নাম উল্লেখ করেছেন যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, আকালমঙ্গলা, (কাশ্মীরের রাজা অনন্তের রাজত্বকালে অর্থাত ১০২৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১০৬৩ খ্রিস্টাব্দের সময়কালে তিনি দারাদাসদের রাজা ছিলেন) [২০], বিদ্যাধর শাহী (রাজা হর্ষের রাজত্বকাল অর্থাত ১০৮৯-১১০১ খ্রিস্টাব্দের সময়কালে তিনি দারাদাসদের রাজা ছিলেন),[২১] জগদ্দল (রাজা উচালার রাজত্বকাল অর্থাত ১১০১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১১১১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়কালে তিনি দারাদাসদের রাজা ছিলেন),[২২] মণিধারা (রাজা সুসালার রাজত্বকাল অর্থাত ১১১২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১১২০ খ্রিস্টাব্দ [২৩] -এর মধ্যবর্তী সময়কালে তিনি দারাদাসদের রাজা ছিলেন), এবং যশোধরা (রাজা জয়সিংহের রাজত্বকাল অর্থাত ১১২৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১১৪৯ খ্রিঃ -এর মধ্যবর্তী সময়কালে তিনি দারাদাসদের রাজা ছিলেন)। [২৪]
উৎকীর্ণ লিপিতে দারাদাসের উল্লেখ
সম্পাদনাকারাকোরামের দক্ষিণ প্রান্তে সিন্ধু ও গিলগিত নদীর ধারে তিনটি প্রাচীন শিলালিপি পাওয়া গেছে যাতে দারাদাস রাজাদের উল্লেখ আছে। বর্তমানে যেখানে গিলগিত এবং স্কার্ডু অঞ্চলের মধ্যবর্তী রাস্তা গিলগিত নদীকে অতিক্রম করে অগ্রসর হয়েছে, সেখানে একটি পাথরের উপর প্রথম শিলালিপিটি পাওয়া যায়। শিলালিপিটি অপটু খরোষ্ঠীতে লিখিত।[২৫] দ্বিতীয় শিলালিপিটি গিলগিত নদী এবং সিন্ধু নদীর সংযোগস্থলের দক্ষিণে অবস্থিত চিলাস গ্রামের চিলাস টেরেস অঞ্চলে পাওয়া গেছে। এটি ব্রাহ্মী লিপিতে লিখিত। এখানে দারানের মহান রাজা বা দারানদের মহান রাজা -এর উল্লেখ পাওয়া যায়। তৃতীয় একটি শিলালিপি সিন্ধু নদীর উপর নির্মিত থালপান সেতুর ঠিক নীচে পাওয়া গেছে। এটিও ব্রাহ্মী লিপিতে লিখিত। এই শিলালিপিগুলিই দারাদাস সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের একমাত্র নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক দলিল হিসাবে চিহ্নিত।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Jettmar, Karl। "Petroglyphs as Evidence for Religious Configurations?" (পিডিএফ)। Archived from the original on ২০১৭-০৭-৩০। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৭-১৫।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ "Daradas"।
- ↑ Kirfel's text of the Uttarapatha Countries of Bhuvanakosha, based on the Puranas.
- ↑ Mahabharata II.27.20-23
- ↑ Mahabharata II.27.18-25.
- ↑ MBH 7.13.15-18.
- ↑ Mahabharata 2.51-2.53; 3.51
- ↑ Mahabharata 6.51, 6.118, 7.20, 7.90, 7.116, 7.118, 8.73 etc
- ↑ Brahmanda Purana, III, Upodghata -pada 16-17
- ↑ Brhatasamhita verse 13.09
- ↑ Brhatsamhita verse 14.29.
- ↑ Tho-gar yul dań yabana dań Kambodza dań Khasa dań Huna dań Darta dań...(See: Pag-Sam-Jon-Zang (1908), I.9, Sarat Chandra Das; Ancient Kamboja, 1971, p 66, H. W. Bailey.
- ↑ Rajatrangini: 4.164- 4.165
- ↑ Rajatrangini 4.166.
- ↑ Rajatrangini 4.168
- ↑ Rajatrangini 4.169, 4.171
- ↑ Rajatrangini 4.172
- ↑ Rajatrangini 4.173-174
- ↑ Rajatrangini 4.175
- ↑ Rajatrangini VII, 167
- ↑ Rajatrangini VII, 913
- ↑ Rajatrangini VIII, 209
- ↑ Rajatrangini VIII, 614
- ↑ Rajatrangini VIII, 2454
- ↑ Fussman 1978:1-6.