গান্ধার

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন অঞ্চল ও তৎকালীন রাজ্য

গান্ধার আফগানিস্তানপাকিস্তানের কাবুলসোয়াত নদীর তীরে অবস্থিত একটি প্রাচীন ইন্দো-আর্য রাজ্য[] এটি প্রাচীন ভারতের ১৬টি মহাজনপদের মধ্যে একটি।[][] হাখমানেশী যুগে এবং হেলেনীয় সময় কালের রাজ্যটির রাজধানী ছিল চরসদ্দা, কিন্তু পরে ১২৭ খ্রিষ্টাব্দে মহান কুষাণ সম্রাট কণিষ্ক দ্বারা রাজধানী পেশাওয়ার শহরে স্থানান্তরিত হয়েছিল।

গান্ধার

প্রায় ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ–৫৩৫ খ্রিস্টাব্দ
বৈদিক যুগের পরবর্তী সময়ে গান্ধার এবং অন্যান্য মহাজনপদ
বৈদিক যুগের পরবর্তী সময়ে গান্ধার এবং অন্যান্য মহাজনপদ
বর্তমানে উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তান এবং উত্তর-পূর্বে আফগানিস্তান গান্ধার মহাজনপদের আনুমানিক সীমানা।
বর্তমানে উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তান এবং উত্তর-পূর্বে আফগানিস্তান গান্ধার মহাজনপদের আনুমানিক সীমানা।
রাজধানীকাপিসি (বর্তমানে বাগরাম,পারওয়ান প্রদেশ)
পুষ্কলাবতী (বর্তমানে চরসাদ্দা,খাইবার পাখতুনখোয়া) এবং তক্ষশীলা,রাওয়ালপিন্ডি বিভাগ এবং পরে পুরুপুরা(পেশাওয়ার,খাইবার পাখতুনখোয়া)
সরকাররাজতন্ত্র
• প্রায় ৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
নাগনাজিৎ
• প্রায় ৫১৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
পুষ্করাশক্তি
ঐতিহাসিক যুগপ্রাচীন যুগ
• প্রতিষ্ঠা
প্রায় ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
• বিলুপ্ত
৫৩৫ খ্রিস্টাব্দ
বর্তমানে যার অংশ আফগানিস্তান
 পাকিস্তান

ঋগ্বেদের (১৫০০-১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)[][] সময় থেকে গান্ধারের অস্তিত্ব ছিল, পাশাপাশি জরাথুস্ট্রীয় আবেস্তায় এটি অহুর মজদা দ্বারা নির্মিত পৃথিবীর ষষ্ঠ সবচেয়ে সুন্দর জায়গা ভাক্করুত্তা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে হাখমানেশী সাম্রাজ্য গান্ধার রাজ্যকে অধিকৃত করে। ৩২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মহান আলেকজান্ডার গান্ধার রাজ্য জয় করে; পরবর্তীকালে এটি মৌর্য সাম্রাজ্যের অংশ হয়ে ওঠে এবং তারপর ইন্দো-গ্রিক রাজত্বের অংশ হয়ে ওঠে। ইন্দো-গ্রীক রাজবংশের অধীনে গ্রেকো-বৌদ্ধধর্মের জন্য এই অঞ্চলটি একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল এবং পরবর্তী সাম্রাজ্যের অধীনে গান্ধার-বৌদ্ধধর্মের জন্য এই অঞ্চলটি একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল। এটি মধ্য এশিয়াপূর্ব এশিয়ায় বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তারের কেন্দ্রীয় স্থান ছিল।[] এটি ব্যাক্ট্রিয়ান জরাথুস্ট্রবাদ এবং হিন্দুধর্মেরও কেন্দ্র ছিল।[] গান্ধার (গেরো-বৌদ্ধ) শিল্প স্থানীয় ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত। এটি কুষাণ সাম্রাজ্যের অধীনে প্রথম শতাব্দীর থেকে ৫ম শতাব্দীর মধ্যে তার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন। গান্ধার "এশিয়ার পারাপারের রাস্তা হিসেবে উদিত হয়ে" বাণিজ্য পথকে সংযুক্ত করে এবং বিভিন্ন সভ্যতার সাংস্কৃতিক প্রভাবগুলো গ্রহণ করে; ইসলাম ধর্ম এই অঞ্চলে রাজত্ব করতে শুরু করার পূর্বে ৮ম থেকে ৯ম শতাব্দী পর্যন্ত রাজ্যটি বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল।[] ১১তম শতাব্দী পর্যন্ত পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকায় বৌদ্ধধর্মের প্রভাব স্থির ছিল।[]

ফার্সি শব্দটি 'শাহী' ইতিহাসবিদ আল-বুরুনি[১০] ব্যবহার করে রাজকীয় রাজবংশের[১১] উল্লেখ করেছিলেন, যা কাবুল শাহী[১২] থেকে এসেছিল এবং ১০তম ও ১১তম শতাব্দীর ইসলামিক বিজয়গুলোর পূর্বে এই অঞ্চলটিতে শাসন করেছিলেন। ১০০১ খ্রিষ্টাব্দে গাজনির মাহমুদ জয়লাভের পর গান্ধার নামটি অদৃশ্য হয়ে যায়। মুসলিম আমলে, লাহোর থেকে বা কাবুল থেকে অঞ্চলটি পরিচালিত হতো। মুঘল আমলে এটি কাবুল প্রদেশর একটি স্বাধীন জেলা ছিল।

ইতিহাস

সম্পাদনা
 
মাতৃ দেবী (উর্বরতা দেবী), সম্ভবত সিন্ধু সভ্যতা থেকে প্রাপ্ত (টেরাকোটা, সার ধেরী, গান্ধার, খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী, ভিক্টোরিয়া ও অ্যালবার্ট যাদুঘর

প্রস্তর যুগ

সম্পাদনা

গান্ধারে পাথরের সরঞ্জাম ও পুড়ে যাওয়া হাড়সহ প্রস্তর যুগের মানুষের বসবাসের প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা মর্দানের নিকটবর্তী সাংহো অঞ্চলের গুহাগুলোতে আবিষ্কৃত হয়েছিল। গুহাগুলোর শিল্পকর্ম প্রায় ১৫,০০০ বছরের পুরানো। আরো সাম্প্রতিক খনন কার্যে পাওয়া তথ্য প্রমাণ বর্তমান সময়ের থেকে ৩০,০০০ বছর আগের সময়কালের ইতিহাসকে নির্দেশ করে।

পুনঃআবিষ্কার

সম্পাদনা

গান্ধার গজনীর মাহমুদের সাম্রাজ্যের মধ্যে বিলীন হওয়ার সময়, বৌদ্ধ ভবনগুলি ইতিমধ্যেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং গান্ধার শিল্প বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল। আল-বিরুনির পরে, কাশ্মীরি লেখক কালহানা 1151 সালে তাঁর রাজতরঙ্গিনী বইটি লিখেছিলেন। তিনি গান্ধারে সংঘটিত কিছু ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন এবং এর শেষ রাজবংশ এবং রাজধানী উদভান্ডপুরা সম্পর্কে বিশদ বিবরণ দিয়েছেন ।

19 শতকে, ব্রিটিশ সৈন্য এবং প্রশাসকরা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন ইতিহাসে আগ্রহী হতে শুরু করে। 1830-এর দশকে অশোক-পরবর্তী সময়ের মুদ্রা আবিষ্কৃত হয় এবং একই সময়ে চীনা ভ্রমণকাহিনীগুলি অনুবাদ করা হয়। চার্লস ম্যাসন , জেমস প্রিন্সেপ এবং আলেকজান্ডার কানিংহাম খরোষ্টির পাঠোদ্ধার করেন1838 সালে লিপি। চীনা রেকর্ডগুলি বৌদ্ধ উপাসনালয়ের জন্য অবস্থান এবং সাইটের পরিকল্পনা প্রদান করে। মুদ্রা আবিষ্কারের পাশাপাশি, এই নথিগুলি গান্ধার ইতিহাসকে একত্রিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সূত্র প্রদান করে। 1848 সালে কানিংহাম পেশোয়ারের উত্তরে গান্ধার ভাস্কর্য খুঁজে পান। তিনি 1860-এর দশকে তক্ষশীলার স্থানটিও চিহ্নিত করেছিলেন। এরপর থেকে পেশোয়ার উপত্যকায় প্রচুর পরিমাণে বৌদ্ধ মূর্তি আবিষ্কৃত হয়।

প্রত্নতাত্ত্বিক জন মার্শাল 1912 থেকে 1934 সালের মধ্যে তক্ষশীলায় খনন করেন। তিনি পৃথক গ্রীক, পার্থিয়ান এবং কুশান শহর এবং প্রচুর সংখ্যক স্তুপ ও মঠ আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কারগুলি গান্ধার ইতিহাস এবং এর শিল্পকলার আরও অনেক কিছুকে একত্রিত করতে সাহায্য করেছিল।

1947 সালের পর আহমেদ হাসান দানি এবং পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ পেশোয়ার এবং সোয়াত উপত্যকায় বেশ কিছু আবিষ্কার করেন। গান্ধার সভ্যতার অনেক স্থানের খনন কাজ পেশোয়ার এবং বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা করছেন।

গান্ধার শিল্প

সম্পাদনা

গান্ধার প্রায় পাঁচ শতাব্দীকাল-খ্রীস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর মধ্যভাগ হইতে খ্রীস্টীয় পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত- ভারতীয় শিল্পের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র ছিল। ভৌগোলিক কারণে এই অঞ্চল পারসিক, গ্রীক, রোমক, শক ও কুষাণগণের প্রভাবাধীন হইয়াছিল। গান্ধার শিল্প গ্রীক আদর্শ ও শিল্পরীতির দ্বারা অনুপ্রাণিত হইয়াও ভারতীয় ইতিবৃত্ত, রূপক, উপকথা এবং মূর্তিনির্মাণরীতির ধারা অনুসরণ করিয়াছিল। বৌদ্ধ কিংবদন্তী এবং দেবমণ্ডলী সম্পর্কিত বিষয়কে বিশেষ প্রাধান্ত দেওয়া হইত। গান্ধার শিল্পে ভারতীয় মূর্তিকে বিদেশী আবরণে দেখা যায়।

তক্ষশিলা ও হান্দা (আফগানিস্থানে জালালাবাদের নিকটবর্তী) গান্ধার শিল্পের প্রধান কেন্দ্র ছিল। কুষাণ যুগে এই শিল্পের পূর্ণ বিকাশ হয়। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মাধ্যমে গান্ধার শিল্পের প্রভাব মধ্য এশিয়া ও চীনে প্রসারিত হয়। মৌর্যোত্তর যুগের দুইটি প্রধান শিল্পকেন্দ্র মথুরা ও অমরাবতীর (বিদর্ভে অবস্থিত) শিল্পকীর্তি গুলির উপর গান্ধার শিল্পের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Lendering, Jona। "Gandara"। LIVIUS – Articles on Ancient History। ১৯ জুলাই ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৯ জানুয়ারি ২০১১ 
  2. Higham, Charles (২০১৪), Encyclopedia of Ancient Asian Civilizations, Infobase Publishing, পৃষ্ঠা 209–, আইএসবিএন 978-1-4381-0996-1 
  3. Khoinaijam Rita Devi (১ জানুয়ারি ২০০৭)। History of ancient India: on the basis of Buddhist literature। Akansha Publishing House। আইএসবিএন 978-81-8370-086-3 
  4. "Rigveda 1.126:7, English translation by Ralph TH Griffith" 
  5. Arthur Anthony Macdonell (১৯৯৭)। A History of Sanskrit Literature। Motilal Banarsidass Publishe। পৃষ্ঠা 130–। আইএসবিএন 978-81-208-0095-3 
  6. "UW Press: Ancient Buddhist Scrolls from Gandhara". Retrieved April 2018.
    • Schmidt, Karl J. (1995). An Atlas and Survey of South Asian History, p.120: "In addition to being a center of religion for Buddhists, as well as Hindus, Taxila was a thriving center for art, culture, and learning."
    • Srinivasan, Doris Meth (2008). "Hindu Deities in Gandharan art," in Gandhara, The Buddhist Heritage of Pakistan: Legends, Monasteries, and Paradise, pp.130-143: "Gandhara was not cut off from the heartland of early Hinduism in the Gangetic Valley. The two regions shared cultural and political connections and trade relations and this facilitated the adoption and exchange of religious ideas. [...] It is during the Kushan Era that a flowering of religious imagery occurred. [...] Gandhara often introduced its own idiosyncratic expression upon the Buddhist and Hindu imagery it had initially come in contact with."
    • Blurton, T. Richard (1993). Hindu Art, Harvard University Press: "The earliest figures of Shiva which show him in purely human form come from the area of ancient Gandhara" (p.84) and "Coins from Gandhara of the first century BC show Lakshmi [...] four-armed, on a lotus." (p.176)
  7. Kurt A. Behrendt (2007), The Art of Gandhara in the Metropolitan Museum of Art, pp.4-5,91
  8. Mohiuddin, Yasmeen Niaz (২০০৭)। Pakistan: A Global Studies Handbook (ইংরেজি ভাষায়)। ABC-CLIO। আইএসবিএন 9781851098019 
  9. Kalhana Rajatarangini referred to them as simply Shahi and inscriptions refer to them as sahi.(Wink, pg 125)
  10. Al Biruni refers to the subsequent rulers as "Brahman kings"; however, most other references such as Kalahan refer to them as kshatriyas. (Wink, pg 125)
  11. Kabul Shahi

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা