ত্রিপুরা রাজবাড়ি

কুমিল্লায় অবস্থিত ঐতিহাসিক ভবন

ত্রিপুরা রাজবাড়ি, যা কুমিল্লা রাজবাড়ি নামেও পরিচিত হলো ত্রিপুরা রাজ্যের শাসক মাণিক্য রাজবংশের প্রাক্তন আবাসিক প্রাসাদ। নবদ্বীপ চন্দ্র দেববর্মণ এটি ১৯শ শতাব্দীতে নির্মাণ করেছিলেন। সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণের পর ১৯৪৭ সাল থেকে ২০১০-এর দশক পর্যন্ত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রশাসনের আওতায় নানা কাজে বাড়িটি ব্যবহৃত হয়েছিল, যার মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সামরিক গুদাম, পশুচিকিৎসা কেন্দ্র, মুরগির খামার ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের খামার ব্যবস্থাপকের কার্যালয়। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলায় অবস্থিত যা একটি জাদুঘরে রূপান্তরের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

ত্রিপুরা রাজবাড়ি
২০০৬ সালে ত্রিপুরা রাজবাড়ি
মানচিত্র
সাধারণ তথ্য
অবস্থাচালু
ধরন
  • বাসস্থান (১৯–২০শ শতাব্দী)
  • সরকারি সম্পত্তি (১৯৪৭–বর্তমান)
ঠিকানাথিরা পুকুর সড়ক, পূর্ব চর্থা, কুমিল্লা
দেশবাংলাদেশ
স্থানাঙ্ক২৩°২৭′২২″ উত্তর ৯১°১১′১৮″ পূর্ব / ২৩.৪৫৬০৯২° উত্তর ৯১.১৮৮৪২৮° পূর্ব / 23.456092; 91.188428
নির্মাণকাজের সমাপ্তি১৯শ শতাব্দী
গ্রাহকনবদ্বীপ চন্দ্র দেববর্মণ
স্বত্বাধিকারীসংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়
কারিগরী বিবরণ
তলার সংখ্যা
পরিচিতির কারণশচীন দেববর্মণের পৈতৃক বাড়ি ও জন্মস্থান

ইতিহাস সম্পাদনা

১৩ বছর ত্রিপুরা রাজ্য শাসন করার পর ১৮৬২ সালে ঈশান চন্দ্র মাণিক্য মারা যান। ঈশান চন্দ্র মাণিক্যের মৃত্যুর পর তার বড় পুত্রের রাজা হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তার ভাই বীর চন্দ্র মাণিক্য সিংহাসন দখল করে রাজ্যের পরবর্তী রাজা হন। উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের কর্মকর্তা শ্রী কৈলাস সিং তখন ঈশান চন্দ্র মাণিক্যের সন্তানদের পার্শ্ববর্তী বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির ত্রিপুরা জেলার কুমিল্লায় চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন, তাদের মধ্যে একজন ছিলেন নবদ্বীপ চন্দ্র দেববর্মণ যিনি ১৮৭০ সালে তার পরিবারের সাথে সেখানে চলে আসেন। তিনি সেখানে পূর্ব চর্থা এলাকায় বসবাসের জন্য একটি বাড়ি তৈরি করেন, যার খরচ বহন করেন তার চাচা বীর চন্দ্র মাণিক্য।[১]

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর কুমিল্লা পাকিস্তান অধিরাজ্যের পূর্ববঙ্গ প্রদেশের অংশ হয়ে ওঠে। ফলস্বরূপ, কুমিল্লায় বসবাসরত মাণিক্য রাজবংশের সকল সদস্য শহর ছেড়ে ভারতে চলে যান[২] এবং পাকিস্তান সরকার বাড়িটি অধিগ্রহণ করে, এটি ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তারপরে এটি পশুচিকিৎসকদের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালে সরকার ত্রিপুরা রাজবাড়ির জমিতে একটি মুরগির খামার প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৮২ সালে শহরের সাংস্কৃতিক কর্মীরা বাড়ির চত্বর থেকে খামারটি সরানোর দাবি করে, কিন্তু তা করা হয়নি।[২] ১৯৮৫ সালের পর এটি সরকারি খামারের দপ্তর ও খামার ব্যবস্থাপকের বাসভবনে রূপান্তরিত হয়। এরপর প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ভবনটি সংস্কার করে।[৩] সেই সংস্কারের পর থেকে দীর্ঘকাল এই বাড়িটির কোনো সংস্কার বা পরিচর্যা করা হয়নি। ২০১৩ সালে মাছরাঙা টেলিভিশনে রাজবাড়ির অবস্থা সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রচারিত হয়। কুমিল্লার জেলা কর্তৃপক্ষ প্রতিবেদনটি লক্ষ্য করে, যার ফলে কর্তৃপক্ষ বাড়ির মালিকানা গ্রহণ করে ও পরের বছর এটি সংস্কার করে।[৪]

কিংবদন্তি সম্পাদনা

এটি ত্রিপুরী গায়ক শচীন দেববর্মণের পৈতৃক বাড়ি ও জন্মস্থান যিনি ১ অক্টোবর ১৯০৬ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাঙালি কবি ও বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে পরিচিত কাজী নজরুল ইসলাম কুমিল্লায় গিয়ে এই বাড়িতেই থেকেছিলেন।[৩] ১৯৮৩ সালে কুমিল্লা নজরুল পরিষদ বাড়ির দেয়ালে একটি স্মারক ফলক স্থাপন করে যাতে লেখা ছিল "কাজী নজরুল ইসলাম শচীন দেববর্মণের সাথে এই বাড়িতে সঙ্গীতচর্চা করতেন"।[৫] ২০১৭ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এটিকে দেশের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা করেছে।[৬] ৩১ ডিসেম্বর ২০২০-এ ত্রিপুরা রাজবাড়ি এলাকায় শচীন দেববর্মণের একটি ম্যুরাল উদ্বোধন করা হয়।[৪] শচীন দেববর্মণের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতিবছর কুমিল্লা রাজবাড়ির সামনে তিন দিনব্যাপী মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে।[৭]

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পাদনা

২০১২ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য সফরের সময় ত্রিপুরা রাজবাড়িকে একটি জাদুঘরে রূপান্তর করার প্রতিশ্রুতি দেন।[৮] ২০১৬ সালে তৎকালীন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ঘোষণা করেছিলেন যে এই বাড়িতে একটি সঙ্গীত সংরক্ষণাগার স্থাপন করা হবে।[৯] কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ. ক. ম. বাহাউদ্দিন বাহার ২০২২ সালে জানান যে ভবনটিকে একটি সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্সে রূপান্তর করার জন্য ৳১.১ কোটি বরাদ্দ করা হয়েছে।[১০]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. আলম ইমরুল, জাহাঙ্গীর (১ অক্টোবর ২০১৮)। "কুমিল্লা শহরের যে বাড়িটি আজো শচীনকে মনে করিয়ে দেয়"রাইজিংবিডি.কম। ৭ আগস্ট ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ আগস্ট ২০২৩ 
  2. রহমান সোহেল, তৈবুর (১ নভেম্বর ২০২২)। "সংস্কার হয়নি শচীন দেব বর্মণের পৈতৃক বাড়ি, থমকে আছে কালচারাল কমপ্লেক্সের কাজ"দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। ৭ আগস্ট ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ আগস্ট ২০২৩ 
  3. গৌতম, দীপঙ্কর (২৩ ডিসেম্বর ২০১৫)। "শচীন দেবের বাড়ি এখন মুরগির খামার"রাইজিংবিডি.কম। ৭ আগস্ট ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ আগস্ট ২০২৩ 
  4. "কুমিল্লায় শচীন দেব বর্মনের পৈত্রিক নিবাসে ম্যুরাল উদ্বোধন"ইলিশেপার। ৩ জানুয়ারি ২০২১। ৭ আগস্ট ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ আগস্ট ২০২৩ 
  5. কিবরিয়া, গোলাম (৯ মার্চ ২০১২)। "হারিয়ে যাচ্ছে সুরসম্রাট শচীন দেব বর্মণের বাড়ি"বাংলানিউজ২৪.কম। ৭ আগস্ট ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ আগস্ট ২০২৩ 
  6. "14 new archaeological sites in Bangladesh recognised"নিউ এজ (ইংরেজি ভাষায়)। ৩০ মে ২০১৮। ৭ আগস্ট ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ আগস্ট ২০২৩ 
  7. "কুমিল্লায় আজ থেকে তিন দিনব্যাপী শচীন মেলা"দৈনিক ইত্তেফাক। ২৯ অক্টোবর ২০২২। ৭ আগস্ট ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ আগস্ট ২০২৩ 
  8. "শচীন দেবের বাড়ি জাদুঘর হবে: প্রধানমন্ত্রী"বিডিনিউজ২৪.কম। ১৪ জানুয়ারি ২০১২। ৭ আগস্ট ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ আগস্ট ২০২৩ 
  9. "কুমিল্লায় শচীন দেব বর্মনের বাড়িটি হবে সংগীত সংগ্রহশালা"কালের কণ্ঠ। ২২ ডিসেম্বর ২০১৬। ৭ আগস্ট ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ আগস্ট ২০২৩ 
  10. মণ্ডল, তুহিনা (২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২)। "Sachin Dev Burman : সংরক্ষিত হবে কুমিল্লায় শচীন দেববর্মণের বাড়ি, কোটি টাকা বরাদ্দ হাসিনার"এই সময়। ৭ আগস্ট ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ আগস্ট ২০২৩