তারিণীখুড়ো
তারিণীখুড়ো সত্যজিৎ রায় সৃষ্ট বাংলা সাহিত্যের একটি অবিস্মরণীয় চরিত্র।[১] তারিণীখুড়ো একজন চিরকুমার (অবিবাহিত) মজলিশি বৃদ্ধ যিনি নিজের জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে গল্প বলতে ভালোবাসেন। তারিণীখুড়োর পুরো নাম তারিণীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তারিণীখুড়োর গল্পগুলির মধ্যে অতিপ্রাকৃত শক্তির স্পর্শ রয়েছে। ফেলুদা ও প্রফেসর শঙ্কু চরিত্রদুটি সৃষ্টির পর সত্যজিৎ তৈরী করেন এই চরিত্রটিকে এবং তারিণীখুড়োকে নিয়ে তিনি প্রায় পনেরোটি গল্প লিখেছেন।
তারিণীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় | |
---|---|
তারিণীখুড়ো চরিত্র | |
প্রথম উপস্থিতি | ডুমনিগড়ের মানুষখেকো |
শেষ উপস্থিতি | গল্পবলিয়ে তারিণীখুড়ো |
স্রষ্টা | সত্যজিৎ রায় |
চরিত্রায়ণ | পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় |
কণ্ঠ প্রদান | পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় |
তথ্য | |
ডাকনাম | তারিণীখুড়ো, তারিণীবাবু |
লিঙ্গ | পুরুষ |
পদবি | তারিণীখুড়ো |
দাম্পত্য সঙ্গী | অবিবাহিত |
ধর্ম | হিন্দুধর্ম |
জাতীয়তা | ভারতীয় |
আদি বাসস্থান | ঢাকা, বাংলাদেশ |
বর্তমান বাসস্থান | বেনিয়াটোলা লেন, কলেজ স্ট্রীট, কলকাতা |
মাতৃভাষা | বাংলা |
চরিত্র
সম্পাদনাতারিণীখুড়ো কলকাতায় কলেজ স্ট্রিটের বেনিয়াটোলা লেনের একজন বয়স্ক ব্যাচেলর। তিনি প্রথমে ঢাকায় বসবাস করতেন, গল্পগুলির কথক পল্টুর বাবার সঙ্গে সেখানেই তাঁর পরিচয় হয়। তাঁর পুরো নাম তারিণীচরণ ব্যানার্জী। তিনি একজন খুব দক্ষ গল্পবলিয়ে। তিনি অনুমিত তার দীর্ঘ পেশাদার জীবনের উপর ভিত্তি করে গল্প বলেন। শ্রোতা পাঁচজন ছেলে।
খুড়োর গল্পগুলিতে বিভিন্ন বৈচিত্র্য রয়েছে - ভূতের গল্প থেকে (যার অনেকগুলিই তেমন ভয়াবহ গল্প নয়)থেকে হাসির গল্প সবই আছে তাঁর ঝোলায়। বেশিরভাগ গল্পগুলিই আসন্ন সমস্যা/বিপদের মুখে তারিণীখুড়োর উপস্থিত বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয়, তবে কিছু গল্পে বর্ণিত হয়েছে যে কীভাবে তিনি ভাগ্যের জেরে কিছু অদ্ভুত ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছেন। তারিণীখুড়ো সারা ভারতের তেত্রিশটি শহরে ঘুরে ঘুরে প্রায় ছাপ্পান্ন রকমের চাকরি বা ব্যবসা করেছেন। এর ফলে নানান অদ্ভুত ঘটনায় পরিপূর্ণ তাঁর জীবন; তাঁর গল্পের স্টক আরব্য রজনীর দুইটি ভলিউম অতিক্রম করে যেতে পারে। তাঁর কাহিনী কিছুটা অতিরঞ্জিত, কিন্তু গল্প বলা যে একটা শিল্প সেটা তিনি প্রমাণ করেন। এক বছরের বেশি সময়ের জন্য তিনি একই চাকরিতে থাকেননি। ৬৪ বছর বয়সে তিনি কলকাতার বেনিয়াটোলা লেনের ফ্ল্যাটে থিতু হন।
এখানে দেখা যায় যে প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদার মতো, তারিণীখুড়ো লম্বা গল্প বলতে পছন্দ করে, যদিও এই গল্পগুলির সত্যতা যাচাই করার কোন উপায় নেই। তারিণীখুড়ো একজন ব্রাহ্মণ। তিনি যৌবনে প্রায় সারা ভারত ভ্রমণ করেছিলেন এবং একটি বৈচিত্র্যময় ও দুঃসাহসিক জীবন কাটিয়েছিলেন (অনেকটা তাঁর সৃষ্টিকর্তা রায়ের মত), তাই ব্যাপকভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক এবাং সমাজিক উত্থানপতনগুলি তাঁর কাহিনীতে উঠে এসেছে, যা বিংশ শতাব্দীতে ভারতে দৃশ্যমান ছিল। যদিও তারিণীখুড়ো সম্ভবত কোনো বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং তাঁর সামাজিক অবস্থানও নির্দিষ্ট ছিল, তবুও তিনি ব্যতিক্রমীভাবে সারাজীবন ভারত ঘুরে পেশার সন্ধান করেছেন (অন্য কথায়, তিনি নিজেকে বাংলার গন্ডিতে সীমাবদ্ধ রাখতে চাননি)। এবং এটি স্পষ্ট যে তিনি বৃদ্ধ বয়সেও বিভিন্ন পেনশনযোগ্য পরিষেবা বা বীমা নীতির উপকারগুলির সুবিধা ভোগ করেন না।
প্লট
সম্পাদনাপল্টু গল্পের কথক, যে একটি কিশোর ছেলে। তারিণীখুড়ো পল্টুর খুড়ো নয়, কিন্তু পল্টু তার শৈশব থেকেই তারিণীখুড়োকে ঘন ঘন তাদের বালিগঞ্জের বাড়িতে আসতে দেখেছে। পল্টুর জন্মের আগে তারিণীখুড়ো এবং তার পরিবার ঢাকাতে পল্টুর পরিবারের প্রতিবেশী ছিল। পল্টুর বাবা তাঁকে খুড়ো (কাকা বা চাচা) বলে ডাকতেন। তাই পল্টু এবং তার পাঁচজন বন্ধুও তাঁকে খুড়ো বলেই ডাকে। পল্টুর পাঁচজন বন্ধুর একজন ন্যাপলা একবার তাঁকে দাদু বলে ডাকায় তিনি তাকে তিরস্কার করে বলেছিলেন যে তাঁকে খুড়ো বলে ডাকতে কারণ তিনি অনেক যুবকের থেকেও অনেক বেশি ফিট।
তারিণীখুড়োর গল্পের শ্রোতা মূলতঃ পাঁচজন - পল্টু আর তার চার সঙ্গী ন্যাপলা, ভুলু, চটপটি আর সুনন্দ। তারিণীখুড়ো পল্টুদের বাড়িতে এলেই খবরটা পল্টুর বন্ধুদের কাছেও পৌঁছে যায় এবং তারা সবাই খুড়োর কাছ থেকে আশ্চর্যজনক গল্প শুনতে জড়ো হয়। তিনি পল্টুদের ভৃত্য লক্ষ্মণের বানিয়ে দেওয়া দুধ ছাড়া চা পান করতে করতে তাঁর আশ্চর্যজনক কাহিনীগুলি বর্ণনা করেন। এছাড়া তিনি ধূমপানও করে থাকেন।
কাহিনীসমূহ
সম্পাদনাতারিণীখুড়োর কীর্তিকলাপ সত্যজিৎ রায়ের লেখা একটি বই, যেখানে তারিণীখুড়োর আটটি গল্প সংকলিত হয়েছে। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে। পরে সত্যজিৎ রায়ের ছোটগল্পের সংকলন গল্প ১০১-এ তারিণীখুড়োর সবকটি গল্প অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এছাড়া তারিণীখুড়োর অভিযান গ্রন্থেও এই সিরিজের কয়েকটি গল্প সংকলিত হয়েছে। এই সিরিজের কাহিনীগুলি হলো:
- মহারাজা তারিণীখুড়ো
- তারিণীখুড়ো ও ঐন্দ্রজালিক
- নরিস সাহেবের বাংলো
- গণৎকার তারিণীখুড়ো
- গল্পবলিয়ে তারিণীখুড়ো
- ডুমনিগড়ের মানুষখেকো
- কনওয়ে কাস্লের প্রেতাত্মা
- শেঠ গঙ্গারামের ধনদৌলত
- লখ্নৌর ডুয়েল
- ধুমলগড়ের হান্টিং লজ
- খেলোয়াড় তারিণীখুড়ো
- টলিউডে তারিণীখুড়ো
- তারিণীখুড়ো ও বেতাল
- মহিম সান্যালের ঘটনা
- জুটি
চলচ্চিত্র
সম্পাদনা১. যেখানে ভূতের ভয় (২০১২): এটি তারিণীখুড়োর উপর ভিত্তি করে তৈরি প্রথম চলচ্চিত্র, যা সন্দীপ রায়ের পরিচালনায় মুক্তি পায়। এই সিনেমাটি তিনটি গল্পের সমন্বয়ে নির্মাণ করা হয় - সত্যজিৎ রায়ের অনাথ বাবুর ভয় এবং ব্রাউন সাহেবের বাড়ি। শেষটি ছিল শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূত ভবিষ্যত। (প্রাথমিকভাবে চারটি গল্প প্রদর্শন করার কথা ছিল, তবে চতুর্থটি লখ্নৌর ডুয়েল-কে দৈর্ঘ্য এড়াতে পরে বাদ দেওয়া হয়েছিল)। তারিণীখুড়োর চরিত্রে অভিনয় করেন পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়।[২][৩][৪]
২. দ্য স্টোরি টেলার (২০১৯): এটি একটি আসন্ন হিন্দি ভাষার চলচ্চিত্র যা অনন্ত মহাদেবনের পরিচালনায় মুক্তি পাবে; অভিনেতা পরেশ রাওয়াল তারিণীখুড়োর চরিত্রটিতে অভিনয় করবেন।[৫][৬][৭]
টেলিভিশনে তারিণীখুড়ো
সম্পাদনা১. জুটি (১৯৯৭): গল্পটি টেলিভিশনে সত্যজিতের গপ্পো টেলিফিল্ম সিরিজে দেখানো হয়েছিলো। শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় তারিণীখুড়োর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।
২. টলিউডে তারিণীখুড়ো (২০০১): এই গল্পটি সত্যজিতের প্রিয় গপ্পো টেলিভিশন সিরিজে প্রদর্শন করা হয়। শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় এবং শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়-কে তারিণীখুড়ো হিসাবে দেখা গিয়েছিলো।
রেডিওতে তারিণীখুড়ো
সম্পাদনা৯৮.৩ রেডিও মির্চি (কলকাতা) সম্প্রচারিত সানডে সাসপেন্স সিরিজে তারিণীখুড়োর অনেকগুলি গল্প শোনানো হয়েছে। তারিণীখুড়োর চরিত্রে কন্ঠ প্রদান করেছেন পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্যান্য চরিত্রে স্বরারোপণ করেছেন মীর আফসার আলী, দীপ, অগ্নি, সোমক প্রমুখ মির্চি বাংলা-এর রেডিও জকিরা। শব্দগ্রহণ ও পর্ব পরিচালনা করেন ডিস্ক জকি রিচার্ড।[৮]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "Tarini Khuro's screen saga"। Times of India। ৭ জুন ২০১২। ৩ জানুয়ারি ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ জুন ২০১২।
- ↑ "Ghost 'writers'"। The Statesman। ১৬ নভেম্বর ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৩ নভেম্বর ২০১২।
- ↑ "Sandip Ray's ghost film"। The Telegraph Calcutta। সংগ্রহের তারিখ ১৩ নভেম্বর ২০১২।
- ↑ "Bhaswar Chatterjee to wear Satyajit's blue sweater"। The Times of India। ৩ জানুয়ারি ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৩ নভেম্বর ২০১২।
- ↑ "Ray's Tarini Khuro set for Bollywood debut"। সংগ্রহের তারিখ ১৯ ডিসেম্বর ২০১৩।
- ↑ "Ananth Mahadevan to adapt Satyajit Ray's short story into film"। ৭ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩০ অক্টোবর ২০১২।
- ↑ "Paresh to tell Ray's story"। The Times of India। সংগ্রহের তারিখ ১৩ ডিসেম্বর ২০১৩।
- ↑ https://onlinebanglaradio.com/audio-story/tarini-khuro-o-betal-radio-mirchi-sunday-suspense/ | সংগ্রহের তারিখ: ৯ মার্চ, ২০১৯