গঙ্গার পানি বণ্টন
গঙ্গার পানি বণ্টন বা গঙ্গার জল বণ্টন বাংলাদেশ ও ভারত রাষ্ট্রদ্বয়ের বৈদেশিক সম্পর্কের একটি দীর্ঘকালীন সমস্যা। এই সমস্যাটি উত্তর ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গঙ্গা নদীর পানিসম্পদের সঠিক বণ্টন ও উন্নয়ন সম্পর্কিত। সুদীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে বিবাদ উপস্থিত হয়েছে। একাধিক বৈদেশিক চুক্তি ও আলোচনা সত্ত্বেও এর কোনো সুষ্ঠু সমাধান সম্ভব হয়নি।
যদিও ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর নতুন দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এইচ. ডি. দেবেগৌড়া ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি সামগ্রিক বৈদেশিক চুক্তি সাক্ষর করেন। এই চুক্তিটি ছিল বাংলাদেশকে ন্যূনতম পানিসরাবরাহের গ্যারান্টি সহ ৩০ বছরের পানিবণ্টন চুক্তি। উল্লেখ্য, গঙ্গার নিম্ন অববাহিকায় বাংলাদেশের অধিকার স্বীকৃত।[১][২][৩]
পটভূমি
সম্পাদনাউত্তর ভারতের সমভূমি থেকে নেমে এসে গঙ্গা নদী ভারত ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সীমান্ত ধরে ১২৯ কিলোমিটার এবং তারপর বাংলাদেশের মধ্যে ১১৩ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছে। মুর্শিদাবাদ জেলার ধুলিয়ানের কাছে গঙ্গার প্রথম শাখানদী ভাগীরথী উৎপন্ন হয়েছে। উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাঞ্চলে এই নদীই আবার হুগলি নদী নামে পরিচিত। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে ফারাক্কা বাঁধ নির্মিত হয়। এই বাঁধ গঙ্গার জলের প্রবাহকে নিয়ন্ত্রিত করে এবং হুগলি নদীর নাব্যতা রক্ষার উদ্দেশ্যে কিছু পরিমাণ জল ফারাক্কা ফিডার খালের সাহায্যে ভাগীরথী নদীর দিকে প্রবাহিত করা হতে থাকে।[৪]
বাংলাদেশে প্রবেশ করে ব্রহ্মপুত্রের বৃহত্তম শাখানদী যমুনা নদীর সঙ্গে মিলিত হবার পূর্বে গঙ্গা নদী পদ্মা নাম ধারণ করেছে। আরও ভাটিতে গঙ্গা ব্রহ্মপুত্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম শাখানদী মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়ে মেঘনা নাম ধারণ করেছে এবং মেঘনার মোহনায় প্রবেশ করেছে। ৩৫০ কিলোমিটার প্রস্থবিশিষ্ট এই মোহনার মাধ্যমে গঙ্গা বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। উল্লেখ্য, ভারত থেকে ৫৪টি নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।[৫]
সমাধান প্রচেষ্টা
সম্পাদনা১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান একটি বহুব্যাপী বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী, সহযোগিতা ও শান্তিচুক্তি সাক্ষর করেন।[৪] এই চুক্তি অনুযায়ী পানি সম্পদ বণ্টন, সেচ, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় নিয়ন্ত্রণের মতো সাধারণ বিষয়গুলির জন্য একটি যৌথ নদী কমিশন গঠন করা হয়।[২]
ফারাক্কা বাঁধ
সম্পাদনাফারাক্কা বাঁধ পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১০ কিলোমিটার (৬.২ মা) দূরে অবস্থিত একটি বাঁধ। এই বাঁধের মাধ্যমে ভারত গঙ্গার জল নিয়ন্ত্রিত করে থাকে। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে পলি জমে হুগলি নদীর নাব্যতা হ্রাস পেতে শুরু করলে কলকাতা বন্দর গভীর সমস্যার সম্মুখীন হয়। এই সমস্যা সমাধানে শুষ্ক মৌসুমে (জানুয়ারি-জুন মাস) গঙ্গার জল হুগলি নদীর অভিমুখে প্রবাহিত করে পলি দূর করার জন্য এই বাঁধ নির্মিত হয়।[৪] বাংলাদেশ দাবি করে, ভারতে এইভাবে নদীর জলপ্রবাহের অভিমুখ পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের নদীগুলি শুকিয়ে যাচ্ছে।[৫] ১৯৭৪ সালের মে মাসে ফারাক্কা বাঁধ চালু করার আগে পানি বণ্টন সমস্যার সমাধানে একটি যৌথ ঘোষণাপত্র জারি করা হয়।[৩] এরপর ১৯৭৫ সালে একটি অন্তর্বর্তী চুক্তির মাধ্যমে ভারত স্বল্পমেয়াদের জন্য বাঁধের ফিডার খালটি চালু করার অনুমতি পায়।[১][২]
অবশ্য, শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ড ও বাংলাদেশে সেনাশাসন প্রতিষ্ঠার পর দুই রাষ্ট্রের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হলে ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারত সকল প্রকার আলাপ-আলোচনা বন্ধ করে দেয়।[৪] জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের একটি শীর্ষ সম্মেলনে এবং ৩১তম জাতিসংঘ সাধারণ সভার বৈঠকে ভারতে একতরফা পদক্ষেপের প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ।[২] অন্যান্য রাষ্ট্র ও জাতিসংঘের পরামর্শক্রমে ভারত ও বাংলাদেশ পুনরায় আলোচনা শুরু করলেও, তা থেকে কোনো সমাধানসূত্র পাওয়া সম্ভব হয় না।[২]
সাময়িক চুক্তি
সম্পাদনা১৯৭৭ সালে ভারতের তদনীন্তন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেসাই ও বাংলাদেশের তদনীন্তন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনকালে দুদেশের বৈদেশিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটে।[৪] উক্ত দুই নেতা সেই বছর একটি পাঁচ বছরের পানি বণ্টন চুক্তি সাক্ষর করেন। কিন্তু ১৯৮২ সালে সেই চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর তার আর পুনর্নবীকরণ করা হয়নি।[১][২][৩]
১৯৮২ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশের তদনীন্তন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ ভারতের সঙ্গে দুই বছরের পানি বণ্টন নিয়ে একটি মেমোরান্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং (মউ) সাক্ষর করেন। ১৯৮৫ সালের ২২ নভেম্বর আরও একটি মউ সাক্ষরিত হয়।[২] তবে প্রবাহিত জলের পরিমাপ বৃদ্ধি নিয়ে কোনো চুক্তি সাক্ষরিত হয়নি। ভারতও চুক্তি সম্প্রসারিত করতে অস্বীকার করে। ১৯৯৩ সালের শুখা মরশুমে বাংলাদেশের দিকে পানি প্রবাহ পূর্বের ৩৪,৫০০ কিউসেকের বদলে কমিয়ে ১০,০০০ কিউসেক করে দেওয়া হয়।[২] বাংলাদেশ জাতিসংঘ সাধারণ সভা এবং দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থায় (সার্ক) বিষয়টি আন্তর্জাতিক স্তরে উন্নীত করতে চেষ্টা করে। কিন্তু তাতেও বিশেষ ফল হয় না।[১]
১৯৯৬ সালের চুক্তি
সম্পাদনা১৯৯৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হলে দুই দেশের বৈদেশিক সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধিত হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর উভয় দেশের নেতৃত্ব নতুন দিল্লিতে মিলিত হয়ে একটি ৩০ বছরের সামগ্রিক চুক্তি সাক্ষর করেন।[১][২][৩] এই চুক্তি অনুযায়ী ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ফারাক্কা থেকে দুই দেশের মধ্যে পানি বণ্টন করা হতে থাকে। পূর্ববর্তী ৪০ বছরের গড় মাত্রা অনুযায়ী ভারত গঙ্গার পানির ভাগ পেতে থাকে।[১][২][৩] যে কোনো সংকটের সময় বাংলাদেশকে ৩৫,০০০ কিউসেক পানি সরবরাহ করার গ্যারান্টিও দেওয়া হয়।[৩]
গঙ্গার পানির দীর্ঘকালীন বণ্টনব্যবস্থা ও অন্যান্য সাধারণ নদীগুলি ক্ষেত্রে একই রকমের পানি বণ্টন ব্যবস্থা কার্যকরী করার জন্যও উভয় দেশের মধ্যে চুক্তি সাক্ষরিত হয়।[১][২] এই চুক্তির ফলে ভারতের গঙ্গার পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ এবং গঙ্গার নিম্ন অববাহিকায় বাংলাদেশের অধিকার সহ জলের সমান ভাগ পাওয়ার অধিকার – দুইই প্রতিষ্ঠিত হয়।[১][২] উভয় রাষ্ট্রই জলসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা সুনিশ্চিত করার কথা বলে। এই চুক্তির ফলে কুষ্ঠিয়া ও গড়াই-মধুমতী নদীর উপর বাঁধ ও সেচপ্রকল্প পারমিট পায়। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলিতে জল সরবরাহ এবং বঙ্গোপসাগরের লবনাক্ত জলের প্রকোপ থেকে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্যকে রক্ষা করা।[২]
মূল্যায়ন
সম্পাদনা১৯৯৬ সালের চুক্তি বাংলাদেশ-ভারত বৈদেশিক সম্পর্কের দীর্ঘদিনের টানাপোড়েন হ্রাস করে।[১][৩] তবে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এই চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করে। বিএনপি ভারত-বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত। তবে ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপি এই চুক্তি ভঙ্গ করেনি। বিএনপি সহ বাংলাদেশের কয়েকটি রাজনৈতিক দল অভিযোগ করে যে, ভারত অনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে কম পানি সরবরাহ করে বঞ্চিত করছে।[১][৫] অপর দিকে ভারতের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, পানি বণ্টনের ফলে অনেক সময়ই কলকাতা বন্দর ও ফারাক্কা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানোর মতো জল পাওয়া যায় না।[৫]
অন্যদিক থেকে, পরিবেশবিদেরা ফারাক্কা থেকে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের ফলে পরিবেশের উপর এর বিরূপ প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছেন। উচ্চ বদ্বীপে বৃক্ষনিধন ও নদীর ক্ষয়ের ফলে নিম্ন বদ্বীপে বছরে প্রায় ২০ লক্ষ টন পলি সঞ্চিত হচ্ছে। লবনাক্ততা বৃদ্ধির ফলে মরুভবনেরও আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে।[৬] বাংলাদেশেও পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের ফলে নদীর পানিতে লবনাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে মাছ উৎপাদন ও নৌচলাচল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে; পানির মান নিম্নগামী হচ্ছে এবং জনস্বাস্থ্যেও তার বিরূপ প্রভাব পড়ছে।[৭] হুগলি নদী ও কলকাতা বন্দরের ক্ষেত্রেও এই ধরনের পলিস্তর বিরূপ প্রভাব বিস্তার করছে বলে মনে করা হচ্ছে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আব্দুর রাজ্জাক পানিসম্পদমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পানিসম্পদমন্ত্রী থাকাকালে ১৯৯৬ সালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। জাতীয় সংসদে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে ২০০৯ সালের জুলাই-আগস্টে একটি সংসদীয় প্রতিনিধি দল ভারতে টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প পরিদর্শন করে।<ref name="AME"/ >
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ ঞ Robie I. Samanta Roy (November 1997). India-Bangladesh Water Dispute ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৮ এপ্রিল ২০০৮ তারিখে American.edu. Accessed 2008-05-30.
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ ঞ ট ঠ ড গঙ্গার পানিবণ্টন ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে, বাংলাপিডিয়া
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ Saswati Chanda & Alok Kumar Gupta (24 January 2000). The Ganges Water Sharing Treaty: Genesis & Significance ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৭ জুন ২০০৭ তারিখে IPCS.org. Accessed 2008-05-30.
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ Bangladesh's relations with India ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৮ মার্চ ২০১৪ তারিখে CountryStudies.us. Accessed 2008-05-30.
- ↑ ক খ গ ঘ Sudha Ramachandran (June 8, 2006). India, Bangladesh fight against the current ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২২ মে ২০১১ তারিখে. Asia Times. Accessed 2008-05-30.
- ↑ "Indo-Bangladesh Common Rivers: The Impact on Bangladesh." Contemporary South Asia. 1. 2. (1992):5.
- ↑ Wolf, Aaron T. “Water and Human Security.” Journal of Contemporary Water Research and Education. 118. (2001): 29.