কন্দারিয়া মহাদেব মন্দির

ভারতের একটি হিন্দু মন্দির

কন্দারিয়া মহাদেব মন্দির (দেবনাগরী: कंदारिया महादेव मंदिर; ‘কন্দারিয়া মহাদেব’ শব্দের অর্থ ‘গুহাবাসী মহাদেব’) হল ভারতের মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের খাজুরাহোর মধ্যযুগীয় মন্দিরক্ষেত্রের বৃহত্তম ও সর্বাধিক অলংকরণসমৃদ্ধ হিন্দু মন্দির। এই মন্দিরটিকে ভারতে মধ্যযুগ থেকে অদ্যাবধি সংরক্ষিত মন্দিরগুলির অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন মনে করা হয়।

কন্দারিয়া মহাদেব মন্দির
ধর্ম
অন্তর্ভুক্তিহিন্দুধর্ম
জেলাছাতারপুর
ঈশ্বরশিব (মহাদেব)
অবস্থান
অবস্থানখাজুরাহো
রাজ্যমধ্যপ্রদেশ
দেশভারত
কন্দারিয়া মহাদেব মন্দির ভারত-এ অবস্থিত
কন্দারিয়া মহাদেব মন্দির
ভারতে অবস্থান
স্থানাঙ্ক২৪°৫১′১১″ উত্তর ৭৯°৫৫′১১″ পূর্ব / ২৪.৮৫৩০° উত্তর ৭৯.৯১৯৭° পূর্ব / 24.8530; 79.9197
স্থাপত্য
ধরনউত্তর ভারতীয়
সৃষ্টিকারীবিদ্যাধর
সম্পূর্ণ হয়আনুমানিক ১০৩০ খ্রিস্টাব্দ

অবস্থান সম্পাদনা

 
খাজুরোহো স্মারকসমূহের নকশা মানচিত্র: পশ্চিমদিকে স্মারকগুলির মধ্যে কন্দারিয়া মহাদেব মন্দির অবস্থিত

মধ্য ভারতের মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের ছাতারপুর জেলায় কন্দারিয়া মহাদেব মন্দির অবস্থিত।[১] খাজুরাহো গ্রামে অবস্থিত এই মন্দিরটি যে মন্দির চত্বরের অন্তর্গত তার আয়তন ৬ বর্গকিলোমিটার (২.৩ মা)-রও বেশি।[২] মন্দিরটি বিষ্ণু মন্দিরের পশ্চিমে গ্রামের পশ্চিমাংশে অবস্থিত।[৩][৪]

খাজুরাহো গ্রামের এই মন্দির চত্বরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৮২ মিটার (৯২৫ ফু) উচ্চতায় অবস্থিত। সড়ক, রেল ও বিমানপথে এটি দেশের অন্যান্য অংশের সঙ্গে সুসংযুক্ত। এই গ্রামটি মাহোবার ৫৫ কিলোমিটার (৩৪ মা) দক্ষিণে, ছাতারপুর শহরের ৪৭ কিলোমিটার (২৯ মা) পশ্চিমে এবং পান্না থেকে ৪৩ কিলোমিটার (২৭ মা) দূরে অবস্থিত। উত্তরে ঝাঁসি থেকে সড়কপথে খাজুরাহোর দূরত্ব ১৭৫ কিলোমিটার (১০৯ মা)। গ্রামটি দিল্লির ৬০০ কিলোমিটার (৩৭০ মা) দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। নিকটবর্তী রেল স্টেশনের সঙ্গে এই মন্দির চত্বরের দূরত্ব ৯ কিলোমিটার (৫.৬ মা)।[১][৫] খাজুরাহো বিমানবন্দর (আইএটিএ কোড: এইচজেআর) খাজুরাহোকে আকাশপথে দিল্লি, আগ্রামুম্বই শহরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। বিমানবন্দরটি মন্দির থেকে ৬ কিলোমিটার (৩.৭ মা) দূরে অবস্থিত।[৫][৬]

ইতিহাস সম্পাদনা

একদা চন্দেল রাজবংশের রাজধানী ছিল খাজুরাহো। কন্দারিয়া মহাদেব মন্দিরটি ভারতে মধ্যযুগ থেকে সংরক্ষিত মন্দিরগুলির অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।[১][৭] এটিই চন্দেল রাজন্যবর্গ কর্তৃক নির্মিত খাজুরাহো মন্দির চত্বরের পশ্চিমদিকের স্মারকসমূহের মধ্যে বৃহত্তম মন্দির। মন্দিরের প্রধান দেবতা ছিলেন শিব[৮]

কন্দারিয়া মহাদেব মন্দির নির্মিত হয়েছিল চন্দেল রাজবংশের রাজা বিদ্যাধরের (রাজত্বকাল: আনুমানিক ১০০৩-১০৩৫ খ্রিস্টাব্দ) রাজত্বকালে।[৯] এই রাজবংশের রাজত্বকালে বিভিন্ন সময়ে হিন্দুধর্মের বিষ্ণু, শিব, সূর্যপার্বতীর এবং জৈন তীর্থংকরদের বিখ্যাত মন্দিরগুলি খাজুরাহোতে নির্মিত হয়েছিল। বিদ্যাধর (মুসলমান ইতিহাসবিদ ইবন আল-আথিরের রচনায় যিনি বিদা নামে উল্লিখিত) ছিলেন একজন শক্তিশালী শাসক। ১০১৯ খ্রিস্টাব্দে গজনির মামুদ প্রথমবার চন্দেল রাজ্য আক্রমণ করলে বিদ্যাধর তা প্রতিরোধ করেন।[১] যুদ্ধটি নির্ণায়ক হয়নি; মামুদকে গজনিতে ফিরে যেতে হয়েছিল। ১০২২ সালে মামুদ পুনরায় বিদ্যাধরের রাজ্য আক্রমণ করেন। মামুদ কালিঞ্জর দুর্গ আক্রমণ করলেও[১] দুর্গ অবরোধ সফল হয়নি। মামুদ অবরোধ তুলে নেন এবং দু’জনে সন্ধি করেন। উপহার আদানপ্রদানের মাধ্যমে বিবাদের নিরসন ঘটে। বিদ্যাধর মামুদ ও অন্যান্য আক্রমণকারীদের প্রতিহত করে বিজয়োৎসবের অঙ্গ হিসেবে কূলদেবতা শিবের উদ্দেশ্যে কেন্দরিয়া মহাদেব মন্দিরটি নির্মাণ করেন। মন্দিরের মণ্ডপের একটি পিল্যাস্টারে খোদিত শিলালিপিতে মন্দিরনির্মাণকারীর নাম উল্লিখিত হয়েছে বিরিমদা, যেটিকে বিদ্যাধরের ছদ্মনাম বলে ব্যাখ্যা করা হয়।[১] ১০২৫ থেকে ১০৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল।[৪]

১৯৮৬ সালে কন্দারিয়া মহাদেব মন্দির সহ খাজুরাহোর অদ্যাবধি বিদ্যমান সকল মন্দির শৈল্পিক সৃজনের জন্য তৃতীয় ক্রাইটেরিয়নের অধীনে এবং ১২০২ সালে মুসলমান আক্রমণের পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত জনপ্রিয়তা বজায় রাখা চন্দেল সংস্কৃতির নিদর্শন হিসেবে পঞ্চম ক্রাইটেরিয়নের অধীনে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়।[১০][১১]

বৈশিষ্ট্য সম্পাদনা

 
কন্দারিয়া মহাদেব মন্দিরের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য
 
মন্দিরের সরল মানচিত্র

৩১ মিটার (১০২ ফু)-উচ্চতাবিশিষ্ট কন্দারিয়া মহাদেব মন্দিরটি পশ্চিম চত্বরে অবস্থিত। এটি চত্বরই খাজুরাহো মন্দিরক্ষেত্রের তিনটি চত্বরের মধ্যে বৃহত্তম।[১২] কন্দারিয়া, মতঙ্গেশ্বরবিশ্বনাথ মন্দির নিয়ে গঠিত পশ্চিম চত্বরটি একটি ষড়ভূজ যন্ত্রের আকৃতিবিশিষ্ট, যা শিবের তিনটি রূপের প্রতীক।[৫] মন্দির স্থাপত্যটি দেহলি ও মিনারের সংমিশ্রণে গঠিত, যা মিলিত হয়েছে একটি শিখরে গিয়ে। এই বৈশিষ্ট্যটি খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীর পর থেকে মধ্য ভারতের মন্দিরগুলির সাধারণ বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়।[১২]

মন্দিরটি গড়ে উঠেছিল ৪ মিটার (১৩ ফু) উচ্চতার এক প্রকাণ্ড ভিত্তিবেদির উপরে।[১৩] ভিত্তিবেদির উপর মন্দিরের গঠনটি অলংকরণ দ্বারা সুসমৃদ্ধ।[১৪] মন্দিরের উপরিভাগটি একটি খাড়া পাহাড়ের আকৃতিবিশিষ্ট। এটি মেরু পর্বতের প্রতীক, যা হিন্দু পুরাণ মতে বিশ্বসৃষ্টির উৎস।[৮] উপরিভাগে যে অলংকার-সমৃদ্ধ ছাদটি রয়েছে তা শেষ হয়েছে ৮৪টি ক্ষুদ্রাকার শিখর-যুক্ত একটি প্রকাণ্ড শিখরে।[৪] মন্দিরটি ৬ বর্গকিলোমিটার (২.৩ মা) আয়তনের একটি ক্ষেত্রে অবস্থিত, যার মধ্যে কন্দারিয়া মহাদেব মন্দির সহ বাইশটি মন্দির এখনও বিদ্যমান। মন্দিরটি দৈর্ঘ্যে ৩১ মিটার (১০২ ফু) ও প্রস্থে ২০ মিটার (৬৬ ফু) একটি নকশার উপর নির্মিত এবং এটির প্রধান শিখরটির উচ্চতা ৩১ মিটার (১০২ ফু)। এই মন্দিরটিকেই “খাজুরাহোর বৃহত্তম ও শ্রেষ্ঠতম মন্দির” বলা হয়।[২][১৪][১৫] খাড়াই সিঁড়ির একটি শ্রেণি মাটি থেকে মন্দিরের প্রবেশপথ পর্যন্ত উঠে গিয়েছে।[১৬] মন্দিরের নকশা খাজুরাহো মন্দির চত্বরের লক্ষ্মণ ও বিশ্বনাথ মন্দিরের মতো পাঁচটি অংশে নির্মিত। প্রবেশপথে রয়েছে একটি তোরণ। এটি খুব সূক্ষ্মভাবে খোদাই করা মালার আকারে নির্মিত, যা একটি মাত্র পাথর কেটে বানানো। এই ধরনের প্রবেশপথ হিন্দুদের বিবাহ শোভাযাত্রার একটি অংশ।[৪] প্রবেশপথের খোদাইচিত্রগুলি “পাথরের স্পর্শগ্রাহ্য গুণ এবং প্রতিসাম্য নকশা”টিকে দেখায়। সমগ্র মন্দিরটিতে অসংখ্য মূর্তি খোদিত রয়েছে।[১৪]

 
৮৪টি ক্ষুদ্রকায় শিখর সহ প্রধান শিখর
 
মন্দিরের বাইরের দেওয়ালে কামোদ্দীপক ভাস্কর্য

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. রিং, সালকিন এবং বোডা ১৯৯৪, পৃ. ৪৬৮।
  2. "খাজুরাহো গ্রুপ অফ মন্যুমেন্টস"। ইউনেস্কো অর্গ্যানাইজেশন। 
  3. "কন্দারিয়া টেম্পল (বিল্ট সিরকা ১০২৫–১০৫০)"। ওরিয়েন্টাল আর্কিটেকচার। 
  4. অব্রাম ২০০৩, পৃ. ৪২০–৪২১।
  5. "ফিজিক্যাল অ্যান্ড রিজিওনাল সেটিং অফ খাজুরাহো" (পিডিএফ)। শোধগঙ্গা – ইনফ্লিবনেট সেন্টার। 
  6. "খাজুরাহো এয়ারপোর্ট"। এয়ারপোর্ট অথরিটি অফ ইন্ডিয়া (এএআই)। ৮ জুলাই ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ আগস্ট ২০১৫ 
  7. Bhatnagar, Asgwini (২০ মার্চ ১৯৯৯)। "ওড ডু ইম্মর্টালিটি সেলিব্রেটিং ১০০০ ইয়ারস অফ সেলেস্টিয়াল এক্সট্যাসি"দ্য ট্রিবিউন 
  8. "কন্দারিয়া মহাদেব মন্দির"। এশিয়ান আর্ট মিউজিয়াম। ২২ জুন ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ জুলাই ২০২২ 
  9. সুশীল কুমার সুলেরি ২০০৪, পৃ. ২৬।
  10. "খাজুরাহো গ্রুপ অফ মনুমেন্টস: ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট"। ইউনেস্কো। সংগ্রহের তারিখ ১২ আগস্ট ২০১৫ 
  11. "ইভ্যালুয়েশন রিপোর্ট: ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ লিস্ট নং ২৪০" (পিডিএফ)। ইউনেস্কো অর্গ্যানাইজেশন। সংগ্রহের তারিখ ১২ আগস্ট ২০১৫ 
  12. "কন্দারিয়া মহাদেব"। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা। 
  13. "দ্য গ্রেটেস্ট সেক্রেড বিল্ডিংস"। মিউজিয়াম অফ ওয়ার্ল্ড রিলিজিয়নস। ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ আগস্ট ২০১৫ 
  14. অ্যালেন ১৯৯১, পৃ. ২১০।
  15. অব্রাম ২০০৩, পৃ. ৪২০-৪২১।
  16. রস ২০০৯, পৃ. ২৮০–২৮১।

গ্রন্থপঞ্জি সম্পাদনা

আরও পড়ুন সম্পাদনা

  • মিশেল, জর্জ; সিং, স্নেহাল. হিন্দু টেম্পলস অফ ইন্ডিয়া (পিডিএফ)
  • সারফেস, স্পেস অ্যান্ড ইনটেনশন: দ্য পার্থেনন অ্যান্ড দ্য কেন্দারিয়া মহাদেব। গ্রেগরি ডি. অ্যালেস. হিস্ট্রি অফ রিলিজিয়নস, ২৮শ খণ্ড, ১ম সংখ্যা, অগস্ট ১৯৮৮, পৃ. ১–৩৬।

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা