আফগান গৃহযুদ্ধ (১৯৮৯–১৯৯২)

আফগান গৃহযুদ্ধ (১৯৮৯–১৯৯২) ছিল ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৯২ সালের ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত আফগানিস্তানে চলা একটি গৃহযুদ্ধ, এবং বৃহত্তর আফগানিস্তান যুদ্ধের অংশ। ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আফগানিস্তান থেকে সর্বশেষ সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তান যুদ্ধের এই পর্যায়টি আরম্ভ হয় এবং ১৯৯২ সালের ২৪ এপ্রিল পেশোয়ার চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আফগানিস্তান প্রজাতন্ত্রের পতনের মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধের অবসান ঘটে।

আফগান গৃহযুদ্ধ (১৯৮৯–১৯৯২)
মূল যুদ্ধ: আফগানিস্তান যুদ্ধ (১৯৭৮–বর্তমান)

১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানের মানচিত্র
তারিখ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯ – ২৪ এপ্রিল ১৯৯২
অবস্থান
ফলাফল

মুজাহিদিন বিজয়

বিবাদমান পক্ষ

আফগানিস্তান আফগানিস্তান প্রজাতন্ত্র
সমর্থক:

মুজাহিদিন
সমর্থক:

সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
আফগানিস্তান মুহম্মদ নাজিবুল্লাহ  আত্মসমর্পণকারী
আফগানিস্তান আব্দুল রাশিদ দোস্তাম (১৯৮৯–১৯৯১)
আফগানিস্তান শাহনওয়াজ তানাই (১৯৮৯–১৯৯০)
আফগানিস্তান মুহম্মদ আসলাম ওয়াতানজার
আহমদ শাহ মাসুদ
আব্দুল হক
জালালউদ্দিন হাক্কানী
বুরহানউদ্দিন রাব্বানী
গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার
আব্দুল রসুল সায়েফ
আব্দুল রাশিদ দোস্তাম (১৯৯১–১৯৯২)
শক্তি

আফগানিস্তান ১৯৮৯:

  • ৫৫,০০০ সৈন্য[২]
  • ১০,০০০ প্রেসিডেন্সিয়াল গার্ড[২]
    ১৯৯১:
  • ~১,৬০,০০০ যোদ্ধা (আধা-সামরিক বাহিনী ও কেএইচএডি সদস্যসহ)
  • ~১,৭০,০০০ মিলিশিয়া
অজ্ঞাত

১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহার সমাপ্ত হয়। সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের পর জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা, হৃত অঞ্চল পুনরুদ্ধার বা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ কোনোটিই সম্ভব না হলেও মুজাহিদদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং আফগান সরকারি বাহিনীর কিছু সাফল্য অর্জনের (উদাহরণস্বরূপ, জালালাবাদের যুদ্ধ) পরিপ্রেক্ষিতে আফগানিস্তানের সোভিয়েত-সমর্থিত সরকার ১৯৯২ সাল পর্যন্ত টিকে থাকতে সক্ষম হয়। কিন্তু আফগান সরকারের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব, শীর্ষ নেতাদের বিশ্বাসঘাতকতা, আফগান সরকারের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক কর্মকর্তা আব্দুল রাশিদ দোস্তামের দলত্যাগ এবং সবশেষে রুশ সরকার কর্তৃক আফগান সরকারকে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া প্রভৃতি কারণে ১৯৯২ সালের এপ্রিলে আফগানিস্তান প্রজাতন্ত্রের পতন ঘটে এবং তদস্থলে আফগানিস্তান ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

আফগান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ (মার্চ ১৯৮৯ – এপ্রিল ১৯৯১) সম্পাদনা

আফগান সরকারের সামরিক শক্তি সম্পাদনা

১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহার সম্পন্ন হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি মুহম্মদ নাজিবুল্লাহর সরকার এবং তার পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান (পিডিপিএ) সম্পূর্ণ একাকী হয়ে পড়ে। মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে আফগান কমিউনিস্ট সরকারের পতন ঘটবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন[৩]

কিন্তু আফগান সরকারের হাতে থাকা বেশকিছু সামরিক সম্পদের বিষয়টি তাদের বিবেচনায় আসে নি। এসবের মধ্যে প্রথমটি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের দান করা বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম। ১৯৮৯ সালে আফগান সশস্ত্রবাহিনী ও সরকারপন্থী মিলিশিয়াগুলোর নিকট ১,৫৬৮টি ট্যাঙ্ক, ৮২৮টি আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার, ৪,৮৮০টি আর্টিলারি পিস, ১২৬টি আধুনিক বোমারু বিমান এবং ১৪টি আক্রমণকারী হেলিকপ্টার ছিল। এছাড়া আফগান সরকার তখনও সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বছরে গড়ে দুই থেকে ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলার সাহায্য লাভ করছিল, এবং আফগানিস্তানে তখনও সোভিয়েত সামরিক উপদেষ্টা মোতায়েন ছিল[৪]। আফগান সরকারি বাহিনী বিপুল সংখ্যক স্কাড ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতেও আরম্ভ করে: ১৯৮৮ থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে ২,০০০টিরও বেশি স্কাড ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষিপ্ত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর কোনো যুদ্ধে এ পরিমাণ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষিপ্ত হয় নি। আফগান সরকারের বিপুল অস্ত্রভাণ্ডার মুজাহিদদের কোণঠাসা করে রাখার জন্য যথেষ্ট ছিল।

আফগান সরকারের আরেকটি শক্তি ছিল সরকারপন্থী মিলিশিয়া বাহিনীগুলো, যেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কার্যকরী ছিল আব্দুল রাশিদ দোস্তামের জোজ্জানি মিলিশিয়া, যেটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ৫৩তম পদাতিক ডিভিশন বলা হত। ৪০,০০০ উজবেক যোদ্ধার সমন্বয়ে গঠিত এই বাহিনীটি নাজিবুল্লাহর ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল এবং এটিকে নাজিবুল্লাহ কৌশলগত রিজার্ভ হিসেবে ব্যবহার করতেন। ১৯৮৯ সালের পর সরকারি বাহিনীগুলোর মধ্যে কেবল এটিই আক্রমণাত্মক অভিযান চালাতে সক্ষম ছিল[৫]

মুজাহিদদের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন সম্পাদনা

একই সময়ে কিছু কিছু মুজাহিদ দল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, পাকিস্তান, চীন ও অন্যান্য রাষ্ট্রের বিস্তৃত সামরিক সহযোগিতায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে। মার্কিন সহায়তা, যেটি পাকিস্তানের মাধ্যমে সরবরাহ করা হত, প্রধানত গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারকে লাভবান করে। সৌদি সহায়তা, বিশেষত সৌদি আর্থিক সহায়তা, আব্দুল রসুল সায়েফ এবং জালালউদ্দিন হাক্কানীকে লাভবান করে। তাদের উভয়েরই সোভিয়েতবিরোধী আরব যোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল আহমদ শাহ মাসুদকে যে আফগান স্নায়যুদ্ধ জয় করেছেন এবং মুজাহিদদের বিজয়ের জন্য মূল কাণ্ডারী বলে অভিহিত করলেও মার্কিন সরকার তাকে প্রায় কোনো সহায়তাই প্রদান করে নি। এর একটি কারণ ছিল মার্কিন আর্থিক ও সামরিক সহায়তা পাকিস্তানের মাধ্যমে সরবরাহ করা হত, এবং পাকিস্তান হেকমতিয়ারকে সমর্থন করত (আর হেকমতিয়ার মাসুদকে তার চিরশত্রু হিসেবে বিবেচনা করতেন)। এছাড়া মাসুদকে অতিরিক্ত স্বাধীন হিসেবেও বিবেচনা করা হত। তবুও আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থানরত মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের এডমন্ড ম্যাকউইলিয়ামস ও পিটার টমসেন মাসুদকে সহায়তা দেয়ার পক্ষে ছিলেন। এছাড়া হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের দুই নয়া-রক্ষণশীল পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক মাইকেল জন্স এবং জেমস ফিলিপস আফগান প্রতিরোধ যুদ্ধের শ্রেষ্ঠ নেতা হিসেবে মাসুদকে রিগ্যান মতবাদের অধীনে মার্কিন সহায়তা লাভের সবচেয়ে উপযুক্ত বলে অভিহিত করেন[৬][৭]

চীন–সোভিয়েত দ্বন্দ্বের সময় চীনসোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে রক্তাক্ত সীমান্ত সংঘর্ষ সংঘটিত হয় এবং তারা একে অপরের শত্রুকে সমর্থন প্রদান করে। আফগানিস্তানে রাজতন্ত্র বিদ্যমান থাকাকালে চীন ও আফগানিস্তানের মধ্যে নিরপেক্ষ সম্পর্ক বজায় ছিল। ১৯৭৮ সালে সোভিয়েতপন্থী আফগান কমিউনিস্টদের ক্ষমতা দখলের পর চীন ও আফগানিস্তানের সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটে। আফগান কমিউনিস্টরা ভিয়েতনামে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সমর্থন করে এবং চীন কমিউনিস্টবিরোধী আফগান মুজাহিদদের সমর্থন করে। আফগানিস্তানে সোভিয়েত সৈন্য প্রবেশের পর চীন আফগান মুজাহিদদের প্রত্যক্ষ সহায়তা প্রদান করতে আরম্ভ করে এবং জিনজিয়াং-এ আফগান সীমান্তে ব্যাপক হারে সৈন্য সমাবেশ করে। সম্ভাব্য সোভিয়েত আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সামরিক সরঞ্জাম লাভ করে[৮]। চীনা সৈন্যরা আফগান মুজাহিদদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে এবং অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করে। এসব প্রশিক্ষণ শিবির পাকিস্তান থেকে চীনের অভ্যন্তরে স্থানান্তর করা হয়। চীনারা আফগান মুজাহিদদের শত শত মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট লঞ্চার এবং মেশিনগান সরবরাহ করে। এছাড়া প্রশিক্ষণের সময় মুজাহিদদের সঙ্গে চীনা সামরিক উপদেষ্টা ও সৈন্যরা উপস্থিত ছিল[৯]

জালালাবাদের যুদ্ধ সম্পাদনা

কিছু মুজাহিদ দলের সাফল্য সম্পাদনা

উত্তর ও মধ্য আফগানিস্তানে অবস্থানরত আহমদ শাহ মাসুদের বাহিনী কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ সালাং মহাসড়ক নিয়ন্ত্রণে নেয় এবং কাবুলের বাইরে বাগরাম বিমানঘাঁটি দখলের জন্য দ্রুত অগ্রসর হয়[১০]

এগারো বছর অবরোধের পর ১৯৯১ সালের ১১ এপ্রিল জালালউদ্দিন হাক্কানীর বাহিনীর নিকট খোস্তের পতন ঘটে। খোস্তের কমিউনিস্ট সৈন্যরা শর্তাধীনে মুজাহিদদের নিকট আত্মসমর্পণ করে। মুজাহিদদের এই অভিযানটি ছিল একটি সমন্বিত অভিযান এবং এর চূড়ান্ত ধাপ ইব্রাহিম হাক্কানীর নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছিল (জালালউদ্দিন এসময় অর্থ ও যোগাযোগ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বিদেশে থাকায় ইব্রাহিম তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন)। খোস্তের কমিউনিস্ট সেনানায়ক গুল আকাকে বন্দি করা হয়। বস্তুত খোস্তের কমিউনিস্ট সৈন্যদের অধিকাংশই মুজাহিদদের সাধারণ ক্ষমার সুযোগ গ্রহণ করে পক্ষ পরিবর্তন করেছিল, যেটি ছিল আংশিকভাবে হাক্কানীর দক্ষ কূটনীতির ফল। হাক্কানীর সঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও কিছু পাকিস্তানি পত্র-পত্রিকা হেকমতিয়ারকে এই অভিযানের মূল নেতা হিসেবে দাবি করলে হাক্কানীর বাহিনী যথেষ্ট বিরক্ত হয়। এসময় পাকিস্তান শক্তভাবে হেকমতিয়ারের পক্ষ নিয়েছিল এবং ১৯৯৪ সালে তালিবানের উত্থানের আগ পর্যন্ত তিনিই আফগানিস্তানে পাকিস্তানের প্রধান তাঁবেদার ছিলেন। অবশ্য পাকিস্তানি সাংবাদিক রহিমউল্লাহ ইউসুফজাই নিশ্চিত করেন যে, খোস্ত অভিযান একটি সমন্বিত অভিযান ছিল এবং জালালউদ্দিন হাক্কানীই এর প্রধান নেতা ছিলেন। হাক্কানী হেকমতিয়ার ও মাসুদের মধ্যেকার তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মধ্যস্থতা করারও প্রস্তাব করেন, কিন্তু তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়[১১]

মাসুদ এবং হেকমতিয়ারের বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ সম্পাদনা

১৯৮০-এর দশকে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোর বক্তব্য অনুযায়ী, হেকমতিয়ারের হেজব-এ-ইসলামি অন্যান্য মুজাহিদ বাহিনী, বিশেষত আহমদ শাহ মাসুদের বাহিনীকে আক্রমণ করা এবং তাদের খাদ্য ও অস্ত্র সরবরাহের ওপর আক্রমণ চালানো বা বন্ধ করে দেয়ার পাশাপাশি ত্রাণ সরবরাহকারী সংস্থাগুলোর কাফেলার ওপর আক্রমণ চালিয়ে কুখ্যাতি অর্জন করে[১২]। লেখক স্টিভ কোলের বক্তব্য অনুসারে, হেকমতিয়ার আহমদ শাহ মাসুদের বাহিনীকে এতবার আক্রমণ করতেন যে ওয়াশিংটন (যে হেকমতিয়ারকে পাকিস্তানের মাধ্যমে সাহায্য করছিল) সন্দেহ করতে আরম্ভ করেছিল যে, "হেকমতিয়ার আসলে একজন কেজিবি এজেন্ট যাঁর উদ্দেশ্য কমিউনিস্টবিরোধী আন্দোলনে বিভেদ সৃষ্টি"[১২]। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, হেকমতিয়ারের সেনাধ্যক্ষরা সোভিয়েতদের আফগানিস্তান ত্যাগের পর হেজব-এ-ইসলামিকে প্রধান মুজাহিদ দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে তাদের লোকবল ও অস্ত্রবল সঞ্চিত রাখছিলেন[১২]

১৯৮৯ সালে হেকমতিয়ারের যোদ্ধারা আহমদ শাহ মাসুদের বাহিনীর ওপর আবার আক্রমণ চালায়। এবারের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিলেন মাসুদ স্বয়ং এবং শুরা-ই নজর – মাসুদ কর্তৃক সংগঠিত ১৩০ জন উত্তরাঞ্চলীয় সৈন্যাধ্যক্ষের সামরিক ও রাজনৈতিক মিত্রজোট – এর ঊর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দ[১০]। হেকমতিয়ারের বাহিনী মাসুদকে নিহত বা আহত করতে ব্যর্থ হলেও মাসুদের ৩০ জন অনুমারীকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে, যাঁদের কেউ কেউ মাসুদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন[১০]। বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরা জানান যে, নিহত ব্যক্তিদের হত্যা করার পূর্বে তাদের চক্ষু উৎপাটিত করা হয়েছিল, তাদের কান ও নাক কেটে ফেলা হয়েছিল এবং তাদের পেট চিরে ফেলা হয়েছিল[১০]। মাসুদ প্রত্যুত্তরে হত্যাকারীদের খুঁজে বের করার জন্য একটি অভিযান চালান। শুরা-ই নজর হত্যাকারীদের বন্দি করতে সক্ষম হয়, কিন্তু মাসুদ তাদের হত্যা না করে পেশোয়ারের একটি আদালতে বিচারের সম্মুখীন করার জন্য প্রেরণ করেন[১০]। আদালত তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে।

আফগান ঐক্যের স্বার্থে মাসুদ ঘোষণা করেন: হেকমতিয়ারের লোকেদের প্রতি আমার বার্তা হলো একটি সংযুক্ত ফ্রন্ট ছাড়া আমরা সফল হতে পারব না, আমরা আফগানিস্তানে কিছুই অর্জন করতে পারব না[১০]। মার্কিন ইনস্টিটিউট অফ পিসের রয় গাটম্যান মাসুদকে "একটি সমন্বিত চিন্তাধারার অধিকারী একমাত্র আফগান নেতা" বিবেচনা করতেন।

অবশ্য ১৯৮৭ থেকে ১৯৮৯ সালের মধ্যে মাসুদ ও হেকমতিয়ার উভয়ই একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত ছিলেন এবং একে অপরের সেনাধ্যক্ষদের হত্যা করছিলেন। মাসুদের বক্তব্য তার কার্যকলাপের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৮৮ সালে মাসুদের বাহিনী বাদাখশান প্রদেশে হেকমতিয়ারের অনুসারীদের ওপর আক্রমণ চালায়। ১৯৮৯ সালে মাসুদ জামাল আগা নামক হেকমতিয়ারের একজন সেনাধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করেন এবং মুহম্মদ ইজ্জতউল্লাহ, মুহম্মদ ইসলামউদ্দিন, মোল্লা আব্দুল-ওয়াদুদ এবং পায়িন্দা মুহম্মদ নামক চারজন জামিয়াত-এ ইসলামি নেতাকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন।

কিন্তু হেকমতিয়ারের সমর্থকরা অভিযোগ করে যে, মাসুদ নিজেই জামায়াতে তার নেতৃত্বকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী করার উদ্দেশ্য এসব সেনাধ্যক্ষকে হত্যা করিয়ে জামালকে ফাঁসিয়েছেন। জামালের সঙ্গে এসব নিহত নেতাদের ভালো সম্পর্ক ছিল বলেও তারা দাবি করে। ২০১৩ সালে হেজব-এ-ইসলামি সমর্থক মুহম্মদ তানভির হালিম তার প্রকাশিত বইয়ে এই দাবি করেন। কিন্তু এই দাবিটি স্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়নি এবং যে কোনো ক্ষেত্রেই হেকমতিয়ার তার হত্যাকাণ্ডগুলোর জন্য অজনপ্রিয় ছিলেন, যদিও আব্দুল রউফ শাফি, আব্দুল সবুর ফরিদ এবং সম্ভবত জামালের মতো হেকমতিয়ারের সেনাধ্যক্ষরা অন্যান্য মুজাহিদ দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন। মাসুদ পরবর্তীতে আব্দুল রউফ শাফিকে কাবুলের সেনাধ্যক্ষ নিযুক্ত করেন।

এছাড়া সোভিয়েত সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষরের জন্য মাসুদকে হেকমতিয়ারের সমর্থকরা বিশ্বাসঘাতকার দায়ে অভিযুক্ত করে এবং এক্ষেত্রে জামিয়াত-এ ইসলামি নেতা মুহম্মদ ইসহাকও তাদের সঙ্গে ছিলেন (ইসহাকও মাসুদকে ১৯৮০-এর দশকের শেষদিকে সোভিয়েতদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি সম্পাদনের জন্য সমালোচনা করেছিলেন)। প্রতীয়মান হয় যে, মাসুদ পাকিস্তানিদের থেকে স্বাধীনভাবে একটি দল গড়তে চেয়েছিলেন এবং এজন্যই তিনি সাধারণভাবে মুজাহিদদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন সরকারগুলোর সঙ্গে (যেমন: রাশিয়াভারত) চুক্তি করেছিলেন। ১৯৯০-এর দশকে মাসুদ তালিবানের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সঙ্গে সহযোগিতা করেন। হেকমতিয়ার এটিকে মাসুদকে আক্রমণ করার জন্য ব্যবহার করেন, এবং মাসুদকে পাঞ্জশিরের শাসকবিশ্বাসঘাতক হিসেবে অভিহিত করেন।

অবশ্য উভয় পক্ষের বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগই বাড়াবাড়ি বলে প্রতীয়মান হয়। পাকিস্তানি সমন্বয়ক মুহম্মদ ইউসুফ জামালের ঘটনায় মাসুদের বক্তব্যকেই সমর্থন করেন, যদিও পাকিস্তান মাসুদের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন ছিল। একইভাবে ফিলিস্তিনি মুজাহিদ নেতা আব্দুল্লাহ আজ্জম দাবি করেন যে, মাসুদ ছিলেন একজন কিংবদন্তীতুল্য যোদ্ধা। অবশ্য দ্বন্দ্ব এড়ানোর জন্য আজ্জম খুব কম সময়ই কোনো মুজাহিদ নেতার নিন্দা করতেন।

আফগান সরকারের ক্রমবর্ধমান দুর্বলতা (মার্চ ১৯৯০ – জানুয়ারি ১৯৯২) সম্পাদনা

অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সম্পাদনা

আফগান সরকারের পতন (১৮ মার্চ – ২৪ এপ্রিল ১৯৯২) সম্পাদনা

পেশোয়ার চুক্তি সম্পাদনা

মুজাহিদ যোদ্ধাদের কাবুলে প্রবেশ সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Starr, S. Frederick (১৫ মার্চ ২০০৪)। "Xinjiang: China's Muslim Borderland"। M.E. Sharpe – Google Books-এর মাধ্যমে।  অজানা প্যারামিটার |access- date= উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)
  2. "Lessons of the Soviet Withdrawal from Afghanistan - Middle East Policy Council"www.MEPC.org। সংগ্রহের তারিখ ১৭ মে ২০১৭ 
  3. Dixon, Norm (২০০১-১২-১২)। "Revolution and counter-revolution in Afghanistan"www.greenleft.org। ২০১২-১২-০২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৭-২৭  |প্রকাশক= এ বহিঃসংযোগ দেয়া (সাহায্য)
  4. Marshall, A.(2006); Phased Withdrawal, Conflict Resolution and State Reconstruction; Conflict research Studies Centre; আইএসবিএন ১-৯০৫০৫৮-৭৪-৮ "Archived copy" (পিডিএফ)। ২০০৭-১২-০১ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০২-১২ 
  5. Marshall, p.3
  6. Phillips, James A. (May 18, 1992). "Winning the Endgame in Afghanistan" ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৮ জানুয়ারি ২০০৬ তারিখে, Heritage Foundation Backgrounder #181.
  7. Johns, Michael (January 19, 2008). "Charlie Wilson's War Was Really America's War".
  8. S. Frederick Starriditor=S. Frederick Starr (২০০৪)। Xinjiang: China's Muslim Borderland (illustrated সংস্করণ)। M.E. Sharpe। পৃষ্ঠা 157। আইএসবিএন 0765613182। সংগ্রহের তারিখ মে ২২, ২০১২ 
  9. S. Frederick Starriditor=S. Frederick Starr (২০০৪)। Xinjiang: China's Muslim Borderland (illustrated সংস্করণ)। M.E. Sharpe। পৃষ্ঠা 158। আইএসবিএন 0765613182। সংগ্রহের তারিখ মে ২২, ২০১২ 
  10. "Afghanistan – the Squandered Victory"। BBC। ১৯৮৯। 
  11. The Demise of the Soviet Union, 1991 - Library of Congress country studies – Retrieved on 2007-08-21.
  12. Gould, Elizabeth (এপ্রিল ৫, ২০১০)। "Gulbuddin Hekmatyar – The Master of Darkness"। Huffington Post। 

বহি:সংযোগ সম্পাদনা

Afghanistan – the Squandered Victory (documentary film) by the BBC
Massoud's Conversation with Hekmatyar (original document of 1992)
Commander Massoud's Struggle (documentary film) by Nagakura Hiromi